#বিবি,৩৫,৩৬
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৫)
অনড়ার সচকিত দৃষ্টি আনমনা হয়ে এলো। মনে পড়ল তার সেই কিশোরী বয়সের মুগ্ধতা, অদ্ভুত অনুভূতির দোলা, প্রথম লেখা প্রেমপত্র। কিশোরী বয়সের অস্থিরপনা পুনরায় সঞ্চালন হলো ভেতরটায়। খুব করে জানতে ইচ্ছে হলো নিবিড় তার প্রেমপত্র পড়েছিল নাকি। পড়ে থাকলে উত্তর দিল না কেন? প্রশ্নটা ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়তে গিয়েও লুফে নিল অনড়া। মস্তিষ্ক জানিয়ে দিল, পড়েনি। যদি পড়ে থাকত তাহলে এত সুন্দর করে বলতে পারত না, প্রণয়ঘটিত ব্যাপার নেই।
অনড়াকে চুপ থাকতে দেখে নিবিড় জিজ্ঞেস করল,
” স্বীকার করবে না? ঠিক আছে, না করলে। এমনিতেও তোমার কোনো কিছুতে আমার আগ্রহ নেই। শুধু মনে রেখ, উদ্দেশ্য হাসিল করতে গিয়ে যদি কোমলকে কষ্ট দেও তাহলে জানে ফেলব। ”
” খুন করবে? ”
” ওর জন্য সব করতে পারব। ”
দৃঢ়চিত্তে কথাটা বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লম্বা করে দম টেনে বসল আবার৷ অনড়ার বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
” এই বিয়ের পেছনে আমারও একটা উদ্দেশ্য ছিল। ”
” কী? ”
” কোমল কে বিশ্বাস করানো যে, আমার কাছে ভালোবাসা মানে কোমল। জীবন মানে ও কোমল। ”
” তার জন্য বিয়ে করতে হলো? ”
” হ্যাঁ। একমাত্র বিয়ে ছিল সেই বিশ্বাসের সঠিক ও স্থায়ী প্রমাণ। কোমলের ভয় দূর করা। বাচ্চাদের প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে এটা জানার পর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। মায়ের কথাগুলোকে সত্য হিসেবে ধরে নেয়। মানতে বাধ্য হয়, একসময় আমিও অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব। ”
” সেজন্য ইচ্ছে করে আপনার সামনে নারী এনে দিল? ”
অনড়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নিবিড়। কুটিল হেসে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” এটা তো পরীক্ষার মতো হয়ে গেল। আর বিয়ে পরীক্ষার মতো ক্ষণস্থায়ী কোনো ঘটনা নয়। ”
” জানি। ”
” জেনেও সায় দিয়েছ? এটা তো অন্যায়। ”
” যার শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে। ”
” কেন? তোমাদের অন্যায়ের শাস্তি আমি ভোগ করব কেন? ”
” সুন্দরী বলে। কোমলের ধারণা, গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি তুমি। সেজন্য মায়ের এক কথায় রাজি হয়ে গেছে। যাতে আমাকে হারাতে পারে। ”
এইটুকু বলে সশব্দে হেসে ফেলল। অনড়া থতমত খেল। বোকা চোখে চেয়ে থাকলে নিবিড় বলল,
” তোমার বুবু প্রায় গর্ব করে বলত, অনু খুব ভালো উকিল হবে। তোমার মধ্যে নাকি সেরকম গুণ দেখেছে। সেজন্য ছোটবেলা থেকে তোমাকে আর্টসে পড়ার জন্য উৎসাহ করত। ”
নিবিড় একটু সামনে ঝুকে নীরিক্ষকের মতো বলল,
” আজ বুঝতে পারলাম, কোন গুণ দেখেছে। ভালো উকিল হবে নাকি জানি না, কিন্তু খুব সুন্দর করে কথার প্যাঁচে ফেলে অপরাধী বানিয়ে ফেলতে পারবে। এই যেমন নিজের বুবুকে বানিয়ে ফেললে। ”
অনড়া লজ্জায় অবনত হলে নিবিড় বলল,
