সুখ নীড় পর্ব-২০

0
274

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২০

– আম্মি, সন্তানকে ত্যাজ্য করার রেওয়াজ চালু আছে শুনেছি কিন্তু জন্মদায়িনী মাকে ত্যাজ্য করা যায় কিনা আমি জানি না। তবে আমি আজ এই নতুন সিস্টেম চালু করছি।
আজ থেকে আমি তোমাকে আমার মা পরিচয় থেকে মুক্ত করছি আর আমিও তোমার ছেলে হিসেবে মুক্ত হচ্ছি। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার সন্তান পরিচয় দিয়ে নিজের জীবনটাকে আর কোনো দায়বদ্ধতায় জড়াতে চাই না। আজ হতে আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। খুব ঠান্ডা মাথায় বলল, পল্লব।

– সাজেদা চৌধুরীর মাথায় যেন বাজ পড়ল। সে হুংকার দিয়ে বলে উঠল, ঔদ্ধত্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছ, পল্লব। কী বলছ, কার সামনে বলছ, কোনো সেন্স আছে?

– আমি পুরোপুরি হুশেই এ কথা বলছি। আমি আর পারছি না। তোমার সাথে একই ছাদের নিচে থাকা মানে নিজেকেই প্রতিমুহূর্তে ছোটো করা! তুমি আমার জন্মদাত্রী। তাই এর থেকে বেশি আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। এটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল কিন্তু পারিনি৷ এবার আমাকে পারতেই হবে। তোমার জন্মের ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না! তাই তোমার শত অপরাধকেও আমার উপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কখন না আবার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়! এজন্য নিজেকেই সরিয়ে নিতে চাই। এতে হয়তো অন্ততপক্ষে সুস্থভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারব।

পল্লবের কথা শুনে জয়ীর হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। এতবড় অপমানে তার শাশুড়ি কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এটা সে জানে আর যাই হোক সবকিছুর জন্য তাকেই দায়ী করা হবে।

– সাজেদা চৌধুরী এবার ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? তুমি যেসব কথা বলছ তার মানে বুঝতে পারছ?

– একদমই ভয় দেখাচ্ছি না। ভয় দেখায় দুর্বল চিত্তের মানুষেরা! আমিও অবশ্য দুর্বল ছিলাম। কিন্তু এখন আর নিজেকে দুর্বল ভাবছি না। নিজেকে শোধরানোর সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করছি। এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছি। তুমি যদি কোনো লিগ্যাল প্রসেসে যেতে বলো আমি তবে সেটা করতেও রাজী।

– পল্লব! চিৎকার করে উঠে তার আম্মি। বুঝতে পারছ তুমি কী বলে যাচ্ছ?

পাশ থেকে কল্লোল বলে উঠল, আম্মি ওর মাথাটা পুরোই গেছে। এত অধপাতে গিয়েছিস! আম্মির সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস?

– আমি কিছুই ভুলিনি। আম্মিকে তোমার জন্য রেখে গেলাম, ভাইয়া। সারাজীবনই তো অভিযোগ করে গেলে আমি নাকি তোমার থেকে সবকিছুতে বেশি ভাগ নেই। যাও এবার সবটুকুই তোমার!

জয়ীকে উদ্দ্যেশ্য করে সে এবার বলল, জয়ী তুমি রুমে যাও। আমাদের পরার কিছু কাপড় প্যাক করো কুইক। এখনই বের হতে চাচ্ছি।

– এই মেয়েটা তোমাকে তার হাতের পুতুল করে ফেলেছে, পল্লব। এত বদলে গেলে কী করে?

– মোটেই বদলায়নি। বরং নিজেকে চিনতে শিখছি প্রতিদিন, আম্মি।

– তুমি কি বুঝতে পারছ আমার পরিচয় ত্যাগ করলে তোমার ফিউচার কী হবে?

– এসব নিয়ে আপাতত ভাবছি না। আর ভাবতেও চাই না। তোমার ভয় নেই। কখোনই তোমার কোনোকিছুতে ভাগ বসাতে আসব না। মরে গেলেও তোমার কোনো সাহায্যের আশা করব না। আর তুমিও দয়া করে আমাকে কখনোই তোমার পাশে আশা করবে না।

জয়ীতা একটা ব্যাগে হালকা পাতলা কিছু কাপড় চোপড় ভরছে। ওদিকে বাকবিতণ্ডা চলছেই। এমনটা সে কখনোই চায়নি।
কী এক অশনিসংকেতে যেনো তার বুকের মাঝে ঢিপঢিপ বেড়েই চলছে। এর ফল যে খুব ভালো হবে না এটা সে জানে। পল্লব সবকিছু যত সহজ ভাবছে ঠিক ততটাই জটিল মনে হচ্ছে জয়ীর কাছে।

জয়ী গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়াল পল্লবের পাশে।

সাজেদা চৌধুরী ঠাণ্ডা মাথায় সোফার ওপরে বসলেন। বসে তিরস্কারের হাসি দিয়ে বললেন, আমার ছায়া থেকে বের হবার মানে বুঝতে পারছ তো! আমার থেকে যাওয়া মানে আমার সবকিছুকে ত্যাগ করে যেতে হবে! সবকিছু মানে সবকিছু! পারবে তো?

