আধারে_তুমি,৩৫,৩৬

0
298

#আধারে_তুমি,৩৫,৩৬
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ৩৫

শান গাড়ি বের করে দুজনকে নিয়ে বেড়িয়ে যায় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। শান মনোযোগী হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। সোহা পাশে বসে থাকলেও ইতির সাথে গল্প করায় ব্যস্ত। দুই বান্ধবীর গল্পের মাঝে শানের মনে হলো এদের থামানো উচিত এবার। নাহলে এরা তাকে ড্রাইভারের তালিকায় ফেলে দেবে। শান গলা ঝেড়ে বলে উঠলো
” আজকে কিন্তু দুজন প্রথম ভার্সিটিতে যাচ্ছো ! মাথায় রেখো সিনিয়রদের র‍্যাগিং এর স্বীকার হতে পারো তোমরা।” ইতি ভয়ের সঙ্গে বললো
” তা তো ভাইয়া ঠিকই বলেছেন। আমি তো কালকে থেকে ভাবছি কোনো ঝামেলায় না আবার পরি!” সোহা ভাবলেশহীন ভাবে বললো
” আরে এতো টেনশন করার কি আছে ? কিছুই করবে না।” শান তাচ্ছিল্য হেসে বললো
” এসব সবাই বলে। আর যখন র‍্যাগিং এর স্বীকার হয় তখন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায়। তোমাকে নিয়ে তো বেশি টেনশন হচ্ছে। বাঁদরামি রূপটা বদলে ভার্সিটিতে ঢোকার আগে শান্তস্বভাবের মতো যাবে। বুঝেছো ?” সোহা ভদ্র মেয়ের মতো নাথা নাড়ালো।
ভার্সিটির গেটের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে দেয় শান। সোহা, ইতি, শান তিনজনই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। শান দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললো
” আজকে প্রথমদিন তোমাদের। তো দিনটা যাতে খারাপ না হয় সেটা তেই খেয়াল রাখবে। এসবের ঝামেলায় পড়ার দরকার নেই।” দুজন মাথা নাড়ালো। সোহাকে মিটমিট করে হাসতে দেখে শান গম্ভীর গলায় বললো
” যদি উল্টো পাল্টা কিছু করো ! তো তোমার টমিকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবো মাথায় থাকে যেনো।” সোহা দাঁত কিড়মিড় করে বললো
” আমার টমির সাথে কিছু করলে ! আপনাকে ধাক্কা মেরে গাড়ির নিচে ফেলে দেবো।” শান বুকে দুই হাত গুঁজে বাকা হেসে বললো
” হ্যা তারপর সারাজীবন জেলের ভাত খাবে আমার কি? অন ডিউটি পুলিশ অফিসারকে হুমকি দিচ্ছো তাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফালাবে ? এখন যদি তোমাকে থানায় নিয়ে যাই ! দুই দিন ক্রিমিনালদের সাথে জেলে থাকলেই সোজা হয়ে যাবে।”
সোহা ভেংচি কাটলো শানের কথায়। ইতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের ঝগড়া দেখছিলো আর হাসছিলো। শান আলতো হেসে ইতিকে ইশারায় ভেতরে যেতে বললো। ইতি হেসে সোহাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। শান তার চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গাড়িতে উঠে বসে গম্ভীরতা নিয়ে। আজ অনেকবড় একটা কাজ রয়েছে।
সোহা আর ইতি ভার্সিটির এদিক ওদিক তাকাতুকি করতে করতে ভেতরে আসতে থাকে। সোহা ইতিকে হাত জড়িয়ে হাটছে। ইতি বিরক্তের সঙ্গে বললো
” আমরা তো আমাদের রুম চিনি না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করারও উওয়ায় নেই। যদি সিনিয়র দের খপ্পরে পরে যাই !” সোহা ইতিকে টেনে নিয়ে ভবনের দিকে যেতে যেতে বললো