” তোমার আত্মবিশ্বাস প্রবল। যেটা প্রশ্ন করা ও উত্তর দেওয়ার সময় বুঝা যায়। বিপরীত মানুষটা সত্য হলেও ঘায়েল হবে। মিথ্যা হলে তো কথা-ই নেই! ”
প্রশংসা পেল নাকি নিন্দা বুঝতে পারছিল না ভবিতব্য উকিল। তাই কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সহসা সুধাল,
” আমি সুন্দরী নই? ”
” অবশ্যই সুন্দরী। সেজন্যই তো ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। ”
অনড়া বিস্ফারিত চোখে তাকাল। বিস্ময়াপন্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” মানে কী? ”
নিবিড় সহজ হতে চেষ্টা করল। বিজ্ঞদের মতো গম্ভীর হয়ে বুঝাতে শুরু করল,
” আমি ঠিক করেছিলাম, একটা মিথ্যা বিয়ের আয়োজন হবে। কনেটি হবে আমার শিখিয়ে-পড়িয়ে দেওয়া কেউ। কিছুদিন বউয়ের অভিনয় করে সংসার করবে। তারপর সময় বুঝে মাকে গিয়ে জানাবে, আমার মধ্যে সমস্যা আছে, বাচ্চা-কাচ্চা তো দূর, সংসার করাও যাবে না। রাগ দেখে বাপের বাড়ি চলে যাবে। আর ফিরবে না কোনোদিন। এরপর প্রয়োজন হলে ডিভোর্সের ব্যাপারটি আনব। এতে কোমলের উপর কোনো অভিযোগ থাকবে না৷ মা এবং কোমল দুজনই চুপ হয়ে যাবে। পরবর্তীতে যখন দেখলাম, কনে তাদের পছন্দের। তখন সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। যদিও চাইলে, কনে বদলাতে পারতাম, তেমনটা করলাম না। মনে পড়ল, অন্য কেউ হলে পুরো ব্যাপারটি মিথ্যা হবে, যেটা একপ্রকার ধোঁকার মধ্যে পড়ে। কোমল যদি জেনে যায় তাহলে খুব কষ্ট পাবে। তাই তাদের পছন্দকে মেনে নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, পুরো ব্যাপারটি তাহলে সত্যি সত্যি হোক। হলোও। কিন্তু সমস্যা করলে তুমি। স্ত্রীর অধিকার পাওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছ! জীবন পর্যন্ত বাজি রাখছ! ”
শেষ বাক্যটি শ্লেষাত্মক শুনাল। একটু জিরিয়ে আবার বলল,
” তুমি দেখতে ভালো, মেধাও ভালো। পড়ছও একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে। একটু মন লাগালে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হবে। সেখানে এই ডিভোর্সটা খুব একটা সমস্যায় ফেলবে না। তবুও তোমার দিক বিবেচনা করে আমি, বিয়ের পুরো আয়োজনটা নিজেদের মধ্যে রেখেছি। আশা করছি ভবিষ্যতেও নিজেদের মধ্যেই থাকবে। ”
অনড়ার মুখের রঙ বদলে গেল। কোথাও থেকে যেন এক মুঠো কালো মেঘ উড়ে এসেছে সুশ্রী মুখটায়। চোখদুটো টলমল করছে। যে কোনো সময় বারিধারা বয়তে পারে। অভিমানের ধাক্কায় ঠোঁট কাঁপছে ক্ষণে ক্ষণে। সে কম্পন ঠোঁটে বলল,
” তুমি এত স্বার্থপর! ”
” এটা ঠিক বলেছ। আমি আসলেই খুব স্বার্থপর। ”
” নির্লজ্জের মতো স্বীকারও করছে! ”
অনড়া মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যপাশে। নিবিড় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” এমন করে আজীবন মুখ ফিরিয়ে রেখ। এতে তোমার, আমার, কোমল সকলেরই ভালো হবে। তুমি সংসারের চেয়েও আদালতে বেশি সুন্দর দেখাবে। ”
কথাটা বলতে বলতে চেয়ারটা আগের জায়গায় রাখল। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বলল,
” সেই সুন্দরের সৌন্দর্য প্রকাশে কোনো বাঁধা এলে আমায় স্মরণ করো। কোমলের মতো আমিও তোমার পাশে থাকব, বন্ধুর মতো। সারাজীবন। ”
