#আলো-আঁধার🖤 পর্ব১৫
#লেখিকা: সালসাবিল সারা
১৫.
হাসপাতাল থেকে তূর্যয়কে ডিসচার্জ করে দেওয়া হলো।তূর্যয় নিজের সব ঔষুধপত্রের খোঁজ নিজেই ডাক্তার থেকে জেনে নিয়েছে।সবকিছু তূর্যয় সজ্ঞানে করলেও,
তার মাথায় ঘুরছে রাণীর কথা।হ্যারি সেই যে রাণীকে দেখতে গেলো এখনো আসেনি।তূর্যয়ের চিন্তা হচ্ছে খুব সেই দুইজনের জন্যে।রাগের মাথায় তূর্যয় রাণীর হাতে বেশি আঘাত দিয়ে ফেললো নাকি,এই নিয়েই এখন তূর্যয় ভেবে যাচ্ছে।কিন্তু, তূর্যয় রাণীর প্রতি তার মনোভাব কোনো মতেই প্রকাশ করছে না।কারণ, তূর্যয় সাধারণত কারো জন্যেই চিন্তা করে না।সেখানে এখন,রাণীর প্রতি চিন্তাটা সবাই হজম করতে পারবে বলে তূর্যয়ের মনে হচ্ছে না।অগত্য তূর্যয় নানান কথা ভেবে চললো নিজ মনে।পকেট থেকে মোবাইল বের করে হ্যারিকে ফোন করলো তূর্যয়।কিন্তু তূর্যয়ের ফোন ধরছে না হ্যারি।এতক্ষণ তূর্যয় এইসব সহ্য করে নিলেও এখন হ্যারির ফোন না ধরাটা তূর্যয়ের আর ভালো লাগছে না।ডাক্তার থেকে সবকিছু বুঝে নিয়ে তূর্যয় ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে হ্যারি আর রাণীর জন্যে।তূর্যয়ের গ্যাং এর কিছু ছেলেও এসেছে আজ।তারা আপাতত তূর্যয়ের পাশে ঢালের মতো দাঁড়িয়ে আছে।তূর্যয় নিজের কপালে হাত রেখে কপাল ঘষে যাচ্ছে।এমনভাবে সে নিজের কপাল ঘষছে,এই বুঝি তূর্যয়ের কপালের চামড়া উঠে গেলো!অনেক্ষণ চুপ থেকে তূর্যয় এইবার তার পাশে দাঁড়ানো এক ছেলেকে বললো,
“ঐ শুন।”
ছেলেটি তূর্যয়ের ইশারা পেয়ে তূর্যয়ের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো।তূর্যয় ছেলেটির ঘাড় চেপে ধরে তাকে বলে উঠলো,
“হ্যারিকে ফোন লাগা।”
তূর্যয়ের কথায় ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ঠিক আছে বস।”
ছেলেটি নিজের মোবাইল থেকে হ্যারিকে কমপক্ষে দশটি কল দিলো।প্রথমে ছেলেটার মুখ নরমাল থাকলেও,
তূর্যয়ের তীক্ষ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা বারবার ইতস্তবোধ করছে।শেষ বার কল দিয়ে ছেলেটা তূর্যয়ের দিকে কিছু বলতে যাবে,তখনই তূর্যয় ছেলেটার দিকে হাত দেখিয়ে বললো,
“চুপ।”
অতঃপর ছেলেটি কিছু বললো না।তূর্যয় মুহূর্তেই রাগে একেবারে বোম্ব হয়ে গেলো।চেয়ার থেকে উঠে হনহন করে হাঁটতে লাগলো সে।তার পিছু পিছু হাটছে তার ছেলেপেলে।তূর্যয়ের দিকে হাসপাতালের অনেকে ভয়ে তো অনেকে অবাকদের চোখে তাকাচ্ছে।কারণ,একে তো তূর্যয় নাম করা একজন গ্যাংস্টার।এতো বড় মাপের মানুষকে বাস্তবে দেখে অনেকে অবাক হচ্ছে।তার উপর তূর্যয় অত্যন্ত আকর্ষণীয়,আর বলিষ্ঠ একজন পুরুষ।অনেক মেয়েই তার সাথে এক মুহুর্ত কাটাতে চায়।যদিও এমন কাজের দুঃসাহস কারো কখনোই হয়নি।তারপরও তূর্যয়কে এক নজর দেখার জন্যে মেয়েরা উঁকিবুকি করছে।