” ধুর জিজ্ঞেস করার কি আছে ? ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে যাবো আর ভার্সিটিও একটু ঘুরাঘুরি হয়ে যাবে।” ইতি আর সোহা হাটতে হাটতে নিচতলা ঘুরে দোতলায় গেলো। সেখানেও তাদের রুম পেলো না পড়ে থার্ডফ্লোরে গেলো। সিরি দিয়ে উঠার পর তিন নম্বর রুমের বাইরে তাদের ক্লাসের নাম আর নাম্বার দেখে বুঝতে পারলো এটা তাদের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস। সোহা আর ইতি ভেতরে ঢুকে দেখলো। ক্লাসের মানুষ জনের অবস্থা দেখে দুজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। একজন মেয়ে বসে বসে কাঁদছে আর দুজন শান্তনা দিচ্ছে। আরেকটা ছেলে পা ধরে বসে রয়েছে তার প্যান্টে ময়লা লেগে রয়েছে। পেছনে আরো দুটো মেয়ে মনে হচ্ছে ভয় পেয়ে আছে আর পুরো ক্লাস ফাকাই রয়েছে। সোহা ফিসফিস স্বরে বললো
” এদের সবার এই অবস্থা কেনো রে ? মনে হচ্ছে কোনো ঝড় এর মুখ থেকে বেঁচে এসেছে। যেভাবে ভয়ে থরথর করে কাপছে !” ইতিও ফিসফিস করে বললো
” জানতে চাইলে তো জিজ্ঞেস করতে হবে নাহলে কি করে জানবি ? এদের কাউকে দেখেই তো মনে হচ্ছে না আজ যে প্রথম ক্লাস।” সোহা সায় জানিয়ে বললো
” তা ঠিল বলেছিস। কি অবস্থা একেকজনের !” ইতি সোহার হাত ধরে সোজা ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছেলেটা বেঞ্চের উপর পা উঠিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখছিলো ঠিক আছে কিনা। সোহা আর ইতিকে সামনে দাঁড়াতে দেখে স্বাভাবিক ভাবে তাকালো। ইতি সৌজন্যতার হাসি ঝুলিয়ে বললো
” হেলো !” ছেলেটাও সৌজন্যতা মূলক হাসি দিয়ে বললো
” হাই ! আপনারা কি ফার্সইয়ার ? এই ডিপার্টমেন্ট এর ?” দুজন মাথা নেড়ে সায় দিলো। সোহা আলতো হেসে সেই কান্না করা মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো
” আচ্ছা ওরা কাঁদছে কেনো ? আর আপনার পায়ে কি হয়েছে ?” ছেলে হঠাৎ ইতি আর সোহার দিকে তাকালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললো
” আপনাদের র‍্যাগ করায়নি সিনিয়র রা ?” সোহা কাছে ছেলেটার এক্সপ্রেশন বড্ড মজার মনে হলো। সোহাও কিছুটা ঝুকে চাপা স্বরে বললো
” না তো আমরা মাত্রই এসেছি কিন্তু আপনাদের এই অবস্থা কেনো ? র‍্যাগিং এর স্বীকার হয়েছেন বুঝি ! আমাদেরও করাবে নাকি ?” ইতি সোহার হাত চেপে ধরে একটু দূড়ে এনে চোখ রাঙিয়ে বললো
” জেছে তুই র‍্যাগিং করতে যাবি নাকি ? ভাইয়া কি বলেছে মাথা আছে ? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। বেশি কথা বললে ভাইয়াকে ফোন দেবো আমি। ওর সাথে আমি কথা বলছি।” সোহা মুখ ফুলিয়েn ইতির সাথে গিয়ে সেই ছেলেটার সাথে দাঁড়ালো। ইতি ছেলেটাকে বললো
” আপনাদের কি র‍্যাগ করিয়েছে ?” ছেলেটা মাথা নেড়ে বললো
” হ্যা তা তো করিয়েছে। তবে আমরা তো ক্লাসমেট। আপনাদের অনুমতি পেলে আমি তুমি বা তুই করেই বললো আর আমার নাম, অনয় রায়। ” ইতি আর সোহাও দুজনের পরিচয় দিলো। অনয় তার বসার জায়গা থেকে কোনো রকমে দুজনকে নিয়ে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো। ক্লাসের বাইরে ভবনের লম্বা বারান্দার এক পাশে গিয়ে অনয় নিচের দিকে ইশারায় দেখালো ইতি আর সোহাকে। সেই জায়গাটা ভিড় জমেছে মনে হচ্ছে। সোহা উৎসাহিত কণ্ঠে বললো
” ওই খানে কি হচ্ছে ?” অনয় সোহাকে এতো উৎসাহিত হতে দেখে মুখ বাকিয়ে বললো
” র‍্যাগিং হচ্ছে যাবে ?” সোহা দাঁত কেলিয়ে না করলো। অনয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে হাটতে বললো