অনড়া তখনও অন্য দিকে মুখ করে থাকলে নিবিড় একটু জোরেই বলল,
” এটা নেও। ”
” কী এটা? ”
নিবিড় সরাসরি না বলে একটু গুছিয়ে বলল,
” মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক দিতে হলে তিন দফায় আইনি পত্র অর্থাৎ ডিভোর্স লেটার দিতে হয়। প্রতি ত্রিশ দিন পর একটি করে চিঠি দিতে হয়। এটা প্রথম চিঠি। আশা করছি, আগামী তিন মাসে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। ”
অনড়া চিঠি নেওয়ার বদলে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। সেই চাহনিতে নিবিড়ের মনে সামান্যতম সহানুভূতি উদিত হলো না। চিঠিখানা বিছানার এক জায়গায় রেখে খানিক কৌতুকের সুরে বলল,
” কোমল তোমাকে ছোট বোন মানে। সে হিসেবে তোমার-আমার সম্পর্ক শালী-দুলাভাই। বাঙালি সমাজে চূড়ান্ত পর্যায়ে রসিকতা ও ঠাট্টা চলে এখানে। সেই সূত্রে তোমাকে ছোট বিবি বলে ডাকা-ই যায়। তার জন্য সত্যিকারের বিয়ে-শাদীর প্রয়োজন নেই। ”
ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ধরে রেখে বেরিয়ে গেল নিবিড়। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে অনড়া চিঠিটা হাতে নিল। খুলে দেখার পরিবর্তে টেনে কয়েক টুকরো করে ফেলল!
___________
সেদিনের পর অনেকটা বদলে গেল অনড়া। কক্ষ থেকে বের হওয়া শুরু করল। কোমলের সাথে রান্নাঘরে দেখা গেল কয়েকবার। ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা চলছে নিয়মিত। নিবিড় ধরে নিল, ডিভোর্সের ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। তার স্বার্থপরতাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। তার বুকের ভারটা নামল একটু! অশান্তি কমল মন থেকে। এখন কোমলকে বুঝাতে হবে, ‘ শুধু সন্তান নয় ভালোবাসাও পারে সংসারের প্রতিটি কানায় কানায় সুখ এনে দিতে। পূর্ণতায় ভরিয়ে রাখতে। সেই ভালোবাসা তাদের মধ্যে বিদ্যমান ও চিরস্থায়ী। এরপরও তার কিসের চিন্তা, ভয়, কষ্ট! ‘ তাকে বিশ্বাস করাতে হবে, ‘ যে ছেলে কিশোর বয়সে সমাজের এক কঠিন নিয়মকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল, সেই ছেলে পরিণত বয়সে পুরো পৃথিবীকে তছনছ করার ক্ষমতা রাখে। ‘
নিবিড় রাতের খাবার শেষ করে একটু বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে রুমে ঢুকতে কোমল বলল,
” আজকেও এখানে ঘুমাবে? ”
সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল,
” তাহলে কোথায় ঘুমাব? ”
” তোমার ছোট বিবির কাছে। ”
নিবিড় চট করে কোমলকে কাছে টেনে নিল। মাথার চারধারে জরিপ করতে করতে বলল,
” দেখি নতুন করে কোন তারটা ছিঁড়ল! ”
কোমল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
” একদম ফাজলামো করবে না। ইসলামের নিয়মানুযায়ী একের অধিক স্ত্রী হলে সবকিছুতেই সমান ভাগ দেওয়া লাগে। ”
” এখন কি তোমার বোনকে ঘুমের ভাগও দেওয়া লাগবে? ”
” অবশ্যই। আজ থেকে তুমি সপ্তাহের তিনরাত এই রুমে বাকি তিনরাত ঐ রুমে থাকবে। ”
” সপ্তাহ তো ছয়দিনে না সাতদিনে হয়। তাহলে কি অবশিষ্ট একরাত আরেকজনের বউয়ের সাথে থাকব? বড়বউ, ছোটবউ, পরেরবউ। শুনতে ভালোই লাগছে। ”
