আধারে_তুমি,পর্বঃ ৩০

0
333

#আধারে_তুমি,পর্বঃ ৩০
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা

আজ শান আর সোহার বিয়ে। সকাল থেকেই বাড়িতে হইচই শুরু হয়েছে। সোহার মা, বাবা আর ইতির মা, বাবাই সব কিছু দেখছে বলা যায়। সোহার বাবার কোনো ভাই নেই তাই দেখার মতো ইতির বাবাই তার একমাত্র বন্ধু রয়েছে আর বাকিরা তো রয়েছেই আত্মীয়তার পরিচয়ে। ইতির মা তার কাজের ব্যস্তার মাঝে সোহাকে উঠিয়ে দিয়ে গেলো। ইতি অনেক রাতে ঘুমিয়েছে এখন ডাকলেও কাজ হবে না সোহা নিজেই তাকে টেনে হিচরে ডেকে তুলবে তাই আর ডাকার প্রয়োজন মনে করলো না। সোহা ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে মিরের সামনে দাঁড়ায়। চোখ খুলে নিজের গালে হলুদ দেখে সোহা অবাক হয়ে যায়। ইতি ঘুমে কাতর সেদিকে পাত্তা না দিয়েই সোহা ইতিকে ডাকতে ডাকতে বলে
” ইতি ! দেখ আমার গালে হলুদ কিভাবে এসেছে আমি তো রাতে শাওয়ার নিয়েই ঘুমিয়েছিলাম। রাতে তো ছিলো না হলুদ এখন কিভাবে আসলো ? তুই দিয়েছিস নাকি ?” ইতির নড়চড় না দেখে সোহা ইতির কাছে গিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘুম থেকে উঠালো। ইতি সোহাকে কুশন দিয়ে বারি মেরে বলে
” ধুর ! দূড়ে গিয়ে মর পাগলনি ! একটু ঘুমাতে দিচ্ছিস না আমাকে। ” সোহা চোখ বড়বড় করে অবাক হয়ে বললো
” কি বললি তুই আমাকে ! আমি পাগলনি ? তুই শাঁকচুন্নি। ঘুম থেকে উঠ বলছি !” সোহা টেনে টেনে ইতিকে ঘুম থেকে উঠালো। ইতি উঠে বসে সোহার চুল টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” বিয়ে করে শশুড় বাড়ি চলে যাচ্ছিস আজ আর এখনও ঠিক হলি না!” সোহা দাঁত কেলিয়ে বললো
” আমি ঠিক হয়ে গেলে তোদের জ্বালাবে কে ? আর সোহা তো সোহাই। সোহা বদলাবে না কখনো। এবার বল আমার গালে এতো হলুদ এসেছে কি করে ?” ইতি সোহার মুখ ধরে চোখ ছোট ছোট করে এদিক ওদিক দেখে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো
” আমার কি মনে হচ্ছে বলতো ! রাতে তুই ঘুমানোর পর শান ভাইয়া চুপিচুপি এসে তোকে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছে। আহা ! কতো রোমেন্টিক আমার দুলাভাই টা।”সোহা ক্ষেপে বলে
” তুই মজা করছিস আমার সাথে ? উনার কি আর কাজ নেই রাত বিরেতে আমাকে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে যাবে !” ইতি সোহার গাল টিপে বলে
” হলুদ লাগিয়ে যেতেই পারে। আমার কথা তো সত্যিও হতে পারে। হবু বউ কে একটু হলুদ ছোঁয়ানোর ইচ্ছা তো জাগতেই পারে। অসম্ভব কিছু তো নয় তাই না !” সোহা ভাবনায় পরে গেলো। ইতি সোহাকে ভাবনায় রেখে ওয়াসরুমে ঢুকে পরে।
এদিকে শান সেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। তার নিজের বিয়েতে সে নিচেই তদারকি করছে সব কিছুর। ঘুরে ঘুরে বাড়ির ডেকোরেশন দেখছে, বাকি সব কিছু ঠিক রয়েছে কিনা সবই দেখছে। মুসফিক চৌধুরী শানের কাজকর্ম দেখে বিরক্ত হয়ে বললো
