প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৪৭,৪৮

0
450

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৪৭,৪৮
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪৭

অর্ষা ওর কথা শুনে থমকে গেল। দর্শনের মতো মানুষ এমন একটা কথা বলতে পারে ভাবতেই পারেনি। পরক্ষণে ভাবল নিশ্চয়ই মজা করছে। কারণ এমন কিছু দর্শন করতেই পারে না।
“মজা করছো তাই না?”

দর্শন ড্রাইভ করতে করতে নিজের সিরিয়াস মুখখানা দেখিয়ে বলল,
“আমার মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে? আমি মজা করছি? আমার মুখ তাই বলছে?”

অর্ষা ওর চোখেমুখে কোথাও দুষ্টুমির ছায়াও দেখতে পেল না।
“দর্শন আর ইউ সিরিয়াস? তোমার মাথা ঠিক আছে? কথা নেই বার্তা নেই বিয়ে?”

“হ্যা, বিয়েটা করে ফেলতে চাই। আমি আর কোন রিক্স নিতে চাই না।”

“কী ধরনের রিক্স? তুমি কীসের কথা বলছো?”

“আমি তোমার কথা বলছি। তুমি কিভাবে আমাকে ইগ্নোর করছো সেটা কী আমি দেখছি না? আমার ভালোবাসা তো গ্রহণ করেছো কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে মন থেকে গ্রহণ করতে পারো নি। তোমার মনে কিছু একটা চলছে। তাই নিজের ভালো নিজেই করছি। রুশান আর অর্পা কাজি অফিসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

“দর্শন আমার মনে কিছু চলছে না। আর তাছাড়া তোমার বিহেভিয়ারে মনে হচ্ছে আমরা নিব্বা নিব্বি। এসব পাগলামির মানে হয় না। গাড়ি ঘুরাও। বাসায় যাব। অফিস করে ক্লান্ত লাগছে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হতে চাই। তোমাকে পরে কল করব।”

দর্শন গাড়ি থামিয়ে দিল। তারপর অর্ষার দিকে তাকাল।
“আচ্ছা তুমি কী চাইছো বলো তো?”

অর্ষা ওর দিকে ঘুরে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“আমি কী চাইছি? জানতে চাও আমি কি চাইছি? আমি চাইছি সবার কাছে সব খোলাসা হোক। তোমার আমার সম্পর্কের কথা, আমার সমস্যার কথা। তোমার বাবা-মা সব জানুক। উনারা যদি রাজি হয় তারপর আমাদের বিয়ে হবে এর আগে কিছু নয়। আমি আবেগে না ভেসে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি। তুমি আর কিছু জানতে চাও?”

“এই জন্য তুমি এমন করছো?”

“হ্যা৷ বিয়ে শুধু তোমার আমার মধ্যেই সম্পর্ক সৃষ্টি করবে না দু’টো পরিবারের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। তাই দুটো পরিবারের মত থাকা জরুরি। আমার পরিবার থেকে কোন বাঁধা আসবে না কিন্তু তোমার পরিবার…… জানি না সত্যিটা জানার পর উনাদের কি রিয়েক্ট হবে।”

“অর্ষা, এটা আমার আর তোমার পার্সোনাল ম্যাটার। এসবে কেন অন্যদের জড়াব?”

“পার্সোনাল হলেও অতি পার্সোনাল নয়। অন্তত তোমার বাবা-মা এই পার্সোনাল ম্যাটারের মধ্যে আছে। তাই তাদের জানা জরুরি। ভবিষ্যতে এই নিয়ে কোন ঝামেলা হোক সেটা আমি চাই না। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়েছি। ভবিষ্যতে আর কোন আঘাত সহ্য করার মতো শক্তি আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।”

দর্শন ব্রেকে পা রেখে সিটে হেলান দিল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মোবাইল বের করে কল দিল রুশানকে। রুশান আর অর্পা আগেই কাজি অফিসে গিয়ে বসে ছিল।
“হ্যালো, তোরা বাসায় চলে যা। আমরা আসছি না।”
সাথে সাথে কল কেটে দিল। অর্ষা মনে মনে খুশি হলেও দর্শনের মুখ দেখে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কি করবে হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভবিষ্যতে কষ্ট পাবে? শুধু কি ওর একার কষ্ট? দর্শন, নিজের পরিবারও কষ্ট পাবে। তারচেয়ে ভালো না আগেই কষ্ট পাওয়া?
দর্শন গাড়ি চালাচ্ছে। ওর মুখটা থমথমে। অর্ষার সাথে আর একটা কথাও বলেনি। একবারের জন্য তাকায়নি ওর মুখ পানে। অর্ষা হাসফাস করছিল কথা বলার জন্য কিন্তু সাহস পায়নি। দর্শন যদি রেগে যায় ওর কথা শুনে। তাই চুপচাপ শুধু অসহায় মুখ করে ওর দিকে চেয়ে ছিল।
অর্ষাকে বাসার সামনে ড্রপ করে দিল দর্শন। অর্ষা বাইরের দিকে একবার চেয়ে দর্শনের দিকে তাকাল।
“দর্শন!”