তূর্যয় সেদিকে তাকানোর একটুও প্রয়োজন মনে করছে না।সে বরং রাণী আর হ্যারির চিন্তা করছে।তূর্যয় মনে মনে ভাবছে,
“ঐ দুইজন পাতানো ভাইবোন কই গেলো আল্লাহ্ জানে।মেয়েটা তো একেবারেই ছিঁচকাদুনে।হ্যারি তার বোনের এমন কান্না দেখে নিশ্চয় মেয়েটার সাথে তাল মেলাচ্ছে! ভাবা যায় এইসব?দুইজন মিলে এখন হয়তো আমার নামে নানা কথা বলে যাচ্ছে।মেয়েটা নিশ্চয় হ্যারিকে ইমোশনাল করে ফেললো।আর দুইজন মিলেই এখন কেঁদে যাচ্ছে।উফ, এই মেয়েটা হ্যারিকে একদম মেয়েলি টাইপ বানিয়ে দিয়েছে।দুইটাকে আজ পেলেই একদম চিল্লিয়ে বকা দিবো।এরপর দুইজন আমার সামনেই কান্না করবে।বাহ্,তূর্যয় ভালো আইডিয়া।”
তূর্যয় নিজের ঠোঁট বাকালো নিজের কথায়।তূর্যয়ের ধারণা,হ্যারি আর রাণী পার্কিং বা নিচের লবিতে থাকবে।হলোই তা।হ্যারি আর রাণীকে লবিতে না পেয়ে তূর্যয় আর তার অনুসারীরা পার্কিং এ গেলো।সেখানে একটু ভেতরের দিকে যেতেই তূর্যয় রাণী আর হ্যারিকে দেখতে পেলো।রাণী বসে আছে পার্কিং এর কিনারায় রঙিন লাইট আর একটা ছোটো ঝর্নার ডিজাইনের মধ্যখানে করা বাগানের পাশে।হ্যারি রাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার পাশে দাঁড়িয়ে।আর রাণী মাথা উঁচু করে হ্যারির দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে।তূর্যয় সাবধানে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে একটা গাড়ির আড়াল করে নিলো নিজেকে।তূর্যয়ের দাঁড়ানোর জায়গা থেকে স্পষ্ট রাণীর কথা শুনতে পাচ্ছে।রাণী কান্না মাখা কন্ঠে হ্যারিকে বলছে,
“ভিনদেশী ভাই,আমি তো আপনাকে সব বলেছি।আমার হাতে এখন ব্যাথা নেই ।কিন্তু আপনার ব্রো এর কথায়, আমার মনের ব্যাথাটা এখনো আছে।।আপনার ব্রো কিন্তু সত্যি একটা দানব।আপনি কিন্তু আবার উনাকে বলবেন না,আমি যে উনাকে দানব ডেকেছি।ডাকবো না কেনো বলুন!আমি এতিম খানায় থাকি বলে, আমি কি মানুষ না?উনি আমাকে বলেছেন,আমার মতো মেয়ের দিকে নাকি ফিরেও তাকানো যায় না।কেনো?আমি দেখতে এতো বিশ্রী?নাকি আমার বাবা মা নেই,তাই আমাকে সবাই ঘৃণা করবে!আচ্ছা,বাবা মাকে কি আমি ইচ্ছে করেই নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি?আমি নিজেই তো তাদের কখনোই দেখিনি।দেখবেন তো,আপনার ব্রো কখনোই সুখী হবে না।উনার জীবনে কখনো সুখ আসবে না।একদিন উনি উনার কোনো এক আপনজনের জন্যে অনেক কান্না করবেন।দেখে নিয়েন এই এতিমের কথা,
ঠিক ঠিক মিলবে!”
