#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_১৮ (শেষ পর্ব)
#লেখক_আয়াশ
‘তুমি এতদিন আমাদের ধোকা দিয়ে আসছ!! দেখতে পেয়েও নিজেকে অন্ধ বানিয়ে আসছ আমাদের আছে?’
শানের সামনে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তিনজন ব্যক্তি। তার মধ্য থেকে শানের বস এই কথাটা বলল। বাকি দুজন রিয়াদ ভাই ও ডিআইজি স্যারও অবাক হয়ে চেয়ে আছে।
শান একটু আগে তাদের সেই বাস কাউন্টারের ঠিকানা দিয়ে আসতে বলেছে। সেখানে আসলেই শান তাদের অবাক করে দিয়ে লাঠি চশমা ফেলে এগিয়ে যায় সামনে। আর এখন তারা সামনের একটি চা দোকানে বসে আছে মুখোমুখি হয়ে।
‘আমি জানি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করবেন। কিন্তু আমি নিরূপায় ছিলাম।আর ডিআইজি স্যার, আপনি হয়ত আমাকে এখন খু’নি ভাববেন। কিন্তু আমি নির্দোষ, বিশ্বাস করুন। উপরওয়ালা চাইলে আর কিছু সময় পরই আমার সত্যতা প্রমাণ হবে ।’
‘মানে কি বলতে চাইছো তুমি!!’
শান ওদের প্রথম থেকে বলা শুরু করলো। তার বিদেশ থেকে আসা হতে এখন পর্যন্ত কি কি হয়েছে। তার অন্ধ হওয়ার কারণ সব। আর আজ একটু পর বাসের অপেক্ষা কেন করা হচ্ছে, কেন তাদের এখানে ডেকে আনা হল সব খুলে বলল।
‘আসলে স্যার আমি জানি আজ হয়ত আ’ইনি সাহায্য না নিলে তাদের ধরেও কিছু করতে পারবো না। তাই আপনাকে ডাকা।’
‘হুম বুঝেছি তোমার কথা। যদিও আইন আমাকে এমন করার অনুমতি দেয়না, তবুও তোমার সততা দেখে আমরা সবাই তোমার সাহায্য করব।’
‘অনেক ধন্যবাদ স্যার। আর রিয়াদ ভাই, বস, আপনারাও আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আসলে পুতুলকে সাব্বিরের সাথে হাতে নাতে ধরতেই আমার এসব করা।’
রিয়াদ ভাই শানকে জড়িয়ে ধরল। ‘জানি আমি ভাই কতটা কষ্ট সহ্য করলে মানুষ এমন করতে পারে। আমরা আপনার পাশে আছি।’
শানের বস বলল,’কিন্তু মিথিলা কোথায় গেলো শান? সেটা কি খোজ খবর করা উচিত নয়?’
‘হ্যা স্যার। কিন্তু এখন আর মাত্র এক ঘন্টা আছে। এখান থেকে গেলে এই সুযোগ আর পরে আসবে না।’
‘ঠিক বলেছো।’
———-
গাড়ি ছাড়তে আর মাত্র ১০ মিনিট দেড়ি। বাস থেমে আছে, যাত্রী প্রায় সবাই উঠে পড়েছে কিন্তু পুতুলের মা বাবার কোন দেখা নেই।
শান সহ বাকি তিনজন রাস্তার অপর পাশে সামনের একটা দোকানে ঘুপটি মেরে আছে। দৃষ্টি বাস কাউন্টার টির দিকে।
হঠাৎ শান দেখলো পুতুলের বাবা একটি ব্যাগ হাতে আসছে। আর পিছনে,,,
পিছনে বোরকা পড়া দুই মহিলা। বাস কাউন্টারে আসা মাত্রই শানরা সবাই আচমকা তাদের ঘিরে ধরল।
শানকে দেখেই পুতুলের বাবা ভয় পেয়ে গেল। স্থির হয়ে দাড়িয়েছে সে।
তবে শানের লক্ষ্য পিছনের মহিলা। সে পুতুলের বাবাকে পাশ কাটাতেই আরেকটা বোরকা পড়া মহিলা তার পথ আটকালো।
‘তুমি! এখানে কি চাই??’ গলার কন্ঠে বুঝলো এটা পুতুলের মা। শান সে কথায় পাত্তা না গিয়ে পিছনের মেয়ের দিকে এগোচ্ছে। মেয়েটি কেমন অস্থির আচরণ করছে।
শান যতই যাচ্ছে মেয়েটি পিছনে যাচ্ছে ততই৷ শান হট করে মেয়েটির মোজা পড়া হাত ধরে ফেলল। কিন্তু একি!!