দর্শন সামনের দিকে চেয়ে বলল,
“এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি ভেতরে যাও। অনেক বড় দায়িত্ব দিয়েছো আমাকে সেটা পূরণ করতে হবে।”

অর্ষা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামল। দর্শনের দিকে আরেকবার তাকাল। সত্যিই কি অনেক বড় দায়িত্ব দিয়ে ফেলেছে? দর্শনকে কি এর জন্য অনেক সাফার করতে হবে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অর্ষা বাসায় ঢুকল।

দর্শন নিজেকে তৈরি করতে পারছে না। কি করে কিভাবে সবাইকে বলবে ব্যাপারটা সেটা বুঝতে পারছে না। যদি ওর বাবা-মা মেনে না নেয়? বিয়ের পর যদি জানতে পারত তাহলে অন্য রকম ছিল কিন্তু বিয়ের আগেই যদি জানতে পারে তাদের ছেলে যাকে বিয়ে করতে চাইছে সে কখনো মা হতে পারবে না তাহলে কোন বাবা-মা মেনে নিতে চাইবে? দর্শনের কিছুই ভালো লাগছে না। মনটা কেমন উথাল পাথাল করছে। তাই বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আয়ানদের বাড়ির বাইরে পাইচারি করছে আর বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে। গাড়ির উপর হেলান দিয়ে অর্ষাকে কল করল। অর্ষা তখনই গেট খুলছে। কল কেটে দিয়ে গেট খুলে বের হয়ে এল। দর্শনকে দেখে ওর দিকে দৌড়ে এল। সরাসরি গিয়ে পড়ল ওর বুকের মধ্যে। ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের অশান্ত মনটা শান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। দর্শন ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মনটা কেমন করছে।
দর্শনকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে রেখেই কাঁদো
কাঁদো সুরে বলল,
“আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে তোমাকে নিয়ে পরিবার, সমাজ সবকিছুর অগোচরে হারিয়ে যাই। যেখানে পরিবার, সমাজ কোন কিছুর ভয় থাকবে না। যেখানে ভালোবাসা, ভালোবাসার মানুষ সব সময় এক রকম থাকবে।”

দর্শন ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল,
“আমারও তাই ইচ্ছে করছে। বাবা-মাকে সব বলার চেয়ে আমার কাছে পালিয়ে যাওয়া অপশনটা ইজি লাগছে। বলতে পারো তুমি কি কাপুরুষ? তোমাকে হারানোর চেয়ে ভালো তো আমি কাপুরুষের তকমা গায়ে লাগিয়ে ফেলি। তাতেও যদি তোমাকে পাওয়া হত।”
দর্শন ওকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“অর্ষা, আমি পারছি না। আমি পারছি না এই চরম সত্যিটা আমার পরিবারকে জানাতে। ভয় হয় যদি তারা না মানে। আর তারা না মানলে তো আবার তুমি মানবে না। আচ্ছা তাদের মানা, না মানা কি খুব জরুরি? আমাদের ভালোবাসা কি এতটা তুচ্ছ হয়ে গেল?”