” মনে হচ্ছে আমরা বাড়ির লোকজন সব মরে গিয়েছি ? আমরা তো সবই দেখছি তুমি আবার এসব করছো কেনো ? অন্যকাজ করো গিয়ে যাও !” শান মুখ ছোট্ট করে বললো
” আর কি করবো বাবা ! বিয়ের দিন তো আর থানার কাজ করবো না ! ছুটি নিয়েছি তো তাই আর কোনো কাজ নেই।” মুসফিক চৌধুরী মুখ দিয়ে শ্বাস ফেলে বিরক্তির চেহারা নিয়ে চলে গেলো।
শান তামিমের পাশে সোহায় গিয়ে বসলো। তামিম সোফায় বসে বসে ঘুমাচ্ছে। সোহার বাড়ি থেকে এসে রাত সব গুলো ছেলে ভোর রাত পর্যন্ত নাচ গান করেছে। বলতে গেলে ব্যাচেলর পার্টি ছিলো। শান তামিমের চোখে মুখে পানি দিয়ে বলতে থাকে
” কিরে তামিম ! সোহাকে বিয়ে করে বাসরও করে ফেললাম আর তুই এখনও ঘুমোচ্ছিস ? এই তো ক্রাশের প্রতি ভালোবাসা ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ !” আধো আধো ঘুমে শানের কথা কানে ঢুকতেই তামিম হুরমুরিয়ে বসে বলতে থাকে
” কি বলছো কি ভাইয়া ! আমি এতো ঘুমিয়েছি ? তোমাদের বিয়ে কখন হয়েছে ? আমাকে ডাকোনি কেনো তুমি ?” তামিম শানকে ভাবলেশহীন ভাবে বসে থাকতে দেখে মুখ কুঁচকে বললো
” তুমি মিথ্যা বললে কেনো ? আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে কেনো ?” শান ধমকে বললো
” ভাঙাবো না তো আর কি করবো ? এটা বিয়ে বাড়ি? সব গুলো ছেলে মরার মতো ঘুমাচ্ছে এখনো। আর দেখ তাকিয়ে মেয়েরা সেই সকালে উঠেই সাজগোছ শুরু করে দিয়েছে।” তামিম সোজা হয়ে বসে বললো
” হ্যা তোমারই তো বিয়ে । তুমিও গিয়ে একটু সেজে নাও !” শান বিরবির করে বললো
” থাক আমি ছেলে হয়ে সাজলে মেয়েদের আর খোঁটা দিতে পারবো না তাদের মেকাপ নিয়ে। তাছাড়া আমার আর সাজের কি দরকার ? আমি কি সুন্দর না নাকি ? এবার গিয়ে ছেলেদের ডেকে তোল। কোথায় না ঘুমিয়ে কাজ করবে ! কিন্তু মহাশয়রা ঘুমাচ্ছে।”
শানের কথা শুনতে শুনতে সিরি দিয়ে নেমে আসে সবাই। ইশান শার্টের হাতা উপরে বটতে বটতে শানের পাশে এসে বসলো। সামিরসহ সব কাজিনরা যা আছে সবাই ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে এসে বসে। ইমন হাই তুলে বললো
” রাতে যে এতোবড় হেল্প করেছি সেটা পাওনা দিয়েছিস ?” শান পা নাচাতে নাচাতে বললো
” কিসের পাওনা ? হাত, পা দেখেছিস ? দুই ঘা বসিয়ে দেবো তখন সব পাওনা পেয়ে যাবি।” ইশান ভ্রু কুঁচকে বললো
” কিসের পাওনা? কি করেছিস তোরা ?” ইমন জায়গা থেকে উঠে এসে ইশানের কাছে আসলো বলার জন্য তা দেখে শান এক লাফে উঠে গেলো। ইমনের কাছে গিয়ে ইমনকে দূড়ে নিয়ে সাবধান করে বললো
” ভেবে চিনতে কাজ করবি কিন্তু ! নাহলে খবর আছে তোর !” ইমন মুখ বাকিয়ে বললো
” সোহার বারান্দায় মই ধরার বদলে কোনো পাওনা দিয়েছিস তুই আমায় ! আবার বলছিস ভেবে চিনতে কাজ করতে ?” শান ভ্রু কুঁচকে বললো
” তুই তো জাস্ট মই ধরেছিস তাও কয়েক মিনিট এর জন্য। তোর হলুদের সময় আমি কয়েক ঘন্টা পাহারা দেবো তোকে।” ইমন খুশি হয়ে বলে
” এই নাহলে আমার বন্ধু !”
