চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ সতেরো

0
771

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ সতেরো
#মম_সাহা

(৪৩)

তুলোর মতন মেঘ গুচ্ছ বিচরণ করছে আকাশে। মিঠে বাতাস, কোমল লাল বর্ণা আকাশ। প্রকৃতিটা কবির ভাষায় কবিতার যোগ্য, প্রেমিকার প্রেম জাগরণের মতন, বিষাদে আচ্ছাদিত মানুষের মনে উৎফুল্লতা আনার মতন।

ছাদে মন খারাপে আবিষ্ট চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। সময়টা ঠিক দিনের তৃতীয় ধাপ- অপরাহ্ন। মুনিয়া বেগম বাড়ি ছেড়েছেন আজ দু’টো দিন হতে চললো। গতকাল থেকে এ অব্দি তার কোনো খোঁজ নেই। চিঠিতে সে চরম অভিযোগের স্বরে লিখে গেছে তার চলে যাওয়ার কথা। চিত্রাই যে সে অভিযোগের কারণ তা লিখতেও বাদ রাখেন নি সে।

চিত্রা তার বা’হাতে গুঁজে রাখা মায়ের চিরকুট টা নিজের অক্ষি দ্বয়ের সামনে মেলে ধরলো। যেখানে কি সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,

প্রিয় চিত্রাঙ্গণা,
চিঠির শুরুতে আমার এক আকাশ ভালোবাসা নিও। তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি তা নিশ্চয় তোমাকে বিশ্লেষণ করতে হবে না, তাই না? তোমার প্রতি আমার এক অগাধ মায়া আছে, কেনো জানো? তোমায় যেদিন দু’হাতের মাঝে পেয়ে চোখ ভরে দেখলাম, সেদিন মনে হলো আমার মাকে দেখছি। সেই দু দিনের শিশুটা কি মায়া লাগালো আমায় কে জানে, এরপর থেকে আমি আমার মা হারানোর শোক ভুলে গেলাম। তোমার পুরো না তোফা চিত্রাঙ্গণা। তোমার নামের আগে পরে কোনো পরিচয় নেই কেনো বলো তো? কারণ আমি তোমায় এমন বানাতে চেয়ে ছিলাম যেন তুমিই তোমার পরিচয় হও। শখ করে রেখেছিলাম তোফা। মানে, উপহার। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তুমি আমার। অথচ আজ তুমি আমার সব ভালোবাসা ভুলে, বাবার মোহে পরে ভুল সিদ্ধান্তে ডুব দিয়েছো। আমি তোমার এমন ক্ষতি দেখতে পারবো না। আমি এ ও জানি, তোমার বাবা হয়তো খুব বাজে ভাবে পিষে ফেলেছে তোমার মন গোপন কোনো কথার আস্তরণে তাই তোমার ও সিদ্ধান্ত। কিন্তু মা, তুমি পিষে যাওয়া টা দেখলে আর আমায় দেখলে না তা যে মানতে পারবো না। তুমি নাহয় তোমার বাবার কথায় জলাঞ্জলি দেও তোমার জীবন, আমি তা দেখতে পারবো না। ভালো থেকো।

ইতি
তোমার তথাকথিত ‘মা’।”

চিঠির শেষে সম্বোধনটাই যেন চিত্রাকে র*ক্তা*ক্ত করতে যথেষ্ট। মা কতটা কষ্ট পেলে নিজেকে এভাবে সম্বোধন করেছে! কিন্তু সেও বা কী করবে? বাবা সেদিন রাতে তাকে তার জীবনের এমন ভয়াবহতার কথা জানিয়েছে যা সে মানতে পারে নি। এমন একটা অপ্রত্যাশিত অতীত সে ভাবতে পারে নি। ঘৃণায় ভরে গিয়েছিলো তার দেহ। পৃথিবীর সব যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা যায় কিন্তু নিজেকে ঘৃণা করে আদৌও বাঁচা যায়? অথচ বিধির বিধান, আত্মহত্যা মহাপাপ। যেখানে জীবনটাই পাপের ফসল সেখানে মহাপাপটাও কেমন হাস্যকর।

অশ্রুরা গোপনে ঝরে গেলো মুক্তোর মতন। তাদের কেমন বিবর্ণতা!