” তোমাদের ভাগ্য ভালো সিনিয়ররা সবাই একসাথে তাই কেউ তোমাদের দেখতে পায়নি। র‍্যাগিং এর হাত থেকে আজ বেঁচে গিয়েছো কিন্তু পড়ে বাঁচতে নাও পারো সাবধানে থেকো। আমাদের যে দেখছো ! যেই মেয়েটা কাঁদছে তার সাথে আমাকে কাপল ডান্স করতে করতে কি..স করতে বলা হয়েছিলো। হুমকি ধমকি মতে আমরা কোনো রকমে নাচলেও কি..স করতে পারিনি। যাই হোক মান-সম্মান রয়েছে আমাদের। তাদের কথা না শোনায় আমার পায়ে মেরেছে কিছুক্ষণ আর ওই মেয়েটা তা দেখেই ভয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আরো তো বাকি সবাইকে নিয়ে গিয়েছে র‍্যাগিং এর জন্যেই। সবাই ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। কেমন সিনিয়র !” ইতি আর সোহা একে অপরের দিকে তাকালো।
কিছুক্ষণ পর ক্লাসের জন্য বেল বাজলো। মাঠে সেই জায়গায় অবস্থান ভিড়টাও কমে আসে। সব স্টুডেন্ট ক্লাসে যাচ্ছে। সোহা রেলিং এর উপর হাত থেকে তাতে থুঁতনি রেখে নিচে তাকিয়ে থাকে। সবাই চলে গেলেও ছয় থেকে সাতজন এর মতো ছেলেমেয়ে দাড়িয়েই রইলো। এরাই যে সিনিয়র তাও বুঝে গেলো। সোহা ছোট ছোট চোখ করে সবাইকে দেখার চেষ্টা করে। ইতি সোহাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বিরবির করে বলে
” তোর এসব বাঁদরামির জন্য কবে যেনো আমরাই র‍্যাগিং এর স্বীকার হই।”
প্রথম দিনের ক্লাস হিসেবে আজ শুধু সব ক্লাসে শুধু পরিচয় আর আড্ডা হয়েছে। সোহা, ইতি আর অনয় ক্লাস থেকে বের হচ্ছিলো। তিনজনের কয়েক ঘন্টায় ভালোই আলাপ পরিচয় হয়েছে। অনয় রায় ছেলেটা হিন্দু। তবে সোহা আর ইতি ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছে ছেলেটা ভালোই। বাবা, মার ছোট ছেলে সে বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় লোক ঘরের ছেলে সে। তবে সেই তুলনায় সাধারণ ভাবে চলতে ভালোবাসে।
হাটতে হাটতে ইতি বলে উঠে
” সব স্যারই তো ঠিকাছে তবে তখন যে একটা স্যার ভুল করে চলে এসেছিলো ! নামটা তো জানা হয়নি তবে সবচেয়ে হ্যান্ডসাম স্যার।” সোহা বিড়াল চোখের মতো ইতির দিকে তাকাচ্ছে বারবার। অনয় সোহাকে এভাবে তাকাতে দেখে বললো
” কি হলো তুমি এভাবে তাকাচ্ছো কেনো ?” সোহা তার বিখ্যাত মন ভোলানে হাসি দিয়ে বললো
” নাহ কিছু না।” ইতি কিছু একটা আঁচ করতে পেড়ে সোহার দিকে তাকিয়ে জোড়পূর্বক হাসি দিয়ে বললো
” আজকে জানিস আমরা কফিশপে যাচ্ছি। তুই যাবি ?” অনয় ভ্রু কুঁচকে বললো
” তোমরাই যাচ্ছো ! আবার সোহাকেই জিজ্ঞেস করছো যাবে কিনা ?” সোহা মিটমিট হেসে বলে
” আরে বোকা ছেলে আমার হবু দুলাভাই আর ইতি যাচ্ছে।” অনয় আর সোহা শব্দ করে হেসে দেয়। ইতিও আলতো হাসলো।
ভার্সিটির বাইরে এসে দেখে বাড়ির গাড়ি এসেছে। সোহা ভেবেছিলো শান আসবে। সোহা আর ইতি অনয়ের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ইতিকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলে সোহা গাড়িতে একা একা চুপচাপ হয়ে যায়।

সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে যায়। সোহা তার পড়ার টেবিল ছেড়েও উঠে যায়। শানের বাড়িতে আসার সময় পেড়িয়ে যায় কিন্তু আজ শান সময় মতো আসেনি। সোহা একা একা বিরক্ত হয়ে টমিকে নিয়ে নিচে গেলো। শাহানাজ বেগম, নিলা, সালমা সবাইকে রুম থেকে ডেকে এনে ড্রইংরুমে বসে ভার্সিটির সহ অন্যান্য গল্প করতে থাকে। নাইসা ঘুমিয়ে পড়েছে আরো আগেই। রাত ১০ টা পেড়িয়ে যায়। ইশান, মুসফিক চৌধুরীও তাদের হসপিটাল আর অফিস থেকে ফিরে আসে। সোহার এবার চিন্তা হতে থাকে। কখনো তেমন ব্যাপার নিয়ে বেশি মাথা না ঘামালেও আজকে মারাত্মক চিন্তায় পড়ে গেলো।

চলবে……….