“দর্শন, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা ভয় তো আমাকেও গ্রাস করছে। তাই আমি চাইছি ভয়ে ভয়ে জীবন না কাটিয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আগামী দিনগুলো কাটাতে। তোমার পরিবারকে আমার মা হওয়ার ব্যাপারটা জানাতে।”

তখনই ওরা কারো গলা শুনতে পেল। পেছনেই কেউ একজন খক খক করে কাশছে। কাশিটা ইচ্ছেকৃত সেটা বুঝতে পেরে দুজনেই সেদিকে ঘুরল। আয়ানকে দেখে অর্ষা হকচকিয়ে গেল। ওদের দু’জনকে এভাবে এক সাথে দেখে ও কি মনে করছে? কি বলবে ওকে?
আয়ান এগিয়ে এল অর্ষার দিকে। থমথমে মুখে বলল,
“আয়ান ভাইয়া…

“আমি আগে থেকেই তোদের ব্যাপারে জানি। তাই এই টপিকে কথা বলে বোর হতে চাই না। এখন যেটা বলছি শোন, তোর মাথায় কি কখনো বুদ্ধি শুদ্ধি হবে না? তোর মা হওয়ার চান্স ১০%। কিন্তু তুই যেভাবে হায় হুতাশ করছিস, মানুষ ১% কে ১০০% করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে আর তুই ১০% এ হাল ছেড়ে বসে আছিস? অবিশ্বাস্য। আবার তুই সবাইকে বলে বেড়াতে চাইছিস তুই মা হতে পারবি না। ১০% কি কিছুই না? অর্ষা নিজের উপর বিশ্বাস কেন হারাচ্ছিস?”

দর্শন ওদের কথার মাঝে বলল,
“ওয়েট ওয়েট! কিহ ১০%? অর্ষা বারবার শুধু বলে আসছে ওর মা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ১০% সেটা তো বলেনি। ১০% ই আমার জন্য ১০০%।”

আয়ান ওর কথা শুনে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“হ্যা, এখুনি তোমার বাবা-মাকে এই ব্যাপারে বলো না কারণ যতই হোক বাবা-মা তো। তারা আবার কি ভাবতে কি ভাববে। আগে তোমাদের বিয়েটা হোক তারপর তোমরা ট্রিটমেন্ট শুরু করো। দেখো ডাক্তার কি বলে। একটা বাচ্চার জন্য তো এত বছরের ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। সব সময় তাকে স্মরণ করো। তিনি কাউকে নিরাশ করেন না। চাওয়ার মতো চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না।”

অর্ষার দিকে আয়ান চেয়ে বলল,
“ওর কথা একদম কানে নিও না। তোমার বাবা-মাকে ততটুকু জানাও যতটুকু জরুরী। তোমাদের পূর্ব পরিচিতির কথা, তোমাদের ভালোবাসার কথা। অর্ষার ফ্যামিলি পজিশন তো উনারা জানেনই। তাই মনে হয় না উনারা না করবেন। দিশা সব জানে। ও তোমাকে সাপোর্ট দিবে। চিন্তা করো না। দ্রুত আমার জিজু হয়ে যাও তো।”
আয়ান মজা করে দর্শনকে সাহস দিচ্ছে। দর্শন হারানো সাহস, শক্তি হঠাৎ করেই ফিরে পেল। অর্ষার কাছে বিদায় নিয়ে দ্রুত বাড়িতে চলে গেল। সবাই তখন খেতে বসেছে। ওর মা ওকে দেখে বলল,
“কিরে? তুই হুট করে কোথায় চলে গেলি? এতবার কল দিলাম রিসিভ করলি না। কোন সমস্যা হয়েছে?”

“না কোন সমস্যা হয়নি। এমনি একটা কাজ ছিল তাই যেতে হয়েছিল।”

“তাই বলে কল রিসিভ করবি না? টেনশন হয় না?”

ওর বাবা খেতে খেতে বলল,
“বাদ দেও। দর্শন, তুমি ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো। আমার ক্ষুধা লেগে গেছে তাই খেয়ে ফেলছি।”

“সমস্যা নেই বাবা। তুমি খাও আমি আসছি।”

দর্শন ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসল। খাওয়া শেষে উশখুশ করতে লাগল। ওর বাবা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। দর্শন ওর বাবার পাশে গিয়ে বসল। ওর বাবা ছেলেকে দেখে বেশ অবাক হলো। ইউএস থেকে আসার পর কখনো এভাবে পাশে বসেনি। খেয়েদেয়ে রুমে চলে গেছে।

ওর বাবা টিভির সাউন্ড কমিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবি?”