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৬)
” স্ত্রীর ভুলকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে নিজে এত বড় ভুল করে ফেললি? ”
দুলাল ভাইয়ের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা, অবিশ্বাস্য। নিবিড় নির্বোধের মতো সুধাল,
” কী ভুল করেছি? ”
” এখনও বুঝতে পারছিস না? ”
উত্তরে কিঞ্চিৎ সংকোচ নিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়ল। সেইরাতে ঘুমের সময়কে ভাগাভাগি নিয়ে সারারাত নীরব ঝগড়া করেছে নিবিড় ও কোমল। একে-অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ রাখলেও শুয়েছিল একসাথে। সকালের দিকে নিবিড় ঘুম থেকে উঠে দেখল, কোমল মেঝেতে শুয়ে আছে। স্বামীকে আলাদা রুমে পাঠাতে অসফল হলেও আলাদা ঘুম পাড়াতে সফল হয়েছে। এই দৃশ্য একই সাথে তিনবার প্রত্যক্ষ করার পর একটা নতুন ভয় তৈরি হয়েছে মনের মধ্যে। আতঙ্ক বাড়ছে সময়ে সময়ে। উপলব্ধি করছে, হঠাৎ করে কোমলের প্রতি তার যেমন ভয়াবহ আসক্ত ও যত্ন বেড়েছে তেমন কোমল হয়ে পড়ছে বৈরাগী, অযত্নশীলা। টেনে রাখা সম্পর্কের সুতোটা ঘনত্ব হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হচ্ছে দুর্বল, নরম। যেকোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে গিয়ে দুটো আলাদা খণ্ডে বিভক্ত হতে পারে। যা নিবিড়ের কাছে মৃত্যু সমতূল্য। আর নিজ মৃত্যুকে গ্রহণ করা কারও পক্ষে সহজ নয়। একজন ডাক্তার হিসেবে তার খুব ভালো করে জানা, প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার শতগুণে ভালো। এই জ্ঞানটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য দুলাল ভাইয়ের শরণাপন্ন হয়েছে। সেই কলেজ জীবন থেকে দুলাল ভাইকে বড় ভাই হিসেবে মান্য করে চলে। প্রয়োজনীয় উপদেশ গ্রহণ করেছে। সম্মানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের পরে যদি কোমলের স্থান হয়। তাহলে কোমলের পরে দুলাল ভাইয়ের স্থান অনাবশ্যকীয়। এই মানুষটাকে ভরসা করে ব্যক্তিগত সমস্যার কথা তুলে ধরতেই হাসপাতালের কর্মসময় শেষ করে সরাসরি এখানে এসেছে। একটা ভালো সমাধানের জন্য কাতর স্বরে প্রার্থনা করতেই নিবিড়কে আসামী বানিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন,
” তোর কি মনে হয়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, জীবনধারণে এত উন্নত হয়েছে যে একজন ডিভোর্সিকে তার প্রাপ্য সম্মান দিবে? প্রথম বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে পূর্বের মতো সহজ আচরণ করবে? নিজেদের সাথে মানিয়ে নিবে? আচ্ছা, সমাজ বাদ দিলাম। অনড়ার দ্বিতীয় স্বামী সবকিছু মেনে নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসবে, সুখে রাখবে এর কি নিশ্চয়তা দিতে পারবি? আমি মানছি, তোদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়নি, হবেও না। এটা শুধু তোরা জানবি অন্যরা নয়। তারা দেখতে আসবে না, প্রমাণও চাইবে না। তারা শুধু মনে রাখবে এই মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল। তারপর স্বামী ছেড়ে দিয়েছে। ”