এটা তো মানুষের হাত না, কি শক্ত, লোহার মত আর কি ভারী!!
শান হাত ধরা মাত্রই মেয়েটি দৌড় দিল। এক সেকেন্ডের মাঝে যেন শান সম্বিত হারালো। সে দেখলো হাতটি তার হাতে খুলে রয়ে গেছে। আর বেরিয়ে পড়েছে সেই হাড় যা সকালে এন্টিক দোকানটিতে দেখেছিলো তারা।
কিন্তু এখন বিলম্ব করার সময় নয়। এক ছুটে গিয়ে সে পিছনে দৌড়াতে থাকা মেয়েটিকে ধরে ফেলল৷ অবশ্য বেশিদূর যেতে পারতো না সে। কারণ সামনে রিয়াদ ভাই ছিল।
মেয়েটির বাম হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে শান। এবার সামনের পর্দা খুলে তার পরিচয় জানার পালা। মুখ বের করতেই যাকে দেখতে পেল তাকে দেখে শান সহ বাকি তিনজনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
‘তুমি!!!’
———–
পুলিশ স্টেশনে বসে আছে শান সহ বাকি সবাই। বাইরে বাকি পুলিশরাও ভেতরের দৃশ্য দেখছে অবাক চোখে। পুতুলের মা বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে
ক্রুদ্ধ চোখে সামনের ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল শান,
‘কেন আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করলে পুতুল!!!!!’
হ্যা, সামনে বসে থাকা বোরকা পড়া মেয়েটি আর কেউ নয়, সেই পুতুলই। চুপ করে আছে সে। কিছুই বলছে না।
‘এখন লুকিয়েও কোনো লাভ নেই পুতুল। যা বলার সত্যি বলে দাও। কেন এরকমটা করলে!!!’
এতসময় পর পুতুল বলা শুরু করলো,
‘সেদিন বিকেলে সাব্বির এসে আমাকে দোষী ভেবে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। সে তার সকল ক্ষতির লোকশান চায়, বলে আমাকেই দিতে হবে নাহলে আমার আর তার ভিডিও সে ভাইরাল করে দেবে। তার কথায় এটাও জানতে পারি যে সে আসলেই মাদকের ব্যবসায় জড়িত ছিল।
আমি ভয় পেয়ে যাই। সাব্বির যাওয়ার পর কি করব চিন্তাই করছিলাম তখনই বাসার কলিংবেল বাজে। দেখি বাবা মা এসেছে আমার, কিন্তু একা না, সাথে এসেছে আরেকটা মেয়ে, নাম সপ্না। সপ্নাকে বাবা মা নিয়ে এসেছিল আমাদের বাসায় কাজ করার জন্য। তারা জানত, তুমি অন্ধ আর আমিও অফিসে যাই তাই কাজের লোক দরকার হবে হয়ত।
বাবা মাকে দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। তাদের সব বলি। তারপর তিনজন মিলে অনেক ভাবার পর এই ভয়ানক প্ল্যান বানাই।
সেদিন রাতে খাবারে ঘুমের মেডিসিন দিয়ে আগে সপ্নাকে খাওয়াই। সে ঘুমিয়ে পড়লে তাকে বাবা মা উঠিয়ে তোমার বাবা মার রুমে লুকিয়ে রাখে, সাথে তারাও লুকিয়ে থাকে।
তুমি আসলে তোমাকে ওষুধ খাইয়ে তোমার কাছে ভাল সাজি যেন তুমি আমার উপর সন্দেহ না করো পরে।
