#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_০১
#মিদহাদ_আহমদ
প্রথম রমজানে যখন আমার মায়ের কানের দুল সাত হাজার টাকায় বিক্রি করে আমার বাবা আমার শ্বশুর বাড়িতে ইফতার নিয়ে এসেছিলেন হাসিমুখে, সেদিনও আমার শাশুড়ি ইফতার করার সময় খেজুর মুখে নিতে নিতে আমাকে শুনিয়ে বলছিলো,
‘গরীব ঘরের মেয়েকে এজন্য আমি না করি ভালো ঘরের বউ করে নিয়ে আসতে৷ এরা নিজেরা জানে না চলা ফেরা, অন্যের চলাফেরায়ও এরা নিয়ম মানে না।’
আমার ছোট ননদ তার মায়ের সাথে যুক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
‘এসব ছোটলোকি ইফতারি না দিলেই তো ভালো ছিলো। আমাদের ঘরের চাকর বাকরদের ঘরেই তো আমরা এসব ইফতারি দিয়ে থাকি। জানি না বড় ইফতারির সময়ে কী দিবে! ঈদে যে মেয়ের জামাইবাড়ির সবাইকে ঈদের কাপড়চোপড় দিতে হয়, তাও জানে কিনা না খুঁজ নিয়ে দেখো৷ ‘
এর মধ্যেই আজান শেষ হলো সেদিন। আমি তখনও খেজুর হাতে নিয়ে বসে ছিলাম। মুখে পানিও তুলতে পারলাম না। বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো আমার অসুস্থ বাবার দেহ, আমার জীর্ণশীর্ণ মায়ের মুখাবয়ব, আমার ছোট ছোট ভাই বোনদের অনাহারী, অর্ধাহারী চেহারাগুলো৷ তার উপর যখন শুনছিলাম আমার ননদের মুখে বড় ইফতারি, ঈদের কাপড়চোপড় দেয়ার কথা, তখন আমি তব্দা খেয়ে গেলাম। আমার দুঃখী বাবা তাদের এই আবদার মেটাবে কীভাবে?
শাশুড়ি মা বললেন,
‘কী নবাবজাদি? মুখে পানি যাবে না এখন? নাকি কিছু বলাও যাবে না তোমাকে?’
শাশুড়ির সাথে ননদ বললো,
‘ছোট ঘরের মেয়ে তো, তাই এসব কথা এদের গায়ে লাগে। কিচ্ছু করার নাই। ছোটলোকি তাদের ইফতারের টেবিলে বসেও দেখানো লাগে।’
কথাগুলো হজম করে ইফতার করলাম। একবার উঠে গিয়ে আমার শ্বশুর আর বাবারা ড্রইংরুমে যেখানে ইফতার করছিলো, সেখানে পোলাও দিতে গেলাম। শুনতে পেলাম আমার শ্বশুর আমার বাবাকে বলছেন,
‘জানেন, গত বছর আমার বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। প্রথম দিনেই ঠেলা ভর্তি ইফতার বানিয়ে নিয়ে দিয়ে এসেছি। ঢাকাই বাবুর্চি দিয়ে সবকিছু করিয়েছিলাম। আর মিষ্টি, রসগোল্লা, নিমকি, জিলাপি, বাখরখানি এসব মিলিয়ে প্রথম দিনেই দিয়েছি হাজার ত্রিশেক টাকার ইফতারি। বুঝেন ই তো, মেয়ের বাড়িতে এসব দেয়া লাগে।’
আমি খেয়াল করলাম আমার অসহায় বাবা, অসহায়ের মতো মুখের অসহায়ত্ব চাপা রেখে হাসি এনে আমার শ্বশুরকে বলছেন,
‘তা অবশ্য ঠিক বলেছেন আপনি।’
বলেই এক লোকমা পোলাও আমার বাবা তার মুখে পুড়ে নিলো। আমি বুঝতে আর বাকি রইলো না যে এই এক লোকমা পোলাও আমার বাবার গলায় আগুনের ফুলকির মতো করে গিয়ে বিধলো। আমি নিরুপায়ের মতো ফিরে এলাম।
সন্ধ্যার পর আমার বড় ননাস আমাদের বাসায় এলো। এসেই তার সেই আগের কথা। রান্নাঘরে গিয়ে সামনাসামনি সেদিন আমাকে বলল,
‘না দিতে পারলে না দিতো, তা এই ফকিন্নিমার্কা ইফতারি দেয়ার কী দরকার ছিলো? আমরা বলেছি যে আমদের দিতে হবে? একটু দেয়া আর পুরোটা দেয়ার মাঝে পার্থক্য কই? যদি তোমার বাবা না দিতো তাহলে হয়তো এই মেনে বুঝ দিতাম যে না, পারেনি। একটা ফকিন্নির ঘরের মেয়েকে এনেছি আমার ভাইয়ের বউ করে, তাই তার বউয়ের বাড়ি থেকে কিছু আসেনি। এখন তাও না। এসেছে এসেছে তাও কী এলো? এসব ফকিন্নি মার্কা ইফতার?’