নিবিড় মনে করিয়ে দিল,
” বিয়ের ব্যাপারে বাইরের কেউ জানে না। শুধু অনড়ার নানি ও আমাদের দুই পরিবার জানে। ”
” জানেনি, কখনও জানবে না। এটা জোর দিয়ে বলতে পারবি? তাছাড়া বিয়ে কোনো শখের বস্তু নয় যে, হাতে পেলি আর সকলের চোখ বাঁচিয়ে সিন্দুকে তুলে রাখলি। এটি একটি সুদীর্ঘ ও স্থায়ী ঘটনা। যা নিজ বা অন্যের সকলের স্মৃতিতে আজীবন রয়ে যাবে। হয়তো সময়ের আস্তরণে একটু ঢাকা পড়বে কিন্তু মুছে যাবে না কখনও। ”
নিবিড় নীরব থাকলে দুলাল আচমকা বলল,
” তুই তো নিজেই গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারিসনি। আমার কাছে প্রকাশ করে ফেলেছিস। এক ঘণ্টা আগেও এটি পারিবারিক গোপনীয়তা ছিল, এখন নেই। বাইরে চলে এসেছে। ”
” আপনাকে তো আমি পরিবারের একজন হিসেবে মানি। ”
” তোর মতো প্রত্যেকেরই এরকম কিছু কাছের মানুষ থাকতে পারে। যার কাছে নিজ দুঃখ, কষ্ট ভাগ করতে ভালো লাগে। সেই হিসেবে তারাও হয়তো এই গোপন ব্যাপারটি সম্পর্কে একদিন জানবে। এভাবেই ধীরে ধীরে এটি গোপনীয়তা হারাবে। ”
নিবিড় অশান্তি কমাতে এসে যেন আরও বাড়িয়ে ফেলল। সমস্যা দূর করতে এসে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ল। মিনতি করে বলল,
” আমি এত কিছু বুঝতে চাই না, দুলাল ভাই। আপনি শুধু একটা ভালো সমাধান দিন। এই যন্ত্রণা আমি আর নিতে পারছি না। ”
তার এমন আকুল আবেদনে মায়া হলো দুলালের। ইচ্ছে হলো এক তুড়িতে সব সমস্যা দূর করে দিতে। তেমনটা সম্ভব না। তাই বলল,
” সমাধান বের করতে হলে আগে সমস্যাটাকে ভালো করে বুঝতে হবে। ধৈর্য্য ধরে শোন। ”
নিবিড় ক্লান্ত স্বরে বলল,
” বলেন। ”
” প্রথমে তোর ভুলটা কোথায় হয়েছে সেটা বলি। ”
” আচ্ছা। ”
” কোমল ভেবেছে, তোর বাচ্চা খুব পছন্দ। যা সে দিতে পারছে না। তাই সারাজীবন যাতে আফসোস করতে না হয় সেজন্য দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছে। আর তুই চাপ সহ্য করতে না পেরে রাজি হয়ে গেছিস, তাই তো? ”
” হ্যাঁ। ”
” এখানেই তোর সব থেকে বড় ভুলটা হয়েছে। প্রথমত, তোর উচিত ছিল কোমলকে এটা বোঝানো যে, বাচ্চারা নিষ্পাপ ও আদুরে হয়। ফলে হোক আপন অথবা পর, যে কেউ তাদের প্রতি একটু দুর্বলতা অনুভব করে, আদর করে, ভালোবাসে, দুষ্টুমি করে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তুই তেমনটা না করে উল্টো দেখাতে চাইলি বাচ্চাদের পছন্দ করিস না। অথচ গোপনে ঠিকই পছন্দ করিস, যেটা কোমল ধরে ফেলেছে। এবং খারাপ প্রভাব ফেলেছে। দ্বিতীয়ত, কোমলের সমস্যার কথাটা মাকে না বলে তাকে বলা দরকার ছিল। এতে শাশুড়ির দিক থেকে কোনো চাপ আসত না। আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা আসতে আসতে কোমল বুঝে ফেলত, বাচ্চা ছাড়াও তোরা সুখে থাকতে পারিস। ”
দুলাল একটু চুপ থেকে চিন্তিত গলায় বলল,
” কোমলের মতো মেয়ে এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি৷ অন্তত তার জানার কথা তোর পক্ষে অন্য মেয়েকে ভালোবাসা অসম্ভব। কষ্ট তো তোর চেয়ে ওর বেশি হওয়ার কথা। ”
” আমার কোমলের মন তার নামের মতোই কোমল । একা সুখ ভোগ করতে পারে না৷ সকলকে নিয়ে সুখী হতে চায়। ”