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ৩৬

কখনো তেমন ব্যাপার নিয়ে বেশি মাথা না ঘামালেও আজকে মারাত্মক চিন্তায় পড়ে গেলো।
শাহানাজ বেগমকে শানের কথা বলেছিলো। উত্তরে শাহানাজ বেগম বলেছে
” বড় কোনো কেস, মিশন বা অন্য কাজ থাকলে মাঝে মাঝে ফিরতে দেড়ি হয়ে যায়। তুই চিন্তা করিস না ঘুমিয়ে পরিস। সালমা উঠে দরজা খুলে দেবে।” সোহা তাও চিন্তা সরাতে পারলো না। খেতে বসেও দুই মুঠো খাবার খেয়ে উঠে চলে যায়। মুসফিক চৌধুরী সোহাকে যেতে দেখে চিন্তিত হয়ে বললো
” সোহার কি হয়েছে ? অসুস্থ নাকি মেয়েটা ? না খেয়ে উঠে গেলো যে ?” শাহানাজ বেগম মাথা নেড়ে বললো
” শান এখনও ফেরেনি তাই চিন্তা করছে সোহা।”
মুসফিক চৌধুরী এবার গম্ভীর রূঅ ধারণ করলো। রাশভারী গলায় বললো
” কোথায় তোমার গুনোধর ছেলে ? বাড়িতে তার বউ যে তার চিন্তায় খাওয়া দাওয়া ছেড়েছে সেটার খবর রেখেছে ?” ইশান মুসফিক চৌধুরীকে উদ্দেশ্যে বললো
” বাবা ! তুমি তো জানোই শান সব কিছু নিয়েই পাংচুয়াল। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া কখনো দেড়ি করে না। রাগারাগি করে কি হবে ? শান আসলে সোহাও খেয়ে নেবে চিন্তা করো না তুমি।” মুসফিক চৌধুরী আর কথা বাড়ালো না। শাহানাজ বেগম স্বামীর প্রতি বড্ড নারাজ। সব কিছু জেনে বুঝেও তার ছেলেকে কথা শোনিয়ে যায় সে। সোহা নতুন বউ, আজ প্রথম দেখেছে শান দেড়ি করছে চিন্তা তো করবেই। শাহানাজ বেগমের নিজেরও কেমন লাগছে আজ কিন্তু কাজ আছে ভেবে নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে। শাহানাজ বেগম মুখ ফুলিয়ে খাওয়া শুরু করলো। নিলা শাহানাজ বেগমকে ইশারায় রাগতে না করেছে বিধায় রাগলো না এই রাতের বেলায়।
ছটফটানি যেনো বেরেই চলছে সোহার। বিয়ের আজ প্রায় ২ সপ্তাহ হতে চললো। তবে আজ প্রথম শানের জন্য মনটা কেমন অস্থির অস্থির করছে। সোহা ফোন হাতে নিয়ে বারবার শানকে ফোন করতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে। প্রত্যেকদিন শানই দুপুরে আর ফ্রি টাইমে সোহাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিতো। সোহার কখনো নিজ থেকে ফোন করা হয়ে উঠেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১২সাড়ে বারোটা ছুঁইছুঁই। সোহা রুম জুড়ে পাইচারি করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর গাড়ির শব্দ পেয়ে সোহা বারান্দায় ছুটে গেলো। শানের গাড়ি দেখে নাক জ্বলে উঠলো। রাগে তার কান্না পেলো এত রাত করে আসবে জানিয়ে দিলে কি হতো ? সোহা মুখ ফুলিয়ে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হলো।
ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই শান গাড়ি খুলে কোনোরকমে আহত অবস্থায় গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে শানের কাছে এসে শানকে ধরলো। শান ড্রাইভারের কাধে হাত রেখে এক পায়ে ভর দিয়ে হেটে গাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ড্রাইভার কলিং বেল বাজানোর আগেই সোহা খট দরজা খুলে দিলো। গার্ডেনের আলোতেই শানকে স্পষ্ট ভাবে দেখা গেলো। শানকে আহত অবস্থায় দেখে সোহা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শান নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললো
” দাঁড়িয়েই থাকবে ? ভেতরে ঢুকতে দাও !” সোহার ঘোর ভাঙে শানের কথায়। সোহা হতভম্ব হয়ে বললো
” আপনার এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে ? আপনি জানেন আমি কতো চিন্তা করছিলাম ? আপনি ফোন করে কিছু জাননি কেনো ?” সোহার ভীতিগ্রস্ত কন্ঠস্বর। শানের অবস্থা দেখে তার চোখে পানি জ্বলজ্বল করছে। সোহার এমতাবস্থা দেখে শানের সব ক্লান্তি যেনো হারিয়ে গেলো। শরীর ব্যাথা গুলোও কমে আসছে। শান ফিচলে হাসি হেসে বললো
” বোকা মেয়ে আমি ঠিক আছি। আর কান্নাকাটি করবে না এখন সবাই ঘুমাচ্ছে। আমাকে আগে ভেতরে নিয়ে চলো। কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো এখানে ?” সোহা পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। ড্রাইভার রাস্তা পেয়ে শানকে ভেতরে নিয়ে যেতে থাকে। ড্রাইভার বেচারা দুজনের কথোপকথন শুনছিলো। ভালোই লাগছিলো তার স্বামীর প্রতি স্ত্রীর চিন্তা দেখে। নিশ্চই এই সম্পর্কগুলোই মধুর মতো সম্পর্ক হয়। এখনও তার এই সম্পর্ককে বোঝার মতো সময় হয়নি। তার তো বিয়ে হয়নি এখনও।
শানকে একদম তার রুমে পৌঁছে দিয়েই সে বেড়িয়ে গেলো তার নিজ গন্তব্যে। সোহা শানকে ভালো করে দেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। শান ঘাড় ঘুরিয়ে সোহার দিকে তাকালো। অসহায় চাহনি দিয়ে বললো
” এভাবে কাঁদছ কেনো তুমি? তোমাকে বলেছি না আগে ! আমার সামনে কখনো কাঁদবে না। কাঁদছ কেনো তাহলে ?” সোহা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো
” আপনার এরকম কি ভাবে হয়েছে ? কতো ব্যাথা পেয়েছেন আপনি ! একবারও ফোন করে জাননি বাড়িতে। আপনার চিন্তায় ভালো করে বসতে পারিনি আর আপনি নিজের এই হাল করে বাড়ি ফিরেছেন ?” শান সোহার দিকে তাকিয়ে সোহাকে বোঝার চেষ্টা করে। সোহা একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। শান বা হাত দিয়ে সোহার হাত টেনে নিজের কাছে এনে বসালো। সোহার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে করুণ স্বরে বললো
” কান্না বন্ধ করো তুমি ! তোমার এমন কান্না ভালো লাগছে না আমার।” সোহা কান্না থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু থামানোর পরেই শানের দিকে তাকিয়ে আবার কেঁদে উঠে। শান ব্যাথা শরীরে সশব্দে হেসে দেয়। সোহাকে টেনে বুকে জড়িয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বললো
” হুশশশ ! কান্না থামাও। এভাবে কান্নার কিছু হয়নি। আমি একদম ঠিকাছি। আচ্ছা তুমি কি আমাকে দেখে কাঁদছ নাকি আমার সেবা করতে হবে ভেবে কাঁদছ সেটাই সন্দেহ হচ্ছে।”
সোহা কান্না থামিয়ে সোজা হয়ে বসলো। শানের বুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে জড়ানো গলায় বললো
