#আধারে_তুমি,#পর্বঃ ০১
#লেখিকা– মার্জিয়া রহমান হিমা
“আমার বাবাকে বিনা অপরাধে থানায় তুলে আনা হয়েছে কেনো মিস্টার শান চৌধুরী ?”
পরিচিত কর্কশ গলার আওয়াজ শুনে শান মাথা তুলে থাকায়। সোহাকে অগ্নিরূপে দেখে শানের ভ্রু কুঁচকে আসে। শান কিছুটা অবাক হয়েই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সোহাকে
” মানে ? আমি কেনো আপনার বাবাকে থানায় তুলে আনবো ? কেউ সেচ্ছায় আসলে সেটাকে তুলে আনা বলা হয় না সেটা জানা নেই আপনার ? আচ্ছা ! মাথা কি অপারেশন করে নষ্ট করেছেন নাকি বাড়ির দেয়ালে ঠুকে ঠুকে ?” শানের ঠাট্টার স্বরে বলা কথা গুলো শুনে সোহা আরো রেগে গেলো। সোহা চেঁচিয়ে বলে উঠে
” সমস্যা কি আপনার ? একে তো আমার বাবাকে বিনা অপরাধে থানায় নিয়ে এসেছেন আবার এখন আমার সাথে ঠাট্টা তামাসা করছেন আপনি ?”
শানের চোখ মুখের গঠন শক্ত হয়ে যায় সোহার চিৎকার শুনে। শান নিজেকে শান্ত করে। পূর্বের মতো নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো। ডেস্কের উপর রাখা ফোন থেকে একজনকে কল করে তার কেবিনে আসতে বলে। শানের ইগনোর সোহার রাগকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলছে। সোহা এবার রেগে ডেস্কের উপর জোড়ে থাপ্পড় দিয়ে বসে। শান শান্ত চাহনি দিয়ে সোহার দিকে তাকায়। সোহা রেগে গরগর করে বলে
” আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন কেনো ? আমার বাবাকে কেনো এখানে আনা হয়েছে জানতে চাই আমি। আমাকে এখনই নিয়ে চলুন বাবার কাছে।” শান কিছুক্ষণের জন্য সোহার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে বসে ফাইল দেখতে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ পরিহিতা শানের বয়সি একজন ছেলে এসে শানের কেবিনের দরজায় এসে দাঁড়ায়। শান তাকে ভেতরে আসতে বলে। সোহা ছেলেটাকে ভালো করেই চেনে। তাই শান কিছু বলার আগেই সোহা ইমনের কাছে ছুটে যায়। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠে
” ভাইয়া ! আমার বাবা কোথায় ? বাবার কাছে নিয়ে চলো না !” ইমন শানের দিকে তাকাতেই দেখে ছোট ছোট চোখে সোহার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমন মুখ টিপে হেসে বলে
” সোহা তুমি এখানে বসো শান তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবে।” সোহা নাক টেনে নাক ফুলিয়ে বললো
” না বজ্জাত লোকটা কিছু বলবে না। এতোক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করছি আমি তাকে কিন্তু সে একটা কথাও বললো না আমাকে। উল্টো মজা করছে আমার সাথে ! পুলিশ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন তিনি ? আমার বাবাকে নিয়ে এসেছে কিন্তু আমাকে বলছে তিনি আমার বাবাকে নিয়ে আসেনি !”
শান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে
” আমার কেবিনে আপনার মুখ থেকে আর একটা কথা বের হলে আপনাকে এখন জেলে ঢুকিয়ে দেবো। মাইন্ড ইট !” শানের গম্ভীর কন্ঠের কাছে সোহার এতোক্ষণের এতো রাগ নিমিষেই পানির মতো গলে গেলো। সোহা কোণা চোখে একবার শানকে দেখে ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে থাকে।
শান সোহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে
” চলুন আমার সাথে।” শান আর ইমন সোহাকে নিয়ে একটা রুমের ভেতরে ঢোকে। সোহা ঢুকেই দেখতে পেলো একটা বড় টেবিলের দুইপাশে তিনজন বসে রয়েছে। একজন ইমতিয়াজ রহমান এবং তারপাশে একজন পুলিশ অফিসার অন্যপাশে ইমতিয়াজ রহমানের অফিসের বিশ্বস্ত লোক যিনি ম্যানেজার পদে কাজ করতেন প্রায় কয়েক বছর যাবত। তার হাতে হাত কড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে। সোহা অবাক হয়ে বলে উঠে
” এসব কি ?” ইমতিয়াজ রহমান সোহাকে দেখে চমকে উঠে। ইমতিয়াজ রহমান তাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে শান্ত গলায় বলে উঠে
” সোহা তুমি এখানে কি করছো ?”
