আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️পর্ব-৩৯

0
869

#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৯

নিশুতি রাতের কান্নাগুলো আটকে আছে।মাঝেরাতের নিস্তব্ধতা চিঁড়ে আরিয়ানের বুকের ভেতর চলছে বিধ্বংসী ঝড়।শ্বাস নেয়ার সাহসটুকো পাচ্ছেনা সে।বদ্ধ বদ্ধ লাগছে।নিজের সাথে নিজেকে সামলে নেয়ার নিরন্তর যুদ্ধ করছে।রাতের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে দিনের আলো উঁকি দিচ্ছে গহীন আকাশে।

এই ভোরবেলাই ড.মিতালী কে ফোন করায় ছুটে এসেছেন তিনি।হসপিটালে এখন কোন ডাক্তার নেই বিধায় সেখানে নিয়ে যাওয়াটা বোকামি ছাড়া কিছুইনা।ইতি আর ডক্টর মিতালী প্রায় একঘন্টা যাবত রুমের ভেতর আছে।রুমের বাইরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান।তার পাশেই তন্ময়।
বেশ অনেকক্ষনের নিরবতা ভেঙে তন্ময়ই বললো,
—“ভাবির ব্লিডিং তো থেমে গেছে ভাই।টেনশন নিয়েন না।ভাবি আর বাচ্চারা তিনজনই সুস্থ থাকবে, দেখেন।”

আরিয়ান অসচ্ছ চোখে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
—“মেয়েটা আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল অথচ ওর ব্লিডিং হচ্ছে আমি খেয়ালই করলাম না তন্ময়।দোষটা তো আমারই।”

তন্ময় দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে।আরিয়ানকে বোঝানো তার পক্ষে অসম্ভব।যদিও তার নিজেরও মাথা ঘুরছে।আরিয়ান ডাকার পর মায়ার রক্ত দেখে নিজেও প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়েছিলো।সম্পর্কে মায়া তার ভাবি হলেও বয়সে তার থেকে খুব ছোট।ভাবি হিসেবে যেমন সম্মান করে তেমনই ছোটবোনর মতোই তাকে খুব স্নেহ করে তন্ময়।

তার ভাবনার মাঝেই গেট খুলে বেরিয়ে আসে ড.মিতালী।তার ক্লান্ত চেহারাতে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে আরিয়ানকে বলে,
—“আপনার স্ত্রী সুস্থ আছেন।বাচ্চাদের হার্টবিট ও ঠিক আছে।মূলত যতটা দেখা গেছে ততটা রক্ত বের হয়নি।সুতি কাপড়ে রক্ত ভিজে ছড়িয়ে পরেছিলো তারউপর উনি সাদা জামা পরে ছিলেন তাই মনে হচ্ছিল অনেক ব্লাড।কিন্তু আসলে অতটা ব্লিডিং হয়নি।আর এটা স্বাভাবিক।আপনাকে বললাম না ব্লিডিং হওয়া মানেই মিসক্যারেজ না।আপনার স্ত্রীর বয়সটা একটু কম,ফার্স্ট টাইম প্রেগন্যান্সিতেই টুইন বেবি হবে আর এমনেই উনি একটু নাজুক,আদুরে প্রকৃতির।ইমিউনিটি সিস্টেম একটু লো।একটু ব্লিডিং হয়েছে যদিও আমার ধারণা এটা ব্যাথাহীন ব্লিডিং তবুও দেখেন উনি ঘুমের মধ্যই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন।”

আরিয়ান স্বস্তির হাসি হাসে।এতক্ষন বুকের উপর চেপে থাকা পাথরটা নেমে যায়।
—“রক্তটা কেন বের হলো ডক্টর?ওর কিছু হবোনাতো?”