“আরে আমাদের চিতাবাঘ, করে কি একা একা?”

পেছন থেকে কারো কণ্ঠ ভেসে আসতেই চিত্রা চোখের অশ্রু মুছে ফেললো। দুর্বলতা আড়ালেই রাখতে হবে, জেনে গেলেই তো জ্বালিয়ে দিবে মানুষ।

চাঁদনীও ততক্ষণে তার ভারী পেট নিয়ে অহির সাহায্যে চিত্রার কাছে এসে দাঁড়ালো। অহি আপাকে কত সুন্দর লাগে আজকাল! মাতৃত্বের সৌন্দর্যতা পৃথিবীর সব সুন্দরকে হার মানায়। কি সুন্দর!

চাঁদনীর মিষ্টি হাসির পরিবর্তে চিত্রাও হাসলো। কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো,
“চাঁদ আপা গো, তোমায় এত সুন্দর কেনো লাগে?”

চাঁদনী গাল টেনে দিলো চিত্রার। মিষ্টি হেসে বললো,
“সত্যিই সুন্দর লাগে নাকি রে? কই তোর দুলাভাই আদর-টাদর করে যে না এখন। মুটিয়ে গেছি কিনা।”

চাঁদনী আপার কথার ধরণে ফিক করে হেসে উঠলো চিত্রা। হাসতে হাসতে বললো,
“ছি আপা, শরম পাচ্ছো না তুমি?”

“শরম কেনো পাবো রে? সত্যি কথা বলতে কিসের শরম? শুনেছি দিনে চৌদ্দ বার সত্যি কথা বলা যায়। আমি তো মাত্র একবার বললাম, তাও তোরা সহ্য করতে পারছিস না?”

চিত্রা আর অহি সশব্দে আবার হেসে উঠলো। চাঁদনী আপা যে চিত্রাকে হাসানোর জন্যই এসব বলেছে তা আর বুজতে বাকি নেই কারো। তাল মিলিয়ে নাহয় হাসা যাক। এই মানুষ গুলো তো ভালোবেসেছে অনেক।

হাসতে হাসতে কখন যেন আনমনেই চোখ থেকে গাড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা রা। আনমনেই, না চাইতেও শব্দ করে কেঁদে উঠলো চিত্রা। সে যে ব্যাথা লুকানোর মতন অত কঠিন আজও হতে পারে নি। আজও তার হৃদয়কে কংক্রিট ছুঁয়ে দিতে পারে নি।

চাঁদনী এবং অহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অহি এই প্রথম চিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে স্বরে বললো,
“কাঁদিস না চিত্রা, চাচী ফিরে আসবে।”

আদুরে আলাপে কান্নারা আহ্লাদ পেয়ে বসলো। গা ছিটকে বেরিয়ে এলো তারা। কিছু কিছু সময় আমাদের অনুভূতিরা বড্ড অবাধ্য হয়।

(৪৪)

দেখতে দেখতে ভ্যাটিকান সিটিতে আজ কতদিনের বসবাস অবনী বেগমের। চেরিও এখন বেশ সুস্থ। এত দ্রুত তার সুস্থতা কল্পনার বাহিরে ছিলো। মেয়েটাও হয়তো বুঝেছে তার মায়ের এ দেশে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একাকীত্বের হাহাকার তার মাকেও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