সোহা এগিয়ে এসে বাবার কাছে দাঁড়ায়। ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে বললো
” বাবা আমি কলেজ থেকে বাড়িতে এসে দেখি মা আর শষী কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলে তোমাকে নাকি উনি থানায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।”
শানকে দেখিয়ে কথাটা বললো সোহা। ইমতিয়াজ রহমান মাথা নেড়ে বলে
” ঠিকাছে তুমি এখন বাইরে গিয়ে বসো আমি এসে সব এক্সপ্লেইন করছি।”
সোহা মাথা নেড়ে বেড়িয়ে গেলো। শান আর ইমনও চলে গেলো। দুজন বেরিয়ে এসে দেখে সোহা ভিডিও কলে কথা বলছে কারো সাথে আর খুবই এক্সাইটেড হয়ে রয়েছে। শান বিরক্তির স্বরে বলে
” এই পাগল মেয়ে যে কি কি করে ! আমার মাথায়ই ঢুকে না। একটু আগে তুলকালাম বাধাতেন ম্যাডাম ! আর এখন দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে খেতে এসেছে।” ইমন আলতো হেসে বলে
” জানিসই তো মেয়েটা এমন ! তাহলে বিরক্ত হচ্ছিস কেনো ?” শান কিছু না বলে সোহার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সোহা শানকে দেখে ভয় পেয়ে ফোনের কল কেটে দেয়। শান গম্ভীর কন্ঠে বলে
” প্রবলেম কি তোমার ? থানাটা কি ভিডিও কল করার জায়গা ? নাকি এটাকে পার্ক মনে হচ্ছে আপনার ?” সোহা শানের তুমি আর আপনি বলে সম্মোধন করার মাঝেই কনফিউজড হয়ে গেলো বরাবরের মতো। সোহা গলা ঝেড়ে আমতা আমতা করে বলে
” আপনি আগে ঠিক করুন আমাকে তুমি নাকি আপনি বলবেন ! প্রত্যেকবার এই তুমি, আপনিতেই আমাকে কনফিউজড করে ঝুলিয়ে রাখেন কেনো ?” শান দাঁত কিড়মিড় করে বলে
” আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো। তোমার সমস্যা কোথায়? আমার কাজ নিয়ে কথা বললে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সোহা জেলে ঢোকাবো। মাথায় রেখো এই থানা আমার আন্ডারে চলে। যা ইচ্ছে সব করতে পারবো।”
সোহা রেগে তেতে উঠে বললো
” আপনার সমস্যা কি সেটা বলুন আমাকে ! যেখানেই যাই করি না কেনো আমার সব কিছুতেই দেখি আপনার প্রবলেম ! আর সব সময় এমন রেগে থাকেন আমার সাথে ? আমি কি চোর? নাকি খুনি ? আর কথায় কথায় পুলিশের ভয় কাকে দেখান ? আপনাকে কানে ধরিয়ে ঘোরাতে পারবো আমি আর সেই আপনি আমাকে জেলে ঢোকাবেন ? সাহস কতো বড় আপনার ?”
শান রেগে চোখ বড় বড় করে তাকায়। শানের চোখ রাঙানো দেখে সোহার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। সোহা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে শানের দিকে তাকিয়েই ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলে
” ভাইয়া আমি বাইরে যাচ্ছি। বাবার কাজ শেষ হলে বলবেন আমি বাইরেই বসে আছি।” সোহা এক প্রকার দৌড়েই দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। ইমন হেসে বলে
” তুই কেবিনে গিয়ে কাজ কর আমি কফি খেয়ে আসছি।” শান কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বলে
” বাদরটাকে চোখে চোখে রাখিস।” ইমন মিটমিট করে হেসে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ রহমান শানের কেবিনে নক করে ভেতরে ঢুকলো। শান মুচকি হেসে ইমতিয়াজ রহমানকে বসতে বলে। ইমতিয়াজ রহমান চেয়ারে বসেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো
” যাকে এতো বছর ধরে এতো বিশ্বাস করে একটা সম্মানজনক জায়গা দিয়েছিলাম সেই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আমার সব বিশ্বাসই ভেঙে গিয়েছে। একটু টাকার লোভের জন্য আমার কোম্পানির এতো বড় লস করিয়ে দিলো।” শান নিঃশব্দে দীর্ঘ নিশ্বাফেলে নেয়। ইমতিয়াজ রহমানকে কিছু বলে শান্তনা দেওয়ার মতো তার কাছে কোনো কথা নেই। শান ভালো করেই জানে ইমতিয়াজ রহমান খুবই শান্ত আর বুদ্ধিমান ব্যাক্তি। যাই হয়ে যাক না কেনো তিনি বাস্তবতাকে খুব সহজে মানিয়ে নিতে পারে।
” আংকেল এসব নিয়ে আর ভাববেন না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এবার থেকে কাউকে এতো বিশ্বাস করার আগে ভেবে চিনতে ডিসিশন নেবেন।” ইমতিয়াজ রহমান হেসে বলে
” তা আর বলতে ? আর তোমাকেও ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। মাত্র দুইদিনে আমার প্রবলেম সলভ করে দিলে। আমি খুব খুশি হয়েছি।”