রান্নাঘরের টেবিলের উপর রাখা ছিলো আমার মায়ের হাতের রান্না করা পোলাও এক হাড়ি। ননাস উঠে ঠাস করে সেই হাড়িটা মাটিতে ফেলে দিলো। তারপর সেই হাড়ির পোলাওয়ে পাড়া দিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘এসব ঘরের মেয়েদের সাথে এমন হওয়া উচিত। গরীব ঘরের কোন মেয়েকেই কখনো বিয়ে করানো উচিত না ভালো খানদানে।’
আমি নুপুর। বিয়ে হয়েছে মাস তিন হলো। আমার গ্রামের অসহায়, দারিদ্র সহজ সরল বাবার বড় মেয়ে আমি৷ বাবা মায়ের টিনচালা ঘরে আমার জীবনে কোন অপ্রাপ্তি হয়নি। যখন যা চেয়েছি, আমার বাবা মা আমাকে তাই এনে দিয়েছে। বাবা খেত খামারে কাজ করে, আর বাড়ির পাশের মুদি দোকান দিয়ে আমাদের ছোট পরিবার বেশ ভালো করেই চালিয়ে নিতো।
আসিফের সাথে আমার বিয়ে হয় আজ থেকে তিন মাস আগে। আমার মামা এই সম্পর্কটা নিয়ে এসেছিলেন। যেদিন মামা এসে আমার মাকে বললেন,
‘আপা, তোমার মেয়ের জন্য এক বড় ঘরের কথা এনেছি। দেখে নিও আমাদের নুপুরের রাজভাগ্য হবে। রাণীর বেশে থাকবে সেখানে। আমার তো ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। মেয়েটা আমাদের এতো কপালি হয়ে জন্ম নিয়েছে।’
আমার মা আমার মামাকে বসতে বলে বললেন,
‘আরে কী হয়েছে? আমাকে বলবি তো খুলে?’
‘আরে বলছি আপা। আমাকে এক গ্লাস পানি দাও আগে।’
আমি বসে বসে পড়ছিলাম তখন। সামনেই আমার এইচ এস সি পরীক্ষা ছিলো৷ মামার সামনে বসে থেকে মা আমাকে ডাক দিয়ে পানি এনে দিতে বললেন। আমি উঠে গিয়ে পানি এনে দিলাম। সব শোনাই যাচ্ছিলো পাশের রুম থেকে। এবার মামা আমার মাকে বলা শুরু করলেন,
‘আমাদের পাশের ঘরের আলতাফ মিয়ারে চিনো না আপা? সেই আলতাফ আমাকে আজ সকালে বলেছে। আর সে সরাসরি আমাদের নুপুরের কথাই বলেছে৷ দেখো, আমাদের নুপুর তো দেখতে, শুনতে কম সুন্দর না। মাশাআল্লাহ। তার পরও আমরা তার জন্য ভালো সম্বন্ধ পাবো কিনা সন্দেহ। আর যে জামাই, তার বিড়াট কাজ কারবার। সিলেট শহরে তাদের পাঁচতলা বাড়ি। জামাইয়ের কাপড়ের দোকান। আর বয়সও বেশি না ছোকরার৷ মাত্র চব্বিশ৷ সব মিলিয়ে দেখো যদি এখানে বিয়ে দিয়ে দিতে পারি আমাদের মেয়েটার, তাহলে মন্দ হয় না।’
‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ওরা বিয়ে করাতে রাজি হবে তো?’