” ওহ এই ব্যাপার তাহলে ?” শান আর ইমন চমকে পেছনে তাকায়। সামির আর ইশান সবই শুনে ফেলেছে। শান অগ্নিদৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামির বললো
” তোরা কি রে ? আমি নিজের বিয়েতেও এমন কিছু ভাবিনি আর তুই আমার ভাই হয়ে এতো ফাস্ট ? এবার তো মনে হচ্ছে তোকেই আমার আগে বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিলো তাহলে কিছু শিখতে পারতাম।” ইশান সামিরের মাথায় চাটা মেরে বললো
” ছাগল তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে এখন এসব বলে নিজের মান-সম্মান খাচ্ছিস কেনো ? তবে শানকে নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে বিয়েটা এরেঞ্জ ম্যারেজ নয়।” ইশানের সন্দেহী কণ্ঠ শুনে শান ঢোক গিললো। তখনই শাহানাজ বেগম ডাকলো শানকে। শান আলতো হেসে বললো
” আমি যাচ্ছি।” শান কোনো রকমে পালিয়ে গেলেও ইশান আর সামির ইমনকে চেপে ধরে।
কিছুক্ষণের মধ্যে নাইসা আসলো দৌঁড়ে ইশানের আঙুল ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বললো
” পাপা মামনি অসুস্থ, মাম্মা ডাকছে তোমাকে।” সামিরের ভ্রু কুঁচকে যায় সিমির কি হয়েছে হঠাৎ ? সামির ছুটে চলে যায়। ইশানও ইমনকে ছেড়ে নাইসাকে নিয়ে গেলো রুমে।
সিমির হাত পা ঘষছিল নিলা আর সামিরের এক ফুফাতো বোন। সামির সিমির পাশে বসতে বসতে অস্থির হয়ে বললো
” সিমির কি হয়েছে ভাবি ?” ইশান আসতেই ইশানকে বসার জায়গা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিলা আর বললো
” জানিনা কথা বলতে বলতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলো। সকাল থেকে দুর্বল লাগছিলো মেয়েটাকে।” সামির অস্থির হয়ে পড়ে সিমিকে নিয়ে। নিলা সেই মেয়েটাকে বললো
” শোনো মাকে ছাড়া বাইরে আর কাউকে বলার দরকার নেই। ঠিকাছে ?” মেয়েটা মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। ইশান রুম থেকে তার স্টেথোস্কোপ আর কিছু জিনিস এনে সিমির চেকাপ করতে থাকে। নিলা কয়েকবার চোখে মুখে পানি ছিটালে সিমির জ্ঞান ফিরে আসে। ইশান চেকাপ করে মিটমিট হাসতে থাকে। সামির করুণ স্বরে বললো
” ভাইয়া তুমি হাসছো কেনো ? কি হয়েছিলো বলবে তো !” ইশান মুচকি হেসে বললো
” সুখবর এসেছে। ফ্যামিলিতে আরো একজন নতুন ম্যামবার আসতে চলছে।” সিমি অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামির বললো
” তা তো আসছেই আজ সোহা।” নিলা বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে দেয়। ইশানও তালমিলিয়ে হাসলো। নিলা সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” আরে বোকারা ! তোদের দুজনের মাঝে একজন নতুন ম্যামবার আসছে মানে সিমি প্রেগন্যান্ট।” সামির আর সিমি চোখ বড়বড় করে তাকালো একে অপরের দিকে। শাহানাজ বেগমও রুমে এসেছিলো শানকে নিয়ে। দুজন এই কথা শুনেই আটকে যায় সেখানেই। খুশির বন্যা বয়ে যায় সবার মাঝে। শাহানাজ বেগম সিমির কাছে এসে কিছুক্ষণ কথা বলে একে একে সবাই বেরিয়ে গেলো। সবাই যেতেই সিমি ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। সামির অস্থির হয়ে বলে
” কি হয়েছে তোমার ? কাঁদছ কেনো তুমি? তুমি কি খুশি না সিমি !” সিমি সামিরকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে
” খুব খুশি আমি, খুব খুশি।” সামির হেসে সিমির মুখ তুলে বলে
” তো কাঁদছ কেনো ? তুমি জানো না আজ কতো খুশি হয়েছি আমি।” সামির সিমি দুই গালে হাত রেখে ছোট ছোট চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিলো। সিমি লজ্জা পেয়ে সামিরের বুকে মাথা রাখে।

সোহার তিন কবুল বলা হলে শান তিন কবুল বলে দুজনে এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলো। তাদের এই বন্ধনে শত মানুষ সাক্ষী হয়। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান সোহার ঘোমটা উঠিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে দুচোখ জুরিয়ে দেখতে থাকে। এতো গুলো মানুষের মাঝেও কেমন বেহায়ার মতো কাজ করছে শান। মুগ্ধা হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সোহার দিকে। সোহার লজ্জা মাখা সেই চেহারা শানের সোহাকে দেখার তৃষ্ণা আরো বাড়িয়ে তুলছে। আর সোহা মাথা নিচু করে তাকিয়ে রয়েছে। লজ্জায় তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here