—“আশা করছি কিছু হবেনা।সাতমাসে যদিও ব্লিডিং হয়না।তবুও উনার হয়েছে।সমস্যা নেই।”এভরি প্রেগন্যান্সি ইজ্ ডিফারেন্ট”।উনি সুস্থ আছেন এটাই খুশির।আমি মেডিসিন লিখে দিয়েছি।কাল থেকে টাইমলি খাওয়াবেন।এখন স্যালাইন চলছে,দূর্বলতা কেটে যাবে।
আর আগামী তিনমাসে উনাকে বেশি লাফালাফি করতে দিবেন না।বেড রেস্টে থাকবে এটাই বেটার হবে।”

—“আচ্ছা ডক্টর।আমি খেয়াল রাখবো।আপনি আজকের রাতটা গেস্টরুমে থেকে যান।সকাল হলে বাসায় পৌছে দিবোনে।”

ড.মিতালী হাসেন।আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
—“সরি বাট আমি থাকতে পারবোনা।আমার মেয়েটা বাসায় একা।আমার ফিরতে হবে।আই হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্টেন্ড।

আরিয়ান আর জোর করে করেনা।ড.মিতালীর স্বামী নেই সে জানে।পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে যার সাথে আরিয়ানের দু চারবার দেখা হয়েছে।বেশ মিষ্টি মেয়েটা।তার কারণে বাচ্চা মেয়েটাকে বাসায় মাঝরাতে একা রেখেই চলে এলো ড.মিতালী ভাবতেই মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো।
_______________
ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করলো আরিয়ান।খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে মায়া।কেউ আসার শব্দে চোখ মেলে তাকালো সে।আরিয়ানকে দেখে সে দূর্বল গলায় বললো,
—“আপনি এতক্ষন কোথায় ছিলেন?সবসময় আমার কাছে কাছে থাকবেন।আপনাকে ছাড়া আমার ভয় করে।”

আরিয়ান দরজা আটকিয়ে মায়ার কাছে এসে বসে।
মায়া ক্ষীণ হেসে ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হাতটা আরিয়ানের হাতের উপর রাখে।
আরিয়ান হুট করে ঝুকে মায়াকে নিজের সাথে লেপ্টে নেয়।তার একহাত মায়ার কোমড় আরেকহাত মায়ার ঘাড়ের পিছে।কয়েক মূহূর্তের মাথায় মায়াকে অসংখ্য চুমু তে ভরিয়ে দিতে থাকে সে।
মায়ার গাল,কপাল,গলা ছেঁয়ে যায় আরিয়ানের তীব্র ভালবাসার স্পর্শে।ভালবাসার ঝড় থেমে যেতেই তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রাখে আরিয়ান।দ্বিতীয়বারের মতোন মায়া তার ঘাড়ে চোখের জলের অস্তিত্ব টের পায়।আলতো করে আরিয়ানের পিঠে হাত রেখে সে বলে,
—“কাঁদছেন কেনো?”

উওরে আরিয়ান আরো বার দুয়েক তার ঘাড়ে ঠোঁট ছুইয়ে ভেঁজা কন্ঠে বলে,
—“মায়াবতী তুমি…।”

—“আমি ঠি ক আছি।বাচ্চারাও সুস্থ আছে।আপনি শান্ত হন।”

আরিয়ান আরো বেশ কিছুক্ষন মায়াকে জড়িয়ে রেখে ছেড়ে দেয়।চোখ লাল হয়ে আছে তার।ঠোঁটগুলো রক্তিম।
স্যালাইন শেষ হলে মায়ার ক্যানেলাটা খুলে দিয়ে তাকে শুইয়ে দেয় আরিয়ান।ঘরের লাইট নিভিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে মাথায় হাত রাখে।
মায়া তখনো সজাগ।ঘরের হাল্কা আলোয় আরিয়ানকে দেখা যাচ্ছে।মায়া তার মাথায় রাখা হাতটা নিজের দুহাতে চেঁপে ধরে বুকের মাঝখানটায় নিয়ে বলে,

—“জানেন,বাবাও না আমাকে খুব ভালোবাসতো।আপনার মতোই পাগলামি করতো।আমার কিছু হলে অস্থির হয়ে উঠতো।আমি শান্ত হতে বললেও শান্ত হতোনা।এতো কঠিন মানুষটাও কেঁদে দিত।ঠিক আপনার মতোই।কিন্তু দেখেন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।আচ্ছা আপনিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”

—“আজেবাজে কথা না বলে ঘুমাও মায়া।তুমি না ঘুমালেতো বাচ্চারাও ঘুমাতে পারেনা।”

বিষন্নতার মাঝেও ফিক করে হেসে দেয় মায়া।হাসিমাখা কন্ঠে বলে,
—“এটা কে বললো আপনাকে?”

