#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃদুই
#মম_সাহা
(৪)
ঝরঝরে রোদ্দুরে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে প্রত্যেকের শরীর। সাথে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে আকষ্মিক ঘটনায়। ধুপধাপ পা ফেলে তন্মধ্যেই ছুটে এসেছে চিত্রা। মহিন গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেও বোধহয় বুঝতে পারছে না চ*ড়ের কারণটা।
তুহিন এগিয়ে এলো প্রথমে। কোনোরকমের উচ্চবাচ্য না করেই শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কী হয়েছে বাহার ভাই? মহিন কিছু করেছে?”
বাহার যে সবে একটা অদ্ভুত কাজ করেছে সেটার কোনো ছাপ তার মুখমন্ডলে নেই। বরং বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“আমি মানুষকে শুধু শুধু কিছু দেই না জানোই তো। নিশ্চয়ই সে দেওয়ার মতন কাজ করেছে তাই দিয়েছি।”
তুহিন মহিনের দিকে তাকালো। বাহার সোজাসাপ্টা উত্তর দিবে না সেটা সে বেশ ভালো করেই জানে। বাহারের চরিত্রের সাথে সোজাসাপটা উত্তরটা আশা করাও এক ধরণের বোকামি। তাই সে দ্বিতীয় প্রশ্নটা মহিনকেই করলো,
“কী করেছো মহিন?”
ততক্ষণে মহিনেরও হতভম্ব ভাব কেটে গেলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমি তো কিছুই করি নি।”
বাহার পকেটে হাত গুঁজেই হাসলো। ক্ষীণ হাসি। কিন্তু ততক্ষণে মহিনের পরিবার ক্ষেপে গেলো। হৈ হৈ করে ছুটে আসলো মহিনের মা মানে চাঁদনীর শাশুড়ি। আঙুল উঁচিয়ে বাহারের দিকে তাঁক করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“এই ছেলে, এই, তোমার সাহস কীভাবে হলো আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার?”
“কিছুই তো করলাম না আন্টি। সাহসের কী দেখলেন এখনো?”
মহিলার দাঁত কিড়মিড় করা প্রশ্নের জবাবে এমন উত্তর যেন অনাকাঙ্খিত ছিলো। দূর হতে চিত্রার ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। এখানে তার বাবা উপস্থিত না থাকলে হয়তো এতটা ভয় তাকে কাবু করতে পারতো না। অথচ তার বাবা র*ক্তলাল চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। ঘটনা বিগড়াতে যে বেশি সময় লাগবে না তা বুঝতে বেশি সময় লাগলো না চিত্রার।
মহিনের মা লতা বেগমের রাগ চক্রবৃদ্ধি আকারে বাড়লো। বেছে বেছে সে চিত্রার বাবা নুরুল সওদাগরের দিকে তাকিয়েই চোখ দিয়ে অগ্নিবর্ষণ করে বললো,
“ভাই সাহেব, আপনারা হা করে সবটা দেখছেন! বাহিরের একটা উটকো ছেলে আপনাদের সামনে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো অথচ আপনারা নিশ্চুপ? ছেলেটাকে ধমকও দিচ্ছেন না!”
“উনার ধমকের পরোয়া অন্তত বাহার করে না, আন্টি। ভুল জায়গায় ভুল তথ্য প্রেরণ করাটাই বোধহয় মহিলা সমাজের কাজ।”
এবারও বাহারের কণ্ঠ স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে পারলেন না নুরুল সওদাগর। খেঁক খেঁক করে বলে উঠলেন,
“এই অ*ভ*দ্র ছেলে, বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না? অন্যায় করেছো অথচ নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই।”
“লজ্জাবোধের ফাংশনটা আমার ঠিক কাজ করে না। আর ভুল জায়গায় তো আরও আগে কাজ করে না।”
সূর্যের তেজ বাড়লো, সাথে তড়তড় করে বাড়লো নুরুল সওদাগরের রাগ। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো বাহারের দিকে। বাহারের বুকের বা’পাশটাতে ধাক্কা দিলো শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে। ছেলেটা দু’পা পিছিয়ে গেলো অপ্রত্যাশিত ধাক্কায়। অথচ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না নুরুল সওদাগরকে। বরং কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই বিরাট আরেকটা চ*ড় বসালো মহিনের গালে। পরিস্থিতি আরেক ধাপ হতভম্ব হলো। সবাই কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। নুরুল আলমও কম হতভম্ব বোধহয় হলো না। বাহার যেন অদৃশ্য ভাবে চড়টা তাকেই দিলো। নুরুল আলমের মতন শক্ত, কঠোর পুরুষ ভাষা হারালেন। নিজের বড় ভাইয়ের দিকে তাকালেন হতভম্ব চোখে। কোনো মতে উচ্চারণ করলেন,
“বড়ভাই, আপনি দেখলেন তো!”
ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে অনবরত কাক শোরগোল তুললো। পরিবেশ যেন প্রয়োজনের তুলনাও শীতল। চিত্রার বড় চাচা গলা পরিষ্কার করে যখন বাহারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালালেন বাহার সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৃতীয় তথাপি শেষ চড়টা মারলো মহিনের ডান গালে। এবং সবাইকে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে হেলতে দুলতে চলে গেলো বাড়ির মেইন গেইট পেরিয়ে। সবাই কেবল তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। বর্তমানে এই তাকিয়ে থাকাটাই যেন উত্তম কাজ হয়ে দাঁড়ালো সবার কাছে।
লতা বেগম তার পাশের চেয়ারটাই ধপ করে বসে পড়লেন। এতক্ষণের ঘটা কর্মকাণ্ড যেন সবারই নেহাৎ ভ্রম মনে হলো। বাহার যখন গেইট পেরিয়ে অদৃশ্য হলো উচ্চকন্ঠ শোনা গেলো নুরুল সওদাগরের। ভয়াবহ রকমের চিল্লিয়ে বললেন,
“এই বে*য়াদব ছেলেটা যেন এ বাড়িতে আর পা না রাখে। বিনা কারণে একটা ছেলেকে এত গুলো চড় মারলো অথচ তার ভয়, আফসোস কিছুই নেই? বড়ভাই, এটার বিহিত আপনাকেই করতে হবে।”
“বাবা, বাহার ভাই অকারণে কিছুই করেন না আমরা সবাই ই জানি। নিশ্চয় আমাদের অজান্তে কিছু হয়েছে।”
তুহিনের কথা থামলো তার কথার পৃষ্ঠে উত্তর দিলো চাঁদনীর স্বামী। লোকটা নিপাট ভদ্রলোক। খুব সহজে রেগে যান না, ভীষণ ঠান্ডা মানুষ। ঝুট-ঝামেলা এড়িয়ে চলে গিয়ে জীবনে সুখী মানুষ সে। কিন্তু আজকের অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর লোকটাও চুপ থাকতে পারলো না। বিষ্ময় নিয়ে বললেন,
“তুহিন তোমার কথা-ই নাহয় মানলাম। এত গুলো চড় তো আর এমনি এমনি দেয় নি, নিশ্চয় কারণ আছে। বাহার ভাই এর উচিৎ ছিলো না সে কারণ গুলো বলার? এত গুলো মানুষকে এক সমুদ্র প্রশ্নের নিচে ফেলে দেওয়া টা উনার মতন বুদ্ধিমান লোকের কাছে প্রত্যাশিত নয়। সব জায়গায় গা ছাড়া ভাবটা আদৌও মানানসই?”
অবস্থা বেগতিক। কথার পৃষ্ঠে শুরু হলো কথার ঘাত-প্রতিঘাত। অথচ যাকে নিয়ে এত কিছু সে নির্জীব ভকবে প্রস্থান করেছে। বাহার ভাইয়ের কাজটা বড্ড চোখে বাজলেও বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই তার পক্ষেই কথা বলছে। কথা কাটাকাটি যখন বাজে পর্যায়ে তখন চিত্রার মনে হলো বাহারের পক্ষ থেকে একটা কারণ উল্লেখ্য করতে হবে যেন চড়টা যুক্তিযুক্ত হয়। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ করার আগেই বাড়ির সবচেয়ে গম্ভীর, ঠান্ডা অহি কথা বলে উঠলো। খুব ক্ষীণ স্বরে বললো,
“বাহার ভাই আমার পক্ষ থেকে চড়টা মেরেছেন। উনার দোষ নেই।”
অবাকের উপর অবাক হচ্ছে পরিবারের বড় সদস্যরা। ছোটোরাও সেই তালিকার বাহিরে না। অহির মা ছুটে এলেন মেয়ের দিকে। ধমকে বললেন,
“কি বলছিস, অহি! আজেবাজে কথা বলবি না একদম।”
মায়ের ধমকে ভয়ে অহির মুখটা এতটুকু হলো। তখন মেয়েটার ভরসার হাত হয়ে এলো চিত্রার মা। এই ভদ্রমহিলা প্রচুর বুদ্ধিমতী। অহির কথার ইঙ্গিত বুঝতে তার এক সেকেন্ডও ব্যয় হলো না। তাই নিজের ছোটো জা কে চোখের ইশারায় চুপ করিয়ে অহিকে আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“আচ্ছা অহি, বলো তো মহিন ঠিক কী করেছে তোমার সাথে? অসভ্যতামো করেছে কি!”