তুমি বেলকনিতে ঘুমানোর পর বাবা মা সপ্নাকে নিয়ে রুমে আসে, ওর দেহ কেটে পিছ পিছ করে আগুন জালিয়ে দেই, সাথে আমার পড়া শাড়িটাও। যেন তুমি বুঝো সেটা আমি। আরো প্রমান রাখতে খুব কষ্টের একটা কাজ করতে হয় আমাকে। নিজের হাতও কাটতে হয়। অবশ্য এর ভিতরে বাবা বাইরে দিয়ে অবশ করার ইনজেকশন এসেছিল। সেই হাতটা কেটে পাশে দেখে দেয় বাবা। আমি রক্ত আর কাটা হাত দেখে জ্ঞান হারাই।
তাই বাবা মা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় বাসা থেকে। এর পর সকালে কি হয় সেটা তো তুমি জানো।
কিন্তু একটা ভুল হয়ে যায়, আমাকে ধরে রুম থেকে নেয়ার সময় আমার বাবার হাতের আংটিটা
খুলে পড়ে যেটা আমরা পরের দিন বুঝি।
পরের দিন সাব্বিরের সাথে দেখা করতে চাই আমি। সাব্বির আসলে তাকে কথার ছলে ভুলিয়ে সে অন্যমনস্ক হলে মাথায় মেরে হত্যা করি। আমার ডান হাত কাটা বিধায় বাম হাত দিয়ে মারতে হয়েছিল। সাথে আমার বাবাও ছিল। সেদিনই আমি আর মা বোরকা পড়ে গিয়ে এই নকল হাতটা
কিনে আনি তোমার নামে মেমো করে।
রাতে বাবার সেই আংটি খুজতে লুকিয়ে বাসায় যাই, কারণ বাসার এক্সট্রা চাবি তো আমার কাছে ছিলই। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ তুমি চলে আসো। তবে আমাকে নিজের কল্পনা মনে করতে থাক, সেসময় আমি বেলকনিতে লুকাই। ভাগ্য ভাল আমার সেদিন তুমি বেলকনিতে দেখোনি। সেদিন আমার আরো প্ল্যান ছিল। তোমার নতুন বউকে মারা। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে সেদিন আর তোমার রুমে যাইনি। কারন তুমি সজাগ ছিলে। বাবার আংটিটা না পেয়েই চলে আসি আমি।
পরদিন রাতে আবার যাই। আংটিটা খুজেও পাইনি, খুজবো কিন্তু তোমার বাবা দেখে ফেলে, তাকে ক্লোরোফম দিয়ে অজ্ঞান করে মাথায় আমার এই হাড়ের হাত দিয়েই জোড়ে প্রহার করি। কিন্তু সেটাই বোকামি হয়েছে। আমার হাতটা একটু ভেঙে পড়ে। অবশেষে প্রমাণ পাওয়া যাবে এই ভয়ে সব কিছু ছেড়ে দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করি আমরা।
সাব্বিরকে মারার সময় তার এটিএম কার্ড সহ সবকিছু নিয়ে আসি। প্ল্যান ছিল যশোরের বেনাপোল গিয়ে সেখান থেকে টাকা তুলে দেশ ত্যাগ করবো বর্ডার পাড় হয়ে,, কিন্তু……””’
‘কিন্তু কি পুতুল!! পারলেনা তো? পারতেও না। আমার ভালোবাসাকে ধোকা দিয়েছো। এর ফল তো তোমাকে ভোগ করতেই হত। আমার ভালোবাসাকে খুন করে সাধ মেটেনি! মানুষ খুন করতেও পিছপা হলে না!! আমার বাবা যে তোমাকে মেয়ের আদর দিয়েছে তাকেও মারতে চেয়েছো? ছি!!’