দিশা ওর বাবার কন্ঠস্বর শুনে কান স্থির করে রাখল।
“হ্যা বাবা। আমি আসলে শুধু তোমাকে না তোমাদের সবাইকে কিছু বলতে চাই।”

দর্শনের বাবা ওর মাকে ইশারা করে ডাকল। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন ছেলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে চায়।
দর্শনের মা এসে বসল। দিশা দূরে দাঁড়িয়ে রইল।
দর্শন কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
“আমি একটা গল্প বলি তোমাদের। আমার গল্প। কলেজে পড়ি তখন। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু তেমন বুঝি না আমি। এত না বোঝার মাঝেও হুট করে স্বপ্নের মতো একটা মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার মতো গোছালো ছিল না কিন্তু আমার প্রতি খুব সিরিয়াস ছিল। আমি ওর মতামত, ওর চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব দিতাম কম কারণ আমি মনে করতাম ও বাচ্চা মানুষ, বুঝে কম ওর কথা কেন শুনব? আর অপর দিকে নিজেকে বুঝ মান, ম্যাচিউর মনে করতাম। ওর লাইফের ডিসিশন আমি নিতাম, কি করবে সেটাও ঠিক করে দিতাম। ও নির্দ্বিধায় মেনে নিত কারণ ওই যে আমার প্রতি অনেক সিরিয়াস ছিল, সবকিছুর উর্ধ্বে প্রায়োরিটি দিত। শেষের দিকে আমার রেজাল্ট খারাপ হতে লাগল। যদিও এতে ওর হাত ছিল না, ইনফ্যাক্ট কারো হাতই ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন, ঠিক কি কারণে আমার সাথে এমন হচ্ছিল। ডিপ্রেশনে পড়ে যাই। ওর সাথে বিহেভিয়ার বদলাতে থাকে। এর সুযোগ অন্যরা নিতে লাগল। সুযোগ আমিই দিলাম আর কি। মেয়েটা আর কত সহ্য করবে, না বুঝে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলি। অভিমানে দূরে সরে যায়। আমার রেজাল্ট খারাপ হয়, তোমাদের চিৎকার-চেঁচামেচি,কটু কথা আর দূরত্ব, সব মিলিয়ে অসহায় হয়ে পড়ি আর একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। সবটা শুনে অভিমান ভুলে ছুটে আসে ও। এতটাই হতবিহ্বল ছিল যে হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। অসাবধানতার কারণে এক্সিডেন্ট করে বসে। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিল। ডাক্তার ওর কন্ডিশন দেখে কিছুই বলতে পারছিল না। অথচ কেউ কিছুই জানতে পারিনি। একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা, জীবনের অনিশ্চয়তা ওর বাবাকে দূর্বল করে ফেলে। মা মারা গেছে জন্মের সময়। বাবাই ছিল একমাত্র ভরসা, আশ্রয়স্থল। তিনি মেয়ের বেহাল অবস্থা মেনে নিতে না পেরে আকস্মিক পরপারে পাড়ি জমান। ও সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়। তখনও কেউ কিছু জানতে পারিনি। জেনেছি সাড়ে সাত বছর পরে।”

দর্শন থামল খানিক। এই গল্পটা পরিচিত লাগছে ওর বাবা-মা দু’জনেরই।
দর্শন ম্লানমুখে ওর বাবা আর মায়ের দিকে তাকাল।
“কি চেনা চেনা মনে হচ্ছে? গল্পটার নায়িকা আয়ানের খালাতো বোন অর্ষা। আমার ভালোবাসার মানুষের। আমি এত বছরে ওকে ভুলতে পারিনি আর কখনো পারবও না। যেদিন ওকে হারিয়ে ফেলি সেদিনই আমার জীবন থেকে সমস্ত সুখ,হাসি, রঙ হারিয়ে গেছে। কেমন নির্বিকার একটা জীবন যাপন করছিলাম। মনে হতো বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই। এত বছর পরে ওকে পেয়ে সবকিছু জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাবা, মা, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। প্লিজ তোমরা অনুমতি দেও। নয়তো অর্ষাকে মানাতে পারব না। সেই বাচ্চা মেয়েটা আজ আমার চেয়ে বেশি ম্যাচিউর হয়ে গেছে। তাই তোমরা প্লিজ অমত করো না। ও খুব ভালো মেয়ে। দেখেছো তো ওকে। ওর সাথে কথাও বলেছো।”

দর্শনের বাবা ছেলেকে উত্তেজিত হতে দেখে বলল,
“রিলেক্স। তুমি শান্ত হও। যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো। আই হোপ নাস্তার টেবিলে সুখবর পাবে।”

দর্শন বাবার উপর ভরসা করে নিজের ঘরে চলে গেল। তারপর ওর বাবা-মা আর বোনের বৈঠক চলতে লাগল। এতদিন ধরে ছেলের নীরবতা আর বদলে যাওয়ার কারণ উদঘাটন করতে কেবল সক্ষম হলো।

