#বিবর্ণ_ভালোবাসা,05,06
#Tahmina_Akhter
৫.
— আগামীকাল ভোর পাঁচটায় আমার ফ্লাইট। মালদ্বীপে ফিরে যেতে হবে।
অনর্গল কথাগুলো রুদ্র পাশ ফিরে শুয়ে পরে। তনুজা চোখ বন্ধ করেছিল সবে। রুদ্রের ফিরে যাওয়ার কথা শুনে চোখ খুলে তাকিয়ে রইলো মাথার ওপরে থাকা ছাঁদের দিকে।
দু’জন মানুষ একই ছাঁদের নীচে, একই বিছানায় শুয়ে আছে। খানিকটা দূরত্ব। তবে অতটা দূরত্ব নয়। দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ দু’জনেই শুনতে পাচ্ছে। হৃদয়ে হাজারো কথা। কিন্তু, মুখে নীরবতা। হয়তো, এইজন্যই বলে পাশাপাশি থেকেও মাঝে মাঝে আমরা অনেক দূরত্বে অবস্থান করি। চাইলেও এতখানি দূরত্ব কমিয়ে কাছাকাছি আসা যায় না।
বহুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর তনুজার মনে হলো রুদ্রের কাছ থেকে এখনি জেনে নেয়া উচিত কেন রুদ্র সেদিন জোরজবরদস্তি করে ওকে বিয়ে করেছে?
তনুজা পাশ ফিরে রুদ্রের দিকে তাকালো। রুদ্র জেগে আছে। তনুজাকে পাশ ফিরতে দেখে রুদ্র পাশ ফিরতে চাইলে তনুজা হাত বাড়িয়ে রুদ্রকে বাঁধা দেয়। রুদ্র নিজের কাঁধে তনুজার হাতের স্পর্শ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে পরে। এমন সময় জানালা দিয়ে উত্তরের বাতাস এসে রুদ্রকে ছুঁয়ে চলে যায়। হিমশীতল হাওয়ার স্পর্শে হোক কিংবা তনুজার স্পর্শে রুদ্রের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
রুদ্রের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তনুজা হাত সরিয়ে নেয়। শোয়া থেকে উঠে বসে। দুই হাঁটুতে মুখে গুঁজে রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কেন বিয়ে করেছেন আমায়? দুদিন হলো তবুও কি জানতে পারব না আমি, কেন আপনি আমাকে বিয়ে করলেন?
রুদ্র সেই আগের মতো চুপ করে রইলো। রুদ্রের এমন নীরবতা দেখে তনুজার চোখে জল ভরে ওঠে। দু-চোখের কোল ঘেঁসে জল গড়িয়ে পরতে থাকে। কান্নারত কন্ঠে রুদ্রকে ফের জিজ্ঞেস করে তনুজা।
রুদ্র তনুজার কান্নারত কন্ঠ শুনে পাশ ফিরে তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আহত দৃষ্টিতে। এতকাল রুদ্র জেনে এসেছে এবং দেখে এসেছে তনুজা খুবই শক্ত এমন কঠিন মন-মানসিকতার অধিকারী। হুট করে কেঁদে ফেলার মতো মেয়ে নয় তনুজা। যেদিন জীবনের চরম ব্যর্থতার জন্য সমাজ ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল সেদিনও তনুজা কাঁদেনি। তবে, আজই কেন? নাকি নিজের জীবনের সঙ্গে একই সুতোয় বাঁধা পরা রুদ্রকে নিজের জীবনের গুরত্বপূর্ণ স্থানে মানতে পারছে না তনুজা?