শান হেসে বলে
” আমি তো আমার কাজ করেছি কিন্তু আপনার মেয়ে তো আমাকে রিতিমতো উল্টোপাল্টা দোষারোপ করে গেলো।” ইমতিয়াজ রহমান শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলে
” তুমি তো জানোই আমার বাড়ির কাজের মেয়ে শষীকে। যা হবে সেটা না বুঝেই সোহার মাকে উল্টো পাল্টা কথা বলবে আর দুজন কিছু না জেনে কান্না কাটি করবে।” শান হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। ইমতিয়াজ রহমান আরো কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসতে থাকে। শান উঠে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। যাওয়ার আগে ইমতিয়াজ রহমানকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে।
বাইরে আসতেই দুজন হতবাক হয়ে গেলো। সোহা একটা পাগল লোকের সাথে পুরো থানায় চক্কর দিচ্ছে। পাগল লোকের সাথে চক্কর দিচ্ছে বললে ভুল হবে। পাগল লোকটাই সোহাকে ধরার জন্য সোহার পেছনে দৌড়চ্ছে আর সোহা ভয়ে প্রাণপণ দৌড়চ্ছে আর চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ইমন আর একজন কনস্টবল পাগল লোকটাকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু লোকটাকে ধরা অতোটা সহজ নয়।
শানও প্রচণ্ড বিরক্ত হলো পাগলের উপর। পুলিশের চাকড়ি হওয়ার পর থেকেই পাগলকে এখানে দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই এমন ব্যবহার করে সবাইকে উত্তপ্ত করে তোলে। কয়েকবার পাগলা গারদে পাঠানোর পর পালিয়ে আসেবারবার তাই সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। সোহা দৌড়তে দৌড়তে শানের পেছনে এসে লুকায়। সোহা তো পারলে এখনি কেঁদে দেবে এমন অবস্থা। পাগলটা শানের সামনে এসে পাগলের মতো বিলাপ করতে করতে বলে
” দে দে ! আমার বউ রে আমার কাছে দে। সর সর !” শান ভাবলো সোহার সাথে একটু মজা করবে তাই পাগলকে বলে
” এটাও আপনার বউ ? যাকে দেখবেন তাকেই কি নিজের বউ বানিয়ে ফেলবেন নাকি ? অন্যকারোর জন্যও তো কোনো বউ বাঁচিয়ে রাখুন! এক কাজ করুন আপনি ওকে নিয়ে জান আর অন্য কাউকে বউ বানানোর দরকার নেই। এই মেয়েই আপনার বউ হয়ে থাকবে।”
পাগল শানের পেছনে যেতে যেতে বলে
” দে, দে আমার বউ, আমার বউ এডা।” সোহা সাথে সাথে দৌঁড়ে শানের সামনে এসে পড়ে। শান মজার স্বরে সোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে
” মিস সোহা ! আপনার জন্য কষ্ট করে একটা লাইফ পার্টনার খুঁজে পেলাম আমাকে ট্রিট দেবেন কিন্তু ! আপনি যেমন আপনার হাজবেন্ডও তেমন। বাদর পাগলের সঙ্গী।”
সোহা ভয়ে কাঁপছে পাগলে দেখে। শানের কথা শুনে কাঁদোকাঁদো হয়ে রাগ দেখিয়ে বলে
” মজা করছেন আমার সাথে আপনি ? আমাকে না বাঁচিয়ে কি শুরু করেছেন ? আমি কোথাও যাবো না এই পাগলের সাথে।”
হুট করে পাগল এসে সোহার হাত ধরে ফেলে সোহা চিৎকার করে কেঁদে দেয়। ইমনরা ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু পাগলটা কোনো মতেই ছাড়ছে না সোহার হাত। ইমন শানের কাছে এসে বিরক্ত হয়ে বলে
” আমার তো মনে হচ্ছে তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস। পাগলকে চিনিস না তুই ? যেকোনো সময় সোহাকে আঘাত করে বসবে। আমরাই এর থেকে দূড়ে দূড়ে থাকি আর তুই পাগলকে উস্কানি দিচ্ছিস সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ? এবার কিভাবে বাঁচাবি সোহাকে সেটা দেখ।”
সোহা কোনো রকমেই যাচ্ছে না পাগলের সাথে। পাগলটাও টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। না পেরে এবার রাস্তা থেকে একটা মাঝারি সাইজ ইট হাতে তুলে নেয়। সোহার দিকে তাক করে বলে
” আসবি, আসবি ! নাকি মেরে ফেলবো তোকে ?” শান দ্রুত পায়ে ছুটে আসে পাগলের কাছে। পাগল শানকে দেখে ইট টা তার দিকে তাক করতেই শান ধমক দিয়ে বললো
” নিচে রাখুন এটা ! ”
পাগলটা শানের ধমকে ভয় পেয়ে ইট ফেলে দিলো।
শান শান্ত ভাবে বলে
” দেখুন বউকে নিয়ে যেতে চাইছেন ভালো কথা। তবে বউ যখন নিচ্ছেনই তখন একটু ভালো করে নিয়ে যান ! আপনার বউকে নাহয় পূর্ণ রূপে সাজিয়ে নিয়ে আসি আমরা! তারপর নিয়ে জান আপনি।” শানের কথা শুনে পাগলের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠে।
সবার রেসপন্স এর আশায় থাকবো।