– তুমি আমার কথার অর্থ বোঝনি তবে। আমি তোমার সবকিছু ছেড়েই যাচ্ছি। তারপরেও আমার কথায় যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, মনে ভয় থাকে তাহলে তুমি আইনগতভাবে আমাকে তোমার সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে দিও। ভয় নেই আমি কখনোই আমার অধিকারের জন্য এসে তোমার কাছে হাত পাতব না। আর আমার ব্যাংক একাউন্টে আমার কাছে যত সেভিংস আছে, এবং কোম্পানিতে যত শেয়ার আছে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রান্সফার হয়ে যাবে। ভয় নেই, একটা কানাকড়িও আমি রেখে দেবো না।

– কোথায় যাচ্ছ তবে! আগের বারের মতো বাবার কাছে যাচ্ছ না নিশ্চয়ই?

– পল্লব খানিক সময় বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বাবা পরিচয় দিয়ে ওই ভালো মানুষটাকে আর কতো ঠকাব, আম্মি।

– সাজেদা চৌধুরীর যেন হুশ ফিরল।সে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। কী বলছে এসব পল্লব? তবে কি? আর কোনো কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলল ছেলেদের সামনে।

পল্লব খানিক সময় ঘৃণার দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে জয়ীর হাত ধরে টানতে টানতে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

সাজেদা চৌধুরী নিশ্চল! পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পল্লব তার দিকে আর একবারের জন্যও ফিরে তাকাল না। কল্লোল কিছুই বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে এসব! সে কয়েকবার পল্লবকে ফেরানোর চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হলো না। ভাগ্যিস চৈতী ঘরে ছিল না। চৈতী থাকলে আরো নানা ধরনের কথা হতো এখানে।

জয়ীকে নিয়ে একটা হোটেলে উঠেছে পল্লব। কাল সকাল হলেই একটা বাসা খুঁজতে বের হবে। মনে মনে সংকল্পবদ্ধ হলো তার মায়ের একটা কানা করিও সে নিবে না। যে সম্পর্ককে সারা জীবনের জন্য সে ছিন্ন করে চলে এসেছে সেখান থেকে সুবিধা নেয়ার কোনো মানেই হয় না। তার কাছে যা কিছু আছে সব সে ফেরত পাঠাবে। আসার সময় সে তার প্রিয় গাড়িটিকেও সাথে নিয়ে আসেনি। জয়ীতা ভয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করছে না পল্লবকে। এই মুহূর্তে পল্লবের মানসিক অবস্থা কতটা ভয়ানক এবং বিধ্বস্ত এটা সে টের পাচ্ছে। রাতে দু’জনের কারোরই খাওয়া হলো না আর।

সাজেদা চৌধুরী রুমের মধ্যে শুধু পায়চারি করে যাচ্ছেন। যে ভয়টা সে বুকের মধ্যে এত বছর ধরে পুষে রেখেছিলেন, যে গোপণ কথা লুকানোর জন্য সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, সেটা এভাবে তার ছেলের সামনে চলে আসবে এটা সে কল্পনাতেও ভাবেনি। নিজের ছেলের চোখে চোখ রাখবেন কি করে সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। তার জীবনের কলঙ্কিত অধ্যায়কে সে চেপে রাখবার জন্য কত কি না করেছে, অথচ… ।

হান্নান সাহেবের কাছে সারাটা জীবন নিজেকে জিম্মি করে রেখেছিলেন এ জন্য। এই হারামির কারণেই তার এই দুর্দশা আজকে। এই হান্নানই জয়ীতাকে জানিয়েছে। আর জয়ীতা জানিয়েছে পল্লবকে। রাগে ক্ষোভে তার চোখ যেন ফেটে বেরিয়ে পড়ছিল। এই মেয়েকে সে যতটা না চালাক মনে করেছিল তার থেকেও হাজারগুণ বেশি বিপদজনক। তার আদরের ছেলেটাকে তার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে এর শাস্তি তাকে দিতেই হবে। সাজেদা চৌধুরী দৃঢ়-সংকল্পবদ্ধ।

ক’দিন বাদেই নির্বাচন! আর এই সময়ে এই ধরনের একটা পরিস্থিতি তার জীবনে ঘটে গেল। এসব কথা যদি মিডিয়ার কানে পৌঁছায় তাহলে কী যে হবে সেটা ভেবেই আরো বেশি ঘাবড়ে গেলেন।

পরের দিন সকালে পল্লবকে কিছুটা স্বাভাবিক মনে হলেও জয়ীতা ভয়ে আছে। জয়ীতা পল্লবের পাশে বসে আস্তে করে বলল, তুমি ঠিক আছো তো, পল্লব?

– হুম, ঠিক থাকব না কেন? একদম ঠিক আছি। একদম স্বাভাবিক। তোমার কাছে কি আমাকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে?

