#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
পর্বঃ তেত্রিশ
বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। ঝড় হওয়ার পর যে বিধ্বস্ততা থাকে ঠিক সে বিধ্বস্ততা বিরাজমান। আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনি করছে দর্শিনীর হাহাকার। তার কান্নায় জমিও বোধহয় খানিক ধ্বংস লীলা চালাতে চাচ্ছে। পুকুর পাড়ের শেষ সিঁড়িটাতে বসে দর্শিনী কাঁদছে। কাকে বিশ্বাস করবে সে! আজকাল তো মনে হচ্ছে সব মানুষই আপন নামের একটা মুখোশ জড়িয়ে রেখেছে মুখে। তাই তো,বারবার রচিত হচ্ছে ঠকে যাওয়ার গল্প। নিয়তি বার বার ধিক্কার জানাচ্ছে জীবনকে। এই হাহাকার করা বিশাল শূণ্যতা নিয়ে বাঁচা যায় আদৌও?
দর্শিনীর মনে পড়লো কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। বৌদি যখন বৌদির ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলো,দর্শিনী তখন ক্ষ্যাপে উঠেছিলো। নিজের ভিতর রাগ চেপে না রেখে সে চিৎকার দিয়েই নিজের ভাইয়ের বৌকে কথা শোনাচ্ছিল। এক কান, দুই কান করে পুরো বাড়িতে কথা ছড়িয়ে গেলো। দর্শিনীর বড়দা বোনের চিৎকারের কারন জেনে আহম্মক বনে যায়। তার অর্ধাঙ্গিনী কিনা শেষমেশ এতটা কুরুচিপূর্ণ হলো! এমন নিকৃষ্ট কথা উচ্চারণ করলো কীভাবে! রেগে গিয়ে প্রদীপ নিজের স্ত্রীর গালে সশব্দে চড় বসায়। ঘটনা আরও বিশ্রী হওয়ার আগে প্রতাপ সাহা ছেলেকে ধমকে থামিয়ে দেয়। নিধি তখন কেবল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ছিলো স্বামীর পানে। তার এত বছরের বৈবাহিক জীবনে প্রদীপ হাত তুলবে দূরের কথা জোর গলায় একটা ধমক অব্দি দেই নি অথচ আজ!
নিধি এরপর আর কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। প্রদীপ কথা শুনালো, নিপা আর সুমনও কথা শুনালো। নিধি কেবল চুপ করে সবটা হজম করলো। অতঃপর ধীর পায়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। নিধির এই নিস্তব্ধতা যেন হঠাৎ করেই দর্শিনীর অপরাধবোধের কারণ হলো। বৌদি হয়তো জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এমন প্রস্তাব দিয়েছিলো অথচ সে কেমন করে বৌদিকে সবার সামনে ছোট করলো! কিন্তু বৌদি একজন মাতাল ছেলের বউ হওয়ার কথা কীভাবে ভাবতে পারলো!
নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা জন্মালো দর্শিনীর। কতটা ফেলনা হয়ে গেছে সে! মায়ের মতন বড়বৌদিরও চোখের বিষ হয়ে গেলো। এতটা অভিশপ্ত জীবন থেকে মু্ক্তি মিলবে আদৌও!
দর্শিনীর হাতের ফোন খানা তার ভাবনার মাঝেই বেজে উঠলো। দর্শিনী খানিকটা চমকে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে মায়ার নামখানা। দর্শিনী অবাক হলো। এই সময় মায়ার ফোন দেখে সে কিঞ্চিৎ বিচলিতও হলো। মোহনার আবার ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলো না তো! সেদিন তো মানুষটাকে ভীষণ অসুস্থ দেখেছে,এরপর আর খবরও নেওয়া হলো না মানুষটার। যতই হোক,একটা সময় ঐ মানুষটাকে তো সে মা ডাকতো। মা ডাকা মহিলাটার খারাপ সময়ে পাশে না থাকাটা তাকে গোপন লজ্জা দিলো। আজকাল কী সে বেশি স্বার্থপর হয়ে গেলো?
দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই ফোনটা কেটে গিয়ে আবার নতুন উদ্যমে বেজে উঠলো। দর্শিনী আর অপেক্ষা না করে সাথে সাথে রিসিভ করলো। রিসিভ করতেই মায়ার বড্ড অস্বাভাবিক শীতল কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সই,ভালো আছো?”
দর্শিনী অবাক হলো। মায়ার সাথে তার যতটুক কথা হয়েছে এ অব্দি, মায়ার কথার ধরণ খুব চঞ্চল। কিন্তু আজ, হঠাৎ এতটা নির্জীব কেনো মেয়েটা? তবে কী কোনো খারাপ খবর আছে?
দর্শিনী বিচলিত কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ ভালো আছি। মায়া, তুমি কেমন আছো?”
“ভালো আছি, সই। আচ্ছা সই,আমায় একটা কথা বলবে?”
দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। মায়া যেমন মেয়ে,কখনো পারমিশন চেয়ে কথা বলে নি। যখন যেটা বলতে ইচ্ছে করেছে তখন সেটাই বলেছে। আজ হঠাৎ অনুমতির প্রয়োজন পড়লো?
দর্শিনী ভাবনা গুলো নিজের মাঝেই রেখে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“হ্যাঁ বলো,কী বলতে চাও।”
“শাশুড়ি কেমন মানুষ ছিলো, সই? খুব অত্যাচার করেছে কী তোমার উপর?”
মায়া যেন আজ দর্শিনীকে অবাকের চরম পর্যায়ে নিয়ে যাবে। দর্শিনী বিষ্মিত হয়ে বললো,
“এসব প্রশ্ন কেনো করছো?”
“কারণ আছে, সই। প্লিজ বলো না। শাশুড়ী তোমাাকে শারীরিক অত্যাচার করেছে কখনো?”
“না,আমার শরীরে সে কখনো হাত দেয় নি। কেবল বিয়ের দিন চড় মেরেছিলো এত বছরের মধ্যে। এ ছাড়া মানসিক অত্যাচার সে প্রচুর করেছে। উঠতে বসতে খোঁটা দিতো। বাচ্চা হচ্ছে না বলে বন্ধ্যা ডাকতো, আরও অনেক কিছু।”
“অথচ সে আমার হাতে গরম তেল ঢেলে দিয়েছিলো। কথায় পারছে না দেখেই বুঝি হাতের ব্যবহার করেছে!”
নিজের সাবলীল উত্তরের বিপরীতে মায়ার এহেন কথায় চমকে উঠে দর্শিনী। শাশুড়িমা এতটা খারাপ মানুষ! এতটুকু একটা মেয়ের সাথে এমন নোংরা আচরণ সত্যিই মানায়? এত শখ করে না ছেলের দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হলেন, তাহলে এসব কেনো করছেন!
নিজের মনে হাজের প্রশ্নের বেড়াজালে দম বন্ধ হয়ে আসে দর্শিনীর। মানুষ পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচি,জেদ,রাগ সবই বদলাতে পারে। হয়তো মোহনারও রুচি বদলিয়েছে। হয়তো নিজের ছেলের জন্য সে আরও ভালো কাউকে পেয়েছে।
মনে মনে হাসলো দর্শিনী। মায়ারও তবে কী দিন ফুরালো? না,এতটুকু মেয়ের সাথে এতবড় অন্যায় সে হতে দেবে না। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। দর্শিনী নিজের কণ্ঠটা কিঞ্চিৎ খাঁদে নামালো, প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“তোমাকেও হয়তো তাড়াতে চাচ্ছে, মায়া। তুমি হাল ছেঁড়ো না। যে ভুল আমি করেছি নরম থেকে, সে ভুল তুমি করো না।”
“ভুল আমি করে ফেলেছি,সই। তবে আর না। আমার মনে হচ্ছে এ বাড়িতে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে সই। আচ্ছা,তুমি কী জানো শাশুড়ির আরও একটা ছেলে আছে?”
মায়ার কথা দর্শিনীর মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো শরীরে। শিরশির করে কেঁপে উঠলো সারা শরীর। সে বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো মায়া? এটা কী করে সম্ভব? আমি তিন বছর ছিলাম ও বাড়িতে, এমন কখনোই শুনি নি।”
“আমি সত্যি বলছি। খুব বিশ্রী কিছুর মাঝে আমি ফেঁসে গেছি সই। আমি বোধহয় নিজেকে বাঁচাতে পারবো না। এ বাড়ির যেই বিভীষিকাময় রহস্য, তার অতলে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। আর হয়তো উপরে উঠতে পারবো না।”
মায়ার কণ্ঠে অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। দর্শিনী কিছু বলার আগেই মায়া ফোনটা কেটে দিলো। দর্শিনী কেবল অবাক হয়ে নিস্তব্ধ পুকুর পাড়টাতে বসে রইলো। তার মাথায় কিছু আসছে না। কি করবে সে! হঠাৎ দর্শিনীর সেদিনের কথা মনে পড়লো যেদিন বিহঙ্গিনী রাস্তার মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলো। দর্শিনী কিছু একটা ভেবে হাসলো। সে বোধহয় রহস্যের সামান্য সমাধান করতে পারবে।
_
বিপ্রতীপ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। সে এখন বাড়িতেই আছে। তার এত সাধের চাকরি খানা চলে গিয়েছে। দু দু’বার জেল খাটা আসামিকে তো আর কেউ জেনেশুনে চাকরিতে রাখবে না। তাই আপাতত বাড়ির সব সদস্য বাড়িতেই। তবে সবাই আলাদা আলাদা রুমে। মোহনা এক রুমে,নিলয় কুমার আরেক রুমে,বিপ্রতীপ আর মায়াও আলাদা রুমে। কারো সাথে যেন কারো সম্পর্ক নেই। যেন কত গুলো প্রাণহীন মানুষ একটা বাড়িতে একসাথে বসবাস করছে।