রাণী মিনমিন করে কান্না করতে লাগলো।রাণীর কথায় হ্যারি আহত গলায় বললো,
“সব অলরাইট।তবে,আমার ব্রো এর জীবনটাও অনেক এলোন। বাট!”
রাণী হ্যারিকে বলতে না দিয়ে নাক টেনে আবারও হ্যারিকে বলে উঠলো,
“জানি জানি,আপনি কি বলবেন।যান যান,আপনার ব্রোয়ের উপর থেকে সব অভিশাপ তুলে নিলাম।উনার মনে সত্যি কোথাও কষ্ট আছে।আর এইসব রহস্য সব এই রাণী বের করে নিবে। ঐ দানবকে আমি মানুষে পরিণত করবোই।”
রাণীর কথা শুনে হ্যারি হাসলো।সে রাণীকে দাঁড় করালো রাণীর হাত ধরে।আর মুচকি হেসে তাকে বললো,
“ইয়াহ ইয়াহ, আই নো।আমার ব্রোয়ের জন্যে তুমি পারফেক্ট। গড আমাকে ওলয়েজ গুড ইশারা দেয়।”
হ্যারির উত্তরে রাণীর মুখটা প্রশ্নে ছেয়ে গেলো।রাণী কিছু বলতে যাবে এর আগেই রাণী দেখলো গাড়ির আড়ালে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।রাণী একটু উঁকি দিতেই দেখলো তূর্যয় একপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাণী ইশারায় হ্যারিকে চুপ করতে বললো।রাণী হ্যারিকে তার পিছু পিছু আসার জন্যে ইঙ্গিত করলো।হ্যারি রাণীর পেছন পেছন আসছে।তাদের আসতে দেখে তূর্যয়ের অন্য ছেলেরা তূর্যয়কে ইশারা করছে।কিন্তু তূর্যয় মাথা নিচু করে ভালো করে রাণীদের কথা শোনার চেষ্টা করছে।রাণী আর হ্যারির কোনো কথা শুনতে না পেয়ে তূর্যয় মাথা উঠিয়ে তাকালো। সামনে রাণী আর হ্যারিকে দেখে তূর্যয় একটু নড়ে উঠলো।হ্যারি তূর্যয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“তুমি হচ্ছো মাসেল ম্যান।তোমার এই ছোট জায়গায় লুকিয়ে থাকা কি মানায়?আর তুমি এইভাবে হাইড হয়ে আমার কনভারসেশন শুনছিল? হাউ চিপ!”
তূর্যয়ের ভ্রু মুহূর্তেই কুঁচকে গেলো হ্যারির কথা শুনে।তূর্যয়কে রাগতে দেখে রাণী হ্যারিকে বললো,
“আরে আরে,কাকে কি বলছেন; ভিনদেশী ভাই?উনি তো দা গ্রেট তাশরীফ তূর্যয়।উনি লুকিয়ে অন্যের কথা শুনবেন নাকি?উনি তো এইখানে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করছিলেন,তাই না তূর্যয় বস? ছি!এত্তবড় একটা গ্যাংস্টার সে নাকি অন্যের কথা লুকিয়ে শুনে।”
কান্না করার ফলে রাণীর গলা একটু অন্যরকম শোনাচ্ছিল।তূর্যয় কিছু না বলে চুপ করেই রাণীর সেই লাল হয়ে যাওয়া চোখ আর চোখ বড় করে কথা বলাকে দেখছে।রাণীর কণ্ঠস্বর তূর্যয়ের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে চললো।তূর্যয়কে এইভাবে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে রাণী হ্যারিকে বললো…
“উনি কি এইখানেই হাঁ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে?উনি যে অসুস্থ এটা উনার জানা নেই?”
রাণী একটু জোরে চিল্লিয়ে কথাগুলো বলল।রাণীর কথায় তূর্যয় বলে উঠলো,”হুঁ?”