‘আরে আপা সেই চিন্তা তোমার করা লাগবে না৷ এই চিন্তা আমাকে দিয়ে দাও। আমি দেখছি সব। তুমি শুধু হ্যাঁ বলো।’
আমার মা সেদিন আর আমার বাবার মতও নিলেন না। আমারও না। বড় ইচ্ছা ছিলো, এইচ এস সি পরীক্ষা দেয়ার পর মেডিকেলে ভর্তি হবো। ডাক্তার হবো। বাবা মায়ের জন্য কিছু করবো। সেই ইচ্ছাটা আমার আর পূর্ণ হলো না। পরীক্ষাও দেয়া হলো না। পরের সপ্তাহ দুইয়ের মাঝেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েতে সে কী আয়োজন! আমার দরিদ্র বাবা, ঋণ করে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করলেন। দুই লাখ টাকা দিয়ে ফার্ণিচার কিনলেন। আমি বাবাকে সরাসরি মামার সামনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওরা যদি এতো বড়লোক হয়, তাহলে কেন ফার্ণিচার নিচ্ছে?
মামা সেদিন সরাসরি আমাকে বলেছিলেন,
‘সবকিছু এতো সহজ না রে মা। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়।’
আশেপাশের ঘরের লোকজন বলাবলি করছিলো,
‘নুপুরের কী কপাল দেখো! একেবারে রাজরাণি হয়ে উঠছে।’
আমার বিয়ের আগেরদিন যখন আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার বিয়ের পোশাক আশাক চলে আসে, আমার মা তখন সাতকাহন ডেকে সবাইকে এনে দেখাচ্ছিলেন। এবাড়ি, ওবাড়ির বউ ঝিয়েরা এক এক করে গুণেছিলো বত্রিশটা শাড়ি। সোনার সীতাহার দেখে কেউ কেউ বলছিলো,
‘এইটা আসল স্বর্ণের তো? দেখে তো ওজন হিসাবে দশ ভরির কম হবে বলে মনে হয় না।’
আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম আমার মা তখন গাম্ভীর্যের গলায় বলছিলেন,
‘আরে দশ ভরি না। স্বর্ণই দিয়েছে সব মিলিয়ে সতেরো তোলা। এই দেখো, এই দেখো হাতের বালা জোড়া। কী পোক্ত না!’
আশেপাশের সবাই ধরছিলো আর বলছিলো,
‘আসলেই তো! আসলেই তো!
সবাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো আর বলছিলো,
‘রাজভাগ্য মেয়েটার! আহা রাজভাগ্য মেয়েটার।’
বিয়ের দিন গাড়ির বহর যেনো বসে গেলো আমাদের গ্রামের রাস্তায়। বরযাত্রী এলো, সব এলো। এলো না শুধু আমার বর। আশেপাশের লোকজন মাতামাতি করছিলো৷ আমি ভেতরে বসে সব শুনছিলাম। কে জানি এসে বলল, বরের নাকি বিশেষ কারণে আজই ইন্ডিয়া যেতে হয়েছে। কেউ কেউ আবার বাহবা দিতে লাগলো! এমন কর্মট আর গুণী বর দেখে!
বিকালে একা একাই আমার বিদায় হলো। স্বামী আমাকে নিতে এলো না। ঘরে এসে ঢুকেই দেখলাম মদ খেয়ে মাতাল হওয়া স্বামী দরজার সামনে বসে তার মাকে বলছে,
‘কাকে নিয়ে আসছো আমার জন্য? আমি কি বলেছি যে আমি বিয়ে করবো? আমি এই বিয়েতে রাজি নই…’
(চলবে)