—“আমার মনে হয়।”

—“ওদেরতো এখনও চোখও ফুটেনি।আপনি যে কিসব বলেন।”

—“ওইদিন ডক্টর বললোনা,তুমি যা খাও ওরাও তাই খায়।তাই ভাবলাম তুমি ঘুমালে ওরাও ঘুমায়,তুমি কাঁদলে ওরাও কাঁদে,তুমি ব্যাথা পেলে ওরাও ব্যাথা পায়,তুমি হাসলে ওরাও হাসে।”

—“হয়েছে চুপ করেন।এখন আপনি আর কথা বললে আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো।”

আরিয়ান বোকা হাসে।দুটো বাচ্চার বাবা হবে তাই হয়তো দিন দিন এতো বোকা হয়ে যাচ্ছে সে।
______________
বাগানের নরম ঘাসের উপর হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে মায়া।মুখে নজরকাড়া হাসি নিয়ে খেলে চলেছে জ্যাক আর জেনির সাথে।
ঘাসের মাঝখানেই বসার জায়গা আছে আরিয়ান সেখানেই বসে আছে কিন্তু মায়া বসেনি।তার ওরকম পা ঝুলিয়ে বসতে তার কষ্ট হয়।অনেক বাঁকবিতন্ডতার পর আরিয়ান তাকে বাগানে এনেছে।নয়তো এই তিনমাস যাবত তাকে একদম ঘোরাফিরা করতে দেয়না আরিয়ান।দিলেও সবসময় নিজে সাথে থাকে।

আরিয়ান ফোন চালাচ্ছে।সেসময়ই তন্ময় আসে।মায়াকে বাগানে বসে খেলতে দেখে মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠে তার।দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেয়ে পকেট হাতরিয়ে একটা বড় চকলেটের প্যাকেট মায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“ভাবি নেন,চকলেট খান।”

মায়া মিষ্টি করে হেসে তন্ময়ের হাত থেকে চকলেটটা নিতেই আরিয়ান গম্ভীর গলায় বলে,
—“তুই ওকে এত চকলেট কেন দেস তন্ময়?সারাদিন খালি খাবারের বদলে চকলেট চকলেট করে।আর তুই ওকে এনেও দেস”।

আরিয়ানের কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকায় মায়া।ততক্ষনে ঠোঁটের চারপাশে ভরিয়ে চকলেট খেতে শুরু করেছে সে।খেতে খেতেই সে বলে,
—“আপনার কি সমস্যা?”

মায়ার এমন বাচ্চা বাচ্চা চাহনী দেখে না চাইতেও হেসে দেয় আরিয়ান।বলে,
—“আচ্ছা খাও।”

তন্ময় পকেট থেকে আরেকটা চকলেট বের করে দিয়ে মায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
—“ওটা শেষ হলে এটা খেয়েন,আপনারা তিনজন মানুষ একটা চকলেটে হয় নাকি!।”

আরিয়ান ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।দুই বাচ্চার মা হবে এই মেয়ে তবুও তরা বাচ্চামো স্বভাব যায়না।বকা দিলে এখনো বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়।
ডেলিভারির ডেটের আর এক সপ্তাহ বাকি আছে।তিনদিন পর মায়াকে হসপিটালে এডমিট করা হবে।এবার সব ভালোয় ভালোয় হলেই হয়।

~চলবে~

[খাপছাড়াভাবে লিখেছি।সময় নিয়ে না লেখলে গল্প সুন্দর হয়না।তবুও দিতে হবে তাই লিখতেই হলো।পরের পর্ব কালকে রাতে দিব]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here