তূর্যয়ের কথা শুনে রাণী নিজের কোমরে হাত রেখে তূর্যয়কে বললো,
“হুঁ না বু! দাঁড়িয়ে বাতাস খান আপনি এইখানে।নিজে অসুস্থ সেটা কি আপনার মাথায় নেই?এই যাহ! দেখুন দেখুন আমি কতো মহৎ মেয়ে।আপনি আমাকে কতো অপমান করেছেন আর আমি আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবছি? ছি! আমার উপর ছি বর্ষিত হোক। হুঁ,রোবট একটা।”
রাণী ধপ ধপ পা ফেলে সামনের দিকে যাচ্ছে।
তূর্যয় চোখ ছোট ছোট করে হ্যারির দিকে তাকিয়ে তাকে বলতে লাগলো,
“কি এই মেয়েটা?এই মেয়ের কি মাথা নষ্ট?ও কি ভাবতে পারে,আমার মেজাজ খারাপ হলে আমি তার সাথে কী করতে পারি?মেয়েটা কি একটুও ভয় পায় না আমাকে?”
হ্যারি তূর্যয়ের কথার উত্তরে তাকে বলে উঠলো,
“তোমাকে ভয় পায় ঠিকই।কিন্তু সে ভয়টা ফেইসে দেখায় না।তুমি যেমন তোমার সকল কষ্ট হাইড করো সবার থেকে।তেমনি কুইনও তার মনের স্যাডনেস আর তোমার প্রতি তার ভয়টাকে হাইড করে।তোমরা দুজনই কেমন যেনো!নিজেদের সবকিছু হাইড করতে লাভ করো।বাট!আমার বিশ্বাস;তোমরা দুইজন দুইজনার সকল স্যাডনেস, লাভ,ভয় সবকিছু ভালই শেয়ার করতে পারবে।”
হ্যারির এমন বক্তব্য শুনে তূর্যয় রাগী গলায় হ্যারিকে চেঁচিয়ে বললো,
“স্বপ্ন দেখতেই থাকো।তূর্যয় নিজের কষ্ট কারো সাথে শেয়ার করে না।আর ঐ মেয়ের সাথে তো একদমই না।”
তূর্যয় দ্রুত হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে।হ্যারির বলা কথাগুলো তূর্যয়কে বড্ড ভাবাচ্ছে।
আর হ্যারি সেখানেই দাড়িয়ে ভাবতে লাগলো,
“অলরেডি দুইজন দুইজনের জন্যে অনেকটা কেয়ার দেখিয়ে ফেলেছো।যাক, লেটস সি;কতদিন দুইজন দুইজন থেকে ডিসটেন্সে থাকবে!”
হ্যারি নিজের মনে কথাগুলো ভেবে সামনের দিকে গেলো।তূর্যয়ের সাথে থাকা ছেলেরা অন্য গাড়িতে উঠলো।আর রাণী,তূর্যয়, হ্যারি অন্য গাড়িতে উঠে পড়লো।গাড়িতে উঠার সময় তূর্যয়ের সাথে রাণীর চোখাচোখি হতেই রাণী মুখ ভেংচি দিলো তূর্যয়কে।তূর্যয় চোখ বড় করতেই রাণী চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো।রাণী খেয়াল করলো,আজ গাড়ি অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।একটু পরেই রাণী চারদিকে সমুদ্রের বিলবোর্ড লাগানো দেখছে।রাণী অবাক হয়ে ভাবছে,
“উনারা কি এখন সমুদ্রে গোসল করবেন?এইটা তো দেখে সমুদ্র পাড় মনে হচ্ছে।”
নিজের মনের প্রশ্ন রাণী নিজের মনেই রেখে দিলো।রাণী চোখ পাকিয়ে সব কিছু দেখছে।রাণী সমুদ্র কখনো দেখেনি।এতিম খানায় থাকে সে,এতিম খানা থেকে তাকে সমুদ্র দেখাতে কেই বা আনবে?রাস্তায় অনেকেই ডাব খাচ্ছে তো,অনেকে পেঁয়াজু, কাকড়ার দোকানে ভিড় করছে।অনেকে পরিবার,বন্ধুবান্ধব বা প্রেমিক প্রেমিকা নিয়ে এসেছে।রাণী চুপ করে দেখে রইলো সব।কিন্তু সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে না আরেকটু দূরে যেতেই রাণী দেখলো গাড়ি একটা সুন্দর গেইট দিয়ে ঢুকছে।এই বাড়ির চারদিকে অনেক সুন্দর।রাণীর ধারণা ছিল “শান্তি মহল” তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ঘর।কিন্তু এই ঘর আর ঘরের পরিবেশ দেখে রাণীর মনের মত পরিবর্তন হলো।দুই তলা এই বাড়ি দেখেই রাণীর চোখ জুড়ে গেলো।গাড়ি থেকে নেমে রাণী হ্যারিকে বললো,
“এটা কার বাড়ি?আমরা কি এইখানে বেড়াতে এসেছি?”