” বাজে লোক একটা ! আমি কি পাষাণ নাকি ? মায়া দয়া নেই আমার ? আপনার সেবা করতে হবে দেখে কাঁদবো আমি ?” শান হেসে সোহাকে আবার বুকে জড়িয়ে বললো
” আচ্ছা বাবা মজা করেছি।” শান সোহার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। সোহা নড়েচড়ে বসলে শান বুঝতে পারলো সোহা উঠতে চাইছে। শান হাসি মুখে সোহকে তার বাহুডোর থেকে ছাড়া দেয়। সোহা শানের হাত আর পা দেখে বললো
” কি ভাবে হয়েছে এসব বলবেন তো নাকি?” শান খাট থেকে নামার চেষ্টা করতে করতে বললো
” আমার ফ্রেশ হতে হবে আগে। পরে বসে বলছি সব।” সোহা শানের শার্ট পেন্ট বের করে টাওয়াল নিয়ে ওয়াসরুমে রেখে আসে। শানের ইউনিফর্ম এর অবস্থাও বাজে বলা যায়। সোহা শানকে নিয়ে ওয়াসরুমে বসিয়ে দেয়। শান সোহার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। সোহা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি হয়েছে ? আর কিছু আনতে হবে ?”
শান বাকা হাসি দিয়ে বললো
” তুমি কি আমাকে গোসল করিয়ে দেবে ? আমার কিন্তু কোনো অবজেকশন নেই। দুজন নাহয় একসাথে শাওয়ার নিয়ে নেবো !” সোহার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। তার খেয়ালই ছিলো না এসব। শানের কথায় লজ্জায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। সোহা দ্রুত পায়ে বের হতে গিয়েও দরজার কাছে গিয়ে থেমে হাসফাস করে বললো
” কিছু দরকার হলে বলবেন প্লিজ ! আর আপনার শেষ হলে আমাকে ডাকবে।” উক্ত কথা বলে বেরিয়ে আসে সোহা। শান ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো।

শাওয়ার নেওয়া শেষ হলে শান সোহাকে ডাকলো। সোহা গিয়ে শানকে নিয়ে আসে। শান সোহার কাধে এক হাত রেখে ভর দিয়ে এসে সোফায় বসলো। ডান পায়ে আর ডান হাতে মারাত্মক ভাবে চোট পেয়েছে মাথায় ব্যাথা না পেলেও কিছুটা আচর কেটেছে সেটা অস্পষ্ট তবে চিনচিন ব্যাথা রয়েছে। সোহা শানকে বসিয়ে বসিয়ে বললো
” আপনি বসুন আমি খাবার গরম করে আনছি।” শান সোহাকে থামিয়ে চিন্তিত হয়ে বললো
” তোমার যাওয়ার কি দরকার ? সালমাকে ডেকে আনো ওই গরম করে দেবে।” সোহা আলতো হেসে শান্ত স্বরে বললো
” এইটুকু করতে পারবো আমি। মাঝে মাঝে রাগ করে না খেয়ে থাকলে রাতে খিধে পেলে গরম করে খেতাম। আর ওভেন এই তো গরম করবো এ আর কি !” শান মাথা নেড়ে সোহাকে যেতে বলে। সোহা যেতেই ইমনের ফোন আসলো। ইমন শানের খোঁজ খবর নিয়ে, নিজের খেয়াল রাখতে বলে ফোন কেটে দিলো। কিছুক্ষণ পর সোহা গরম খাবার নিয়ে আসলো। শানের সামনে রাখতেই শান মুখ কুঁচকে বললো
” রেখে দিয়েছো কেনো ? খাইয়ে দাও আমাকে ! আমি কি সাপ নাকি যে জিহ্বা বের করে খেয়ে ফেলবো। খাইয়ে দাও আমাকে।” সোহা জিভ কেটে খাবার প্লেট হাতে নেয়। খাবার মেখে শানকে খাইয়ে দিতে গিয়েই পড়লো আরেক বিপত্তিতে। শান সোহার পুরো হাত চুষে খাচ্ছে যেনো হাতটাই খেয়ে ফেলবে। সোহার শরীরে যেনো কারেন্টের ছোঁয়া লাগছে। হাত থরথর করে কাঁপছে তার। শান ইচ্ছে করে সোহার হাত চুষে খাচ্ছে। সোহা বারবার ঢোক গিলছে আর শানের দিকে তাকাচ্ছে। শান হেসে যাচ্ছে শুধু। শান খেতে খেতে এক পর্যায়ে বলতে শুরু করে করলো