চলবে……

#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪৮

প্রিয়া আর দিশা মিলে জোর করে অর্ষাকে শাড়ি পরাচ্ছে। দর্শনের বাবা-মায়ের সাথে আজ প্রথমবার তো দেখা হচ্ছে না। আজ হঠাৎ শাড়ি পরে সেজেগুজে গেলে কি ভাববে? অর্ষার ভীষণ লজ্জা লাগছে কিন্তু খালা মনির কঠোর নির্দেশ শাড়ি পরতে হবে। শাড়ি পরেই আজ ওদের সামনে যেতে হবে। বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।
“অর্ষা, এমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে শাড়ি পরা সুন্দর হবে।”
প্রিয়ার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল অর্ষা।
“তোদের শাড়ি পরানো শেষ হবে না? এতক্ষণ লাগে একটা শাড়ি পরাতে?”

“তুই ঠিক করে না দাঁড়ালে কী করে হবে?”
প্রিয়া আঁচলটা ঠিক করে দিচ্ছে। দিশা কুচিটা হাত দিয়ে ধরে ঠিক করে দিল। ওকে সাজিয়ে আয়নার সামনে নিয়ে প্রিয়া বলল,
“মাশাল্লাহ, কেউ চোখ সরাতে পারবে না। আয় মেক আপ করিয়ে দেই।”

“আটা ময়দা ছাড়াও উনারা আমাকে দেখেছে তাই এসব মেখে ওখানে গিয়ে লাভ নেই।”

“ধুর! দিশা চলো তো। ও নিজে নিজে সাজুক অথবা বসে থাক।”
ওরা যেতেই অর্ষা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শাড়িতে ভালোই লাগছে। মেক আপ যে ও করে না তা নয় কিন্তু আজ লজ্জা লাগছে দর্শনের বাবা-মায়ের সামনে মেক আপ করে যেতে। যদি ভাবে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে আছে তাই নরমাল সাজেই যাবে। ও নিজে টুকটাক সাজগোজ করে নিল।

অর্ষা নার্ভাসনেস নিয়ে নিচে গেল। দর্শনের বাবা-মা চা খেতে খেতে অর্ষার খালা-খালুর সাথে কথা বলছে। অর্ষাকে দেখে দর্শনের পাশে বসতে বলল। অর্ষা দর্শনের পাশে বসতেই দর্শনের মা হাসতে হাসতে বলল,
“দেখেছো কি ভুল করেছিলাম? নিজের ছেলের পছন্দ করা মেয়েকে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য ঘটকালি করছিলাম। ভাগ্যিস কথা আগায়নি। তাহলে আমার ছেলের যে কি হত।”
বলেই আবার হাসতে লাগল। সাথে সবাই হাসছে।

দর্শনের বাবা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“তবুও তো তখন তোমার ছেলে মুখ খুলেনি। চুপচাপ শুনে গেছে। এই দাঁড়াও দাঁড়াও অর্ষার তো আবার ডাক্তার ছেলে পছন্দ না। এখন উপায়?”

অর্ষার খালু বলল,
“তাহলে আর কি করার। বিয়ে ক্যান্সেল। আপনার ছেলে তো আর আমাদের মেয়ের জন্য প্রফেশন চেঞ্জ করবে না।”