মেয়ের মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে যাচ্ছে অবনী বেগম। আর কয়েকদিন পরই দেশের মাটিতে হয়তো ফিরে যেতে পারবে তারা। হয়তো দুঃখ ভুলে আবার বাঁচতে পারবে সে। হয়তো আবারও হাসি-খুশি একটা জীবন পাবে তারা। জীবনে অবনী বেগমের চাওয়ার আর কি ছিলো? একটু সুখ, একটু ভালো থাকতে চাওয়ার ইচ্ছে ছাড়া? কিন্তু হঠাৎ জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে যায় সেই অপরিচিত পুরুষের আগমনে। এরপর কত-শত দিন গেলো, অবনী বেগম কেবল বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে ছিলেন। অহি যখন হলো তখন তার বয়স আঠারো-উনিশ হবে। সে মানতে পারে নি অহিকে প্রথম প্রথম। সবার অমতে মেয়েটাকে হোস্টেলে রাখে। কিন্তু যখন মা হওয়ার মর্ম বুঝলো ততদিনে মেয়েটা তার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কাছাকাছি এনেও সে দুরত্ব মেটাতে পারে নি সে।

অবনীর ভাবনার মাঝে কেবিনের দরজা খুলে প্রবেশ করলো আমজাদ। পরনে তার বেশ ফর্মাল পোশাক। প্রতিদিন সে মেয়েকে এসে দেখে যায়। স্ত্রীর সাথে খুব কমই কথা হয় তার। না পারতে বলে আর কি।

আমজাদকে দেখেও তেমন একটা হেলদোল দেখালো না অবনী। আগের জায়গায় বসে রইলো নীরব হয়ে। আমজাদ কেবিনে প্রবেশ করেই শার্টের বোতাম দু’টো খুলে দিলো। সরাসরি অফিস থেকে এসেছে বোধহয়। ফোনটা চেরির বেডে রেখে সে কেবিনের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুমে গেলো বোধহয় হাত-মুখ ধোয়ার জন্য। আমজাদের বয়স পয়তাল্লিশের এপার-ওপার হবে। এখনো দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। যখন তাদের বিয়ে হয় তখনও আমজাদ এতটা বোধহয় সুপুরুষ ছিলো না। কেমন বোকা বোকা। সাধে কি আর মানুষ বউ পাগল বলতো! অথচ আজ সে আমজাদ গম্ভীর, শীতল।

হঠাৎ নিস্তব্ধ এই কেবিনটাকে শব্দে ভরিয়ে দিতে উচ্চশব্দে বেজে উঠলো আমজাদ সওদাগরের ফোন। অবনী বেগম তাকাবে না তাকাবে না করেও কৌতুহল নিয়ে তাকালো ফোনের স্ক্রিনে, যেখানে জ্বলজ্বল করছে সেই মধ্য রাতের হৃদয় ঝলসে দেওয়া নাম টা ‘জেসি’।

অবনী বেগম সাথে সাথে শ্বাসটা বন্ধ করে নিলেন। এ বয়সে এসে সঙ্গী হারানোর তীব্র ব্যাথা সে নিতে চায় না। অথচ সে যতই দূরে যাচ্ছে সেসবের থেকে, ততই যেন তাকে এসব জাপ্টে ধরছে। বার বার একই যন্ত্রণা যে কতটা ভয়ঙ্কর তা ব্যাখ্যা করার মতো না।

ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যেতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো আমজাদ। অবনীর ঘামে চুপচুপ হওয়া মুখমন্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার। অবনীর কাছে এসেই সে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“এমন শীতল রুমেও ঘামছো কেনো, অবু? তোমার কী শরীর খারাপ করছে?”

অবনী বেগম নিজেকে যথেষ্ট সংযত করার চেষ্টা চালালেন। অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষমও হলো সে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন নিজের মুখমণ্ডল টা। অতঃপর বেশ ধীর কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছি আমি।”

কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারলো না আমজাদ সওদাগর। স্ত্রীর পাশে এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষাও করলেন সে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে কপাল কুঁচকালেন। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“জ্বরও তো উঠে নি। তবে এমন অসুস্থ লাগছে কেনো তোমাকে?”

“আজও আমার অসুস্থতা তোমায় ছুঁতে পারে, আমজাদ?”