” আজকে আমরা সেই বড় গ্যাংটার আস্তানার খোঁজ পেয়েছিলাম। আমাদের ফুল ফোর্স তৈরি করা হয় তাদের ধরবে বলে। আমরা পৌঁছেও যাই কিন্তু সেখানে কাউকে পাইনা। আমরা আসছি সেই খবর পেয়ে গিয়েছিলো কোনো ভাবে তারা তাই কোনো রকমে পালিয়েছে তারা তবে আমরা বেরিয়ে যাওয়ার পথে একজনকে পাই। এটা তাদেরই লোক ছিলো যে জানতো না আমরা আসছি। আমরা তাকে নিয়ে আসি আমাদের সাথে। একজন কন্সটেবেল সহ ইমন জেরা করে, মারধর করে কিন্তু মুখ খোলেনি। শেষে আমি যাই, অনেক হুমকি ধমকি দিয়ে বোঝানোর পর বললো তার পরিবারের কথা। সেই লোকটার পরিবার ওই গ্যাং এর লোকদের কাছেই বন্দি। কিছু বললেই তার পরিবার হারিয়ে ফেলবে আর তেমন কিছুই তার জানা নয় শুধু আরেকটা গোপন আস্তানার কথা জানতো। আমরা আবারও সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। সেখানে গিয়ে দেখি সত্যিই সেই গ্যাং এর কয়েকজন লোক সেখানে রয়েছে তাদের মধ্যে সেই লোকটাও ছিলো যে তোমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিলো। আমাদের দেখে সবাই পালানোর চেষ্টা করলেও কেউ পারেনি তবে সেই লোকটা পালিয়ে যায়। আমি গাড়ি নিয়ে তার পিছু নেই কিন্তু সে ইচ্ছে করে গাড়ি এমন ভাবে চালাচ্ছিল যাতে আমি এক্সিডেন্ট করি।আমি তাকে নাগালের কাছে পেয়ে যাই কিন্তু তখনই গাড়ি কন্ট্রোল হারিয়ে একটা টাওয়ারে গিয়ে বারি খায় আর এক্সিডেন্ট হয়। সন্ধ্যার পর সেই এক্সিডেন্ট হয় তারপর আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। এতোক্ষণ পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। ফোনের খোঁজ নেই তাই জানানো হয়নি বাড়িতে পরে ইমনকেও আমি জানাতে না করেছিলাম।”
সোহা গুটি মেরে বসে রয়েছে। সোহা ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে শান হা করে বললো
” খাইয়ে দেবে তো নাকি ? খাবার নিয়ে বসে থাকলে হবে ? খিধে পেয়েছে আমার।” সোহা শানের মুখে খাবার তুলে দিয়ে ঢোক গিলে বললো
” আপনি আর জাবেন না সেখানে। ওদের ধরতে হবে না।” শান আলতো হেসে বললো
” যদি ওদের থেকে পালিয়ে বেড়ানোর হতো তাহলে পুলিশ হয়ে লাভ কি হলো ? আমি তো এদের মতো ক্রিমিনালদেরই শাস্তি দিতে চাই, সমাজের শান্তি বজায় রাখতে চাই তাই তো পুলিশ ফোর্সে জয়েন করেছিলাম। আজ যখন আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করছি তখন নিজেকে গুটিয়ে নিতে বলছো ! এটা কি করে বলছো তুমি ?” সোহা অসহায় চাহনি দিয়ে তাকালো। শান আহত আর ভালো হাত দিয়ে সোহার কানের উপএ হাত রেখে সোহার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে আশ্বস্ত করে বললো
” আল্লাহ তায়ালা সাথে থাকলে কিছু হবে না আমার। চিন্তা করো না তুমি। তুমি তো আছোই আমার সাথে আমার তোমাকে আমি আগলে রাখবো আমার আর কোনো ভয় নেই।” সোহা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে শানের দিকে।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here