অর্ষা আর দর্শন লাজুক ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে তাকাল। সবাই ওদের নিয়ে মজা করছে। তবে অর্ষার মনে এখনো সেই চিন্তা রয়ে গেছে। বারবার আয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। আয়ান চোখের ইশারায় বারবার ওকে শান্ত হতে বলছে। অবশেষে অর্ষা আর দর্শনের বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো আয়ান আর দিশার বিয়ে যেদিন হবে সেদিন। দুই ভাইবোনের বিয়ে এক দিনেই হবে।

~~~~

অর্ষা আর দর্শন ছাদে এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শন খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলে অর্ষা মন খারাপ করে বলল,
“দর্শন, আমার টেনশন হচ্ছে। আসল বিষয়টা এভাবে এড়িয়ে যাওয়া উচিত হলো?”

“ওহ অর্ষা, তুমি সব বিষয় নিয়েই অধিক পরিমাণে চিন্তা করো। এখন এসব নিয়ে ভেবো না। সব ঠিক হবে। এখন আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু ভালোবাসো তো।”
বলেই দর্শন, অর্ষাকে পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে।

দর্শন-অর্ষা, দিশা আর আয়ানের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বিয়ের কেনাকাটা শেষ। দর্শন শুধু চাইছে বিয়েটা যেন ভালোমতো হয়ে যায়। কেউ যেন কোন বাঁধা সৃষ্টি করতে না পারে। অর্ষার খুশি যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে। ওকে কথা দিয়েছে অনেক সুখে রাখবে। ওর চোখে কখনো পানি আসতে দেবে না। অর্ষা কিছুক্ষণ পর পর ওকে কল করে উচ্ছাসিত কন্ঠে বিয়ে, বিয়ের কেনাকাটা, সাজগোজ, কি কি প্ল্যান করেছে এসব নিয়ে কথা বলে। মনে হচ্ছে আগের সেই উচ্ছাসিত অর্ষা।
“এই, দর্শন লেহেঙ্গা তোমার পছন্দ হয়েছে?”

দর্শন মৃদু হেসে বলল,
“তোমার পছন্দ হলেই হবে। তোমার বিয়ে তোমার পছন্দের সব পরবে।”

“তাতে কি? পরছি তো তোমার জন্য। তাই তোমার পছন্দটাই জরুরী। তোমার পছন্দ না হলে এত সাজগোজ সব বৃথা।”

“সাজগোজ এমনিতেও সব বৃথা যাবে।”

অর্ষা চোখ বড়বড় করে বলল,
“কেন কেন?”

দর্শন বাকা হেসে বলল,
“বাসরঘরে ঢোকার পর কিছু থাকবে না-কি?”

অর্ষা চোখ বড়বড় করে,
“শয়তান! ফোন রাখো তুমি। তোমার সাথে কথা নাই।”
অর্ষা কল কেটে দিল। দর্শন ফোনের দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে। এসব না বললে অর্ষাকে থামানো যেত না। হাসপাতালে আছে। কাজের কত চাপ। কিন্তু অর্ষার কথাই শেষ হচ্ছে না। ওর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দায়িত্বের কাছে ইচ্ছে কিছুই না।

~~~
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এল। দুই পরিবার এক সাথে বিয়ের কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেননা প্রতিপক্ষে ছেলে মেয়ে দু’জন আছে। সকল কাজের সুবিধার্থে হলুদ যার যার মতো হলেও বিয়ের অনুষ্ঠান এক সাথে হচ্ছে। দিশা আর অর্ষা এক সাথে বউ সাজছে। অর্পার খুব কষ্ট হচ্ছে। ওর বিয়েটা যদি এই চান্সে হয়ে যেত কত মজা হত। এ নিয়ে রুশানের সাথে ওর ঝগড়া লেগেছে কয়েকবার। রুশান বারবার বুঝিয়েছে সবার বিয়ে এক সাথে হলে মজাটা কম হত। ওদের বিয়ে হবে আরেকবার মজা করতে পারবে।
অর্ষা আর দিশা লাল বেনারসি পরে, ভারি গয়না পরে বরদের জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা হাসি হাসি মুখ করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অর্ষার খালা দূর থেকে দেখে চোখের পানি মুছছে। আজকে উনি অনেক খুশি। ছেলের বিয়ের খুশির চেয়ে অর্ষার বিয়ে হচ্ছে এটা দেখেই উনার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা মরা মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে হবে না। ওর চোখে আর পানি আসবে না। নতুন একটা পরিবার পাবে, ভালোবাসার মানুষ পাবে। বিয়ে পরানো শেষে দুই পরিবারের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। কেননা দুই পরিবারই তাদের পুত্রবধূকে আমন্ত্রণের পাশাপাশি মেয়েদের বিদায় দিয়েছে। তাদের মেয়েরা অন্যকারো ঘরের আলো হয়ে চলে যাচ্ছে।