” এই জায়গাটাতে এসে ভুল করে ফেলেছে। সবকিছুতে ভাগ হয় না। আমার কী মনে হয় জানিস? ”
” কী? ”
” তোর চারিত্রিক গুণ, ভালোবাসার ধরনে এতই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে যে, অনড়ার জন্য শ্রেষ্ঠ পুরুষ তোকেই চোখে পড়েছে। এক মুহূর্তের জন্য ভেবে বসেছে, ওর জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো পাত্র পাবে না। তার মধ্যে ভাগটা নিজের বোনকেই দিচ্ছে, অন্য কাউকে না। এমন আত্ম সান্ত্বনাও পাবে৷ এজন্যই তোর দ্বিতীয় বউ হিসেবে অনড়াকে বেছে নিয়েছে। নাহলে নিজ হাতে গড়ে তোলা বোনকে কি বিবাহিত পুরুষের হাতে তুলে দিবে? ”
নিবিড় সহমত পোষণ করে বলল,
” হ্যাঁ। অথচ এটা বুঝতে পারেনি, আমি শুধু তার চোখে শ্রেষ্ঠ, গুণবান, আদর্শ স্বামী। ”
এইটুকু বলে আফসোসে ভেঙে পড়ে বলল,
” আমার কোমল সর্বক্ষেত্রে জ্ঞানী, অভিজ্ঞ, উপদেষ্টা। ছোটবেলা থেকে আমাকে আগলে রেখেছে, ভেঙে পড়তে দেয়নি কখনও। প্রতিটি সমস্যার সঠিক সমাধান বের করে দিয়েছে, অথচ আজ স্বয়ং সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার সামনে! ”
” এতেই প্রমাণ হয়, জ্ঞানীরাও মাঝেমধ্যে বোকামি করে। সুবিবেচকরাও ভুল বিচার করে। ”
নিবিড় একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
” আপনি কি এখন দর্শনশাস্ত্র শেখাবেন? ”
” সুযোগ পেলে সবই শিখতে হয়। ”
” দুলাল ভাই! এসব বাদ দিয়ে সমাধান দেন। ”
দুলাল ভাই গম্ভীর হয়ে একটু ভাবনায় মশগুল হলেন। সহসা বললেন,
” তোর একমাত্র সমাধান হলো অনড়ার কাছে মাফ চাওয়া। ”
” ঐ মেয়ের কাছে মাফ চাইব? ও তো একটা অভদ্র, মাথা নষ্ট। ”
” সে কেমন তা তো আমি জানি না। তোর থেকেই শুনেছি বাবা-মা নেই। এর মানে মেয়েটা এতিম। আর এতিমদের কষ্ট দিলে আল্লাহ খুব রাগ করেন, জানিস তো? তাদের বদদোয়া করতে হয় না। এমনিতেই লেগে যায়। জোর করে তাড়ানোর চেয়ে ভালো নিজ ইচ্ছায় চলে গেলে। আর সেটা সম্ভব একমাত্র ক্ষমা প্রার্থনায়৷ ”
” ও কি ক্ষমা করবে? ”
” না করলে শাস্তি নিবি। ”
” শাস্তি হিসেবে যদি আমাকে চেয়ে বসে? ”
” দিয়ে দিবি। ”
নিবিড় করুণ স্বরে বলল,
” মজা করছি না৷ ওর আচার-ব্যবহার কেমন যেন! বিয়ের পর থেকে দেখছি, সকল চাওয়া আমি সংক্রান্ত। ”
দুলালের মেয়ের ঘুম ভেঙেছে। তাকে কোলে নিয়ে বলল,
” মজা করছি না। বিয়ে যেহেতু করেছিস অধিকার দিতেই হবে। আইন, ধর্ম, বিবেক সব দিক দিয়ে সে জিতবে। ”
দুলালের মেয়ের দিকে হাত বাড়াল নিবিড়। কোলে তুলে নিতে নিতে বলল,
” ক্ষমা চাইব, মাফও পাব। এরজন্য যতদূর যেতে হয়, যাব। ”
মেয়েটার কপালে চুমু খেয়ে আপনমনে বিড়বিড় করল,
” তোমারও বাচ্চা খুব পছন্দ, তাই না কোমলমতি? এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন নিষ্পাপ ও নরম শরীরের বাবু আনব আমরা। যার সাথে রক্তের নয় ভালোবাসার সম্পর্ক থাকবে। ”
দুলাল ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইল নিবিড়। তখন বললেন,