ডি আই জি স্যার শানকে থামিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। পুতুলের পরিবারের ফাসিই হবে। দুইটা মানু্ষ হ’ত্যা ও একজনকে এটেম্প টু মার্ডারের চেষ্টা করেছে। বাচার কোনো পথ নেই আর বাচানোর কোনো লোকও নেই।
‘স্যার আমিও তো দায়ী।’
‘কেন শান!’
‘আমি তো সাব্বিরকে ফাসাতে চেষ্টা,,,,’
‘চুপ করো, আমাকে বলেছো, আর কাউকে বলোনা। তাছাড়া তুমি শুনলেনা? সাব্বির তো আগে থেকেই মাদক ব্যবসায়ী ছিল। আর তার মরে যাওয়ার পর তো সেই কেস ক্লোজও হয়ে গেছে। যাও পরিবারের কাছে যাও।’
‘স্যার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
‘তুমি আমার ছেলের মত শান। যাও এবার বৌমাকে খুজো গিয়ে। সমস্যা করে আমাকে ফোন করবে।’
‘জি স্যার।’ শানের মিথিলার কথা মনেই ছিল না।
আর মিথিলা যে এসবে জড়িত নয় এটা জেনে শানের খুব খুশি হল। কিন্তু মিথিলার থেকে অনেক কথা জানার বাকি আছে শানের। কারন মিথিলার শাড়ি পাওয়া গেছে।
——–
রিয়াদ ভাই আর বসকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে গেল শান। আজ আর লাঠি চশমা পড়ে নয়। স্বাভাবিক হয়ে।
‘বাবা তুই দেখতে পারছিস?’ শানকে দেখা মাত্রই তার মা ছুটে আসলো তার কাছে। তার বাবাও পিছনে থেকে অবাক চোখে তাকিয়ে।
‘মা আমি তো বিদেশ থেকে ফেরা হতেই দেখতে পাই।’
‘মানে!!’
‘সব কিছুর সমাধান হয়েছে মা।’ বলে সব কিছু খুলে বলল শান তার মা বাবাকে।
সকল কাহিনী শুনে তার মা বাবাও আশ্চর্য।
‘এতো কিছু করেছে ওই মেয়ে!!!’ শানের বাবা বলল।
‘হ্যা বাবা।’
‘তুই চোখে দেখতে পাস, এর থেকে ভাল খবর আর কিছুই হতে পারে না আমাদের জন্য। কিন্তু বাবা আমাদের তো বলতে পারতি তোর একথা। আমরা কি বলতাম নাকি কাউকে?’ শানের মা শানকে জড়িয়ে রেখেছে। শানের বাবাও ছেলের চোখে দেখতে পাওয়ার খবরে খুব খুশি।
‘মা বাদ দাও পুরাতন কথা। মিথিলা কোথায় গেল মা? ও আসেনি কেনো?’
‘হ্যা বাবা আমিও সেটাই ভাবছি। মেয়েটা কোথায় গেল।’
—-
মিথিলাকে খুজার জন্য হাসপাতাল থেকে বেড়বে তখনই দেখে মিথিলা একটা রিক্সা থেকে নেমে এলোমেলো ভাবে হেটে হাসপাতালের দিকেই আসছে। হয়ত অতিরিক্ত দুর্বল শরীর তাই।
পড়ে যাবে ওমনিই শান ধরে ফেলল মিথিলাকে।
মিথিলা চোখ বন্ধ করে ছিল ভয়ে।
‘মিথু!!!’
শানের আওয়াজ শুনে মিথিলা চোখ খুললো। শানকে দেখেই কেদে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
কিন্তু হঠাৎ যেন অভিমান ডানা বাধলো তার। শানের কাধ থেকে হাত ছাড়িয়ে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল সে।
শান অবাক হচ্ছে যে, মিথিলা সে চোখে দেখতে পারছে জেনেও আশ্চর্য হচ্ছে না কেনো?’