গায়ের কাঁথা সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে রুদ্র। খাটের সাথে বালিশ রেখে তাতে হেলান দিয়ে বসে রুদ্র। রুদ্রকে উঠে বসতে দেখে তনুজা অতি সন্তর্পনে চোখের জল মুছে নেয়। ভাগ্যিস, পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার বিরাজমান। রুদ্র যদি তনুজার চোখের জল দেখে ফেলত তবে মনে মনে তনুজাকে দূর্বল দলের লোক হিসেবে দেখত।
— তোমাকে আমি আরও আগে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। তখনও, তুমি রাজি ছিলে না তনুজা।
বহুকাল পর রুদ্রের মুখ থেকে নিজের পুরো নাম শুনে তনুজার বুকে কাঁপন ধরে যায়। তনুজাকে সবাই পুরো নামে কেউ ডাকে না। সবাই তনু বলে ডাকে। একমাত্র রুদ্র ছিল যে কি না তনুজা বলে ডাকত। তনুজার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা গলায় বিঁধে আছে ; হয়তো সংকোচ!
রুদ্র দেখছে তনুজাকে মন ভরে। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে আসছে। সেই আলো এসে তনুজার গায়ে পরছে। সবুজ রঙা শাড়িতে অদ্ভুত সুন্দরী দেখাচ্ছে। গায়ের রঙের সাথে শাড়িটা বেশ ফুটেছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। দীঘল কেশের আড়ালে ঢাকা পরেছে চাঁদ মুখখানা। পিঠের কাছ থেকে শাড়ি সরে যাওয়ায় ঘাড় থেকে কোমড় অব্দি মাঝখানে দেবে যাওয়া লম্বালম্বি খাঁজটা রুদ্রকে বেশ টানছে।
— আমি অতীত সম্পর্কে জানতে চাইনি। পুরনো স্মৃতি হারিয়ে গেছে আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে। তাই নতুন করে সেই কালো অধ্যায় নতুন করে মনে করতে চাই না। আমি জানতে চাই কেন আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন?
তনুজার কথা শুনে রুদ্র তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
— অতীত ভুলে গিয়েছো তুমি! বেশ ভালো। এখন তুমি আমার কথা শুনো। অতীতে তুমি রুদ্রের ভালোবাসাকে অনাদরে নিজ হাতে মনের গহীনে মাটি চাপা দিয়েছো। কিন্তু, বর্তমান অর্থ্যাৎ আজকের এই রাতে তুমি কিন্তু সেই রুদ্রের ঘরে, তারই বিছানায়, তারই পাশাপাশি বসে আছো, তারই স্ত্রী হয়ে। ভাগ্যের ফেরে তুমি মেহরাব মুস্তাকিম রুদ্রের স্ত্রী। এবার বলো, তুমি কি করে অতীত ভুলে গেলে? আমি ঠিক যতবার তোমার চোখের আসব ঠিক ততবার তোমার অতীত তোমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হবে।
তনুজা নিজের ভেতরে রাগটুকু অতি সন্তর্পনে চাপা দিয়ে রুদ্রকে বললো,
— আমার প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই এই কথাগুলো নয়?