” এই পৃথিবীর সবকিছুরই একটা সীমা আছে। ভালোবাসারও। যেটা তুই অতিক্রম করে ফেলেছিস। সেজন্যই এত বড় ভুলটা হলো। ভালোবাসাকে সীমানার মধ্যে এনে একটু কঠোর হ। দেখবি, সব সমস্যা দূর হয়ে গিয়েছে। আমি বলছি না, কোমলকে ধমকা, অসম্মান কর। আমি বলতে চাচ্ছি, সম্মানের মধ্য দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর কোমল তো ধর্ম অনুরাগী। এমন মেয়েরা স্বামীকে খুব মানে। ”
_____________
নিবিড় বাসায় ফিরে দেখল, কোমল বোরকা পরে বসে আছে। হাতে ছোট-বড় ব্যাগ। সে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কোথাও যাচ্ছ? ”
” হ্যাঁ, বাবার বাড়ি। ”
” হঠাৎ? কেউ অসুস্থ? ডাক পাঠিয়েছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” আজ থেকে আমি ওখানে থাকব। ”
নিবিড় একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে গেল। কোমলের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণটা কী হতে পারে তাই অনুমান করার চেষ্টা করছে। বুঝতে পেরে মেজাজ গরম হলো। রাগ সংবরণ করে বলল,
” তুমি কি আমার দেওয়া শর্ত ভুলে গেছ? ”
” যদি আমার চাওয়াটাই পূরণ না হয় তাহলে শর্ত মনে রেখে কী লাভ? ”
কোমল কোন চাওয়ার কথা বলছে এক নিমিষেই বুঝে ফেলল সে। স্ত্রীর হাত থেকে ব্যাগগুলো কেড়ে নিয়ে জামা-কাপড় বের করল। যেটা যেখানে থাকার কথা সেখানে সাজিয়ে রেখে অনড়ার রুমের দিকে অগ্রসর হলো। দরজায় আঘাত করতে সে খুলে দাঁড়াল। নিবিড় তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে খাটের একপাশে বসল। অনড়া গ্লাসে করে পানি এনে বলল,
” তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। শরীর খারাপ? ”
নিবিড় উত্তর দিল না। নীরবে পানির গ্লাস নিয়ে খেতে লাগল। অনড়া সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সে জিজ্ঞেস করল,
” পড়ছিলে? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে পড়ো। আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হতে হবে না। আমি কিছুক্ষণ বসব এখানে। ”
অনড়া নড়ল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। নিবিড় পানি খাওয়া শেষ করে গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে পুনরায় বলল,
” পড়া বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, পড়া শেষ করো। তোমার সাথে আমার কথা আছে। ”
” কী কথা? ”
নিবিড় আর নরম থাকতে পারল না। দৃষ্টি একটু কঠিন করতে অনড়া পড়ার টেবিলের কাছে চলে গেল। মেলে রাখা বইটায় চোখ রেখে আপনমনে বলল, ‘ তোমার কথা শোনার জন্য শুধু পড়া কেন, জীবনটাই নষ্ট করে ফেলতে পারি! ‘
বিছানায় বসে থাকতে থাকতে একসময় আধশোয়া হলো নিবিড়। চোখ বুজে দুলাল ভাইয়ের কথাগুলো মনে করছে বার বার। যত মনে পড়ছে ততই ব্যাকুল হয়ে পড়ছে। প্রথমে সন্দেহ হলেও এখন সঠিক বলে নিশ্চিত হয়েছে। নিবিড় চোখের পলক মেলল হালকা করে। সরাসরি দৃষ্টি গিয়ে পড়ল অনড়ার মুখটায়। কী নিখুঁত তার মুখশ্রী! লতানো দেহ থেকে সোনার মতো জ্যোতি ছড়াচ্ছে যেন! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায় না। ধাঁধা লেগে যায়। সে চোখ বন্ধ করে নিল। মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘ এমন মিষ্টি একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেললাম! ‘