” অন্যর বাড়িতে চুরি করতে এসেছি।আমার টাকার অনেক অভাব তো, তাই।”
তূর্যয় বাঁকা চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বললো রাণীকে।
হ্যারি হেসে উঠলো ঐ দুইজনকে দেখে।রাণীকে হ্যারি বলে উঠলো,
“এইটা ব্রোয়ের বাড়ি।কিছুদিন আগেই কিনেছে।ব্রো এখন দিনের বেলায় এইখানে থাকে।বাট রাতে সেই শান্তি মহলে ব্যাক করে।”
রাণী অবাক হয়ে হ্যারিকে বললো, “কেনো?”
এইখানে রাতে কি ভূত আসে?উনি এইখানে রাতে থাকে না কেনো?”
“স্টুপিড।” তূর্যয় কথাটা বলে বাড়ির ভেতরে যেতে লাগলো।আর হ্যারি রাণীকে, তূর্যয়ের মায়ের দেওয়া ওয়াদা শোনাচ্ছে।তূর্যয়ের দলের ছেলেরা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির আঙিনায় বসে রইলো।
ভেতরে গিয়ে রাণী আরো বেশি অবাক।এই ঘরের সবকিছু যেনো রাজকীয়।রাণী অবাক হয়ে হ্যারিকে বলে উঠলো,
“এই ঘরের দাম অনেক।তাই না?”
হ্যারি মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বললো।রাণী হ্যারির ইশারা দেখে হাসলো।রাণী ঘুরে ঘুরে সারা ঘর দেখছে।একটু পরে হ্যারি এসে রাণীকে বললো,
“সিস,তুমি থাকো।আমি বেরুচ্ছি ওয়ার্কে।রাতে আমি ব্যাক করলে, তোমাকে এতিম খানায় পৌঁছে দিবো। ব্রোকে দেখে রেখো।তাকে ভয় পাবে না একদম।তার কাছে গিয়ে আস্ক করবে,তার কিছুর নিড হয় কিনা!”
হ্যারি দাঁড়ালো না কথাগুলো বলে। কানে ফোন লাগিয়ে চলে যাচ্ছে সে।আর রাণী মনে মনে ভাবছে,
“আমাকে এই দানবের কাছে একা রেখে চলে গেলেন আপনি ভিনদেশী ভাই!এই দানব সন্ত্রাসী আমাকে যেনো খেয়ে না ফেলে,আল্লাহ্।”
রাণী একটা রুমে বসে রইলো।এই রুম থেকে সমুদ্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে।কিন্তু সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না।ঘরের সবকিছু একেবারে চিকচিক করছে।হ্যারি থেকে রাণী শুনেছিল,সকালের দিকে এই ঘরের দরজা খোলা হয় আর চাকররা সম্পূর্ণ ঘর পরিষ্কার করে দেয়।এরপর সারাদিন কোনো কাজের লোক আসে না এইখানে।রাণী অনেক্ষণ এই রুমে বসে থেকে সে তূর্যয়ের ঘরের দিকে যাচ্ছে।হাজার হলেও,রাণী তূর্যয়ের জন্যে কাজ করে।তূর্যয়ের সাথে তার এতো ভাব নেওয়া ঠিক হবে না।তূর্যয়ের রুমের সামনে আসতেই রাণী তূর্যয়ের দরজায় নক করলো।ভেতর থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে রাণী দরজা ঠেললো।নিজে নিজেই দরজা খুলে গেলো।দরজা খুলতেই রোদের একটা তীব্র আলো এসে পড়লো রাণীর মুখে।রাণী রোদ থেকে বাঁচার জন্যে নিজের মুখের সামনে হাত রাখলো। রোদের জন্যে রাণী কিছুই দেখছে না।