শান বিলম্ব না করে তাকে কোলে তুলে নিল। হাসপাতালের কেবিনে এনে তারপর শুইয়ে রাখলো। সবাই রুমে জড়ো হয়েছে তখন।
‘কোথায় গেছিলে মিথু?’
মিথিলা চুপ।
শানের মা এসে এবার তার পাশে বসল। শানের বাবাও মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে এসেছে বেডের পাশে। রিয়াদ আর শানের বসও পেছনে।
‘মা চুপ কেন? বলো কোথায় গেছিলে?’
মিথিলা কান্না কান্না স্বরে বলল,’বাবা মা আপনাদের ছেলে আমাকে সন্দেহ করেছে।’
শানের বাবা মা রেগে শানের দিকে তাকালো।
শান চুপ করে আছে।
‘আচ্ছা মিথু, তুমি জানতে যে আমি দেখতে পাই?’ শানের প্রশ্নে সবাই অবাক হল।
‘আমার প্রথম থেকে বলতে হবে সব। শুনবেন?’
‘হ্যা মিথিলা বলো।’
‘আমি আপনাকে ৪ বছর ধরে চিনি, ভালোবাসি।’
‘মানে!!!’
মিথিলা তার সাথে নিয়ে আসা ছোট্ট ব্যাগটা খুলে একটা শার্ট বের করল।
‘দেখুন তো চিনতে পারেন নাকি?’
শার্টটা দেখে শান অবাক। অনেক পুরাতন হলেও শার্টটা তার নিজের। কিন্তু কোথায় এটা রেখেছিল, শার্টটা কোথায় গেল মনে করতে পারছে না।
‘এটা তো আমার,,,,’
‘৪ বছর আগে নবাবগঞ্জ থাকার সময় এক সন্ধ্যায় আপনি কিছু বখাটে ছেলের হাত থেকে একটা মেয়ের ইজ্জত বাচিয়েছিলেন মনে আছে? তার বোরকার হাতার দিকটা ছিড়ে গেছিলো বলে আপনি নিজের শার্ট খুলে পড়িয়ে দিয়েছিলেন?”
‘হ্যা, মনে পড়ছে।’
‘আমিই সেই মেয়ে।’
‘কি!!’
‘আমার তো তখন বয়স আরো কম, ১৫ কি ১৬ হবে। হয়ত ভালোবাসা বুঝতাম না, কিন্তু আমার আবেগ সেদিন থেকে আপনি। আমাকে কেউ ভালোবাসতো না, বখাটেগুলো থেকে বাচিয়ে আপনি যখন আমাকে বুকে জড়ালেন ভয় পেয়েছি বলে, তখন জীবনে প্রথম মনে হয়েছিল আমার একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল আছে। সেদিন হয়ত আমার চেহারা আপনি দেখেননি কিন্তু আপনার চেহারা আমার এই মনে গেথে গেছিলো।
আমার বান্ধবীরা এসে যাওয়ায় আপনি তাদের কাছে দিয়ে আমাকে রেখে যান। তারপর প্রায় প্রতিদিন সেই স্কুল থেকে আসার সময় যাওয়ার সময় রাস্তায় আপনাকে খুজতাম। কিন্তু পাইনি, দিনশেষে মামীর হাজারো অত্যাচারের পর এই শার্টটাই ছিল একমাত্র আশ্রয়স্থল। এই শার্ট বুকে নিতেই মনে হত আপনি আমার কাছে আছেন।
একদিন হঠাৎ আপনাকে রাস্তায় দেখে স্কুল কামাই দিয়ে আপনাকে ফলো করি। আপনার অফিসের ঠিকানা পাই। এরপর থেকে প্রতিদিনই দূর থেকে দেখতাম আপনাকে। কিন্তু কাছে যাইনি, মনে করতাম আমি যে অনাথ, আর অনাথকে কি কেউ ভালোবাসবে? মেনে নেবে তার পরিবার? মামী বলত এই অনাথকে বিয়ে করবে কে? কি আছে এর। এরকম দূর থেকে দেখতাম প্রতিদিন। চলতেই থাকলো এই দেখা।
তারপর একদিন আপনি অফিসে আসেন না। পরদিনও না। এভাবে দশদিন আপনাকে না পেয়ে অফিসে যাই। আপনার নামও তো জানতাম না। চেহারার বর্ণনা দিতেই বলে আপনার বদলি হয়েছে। জীবন আমাকে বাচার উৎস দিয়েও কেড়ে নিল এভাবে। আবার আমি মনমরা হয়ে গেছিলাম।