তনুজার কথার জবাবে রুদ্র গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো,
— সঠিক সময় এলে জবাব আপনা-আপনি তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। ততদিন না হয় শান্তিতে বসবাস করো এই জমিদার বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশ রুদ্রের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে।
তনুজা রুদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই রুদ্রকে সে চেনে না। চোখের সামনে থাকা রুদ্রের চোখে কি যেন দেখতে পাচ্ছে তনুজা! হয়তো, তনুজাকে ধ্বংস করার অদম্য ইচ্ছা। অথচ, বছরখানেক আগে রুদ্রকে দেখলে মনে হতো ভোরবেলার পবিত্র বেলি ফুল।
রুদ্র তনুজার ওমন গভীর চাহনি থেকে বাঁচার জন্য খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায়। তনুজা রুদ্রকে আঁটকায় না। হয়তো, রুদ্রের চলে যাওয়াটা এখন তনুজার জন্য স্বস্তিদায়ক।
তনুজা এক পাহাড়সম দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বালিশে মাথা পেতে শুয়ে পরে। ঘুমানোর জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করে। ব্যর্থ চেষ্টা একসময় সফল হয়। তনুজা ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যায়।
গভীর রাত ; আকাশে তারাগুলো মিটমিটিয়ে জ্বলছে। চাঁদ তখন ঠিক মাথার ওপরে। রুদ্র বারান্দায় বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। এমন সময় রুদ্রের দৃষ্টি গেল সেদিনের দেখা পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির উঠোনের মাঝে। কে যেন হাতে হারিকেন নিয়ে দ্রুতগতিতে হেটে পুরনো জমিদার বাড়িতে ঢুকে পরেছে? জোৎসনার আলোয়ে যতটুকু রুদ্র দেখছে ততটুকুতে বুঝা সম্ভব হলো না পুরনো জমিদার বাড়িতে ঢুকে পড়া মানুষটা নারী নাকি পুরুষ। রুদ্র ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলো উঠোনের দিকে।
হুট করে রুদ্রের মনে ভয়ের দানা বাঁধতে লাগল। হাতের সিগারেট পায়ের নীচে ফেলে পা দিয়ে পিষে দ্রুত পায়ে নিজের কামরার দিকে পা বাড়ায় রুদ্র।
কামরায় প্রবেশ করে দ্রুত দরজা খিল এঁটে দেয়। হাত বাড়িয়ে লাইট অন করে। জানালা দুটো আঁটকে খাটের ওপর বসে রুদ্র। রুদ্র ঘেমে নিয়ে একাকার। গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের এককোনায়। ফ্যানের বাতাসও যেন রুদ্রের শরীরকে শীতল করতে পারছে না। রুদ্রের মনে হচ্ছে ও ভীষন তৃষ্ণার্ত। হাত বাড়িয়ে টেবিলসাইডের ওপর থেকে জগটা নিয়ে ঢকঢক করে বেশ খানিকটা পানি পান করে রুদ্র। ধীরে ধীরে রুদ্রের শরীর ঠান্ডা হতে থাকে।
এমন সময় তনুজার কথা স্মরণে আসে রুদ্রের। চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পেলো তনুজা গভীর ঘুমে। ঘনপল্লব আঁখি যুগল স্থীর হয়ে আছে। জেগে থাকলে হয়তো বারবার পলক ফেলত ।
রুদ্রের মন হচ্ছে তনুজার ওই দুই চোখে একটু স্পর্শ করা প্রয়োজন। কতকাল ধরে মনে মনে এই সুপ্তবাসনা লালন-পালন করে আসছে। আজ নাহয় সেই সুপ্তবাসনার অবসান হোক। রুদ্র লাইট অফ করে তনুজার পাশে শুয়ে পরে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তনুজার চোখের কাছে। তারপর, দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু এঁকে দেয় তনুজার আঁখি যুগলে। নিজের চোখে কারো ভেজা স্পর্শ পেয়ে তনুজার ঘুম ভেঙে যায়। তনুজা ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলো, রুদ্র তার বেশ কাছে। রুদ্রের চাহনিতে আজ ভীন্ন আবদার দেখতে পাচ্ছে তনুজা। তনুজা রুদ্রের আবদার বুঝতে পারে। তাই তো ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে চায়। কিন্তু, রুদ্র তনুজাকে আবদ্ধ করে