অবনীর চল্লিশতম বয়সের কণ্ঠে পঞ্চদশীর ছোঁয়া। কি প্রগাঢ় অভিমানে ছাপ! আমজাদ কি বুঝতে পারলো সে অভিমান!

তন্মধ্যেই আবারও সশব্দে বেজে উঠলো আমজাদের ফোন। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সে খুব ধীরে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

অবনী বেগম শ্বাস ফেললেন। তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“কিছু মানুষের কখনো নিজিস্ব ঠিকানা হয় না। ভবঘুরে হয় সে মানুষ। আমিও তেমন কূলহীন।”

(৪৫)

কোচিং এর নাম করে বেশ রাত হলো চিত্রা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা ছাড়া বাড়িটাতে তার এক মুহূর্ত ভালো লাগে না। কেমন পানসে লাগে সব! পৃথিবীটা হুট করে কেমন তেতো তেতো ঠেকছে। মা-ই বুঝি পৃথিবীর মধু!

কাঁধে ব্যাগ। ছোটো চুল গুলো এক পাশে বেণীগাঁথা। শরীরে বেশ সাদামাটা জামা। ছাঁই রাঙা। এধার ও ধার কেবল উদ্দেশ্য বিহীন ঘুরে বেড়ানো।

“আরে, রঙ্গনা রাস্তায় কি করে?”

চিত্রা থামলো। একা রাস্তায় একাকীত্ব কাটানোর মানুষ এলো। সে ধীর গতিতে পাশ ফিরে চাইতেই বাহারের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দৃষ্টিগোচর হলো। বাহার ভাই সচারাচর হাসেন না, অথচ আজ কি সুন্দর হাসির ঝিলিক মুখ জুড়ে।

চিত্রা থামলো। ধীর কণ্ঠে বললো,
“আপনি এ রাস্তায় যে, বাহার ভাই?”

বাহার চিত্রার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো,
“হ্যাঁ, কাজে এসেছিলাম। তা তুমি এখানে কেনো?”

“এমনেই, কোচিং করতে এসেছিলাম।”

“তোমার কোচিং এর রাস্তা এটা তো না। ঘুরছিলে একা একা?”

বাহারের দৃষ্টি তখনো চিত্রার মুখমন্ডল জুড়ে। চোখে অবাধ প্রশ্নদের ছড়াছড়ি।

চিত্রা ধীর কণ্ঠে বললো,
“ভালো লাগছিলো না, বাহার ভাই। আম্মু যে কোথায় গেলো।”

“চিন্তা করো না, ফিরে আসবেন। তোমার মিছে জেদের জন্য উনি বোধহয় অনেক কষ্ট পেয়েছে। অহেতুক কাজ টা না করলেও পারতে।”

চিত্রার খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“আমি কি করতে চেয়েছিলাম নিজের সর্বনাশ! বাবা’র আকুতি, আমার অতীত নিয়ে তাচ্ছিল্য আমি মেনে নিতে পারি নি, বাহার ভাই।”

বাহার দাঁড়ালো। চিত্রার মুখে তাকালো। কিছু একটা ভেবে সে ফুটপাতের কিনারায় এসে বসলো। হলুদ আলোয় রাস্তাটা কেমন মোহনীয় লাগলো! চিত্রাও বাহারের পাশে এসে বসলো। বহুদিনের শখ তার, বাহার ভাইয়ের পাশে বসে রাতের রাস্তা দেখবে, সোডিয়ামের কৃত্রিম আলোয় নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প করবে। তবে কি খুব দ্রুতই এসে পড়লো সে দিন খানা?

পাশের টং দোকান থেকে বাহার গরম গরম দু’কাপ চা নিয়ে এলো। চিত্রার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“এবার বলো তো, হুট করে বিয়ের মতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী? কি হয়েছিলো?”