🥀🥀
ফুলে ফুলে সাজানো ঘরে অর্ষা বসে আছে। মনে হচ্ছে ও ফুলের রাজ্যের রাজকন্যা। চারদিকে বিস্ময় নিয়ে দেখছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এক বছর আগেও ভাবেনি জীবনে কখনো এই দিনটা আসবে। যাকে ভালোবেসেছিল তাকেই নিজের করে পাবে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে অর্ষা ভাবনা বাদ দিল। হালকা আলোয় দর্শনকে দেখতে পাচ্ছে। অর্ষা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। দর্শনকে দেখে ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কেন জানেনা ওকে দেখে হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। দর্শন হঠাৎ ওকে কাঁদতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বিচলিত হয়ে ওর চোখ মুছতে গেলে অর্ষা ওকে থামিয়ে দিল।
“তোমাকে আরেকটু দেখি দর্শন।”
অর্ষা আবার কাঁদতে লাগল।
“কাঁদছো কেন?”
অর্ষা গালে হাত রেখে মুখমণ্ডল ছুয়ে দিয়ে বলল,
“সবকিছু আমার স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।”
দর্শন ওর হাতটা বুকের বামপাশে রেখে আলতো চাপ দিয়ে বলল,
“এখন ফিল করো। জলজ্যান্ত মানুষের হার্টবিট। আমি স্বপ্ন নই, আমি তোমার বাস্তবতা।”
“তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? কখনো আমাকে কষ্ট দিবে না তো?”
“দূর পাগলি ছেড়ে দেওয়ার জন্য কি বিয়ে করেছি? জীবনে সব পাব কিন্তু অর্ষাকে হারালে কোথায় পাব? একবার হারিয়ে শিক্ষা হয়ে গেছে। আর হারাতে চাই না। শুধু ভালোবাসতে চাই। বাসরঘরে কান্নাকাটি কেন? চোখের পানি মুছো।”

দর্শন আলমারি খুলে একটা বক্স বের করে অর্ষার কাছে এল। অর্ষা বক্সটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। বক্সের উপরে একটা লাল গোলাপ। অর্ষা বক্সটা খুলে দুটো নুপুর পেল। হাতে তুলে বিস্ময় নিয়ে দর্শনের দিকে তাকাল।
দর্শন মুচকি হেসে বলল,
“আমি চাই এগুলো সব সময় তোমার পায়ে ঝনঝন আওয়াজে ঝড় তুলুক। আর সেই ঝড়ে আমি মাতোয়ারা হই।”
দর্শন নুপুর দুটো ওর পায়ে পরিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে আরেকটা বক্স বের করে অর্ষাকে দেখাল। অর্ষা বক্সটা নিয়ে দেখতে চাইলে দর্শন বক্সটা সরিয়ে ফেলে বলল,
“এটা তোমাকে দেখানো যাবে না। এটা আমার মেয়ের। আমাদের রাজকন্যার।”

অর্ষার মনটা খারাপ হয়ে গেল। দর্শন বাচ্চার কথা বলছে। দর্শন অর্ষার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
“দেখো,আমাদের বেবি হবে। নয়তো হঠাৎ এই ছোট নুপুর জোড়া আমার কেন পছন্দ হবে? আর কেনই-বা আমি নিয়ে আসব?”

অর্ষা বক্সের দিকে তাকাল। একটা ভালো লাগা ওকে ছুয়ে গেল। মুখে একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছে। দর্শনের দু গালে হাত রেখে বলল,
“আজ থেকেই ট্রাই করি।”
তারপর দর্শনের ঠোঁটে ঠোঁট ছুইয়ে দিল। দু’জনে সীমাহীন ভালোবাসার অতলে হারিয়ে গেল।

অর্ষা ঘুমাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে ছোট্ট এক পরীর। তখনই মনে হচ্ছে কেউ ওকে দোলাচ্ছে। কিঞ্চিৎ বিরক্তি কপালে ফুটে উঠল। ওর পরীটাকে আদর করতে দিচ্ছে না।
“অর্ষা, উঠ। এগারোটা বেজে গেছে। উঠো না।”
অর্ষা ঘুমঘুম চোখে দর্শনের দিকে তাকাতেই বুঝল স্বপ্ন দেখছিল ও।
“কী হয়েছে?”
“এগারোটা বাজে বেবি।” দর্শন মুখ বাকিয়ে বলল।
অর্ষা ধরফর করে উঠে বসল। ঘড়ির দিকে চেয়ে ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এত বেলা হয়ে গেছে বাইরে সবাই কি ভাবছে। অর্ষা দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
“আগে ডাকোনি কেন?”
“আরে, আমার ঘুমই ভাঙলো মাত্র। তুমি আমাকে রাতে ঘুমাতে দিয়েছো যে সকাল সকাল উঠব?”
দর্শন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল। ওর ঠোঁটের কোণে মিটমিটে হাসি।
অর্ষা ওকে ধাক্কা মেরে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here