নেয় নিজের বুকের মাঝে। তনুজা ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করতে থাকে। কিন্তু, রুদ্র তনুজাকে ছাড়ে না বরং আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। একসময় তনুজার অঁধর নিজের অঁধর দিয়ে চেপে ধরে। তনুজা থমকে যায়। ছটফট ভাবটা নিমেষে চলে যায়। প্রথমবারের মতো সেই অচেনা অনুভূতি অনুভব করে তনুজা। দীর্ঘ সময় পর রুদ্র তনুজার অধরসুধাপান করে ছেড়ে দেয়। তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তনুজা চোখ বন্ধ করে থাকে। দুইচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে তনুজার। নিজের বুকে বন্দিনী তনুজাকে কান্নারত অবস্থায় দেখে রুদ্র তনুজাকে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,
— আমার স্পর্শ পেয়ে খুব ঘেন্না হচ্ছে তাই না, তনুজা? কিন্তু, কি করব বলো? তোমার অধরসুধাপান করেও যেন আমার নেশা কাটছে না। বরং, নেশা আমাকে আরও চেপে ধরেছে। মন বলছে নেশাটা আরও ভিন্নভাবে কাটাতে হবে। তোমার মন গহীনে লুকায়িত হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফের জাগ্রত করার তীব্র ইচ্ছা জেগেছে আমার মনে। চলে যাওয়ার আগে আজ তোমার অতি ঘনিষ্ঠে যেতে চাই আমি।
তনুজা রুদ্রকে বাঁধা দিতে পারল না। বরং, মনের কোণে লুকায়িত একটি অংশ বারংবার তনুজাকে যে অনুরোধ করছে আজ যেন নিজেকে রুদ্রের কাছে পুরোপুরি অর্থে সমর্পন করতে পারে। মনের চাওয়াকে পূরণ করতে চায় তনুজা। ভালোবাসার মানুষ তাকে আহ্বান জানাচ্ছে সে কি করে সাড়া না দিয়ে থাকবে? হয়তো, তনুজা মুখে স্বীকার করে না যে সে রুদ্রকে আগের মতো ভালোবাসে না। কিন্তু,মন তো জানে রুদ্র ঠিক সেই আগের মতো তার হৃদয়ের পবিত্র স্থানে বাস করে।
দুটি মানুষ আজ এক হলো। পুরনো ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে। কিন্তু, তাদের পরিণতি কেমন হবে কারো জানা নেই?
#চলবে
#বিবর্ণ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
৬.
রাতটা ততটুকুই উপভোগ্য ছিল যতক্ষণ অব্দি দুজন নর-নারী একে অপরের অতি নিকটে অবস্থান করছিল। একসময় বিদায়ের ঘন্টা বেজে ওঠে। রুদ্রের প্রেমময়ী শহর আজ বিভীষিকাময় শহরে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছে। হোক না প্রেমময়ী রাতটুকু অল্প সময়ের। তবুও, তো আজ সে তনুজার বুকের মাঝে মাথা রেখে শান্তির প্রশ্বাস ফেলেছে।
শেষরাতে মুয়াজ্জিনের আজান শুনে ঘুমন্তরত তনুজাকে নিজের নগ্ন বুক থেকে সরিয়ে উঠে বসে রুদ্র। ধীরপায়ে এগিয়ে যায় স্নানঘরের দিকে। মাঘমাসে এই সময়টাতে গোসল করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু, রুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে ওর কাছে এখন এই বাড়ি থেকে চটজলদি বের হয়ে যাওয়াটা জরুরি। গোসল শেষ করে নিজের কামরায় না গিয়ে মেহমানের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় চলে যায় রুদ্র। গতকাল, ব্যাগ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে রাখে রুদ্র। হলদে রঙের টিশার্ট, বাদামী রঙা প্যান্ট, চোখে সানগ্লাস পরে একবারে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে রুদ্র। যেহেতু এখন ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে তারমানে সালেহা ঘুম থেকে জেগে ওঠেছে। রুদ্র তড়িঘড়ি করে ওর দাদীজানের ঘরে চলে যায়। গিয়ে দেখে ওর দাদিজান সবেমাত্র বিছানা থেকে নামছেন। রুদ্রকে অসময়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালেহা দ্রুতপায়ে নাতির কাছে চলে যান। ভয়ার্ত স্বরে রুদ্রকে জিজ্ঞেস করছেন,
— রুদ্র অসময়ে তুমি এখানে? তনু ঠিক আছে তো?