তূর্যয় হ্যারিকে তার সকল মিটিং কালকে থেকে ফিক্স করার জন্যে ফোন করেছিল।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে হ্যারির সাথে কথা বলছিল।রুমের ভেতরে আসতেই রাণীকে দেখে থমকে গেলো তূর্যয়। রোদে রাণীর কুঁচকানো মুখ তার পরিচিত লাগছে অনেক,সেই আগের মতো!যেদিন প্রথম দেখেই রাণীকে তূর্যয়ের পরিচিত মনে হয়েছিল।
রাণী মুখে হাত রেখেই তূর্যয়ের অবয়ব দেখতে পেয়ে চোখ বন্ধ করে তাকে বললো,
“আপনার কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে জানাবেন।ভিনদেশী ভাই বললো,আপনার যত্ন নিতে।”
তূর্যয়ের কানে রাণীর কথা ঢুকেছে ঠিকই।কিন্তু সে দেখে যাচ্ছে রাণীকে।রাণীকে দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে তূর্যয় এসে রাণীর সামনে দাঁড়ালো।
নিজের সামনে রোদের তাপ আর না লাগায় রাণী তার চোখ খুললো।সে দেখলো,তূর্যয় তার সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে।যার কারণে তার মুখে রোদ লাগছে না।
অন্যদিকে রাণীর স্বাভাবিক মুখ থেকে তূর্যয় আবারও রাণীর সামনে থেকে সরে গেলো। যার কারণে রাণীর মুখে আবারও রোদ পড়লো আর রাণী তার মুখ আবারও কুঁচকে নিলো।তূর্যয়ের মুখে অচিরেই হাসি ফুটে উঠল রাণীর এমন মুখ দেখে।পরক্ষণে তূর্যয় নিজের হাসি থামিয়ে রাণীর হাত চেপে তাকে রোদ থেকে সরিয়ে নিলো।আর রাণীর মুখ চেপে ধরে তাকে প্রশ্ন করলো,
“কে তুই?কেনো এতো পরিচিত আমার কাছে তুই? তোকে আমি কেনো চিনি? কোথায় পড়ালেখা করেছিস তুই?”
তূর্যয়ের প্রশ্নে রাণী কাঁপতে লাগলো।কারণ,তূর্যয়ের চোখে অন্যরকম এক ভয়ংকর আক্রোশ দেখতে পাচ্ছে সে।রাণীর মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না।কিন্তু, সে সাহস নিয়ে তূর্যয়ের নজরে নজর মিলিয়ে বলতে লাগলো..
“সব বলবো, সব।আপনি একটু শান্ত হোন।প্লিজ!আপনার শরীর এখনো অনেকটাই দুর্বল।”
রাণীর নরম চাহনিতে তূর্যয়ের রাগী চোখ নিমিষেই বিলীন হয়ে গেলো।তূর্যয় রাণীর বাহু ছেড়ে দিলো।কিন্তু সে রাণীর সামনে থেকে সরলো না। বরং তূর্যয় রাণীর মাথার উপর দেওয়ালে এক হাত ঠেকিয়ে তার আরেক হাত রাণীর কোমরের পাশে দেওয়ালে রেখে বললো,
“এইবার বল।তুই কোন স্কুলে বা কলেজে পড়েছিস?”