চিত্রা চায়ের কাপটা হাতে নিলো। চোখ জুড়ে নেমে এলো তার সে দিন রাতের কথা,

সেদিন নুরুল সওদাগরের এমন পরিবর্তনে অবাক হয়েছিলো চিত্রা। বাবা হঠাৎ এত স্নেহ ঢেলে দিচ্ছে ভেবে চোখ-মুখ টলমল করে উঠে তার। নুরুল সওদাগরের দৃষ্টি তখনো বাড়ির সামনের রাস্তায়। সে রাস্তায় মানুষ-জনের আনাগোনা দেখতে দেখতে হুট করে চিত্রাকে বললো,”চা বানাতে পারো?”

চিত্রা তখনো কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বাবার হুট করে বলা উঠে প্রশ্নে সে হতভম্ব। নুরুল সওদাগর মেয়েকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো, “পারো চা বানাতে?”

চিত্রা চা বানাতে পারে না কিন্তু তবুও বাবার প্রশ্নে উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। ধীর কণ্ঠে বললো, “হ্যাঁ আব্বু,পারি।”

“তাহলে দুকাপ চা নিয়ে এসো চট জলদি। আমি অপেক্ষা করছি।”

বাবার বলতে দেরি অথচ চিত্রার ছুটে যেতে দেরি নেই। চা না বানাতে পারা চিত্রাও সেদিন হাত পুড়িয়ে চা বানালো। আধাঘন্টার মাঝে সে চা নিয়ে ঘরে পৌঁছালো। তখনও বাবা আগের মতন ঠাঁই বসে আছেন। চিত্রা চা এগিয়ে দিতেই নুরুল সওদাগর বেশ হাসি মুখে চা নিয়ে নিলেন। চিত্রাকেও অপর চায়ের কাপটা মুখে দেওয়ার ইশারা করলেন।

পোড়া হাত নিয়েই চিত্রা চায়ের কাপ মুখে তুললো। নুরুল সওদাগর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির দৃষ্টি ফেলেন। চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলেন, “বাহ্, চা তো বেশ বানাতে পারো।”

চিত্রা কেবল অস্বস্তি নিয়ে ক্ষীণ হাসি দিলো। নুরুল সওদাগর চায়ের কাপটা পিরিচের উপর রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেমন বিবশ কণ্ঠে বললেন, “তোমায় আজ কিছু কথা বলি, চিত্রা? তোমার তো উচিত নিজের জন্ম পরিচয় জানা, তাই না?”

চিত্রা বাবার কথায় অবাক হলো। হৃদপিণ্ড প্রয়োজনের তুলনায় দ্রুত লাফাচ্ছে যেন। বাবা কি তার জীবনের চির সত্যি কথাটা আজ বলবে?

নুরুল সওদাগর তন্মধ্যেই বলা শুরু করলেন,
“তোমায় অপছন্দ করার সবচেয়ে বড় কারণ কি জানো? তুমি আমার মেয়ে না।”

বাবার মুখে এমন একটা কথা শুনে ঘুরে উঠেছিলো চিত্রার পৃথিবী। বিস্ফো*রিত নয়নে সে বাবার দিকে তাকায়। নুরুল সওদাগর সে দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়েই বললেন,
“হ্যাঁ, এটা সত্যি যে তুমি এই সওদাগর বাড়ির কেউ না।”

চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অনড় তার দৃষ্টি, ভাষারা তখন স্তব্ধ। নুরুল সওদাগর তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন চিত্রার উপর থেকে, তা রাস্তায় নিবদ্ধ করে বললেন,
“তুমি আমার মেয়ে না, এটা তোমাকে অপছন্দ করার বড় কারণ হলেও, তার চেয়ে বড় কারণ হলো তুমি একজন নিষিদ্ধ পল্লির মায়ের মেয়ে।”

চিত্রা ততক্ষণে হতভম্ব। পায়ের নিচের মাটিটাও যেন খুঁজে পেলো না। কি শব্দ উচ্চারণ করলো বাবা?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here