রুদ্র এগিয়ে এসে মুখে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে ওর দাদীজানের হাত ধরে বললো,
— আমি ফিরে যাচ্ছি, দাদিজান। তনুজার খেয়াল রাখবেন।
রুদ্রের ফিরে যাওয়ার কথা শুনে থমকে যায় সালেহা। নাতির হাত সরিয়ে দিলেন। মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন,
— তোমার আমানতের খেয়াল আমি কেন রাখব? তাকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছো না কেন?
রুদ্র ওর দাদীজানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে “আল্লাহ হাফেজ” জানিয়ে বের হয়ে আসে। দুই কদম পেরুতে নিজের কামরার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পরে রুদ্র। মন বলছে শেষবারের মতো একটিবার তনুজাকে দেখা নেওয়া যাক। কিন্তু, মস্তিষ্ক বলছে, আজ যদি মনের কথা শুনে তবে রুদ্রকে মুখ থুবড়ে পরতে হবে। মনটাকে শক্ত করে বাঁধতে হবে। নয়তো, পরিকল্পনা মোতাবেক রুদ্র কিছুই করতে পারবে না।
মন এনং মস্তিষ্কের স্নায়ুযুদ্ধে মনের বিজয় হলো। রুদ্র বিনাশব্দে দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেয়। তনুজা বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে। শরীরের কাপড় এলোমেলো হয়ে আছে। রুদ্র দরজা খুলে তনুজার কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। খাটের কাছাকাছি এসে রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে। তনুজার মুখখানি দেখতে থাকে অনিমেষ দৃষ্টিতে। মনে হচ্ছে যেন তনুজার মুখশ্রী মুখস্থ করছে। একসময় মনের অদম্য ইচ্ছেকে পূরণ করতে উপুড় হয়ে তনুজার কপালে চুমু দেয়। সোজা হয়ে ওঠে দাঁড়ায় রুদ্র। তারপর, পেছনের দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। রুদ্র যদি একটিবার পেছনে তাকিয়ে দেখতো তবে দেখতে পেতো তনুজা অশ্রুসিক্ত নয়নে রুদ্রকে বিদায় জানাচ্ছে।
১৯শে ফেব্রুয়ারী,
আজ রুদ্র ফিরে আসছে।দীর্ঘ দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আজ রুদ্রের পদধূলি তার জন্মভূমিতে পরবে। জমিদার বাড়িতে যেন আনন্দের ঢেউ বইছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। সালেহা এবং রুক্মিণী মিলে দাসীদের বিভিন্ন কাজের হুকুম দিচ্ছে।
— ছোট সাহেবের বৌকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না বড়ো মা।
হতদন্ত হয়ে এইবাড়ির একজন বিশ্বস্ত দাসী সালেহার কাছে এসে জানালেন তনুজার নিখোঁজ হবার সংবাদ। সালেহা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলেন দাসীর দিকে। রুক্মিনি এগিয়ে এসে নিজের শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন,
— কি হয়েছে, আম্মা?? আপনাকে এতটা বিচলিত দেখাচ্ছে কেন?
— তনুজাকে পুরো বাড়িতে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। রুদ্র এসে যদি তনুজাকে দেখতে না পায় তবে আমি কি জবাব দিব?