অহি উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ “হ্যাঁ”। চোখের গোল গোল গ্লাসের চশমাটা ঠেলে চোখের সাথে আঁটসাঁট করে দিয়ে নত মুখে বললো,
“মহিন আমার স্পর্শকাতর জায়গায় বাজে ভাবে ছুঁয়েছে। সেটাই হয়তো বাহার ভাই দেখে ফেলছে, আমি তো লজ্জায় প্রতিবাদ করতে পারতাম না, ভাগ্যিস উনি করে দিয়েছে।”
সবার দৃষ্টি এবার মহিনের দিকে পড়লো। মহিন অবাক চোখেই তাকিয়ে রইলো অহির দিকে। তুহিন এসে এলোপাথাড়ি কতগুলো আঘাত করলো তার শরীরে। ঘৃণায় প্রত্যেকের শরীর রি রি করে উঠলো। অহি স্বভাবসুলভ বেশ ঠান্ডা মেয়ে। এই মেয়ে যে বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলবে না সেটা সবারই জানা।
লতা বেগম নিজের ছেলের বেহাল অবস্থা মানতে না পেরে ছেলের সামনে সুরক্ষার দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন। ছেলেকে নিজের পিছে আড়াল করে হাত জোর করে বললেন,
“আমার ছেলেকে আর মেরো না, বাবা। অনেক তো মেরেছো। ও ক্ষমা চাইবে অহির কাছে। এবার মতন ছেড়ে দেও। আমি ওর আচরণে লজ্জিত। ভাবতে পারি নি আমার ছেলে এমন হবে। ক্ষমা করো বাবা।”
তুহিনের রাগ তখন আকাশ সমান। নিজের বাড়ির মেয়েদের সে যথেষ্ট সামলে রাখে, অথচ এই আত্মীয় নামক জা*নোয়ারটা নাকি বাজে আচরণ করে বেঁচে যাবে, কখনোই না।
তুহিন তার বাবার উদ্দেশ্যে হুংকার ছাড়লো,
“বাবা, এবার আপনি কিছু বলবেন না? এতক্ষণ তো অনেক কথা বলছিলেন। ওরে এবার জেলে দেন। এত বড় সাহস ওর। হ্যারাসমেন্টের দায়ে জেলের ঘানি টানবে ও। ব্যবস্থা করুন।”
উৎসবমুখর পরিবেশটা হুট করে ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। চেরিকে আকড়ে ধরে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো চিত্রা। সওদাগর বাড়ির সকল সদস্যই বেশ চতুর। আত্মীয়দের মাঝে এমন বিশ্রী ঘটনা ঘটলে তাদের বড় মেয়ের সংসারেও যে আঁচ আসতে পারে সেটা তাদের ঢের জানা। পাড়া প্রতিবেশী তন্মধ্যেই ছিঃ ছিঃ শুরু করলো। তিলকে তাল বানালো। অহির চরিত্রে কিঞ্চিৎ কালি ছোড়াছুড়ি হয়ে গেলো।
বাড়ির সবচেয়ে বড় সদস্য আফজাল সওদাগর নিজের মুখ খুললেন। গম্ভীর থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“যা হয়েছে তা শেষ। মহিনকে তো যথেষ্ট শাস্তি দেওয়া হয়ে গিয়েছে, বাকিটা আমরা পারিবারিক ভাবে মিটিয়ে নিবো। এ নিয়ে আশাকরি আর কোনো কথা হবে না। আমাদের মেয়ে এখানে নেহাৎ ই ভুক্তভোগী, ওরে নিয়ে আর কোনো সমালোচন আর কেউ করবেন না আশা রাখি।”
শেষের কথা টা যে পাড়া প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলা তা বুঝতে বাকি রইলো না কারো। লতা বেগম নিজির র*ক্তা*ক্ত ছেলেকে কোনোভাবে ধরে রেখে ক্ষীণ অথচ কঠোর স্বরে বললো,
“আমি ওরে নিয়ে এখনই চলে যাচ্ছি। চাঁদনীর তো আর কয়েকমাস পরেই ডেলিভারির ডেইট, ও এখানেই থাকুক। আমাদের বংশে বউদের প্রথম সন্তান তার বাবার বাড়িতেই হয়। জুনায়েদ, তুই কি যাবি আমাদের সাথে?”