মায়া এখন যতটুকু পারছে মোহনার সাথে সাবলীল ভাবে কথা বলছে। এ মহিলাকে রাগানো আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা যেন একই ব্যাপার।
প্রকৃতিতে এখন ঠিক ভর সন্ধ্যা। বাতাসে ভেসে আসছে যে সাবধান বাণী। খুব খারাপ কিছু হওয়ার সতর্ক বার্তা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে বাতাসের তালে তালে। মায়া চিলেকোঠার ধূলোমাখা ঘরটাতে টিপটিপ পায়ে হাজির হয়েছে। তার মনে হচ্ছে আরও কিছু হয়তো এই ঘরটাতে লুকিয়ে আছে যা তারা দেখছে না। সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
চিলেকোঠার ঘরটাতে পুরোনো আলমারি, খাট রয়েছে। একটা বুক সেলফ ও আছে। মায়া তন্নতন্ন করে আবার খোঁজ লাগালো। তাকে খুঁজে বের করতেই হবে এ বাড়িতে লুকানো রহস্য। মায়া বেশ খানিকটা সময় খোঁজাখুঁজি করে ক্লান্ত হলো। না,আর তো তেমন কিছুর দেখা মিলছে না।
মায়া ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো সামনের খাটতাতে। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে আশাপাশ তাকাতেই খোলা আলমারির এক কোণায় কিছু একটা দেখতে পায় মায়া। তৎক্ষনাৎ সে উঠে আলমারির দিকটাতে এসে সেই জিনিসটা বের করে। একটা মেয়েলি ড্রেস! না না,সাধারণ ড্রেস না এটা, কোনো স্কুল ড্রেস হবে। মায়া নেড়েচেড়ে দেখতে নিবে এর মাঝেই মোহনার বাজখাঁই গলা ভেসে এলো। ভয়ে মায়ার হাতটা থেকে জামাটা নিচে পড়ে গেলো। মায়া কোনোমতে জামাটা উঠিয়ে আলমারিতে রেখে ছুট লাগিয়েছে নিচে।
মোহনা কিছুটা সুস্থ এখন। বা’হাতটা নাড়াতে পারে না কিন্তু এমনেতে সে স্বাভাবিক সব করতে পারে এখন।
মায়া হুড়মুড় করে ড্রয়িং রুমে হাজির হয়। ঘামে লেপ্টে থাকা মুখটা মুছতে মুছতে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ শাশুড়ি, কিছু বলবেন!”
মোহনা হাসি হাসি মুখ করে তার হাতে থাকা বাটিটা এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“কষা মাংস রাঁধছি,দেখো তো লবন হলো কিনা। আমি তো মাংস খাই না। আমার বাবুর ভীষণ পছন্দের তো তাই রাঁধলাম। নেও ধরো।”
মায়া কিঞ্চিৎ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। ধীর হাতে বাটিটা নিয়ে এক টুকরো মাংস মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলো। হঠাৎ মোহনা ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
“এ বাড়ির প্রতিটা ইটের খবর আমি জানি, বৌমা। আর চিলেকোঠার খবর রাখবো না ভাবলে কী করে? ধূলোমাখা টেবিলে ধূলোর স্তূপ হালকা। তা সেখানে তোমার কী কাজ শুনি?”
মায়ার গলায় খাবার আটকে গেলো। নাকেমুখে কাশি উঠে গেলো। মায়ার অনবরত কাশির শব্দে সবাই ই বেরিয়ে এলো। মোহনা তার সাথে থাকা জলের গ্লাস টা এগিয়ে দিলো মায়ার দিকে। মায়া কোনো রকম জলটা মুখে দিয়ে গট গট করে পান করে নিজেকে ধাতস্থ করলো। বিপ্রতীপ, বিহঙ্গিনী,নিলয় কুমার – সবারই কৌতূহল দৃষ্টি মায়ার দিকে। কাশতে কাশতে মেয়েটার মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ মায়া কৌতূহল দৃষ্টি গুলোকে আরও কৌতূহল করতে গগণ বিদারক চিৎকার দিয়ে উঠলো। নিজের পেট চেপে বসে পরলো মাটিতে। চোখের নোনাজল ফেলে বললো,
“কী অসহ্য পেট ব্যাথা গো,আমি ম*রে গেলাম। আমাকে বাঁচাও প্লিজ।”
মায়ার চিৎকারে ভড়কে গেলো সবাই। সর্বপ্রথম বিহঙ্গিনী এসেই ওকে জড়িয়ে ধরলো। মায়া কোনোমতে ঝাপসা চোখে আশপাশে তাকালো। মোহনা কী তবে বাজিমাত করে দিলো!
#চলবে