মনের অস্থিরতা বৃথা লুকানোর চেষ্টা করে কথাটি বললেন সালেহা। রুক্মিণী কিছু একটা ভেবে দাসীকে জিজ্ঞেস করলো,
— রুদ্রের কামরায় দেখেছো? তনুজা সেই ঘরে থাকতে পারে। একটি দেখে এসো তো।
দাসী আদেশ পাওয়া মাত্র একদৌঁড়ে রুদ্রের কামরার দিকে পা চলে যায়। পিছু পিছু সালেহা এবং রুক্মিণী রুদ্রের কামরার উদ্দেশ্য হাঁটতে শুরু করে।
পশ্চিমের হাওয়া ; অদূরে ঘাট বাধানো পুকুর। পুকুরের চারপাশে নারিকেল আর সুপারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের সাথে সাথে গাছের ডালপালা গুলো এপাশ থেকে ওপাশে এলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিশাল বটগাছের মগডাল থেকে কোকিলের কুহু কলরবে চারদিকে এক অন্যরকম সুর তৈরি হচ্ছে। তপ্ত দুপুরে ঝাপসা গরমে পুরো শরীর থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে। তবুও, আজ রুদ্রের ঘরে বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছে তনুজার। পুরো জমিদার বাড়ির এক একটি ইটের কোণায় যেন কিসের হাহাকার মিশে আছে। যার দরুন তনুজার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই তো সেই বিশ্রী অনুভূতি থেকে বাঁচতে তনুজা রোজ রুদ্রের ঘরে এসে বসে থাকে। সময় কেটে যায় অতি দ্রুত। মাঝে মাঝে রুদ্রের ঘরে থাকা বুক সেলফ থেকে বই বের করে অতি মনোযোগ নিয়ে পড়া হয়। কখনোবা রুদ্রের ঘর দক্ষিণের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো রুদ্রের ছবির দিকে তাকিয়ে তনুজা মনে মনে হাজারো কথা লেনদেন করে রুদ্রের সঙ্গে। ছবিতে হাসৌজ্জ্বল রুদ্র শুধু তনুজার কথাগুলো শুনেই যায় পাল্টা জবাব দেয় না।
হলদে রঙের তাঁতের শাড়িতে আজ তনুজাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। যেমন: নতুন কনেকে হলুদের উদ্দেশ্য হলুদ শাড়ি পরানো হলে যেমন দেখানো হয় ঠিক তেমন। ফুলের গহনা পরিধান করলে হয়তো তনুজাকে দেখলে কেউ নতুন কনে ভাবত!
— তুই এখানে, তনু! আমরা সবাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায় দশা। কাউকে না জানিয়ে এই ঘরে বসে আছিস কেন?
নানীজান সালেহার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালে তনুজা দেখতে পায়, রুদ্রের বড়ো মা, ওর নানীজান এবং এই বাড়ির একজন দাসী তনুজার দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে।
তনুজা জানালার কাছ থেকে সরে এসে সর্বপ্রথম মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিল। তারপর, মাথা নিচু করে নানীজান সালেহার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
— নানীজান, আমি বুঝতে পারিনি আপনারা এতটা অস্থির হয়ে পরবেন। খুবই লজ্জিত আমি।
তনুজার কথা শুনে সালেহা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
— তোকে না পেয়ে আমি অস্থির হয়েছি ঠিকআছে। কিন্তু, তোর স্বামী এসে যদি তোকে দেখতে না পায় তখন আমি কি জবাব দিব? ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে আরও অস্থির হয়ে পরেছিলাম আমি। জানিসই তো রুদ্র চলে যাবার সময় আমার কাছ তোকে আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছে। এখন সেই আমানতের খিয়ানত করি করে করে? যাক এখন রুদ্র এলেও আমার চিন্তা নেই।
সালেহার কথার মানে বুঝতে না পারছে না তনুজা। রুদ্র এখানে আসবে কেন? এই না কিছুদিন হলো দেশের বাইরে গিয়েছে। বছর দুয়েক গেলে তবেই না দেশে ফিরবে।
— আবার কি ভাবছিস? রুদ্র বাড়িতে ফিরে আসার আগে গোসল সেড়ে নতুন শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নে। জানিসই তো স্ত্রীর সৌন্দর্য দেখার হক একমাত্র তার স্বামীর।
সালেহা কথাটি বলে তনুজার হাত ধরবে তার আগে পেছনে থেকে কেউ এসে বলছে,
— আমার ঘরে এত লোকজন ভিড় জমিয়েছে কেন?