শেষের প্রশ্নটা তিনি নিজের বড় ছেলের উদ্দেশ্যে করলেন। জুনায়েদ লোকটা ভদ্রলোক, সহজ সরল হলেও ভীষণ বাস্তববাদী। তাই নিজের মায়ের প্রস্তাবকে অকপটে না করে বললো,
“আমার তো কথা ছিলো সময়ে, অ-সময়ে চাঁদনীর পাশে থাকার। তাই এসময়েও ওর পাশেই থাকতে হচ্ছে। তোমরা যাও মা।”
লতা বেগম বড় ছেলের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে চলে গেলেন। মহিলার ভাব এমন যে এ পৃথিবীতে তার ছোটো ছেলের মতন শুদ্ধ পুরুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই ছোটো ছেলে যাই করবে তা হাসিমুখে মেনে নেওয়া টা উচিৎ কাজ। যেহেতু চাঁদনীর পরিবার মেনে নেই নি তাই বংশের নতুন নিয়ম বের করে শাস্তিস্বরূপ চাঁদনীকে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ও বাড়িতে নিবেন না তা বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। কেউ কোনো রকম প্রতিক্রিয়া জানালেন না। সবার ভাব এমন যে, লতা বেগমের বংশের নিয়মটা তারা নির্দ্বিধায় পালন করবেন।
যখন বড়দের কথোপকথন চললো মহিন ধীর কণ্ঠে বললো,
“আপনাকে তো আমি ছুঁই নি অহি, তবে এবার নিশ্চয় ছুঁয়ে দিবো। এমন ভাবে ছুঁবো যেন নিজেকে দেখে নিজে লজ্জা পান।”
অহি নিরুত্তর রইলো। ভাব এমন, সে কথাখানা শুনে-ই নি।
মহিন আর তার মা চলে যেতেই আরেক দফা ক্ষমা চাইলো জুনায়েদ। ভাইয়ের কর্মকান্ডে যে সে লজ্জিত সেটা তার আচরণেই প্রকাশ পেলো।
সবটুকু ঘটনায় চাঁদনী ভড়কে গেছে। সংসারটা ভাঙতে বসলো ভেবেই ভয়ে কাঁপলো তার মন। বাঙালি নারীদের কাছে তো আবার সংসারই সব। ধ্যান, জ্ঞান, বেঁচে থাকা।
(৫)
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাড়ির পরিবেশ ক্ষানিকটা থমথমে। যে যার মতন নিজেদের ঘরে আছেন। অন্যান্য দিনের মতন হৈ চৈ নেই, হাসি-তামাশা নেই।
আকাশ যখন কমলা রঙ ছেড়ে কালো রঙে নিমজ্জিত হলো ছাঁদ থেকে ভেসে এলো তখন গিটারের টুংটাং শব্দ। চিত্রার বয়ঃসন্ধি মনের মন খারাপের আবেশটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো হুট করেই। গিটার তো বাহার ভাই মাঝ রাতে বাজান, তাও মাঝে মাঝে। আজ এমন একটা দিনে এসময়ে গিটার বাজাচ্ছেন যে! পরক্ষণেই মনে পড়লো আজ বাবা বাড়িতে। আর বাবাকে বিরক্ত করা বাহার ভাইয়ের সবচেয়ে পছন্দের কাজ। আনমনেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
বাহার ভাই তাদের বাড়িতে এসেছে আজ একবছর হতে চললো। কোনো আত্মীয়তা নেই লোকটার সাথে। কেবল আর কেবল মাত্র দিহান আর তৃষাণের শিক্ষক হয়েই এ বাড়িতে খুঁটি গেড়েছেন সে। গতবছর যখন দিহান আর তৃষাণ ভাইয়ার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে তখন কূলকিনারা খুঁজে ভালো শিক্ষকের সন্ধান চললো। অতঃপর একদিন হুট করেই বড় চাচা বাহার ভাইকে নিয়ে এলেন। কঠোর, গা ছাড়া ভাবের এই বাহার ভাইয়ের কড়া শাসন আর পরিশ্রমে দু’জনই দারুণ রেজাল্ট করলো। বাহার ভাই বর্তমানে ইংলিশে মাস্টার্স পড়ছেন পাবলিক ভার্সিটিতে। ছাত্র