– এমন পাগলামী না করলেও পারতে! এখন কি করবে ভেবেছ?

– এটা পাগলামি না, জয়ীতা। এটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। চিন্তা করো না একটা না একটা উপায় ঠিকই খুঁজে বের করব। প্রথমে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য একটা বাসা খুঁজতে হবে তারপরে একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে।

– চাকরি করতে পারবে তুমি?

– কেন পারব না? অবশ্যই পারব। আমাকে পারতেই হবে তবে ভয় হচ্ছে চাকরি পাব কিনা সেটা নিয়ে। আমাদের পরিচিত একটা বিশাল বড় সার্কেল আছে। এসব সার্কেলের বাইরে আমাকে থাকতে হবে। কারণ এসব জায়গা আমার চাকরি হবে না। সবাই জানে আমি কার ছেলে। তোমার কি মনে হয় আম্মি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে? আমাকে ধ্বংস করার জন্য তার যত ধরণের অস্ত্র আছে সে ব্যবহার করবে। যাইহোক এসব ভাবার দরকার নেই তোমার। রেডি হয়ে আসো। নিচে যাব নাস্তা করতে।

জয়ীতার নিজের কাছে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আজ পল্লবের সাথে যা কিছু ঘটছে তার কারণে ঘটছে। আর আসলে উচিতই হয়নি আবার পল্লবের জীবনে ফিরে আসাটা।

বিশদিন হয়ে গেছে। জয়ী আর পল্লব নিজেদেরকে সাজেদা চৌধুরীর ছায়াতল থেকে আলাদা করে ফেলেছে একদম । আগের সিমকার্ড নষ্ট করে ফেলেছে। ছোট একটা দুই রুমের ফ্লাট নিয়েছে তারা। মালপত্র বলতে একটা খাট আর কিছু নিত্যকার কাজকর্ম চালানোর বাসন কোসন।

পল্লব হন্যে হয়ে ঘুরছে একটা চাকরির জন্য। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। এর মাঝে একদিন তুহিন এসে দেখে গেছে তাদের।

আজ আবার তুহিন এসেছে তাদের বাসায়। তুহিনের আন্তরিকতায় পল্লব ভীষণ মুগ্ধ। আসলে বিপদের সময় যাকে পাশে পাওয়া যায় তাকেই পরম বন্ধু মনে হয়।

তুহিন তাদের দুরবস্থা দেখে তাদের কোম্পানিতে চাকরি করবার অনুরোধ করে। আসলে তুহিন তার বড় ভাই শাহিনের সাথে কথা বলেছে পল্লবের চাকরির ব্যাপারে। শাহিন পল্লবকে নিতে রাজি হয়েছে। লাভ ছাড়া এক পাও ফেলবার পাত্র নয় শাহীন তালুকদার। আর ক’দিন বাদেই নির্বাচন। এই সময় অপজিশন পার্টির নেতার ছেলেকে বাগে পাওয়া কম কথা তো নয়!
পল্লবের জন্য এক লাফেই তার গার্মেন্টস এর এজিএম পোস্ট রেডি তার কাছে।

পল্লব প্রথমে কিছুতেই রাজী হতে চায় না। পরে তুহিনের আন্তরিকতা আর নিজের অপারগতার কারণে রাজী হয়ে যায়। একদিকে কোথাও তার উপযুক্ত একটা কাজ পাচ্ছে না, অন্যদিকে হাতের টাকাও ফুরিয়ে আসছে প্রায়।

জয়ীতা অবশ্য বেশ কয়েকবার মানা করেছে তাকে। কারণ জয়ীতা জানে এটা তার শাশুড়ি কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিবে না।

এটা শুনে পল্লব আরো শক্ত হয়৷ সে তার মাকে কষ্ট দেবার জন্যই আসলে শাহীন তালুকদারের কোম্পানিতে চাকরি নিতে রাজী হয়।

চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতেই পল্লবকে গাড়ি দেওয়া হলো। তুহিনের মতো শাহীনও পল্লবকে কাছে টেনে নিলো। শাহীনের আন্তরিকতায় এতদিনের সব অভিযোগ যেনো মুহূর্তেই গায়েব পল্লব এবং তুহীন দু’জনের কাছেই।

পল্লব শাহিন তালুকদার কাছে জিজ্ঞেস করল, এই গাড়ি কি আগেও বরাদ্দ ছিল আগের এজিএম এর জন্য?

শাহীন তালুকদার হেসে বললেন, তুই তালুকদারের ভাই। গাড়ি ছাড়া কি মানায়? আগের এজিএম তো আমার ভাই ছিল না। সে গাড়ি পাবে কেনো? তোর যখন যা লাগবে আমাকে বলতে সংকোচ করবি না। তবুও যদি সংকোচ হয় তুহিনকে জানাবি।

সাজেদা চৌধুরীর কানে এসব প্রতিদিনই পৌঁছে যাচ্ছে সময়ের খবর সময়ে।

চলবে…..

পর্ব- ১৯

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/478926990556642/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here