অবশেষে আমার মামারও বদলি হল ঢাকায়। কিন্তু ভয় হত, আপনি তো অন্য কাউকে বেছে নিতেও পারেন এই জীবনে। কে জানত আমার ভাবনাই সত্যি হবে।
কিন্তু কি ভাগ্য দেখুন, আপনার ঠিক পাশের বাসায় ভাড়া নেয়া হল আমাদের। হঠাৎ একদিন বেলকনি থেকে আপনাকে দেখলাম। আপনি সেদিন হয়ত বিদেশ থেকে আসছিলেন। আপনাকে দেখে নিচে নেমে আপনার কাছে যাব, তখনই দেখি আপনি লাঠি বের করে চশমা পড়ে অন্ধের অভিনয় করলেন। আমি অবাক। এই এক সেকেন্ড আগেও তো ভাল ছিলেন আপনি। তাহলে!! তার কিছু মুহুর্ত পরই একটা মেয়ে আপনাকে এসে জড়িয়ে ধরে। আমার যেন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন। সব পেয়েও হারালাম আমি। জানতে পারি আপনি বিবাহিত।
কিন্তু আপনার এই অন্ধের নাটকে আমার খটকা লাগে। তার পরদিন ইচ্ছা করে আপনার সাথে ধাক্কা লাগাই৷ এর পর থেকে তো জানেন, কখনো চাইতে, কখনো না চাইতেও আমার আপনার সাথে দেখা হয়। প্রতিরাতে বেলকনি থেকে দেখতাম আপনি ভাল সেজে অফিস থেকে বাড়িতে ঢোকার আগ মুহুর্তে আবার অন্ধের অভিনয় করতেন। আপনার সাথে মিশে কারণ জানার চেষ্টা করি কিন্তু আপনি কিছুই বলতেন না।
তারপর হঠাৎ এক রাতে দেখি আপনার স্ত্রীর সাথে কিছু কথা হচ্ছে বেলকনিতে। আপনি তাকে দরজার অপাশে রেখে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন চেয়ারে। সারারাত আপনাকে আমি দেখেছি নিজে না ঘুমিয়ে। কিন্তু ভোরের দিকে দেখি রুমের জানালা দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে। ছুটে যাই আমি। আমার দেখা দেখি অন্যরাও আসে। তখনো আপনি ঘুমিয়েই ছিলেন। তারপর সব জানার পর আমার সন্দেহ আরো প্রবল হয়। কেউ আপনাকে ফাসাতে চাচ্ছে। কারণ
আপনি তো আমার সামনেই ঘুমিয়ে ছিলেন সারারাত।
আপনাকে এভাবে রেখে একা কেমন করে আসব? সারাদিন সাথেই ছিলাম আপনার। মামী আমাকে বিয়ে দিতে চাইলে আমার সব আশা যেন ভেঙে গেল। কিন্তু যখন মামাকে সব বলার পর আপনি আসলেন আর বিয়ে হল আমাদের, বিশ্বাস করুন,এই জীবনে ওতটা খুশি আমি আগে কখনো হইনি।
সেদিন রাতে আমিও অই ঘরে গেছিলাম নিজের মত খুজতে। একটা আংটি খুজেও পাই। আপনাকে সেদিন রাতে বলব বলব করে বলা হয়নি তার আগেই বাবার এই অবস্থা।’
মিথিলা ব্যাগ থেকে আংটিটাও বের করল।
‘অহ সেই জন্য হয়ত তোমার শাড়ির একটা অংশ লেগে গেছিলো আসার সময়।’
‘জানিনা, হয়ত খেয়াল করিনি।’
শানের কাছে এবার সব ক্লিয়ার। রিয়াদ ভাইকে আংটিটা দিল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার জন্য।
শান উপরওয়ালাকে হাজারো ধন্যবাদ দিচ্ছে এরকম একজনকে তার জীবনে আনার জন্য। তার মা বাবা তো মিথিলার কথা শুনে তাকে এখন পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এত ভালোবাসতেও
কেউ পারে??