” আমাকে কিছু বলছেন? ”
নিবিড় চোখ মেলল। খাট থেকে পিঠ আলগা করে সোজা হয়ে বসে বলল,
” আমরা অন্যায় করেছি। ক্ষমা করে দেও। ”
” আমরা বলতে কারা? তাদের অন্যায়টা কী? ”
নিবিড় নিজেদের অন্যায়টাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে আকুল স্বরে পুনরায় ক্ষমা প্রার্থনা করলে অনড়া বলল,
” তোমার কি মনে হয়, এটা ক্ষমা পাওয়ার মতো অন্যায়? ”
” শাস্তি দিতে চাও? দেও। একটাই অনুরোধ সেই শাস্তিতে যেন তোমার বুবু কষ্ট না পায়। ”
” কেন? বুবুও তো এই অন্যায়ের অংশীদার। তাহলে সে কেন মুক্তি পাবে? ”
” তার কষ্ট আমি সয়তে পারব না। আমাকে নাহয় দ্বিগুন শাস্তি দিলে। ”
অনড়া একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,
” যে শাস্তি দিব সেটাই মানবে? ”
” হ্যাঁ। ”
” খুব কঠিন শাস্তি কিন্তু। ভেবে দেখ। ”
” ভাবতে হবে না। তুমি বলো, আমি তৈরি আছি। ”
” আজ আমি যতক্ষণ পড়ব তোমাকে ততক্ষণ এ রুমে থাকতে হবে। ”
” ব্যস? এইটুকুই? ”
” হ্যাঁ, যদি সারারাত পড়ি তাহলে সারারাত-ই থাকতে হবে। ”
” তাহলে ক্ষমা পাব? ”
” হ্যাঁ। ”
” এরপর নিজ থেকে এবাড়ি থেকে চলে যাবে? ”
অনড়া সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। একটু সময় নিয়ে বলল,
” যাব। ”
নিবিড়ের চোখ-মুখ ঝলমল করে উঠল। আনন্দিত স্বরে বলল,
” ঠিক আছে। তুমি পড়ো, আমি আছি এখানে। তুমি না বলা পর্যন্ত কোথাও যাব না। ”
অনড়া তার উদ্ভাসিত মুখটায় এক মুহূর্ত চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল বইয়ের পাতায়। আর একবারের জন্যও তাকাল না নিবিড়ের দিকে। কোনো থামাথামি নেই। নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। সহসা গ্লাস পড়ার শব্দ পেল। সে চমকে পেছনে তাকাল। সচকিত দৃষ্টিতে দেখল, নিবিড় পানির জগের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে। ভাঙা গ্লাসের দিকে ঝুকতে নিলে অনড়া দৌড়ে গিয়ে বলল,
” আমি তুলছি। ”
বলতে বলতে টুকরো কাচগুলো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার দিকে চেয়ে থেকে নিবিড় কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
” পানি খেতে চাচ্ছিলাম। কী করে যে গ্লাসটা পড়ে গেল বুঝতে পারিনি। ”
অনড়া মাথা তুলে দেখল, নিবিড় চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। পা’দুটো টলমল করছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে সুধাল,
” তুমি ঠিক আছ? ”
নিবিড় সরল গলায় বলল,
” না। মাথা চক্কর দিচ্ছে। অন্ধকার দেখছি সব। ”
অনড়া কাচ তোলা বাদ দিয়ে নিবিড়কে ধরল। বিছানায় বসিয়ে দিলে সে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” কোমলকে ডেকে দেও। ”
কথাটা বুঝতে পারেনি এমন ভান করল সে। একটা বালিশ টেনে এনে নিবিড়কে শুয়িয়ে দিতে চাইলে অনড়াকে ঠেলে সরিয়ে দিল। বালিশ দূরে ঢিল মেরে বলল,
“কোমলকে ডেকে দেও। ”
কথাটা চিৎকার করে বললেও শোনাল অস্ফুট, হালকা। অনড়া বুবুকে ডাক দেওয়ার বদলে দুয়ারে ছিটকানি লাগিয়ে দিল। মেঝে থেকে বালিশ তুলে নিয়ে ঘরের আলো নিবিয়ে দিল।
চলবে