চেনা সুর কর্নকুহুরে পৌঁছেতেই তরিৎ গতিতে দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তনুজার পা শীতলের ন্যায় জমে যায়। বহুদিন পর দৃষ্টি আড়ালে থাকা মানুষটা হুট করে যখন দৃষ্টির অতি নিকটে অবস্থান করে তখন কেমন অনুভূত হয় আজই অপলব্ধি করতে পেরেছে তনুজা! পানির পিপাসাযুক্ত একজন মানুষ যেমন পানি দেখলে খুশি হয়। ঠিক তেমনি একপলক রুদ্রকে দেখার দৃষ্টির পিপাসা মিটে গেছে তনুজার।
একমাসে কি রুদ্র কিছুটা শুকিয়ে গেছে? কিন্তু, গায়ের রঙ আগের থেকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চাপা দাঁড়ি যেন আরও ঘন হয়ে গজিয়েছে। কালো রঙের শার্ট আর ব্লু রঙের জিন্স প্যান্ট। শার্টের হাতা কনুই অব্দি গুটিয়ে রেখেছে।
তনুজার পখর দৃষ্টিকে লক্ষ করছে রুদ্র। তনুজাকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। কিন্তু, গুরুজনেরা সামনে থাকায় সেই ইচ্ছেকে বলিদান দিয়ে ভদ্রলোক সেজে সকলের মধ্যমনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— তুমি এসেছো রুদ্র! আমরা তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। এবার হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি খাবার খেতে চলে এসো। আর, তনু তুই চলে আসিস রুদ্রের সঙ্গে। চলো বৌমা চলো। দাসীকে বলে খাবার গুলো টেবিলে সাজাতে হবে।
কথাগুলো ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন সালেহা। তনুজা রুদ্রের সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকবে এই কথাটি স্মরণে আসতেই সালেহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— নানীজান আমি আপনাদের সাথে যাব। আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারব আমি।
তনুজার কাঁপা কন্ঠে বলা কথাটি শুনে রুদ্র, রুক্মিনি এবং সালেহা কিছু একটা আন্দাজ করতে পারে। রুদ্র ঘরে ঢুকে সোজা খাটের ওপরে গিয়ে বসে। আর সালেহা তনুজাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,
— আমি যা বলেছি তাই কর। তুই রুদ্রকে সাথে নিয়ে তবেই আসবি।
চলে গেলেন সালেহা। আর তনুজা হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
রুদ্র তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তনুজাকে দেখছে। আগের আর এখনকার তনুজার মাঝে বিস্তর ফারাক আছে তাই বুঝার চেষ্টায় আছে রুদ্র। আগের থেকে স্বাস্থ্য কিছুটা উন্নিত হয়েছে। চেহারা যেন আরো লাবন্যময় হয়ে ওঠেছে। দেখতেও বেশ আদুরে দেখাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের দেখলে যেমন গাল হাজারটা চুমু খেয়ে আর গাল টেনে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে। ঠিক তেমনি তনুজাকে দেখে রুদ্রের তেমনি আদর করতে ইচ্ছে করছে।
লজ্জা এবং অস্বস্তি দুটোই আবিষ্ট করে রেখেছে তনুজাকে। মাথা নিচু করে রুদ্রের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে চাইছে তনুজা। কিন্তু, এভাবে কি আর বাঁচা যায়?
— তনুজা???
রুদ্রের ডাক শুনে তনুজা চোখ বন্ধ করে ফেলে। হটাৎ করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। গায়ে কেমন শীত শীত অনুভূত হচ্ছে! একটা ডাক শুনে মূহুর্তের মাঝে শরীরে এতটা পরিবর্তন হতে পারে?
— তোমাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছি। যাবে তো তুমি আমার সঙ্গে?
তনুজা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে রুদ্রের তরে অবিশ্বাস্য চোখে। তবে, কি রুদ্র তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছে?
#চলবে