রাণী নিজের বুকের উপর এক হাত চেপে বলতে লাগলো,
“সান.. সানসাইন হাই স্কুলে।আমার ম্যাডাম
পড়িয়েছিলেন আমাকে সেখানে।”
রাণীর এতটুকু কথায়, তূর্যয়ের এতদিনের রাণীকে চেনা চেনা ভাব একদম পরিষ্কার হয়ে গেলো।তূর্যয়ের চোখজোড়া এখন একদম মায়ায় ছেয়ে গেলো।যে মায়ায় সে, অনেক বছর আগে সেই বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতো।রাণীর কপালে চলে আসা চুলকে তূর্যয় হাত দিয়ে সরিয়ে বলে উঠলো,
“তোকে আমি চিনি।সেই প্রথম দিনেই চিনতে পেরেছিলাম।এইযে তোর চোখ,এই চোখ দেখেই আমি তোকে চিনেছিলাম।সবটাই পরিবর্তন হলো তোর,কিন্তু রোদ লাগলে মুখ কুঁচকে নেওয়াটা কমলো না তোর।”
তূর্যয়ের সব কথা রাণীর মাথার উপর যাচ্ছে। রাণী ডুবে গেলো তূর্যয়ের মায়ামাখা চোখ দেখে।রাণী তূর্যয়ের মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে তূর্যয়কে প্রশ্ন করলো,
“আপনি কিভাবে চিনেন আমাকে?আপনিও কি সেই স্কুলে পড়তেন?কিন্তু আমার তো মনে নেই আপনার কথা!”
রাণীর কথায় হুঁশ এলো তূর্যয়ের।সে রাণীর সামনে থেকে সরে গেলো।আর জোরে রাণীকে ধমকে বললো,
“বেরিয়ে যা এই রুম থেকে।এক মুহূর্তও এইখানে যেনো না দেখি তোকে আমি।”
রাণীর মাথা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেলো তূর্যয়ের কথা শুনে।সে দৌড় দিয়ে রুমের দরজা পর্যন্ত এলো এরপর সে তূর্যয়কে চিল্লিয়ে বললো,
“দানব সন্ত্রাসী,আপনার মাথা ঠিক নেই।সারাজীবন খুন করতে করতে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।পাগল সন্ত্রাসী কোথাকার!”
রাণী এক মিনিটও দাঁড়ালো না।তূর্যয়ের রাগী কথা শোনার পূর্বে, মুহূর্তেই সে এই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
তূর্যয় নিজের আঙ্গুলের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বসে আছে।সে এই ভেবে অবাক হচ্ছে,
“এতো বছর পর এই চঞ্চল মেয়েকে আমি আমার জীবনে আবারও পাবো কখনোই ভাবিনি আমি।মেয়েটাকে যখন থেকে চিনি,তখন তো আমি এতো হিংস্র ছিলাম না!কিন্তু, এই মেয়েই সেই আগের ছোট্ট রোদ্র কন্যা হবে এমনটা আমি কিভাবে মিলিয়ে ফেলেছি?এখনো কি সেই ছোট্ট মেয়ের জন্যে জমানো মায়া, আমার হৃদয়ে স্থাপন করা আছে? নিশ্চয় আছে,
নাহলে আমি কিভাবে এই মেয়েকে সহ্য করে নিই?যেখানে আমার আশে পাশ অন্য মেয়ের কোনো দেখা নেই,সেইখানে কিভাবে আমি এই মেয়েকে অত্যাচার করতে পারি না?”
তূর্যয়ের মনের প্রশ্নের শেষ নেই।তূর্যয় তার সেই রোদ্র কন্যাকে খুঁজে পাবে,আর সেই মেয়েটি বড় হয়ে তার সামনেই আসবে;এমনটা সে কখনো ভাবেনি।তার হিংস্র জীবনে রোদ্র কন্যার আগমন হবে, এই ভাবনাটা কখনো আসেইনি তার মাথায়।কিন্তু, এই প্রথম সে অতীতের কথা ভাবতেই খুশি হয়েছে।হবে নাই বা কেনো?তূর্যয়ের অতীতে, রাণী নামক সেই ছোট্ট মেয়েটির চোখের মায়া দেখেই তূর্যয় তার রাতভরের কষ্ট মুহূর্তেই যে ভুলে যেতো!
চলবে…
কপি করা নিষেধ।এক্সাম চলছে আমার।তারপরও চেষ্টা করবো সবার সাথে কমেন্টে কথা বলার,কমেন্টের উত্তর দেওয়ার।ভালোবাসা অবিরাম❤️।