——
মিথিলা এখনো মুখ ফুলিয়ে আছে। শান অইভাবেই খাইয়ে দিচ্ছে তাকে নিজের হাতে। ঘরে তারা দুইজনই আছে। সবাই চলে গেছে। শানের মা বাবা পাশের রুমে, শানের বাবাকে যে রুমে শিফট করা হয়েছিল সেই রুমে।
‘অভিমান পরেও করতে পারবে, আমার উপর রাগ
সারাজীবন দেখাতে পারবে। আগে খেয়ে দেয়ে সুস্থ তো হয়ে নাও।’
মিথিলা একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার অন্যদিকে ফিরল।
‘আচ্ছা এরকম করলে আরজে শানের মেয়ে ফ্যানের অভাব নেই।’
কথা শোনা মাত্রই শানকে এক খামছি দিল মিথিলা৷ খামচি দিয়ে ধরেই আছে। শান ব্যাথা পেলেও মুচকি হাসছে।
‘আমাকে এক টুকরো শাড়ির জন্য অবিশ্বাস করতে পারলেন আপনি!!’
‘সরি বউ। তাছাড়া তুমিও তো বলোনি আমাকে যে তুমি জানো আমি দেখতে পাই!!’
‘এক টুকরো কাপড়েই এরকম আর সেটা বললে তো ফাসি দিয়ে দিতেন।’
‘বউ ব্যাথা লাগছে কিন্তু!!’
মিথিলা সাথে সাথে ছেড়ে দিল শানকে। নখের দাগ বসে আছে। নিজেই হাতটা নিয়ে ফু দিতে লাগলো।
‘মেরে আবার আসছে এখন।’
মিথিলা কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,’আর অবিশ্বাস করবেন?’
‘না না কোনোদিন না। আগে খেয়ে নাও,” আরো এক লোকমা মিথিলার মুখে তুলে দিল শান।
খাওয়ানো শেষ করে নিজেও সামান্য খেয়ে মিথিলার পাশে বেডে বসেছে শান। মিথিলা তার মাথা শানের কাধে রাখলো।
‘উপরওয়ালা সবার ভাগ্যে একজনকেই ঠিক করে রাখে। তাইতো সব কিছুর পরও আমি তোমাকে পেলাম মিথু।’
‘আমিও ভাবিনি আপনাকে পাবো আমার জীবনে।’
মিথিলার হাত নিজের হাতের ভাজে নিল শান। মিথিলাকে নিজের আরো কাছে আগলে ধরল৷ মিথিলাও পরম আবেশে শানের বুকে মাথা রাখলো। মিথিলার মাথায় অধর ছুইয়ে শান বলল,
‘মিথু, হয়ত আমাদের এ জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এই ছোট্ট জীবনে যে সংসার নামক #তাসের_ঘরে_তুমি_আমি বন্দী হয়েছি, সেটা দীর্ঘস্থায়ী করার দায়িত্ব শুধু আমাদের, আমাদের ভালোবাসার।’
মিথিলা বিনিময়ে তার ভালোবাসার মানুষটির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিল।
সমাপ্ত