হিসেবে ভীষণ মেধাবী হওয়ায় সে এ বাড়ির সকলের মন পেয়ে যায়। অবশ্য অনেকটা গা ছাড়া ভাব আছে বিধায় চিত্রা আর তার বাবা বাহারকে পছন্দ করে না। চিত্রাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান হলো তুহিন, সে সবার বড়। বড় চাচার তখন সন্তান ছিলো না। কিন্তু তুহিন ভাইজান হওয়ার পর বড় চাচার ঘর আলো করে চাঁদনী আপা এলো তারপর ছোট চাচার ঘরে এলো অহি আপা, তারপর দিহান আর তৃষাণ ভাই যমজ হলো বড় চাচীর ঘরে। অতঃপর চিত্রা এবং তারপর সবার ছোটো আদরের চেরি। বর্তমানে তৃষাণ ভাই আর দিহান ভাইকে পড়াশোনায় সাহায্য করার পাশাপাশি চেরি আর অনয়কেও পড়ান বাহার ভাই। এলাকায় মোটামুটি বাহার ভাইয়ের একটা পরিচিতি আছে, কারণ সে সবাইকে বেশ সাহায্য করেন।
নানান রকম কথা ভাবতে ভাবতে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো চিত্রা। বাহার ভাই তো আজ দুপুরে খায় নি, এখন খাবেন কিনা জিজ্ঞেস করতেই ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। ছাঁদের চিলেকোঠার ঘরেই বাহার ভাই থাকেন। থাকার খরচ না দিলেও খাবার খরচ বাহার ভাই দেন। তার এক কথা, অন্যের থালে খেয়ে খোঁটা কামাতে পারবেন না।
ছাঁদের দরজার সামনে আসতেই অস্বচ্ছ গিটারের শব্দটা তুমুল হলো। বাহার ভাইয়ের গলা ছেড়ে গানের শব্দ এলো,
“রক্তের সাথে মানুষ গুলি করে বেইমানি,
স্বার্থের কারণে মানুষ হয়, হারামি,,
আবার চলার পথে সুখ দুঃখে, পর আপন হয়,
আমি শুধু আমার আপন কথা মিথ্যে নয়।”
চিত্রা মনযোগ দিয়ে তাকালো মানুষটার দিকে। হাঁটু অব্দি প্যান্ট পড়া, ফুটপাতের খুব সস্তার একটা ছাই রাঙা পাতলা টি-শার্ট গায়ে, চুল গুলো এলোমেলো সাথে সিক্ত, বোধহয় গোসল করেছে। মানুষটার বেলা – অবেলায় উদ্ভট কাজ করার শখ।
তন্মধ্যেই গান থামিয়ে সিগারেট ধরালো বাহার। পরিবেশ তখন নিশ্চুপ প্রায়। এর মাঝেই ধপধপ পা ফেলে কে যেন ছাঁদের দিকে আসছে মনে হতেই দরজার আড়ালে লুকালো চিত্রা। ভেবেছিলো মা-চাচীর মধ্যে কেউ এসেছে কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে অহি হাজির হলো। হাতে তার ঢেকে রাখা থালা। চিত্রা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো। অহি আপা কিনা খাবার এনেছে! এক গ্লাস পানি খায় না যে, সে নাকি আজকাল বাহারের জন্য খাবার আনছে!
অহি চুল গুলো দুলাতে দুলাতে ছাঁদে পা রাখতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো চিত্রা। অতঃপর বাহারের মতন করে আনমনেই বললো,
“শুনো মেয়ে,
বাহার ছুঁয়ে দিলে পরে, অকালেই যাবে ঝরে,
গলে যাবে যে বরফ গলে না।”
চিত্রার গান থামতেই ছাঁদ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। পরক্ষণেই বাহারের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“চিন্তা নেই মেয়ে,
কারো একদিন হবো, কারো এক রাত হবো,
এর বেশি রুচি কারো হবে না।”
চিত্রার চোখ অবাকে বড় বড় হয়ে গেলো। তার গান কি তবে বাহার ভাই শুনে ফেললো!
#চলবে