#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩
লেখিকাঃ মাহীরা ফারহীন
ধুপধাপ পা ফেলে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মাহীন নিচে নেমে আসলো। কাঠের সিঁড়িতে পা ফেলার ধপধপ শব্দ করে উঠলো। কাঁধে ওর বই খাতা ভরতি ব্যাগ ঝুলছে। গতকাল সন্ধ্যায় মি.মোর্শেদ ওর দশম গ্রেডের সব বইখাতা কিনে এনেছেন। রান্না ঘর থেকে মিসেস নাসরিন উচ্চস্বরে বললেন,
“একটু আস্তেধীরে নামা উঠা কর। পরে তো হাত পা ভাঙ্গবে।”
রান্নাঘরের সামনেই বসার ঘর। মি.মোর্শেদ সেখানেই সোফায় বসে সকালের খবরের কাগজ পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। বসার ঘরের বাম দিকে কোনো দেয়াল নেই। রয়েছে কাঁচের থাই স্লাইডিং গ্লাস। এখান থেকে সরাসরি পেছনের বাগানে বের হওয়া যায়। নাইম সোফায় বসে গেম খেলতে ব্যস্ত। মাহীন বলল, মা আমি স্কুলে যাচ্ছি। বলেই দরজার দিকে পা বাড়ালো।
তবে মাঝপথে বাঁধা দিয়ে মি.মোর্শেদ বললেন,
“দাঁড়া অপেক্ষা কর। আমি গাড়ির চাবি নিয়ে আসছি।”
মাহীন থমকে দাঁড়ালো। তারপর পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
“বাবা আমি একা স্কুলে গেলে কি খুব সমস্যা হবে?”
মি.মোর্শেদ বিভ্রান্তি ভরা নয়নে চাইলেন। তারপর বললেন,
“তুই এখন ওই পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছতে পারবি? এখনো তো তোর সাইকেল কেনা হয়নি।”
মাহীন সোফার পাশে গিয়ে দাঁড়াল এবং অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
“বাবা প্লিজ, আমি তো গতকাল দেখেই এলাম জায়গাটা কোথায়। এবং এখন গুগলস ম্যাপ থাকতে কি আর কোনো কিছু খুঁজে পেতে চিন্তা করতে হয়?”
রান্না ঘর থেকে মিসেস নাসরিন রীতিমতো হুংকার দিয়ে বললেন,
“খবরদার তুমি যদি ওর ভণ্ডামি কথাবার্তায় সায় দিয়েছ! আজকে তোর বাবা তোকে দিয়ে আসবে আর কোনো কথা নেই। সাইকেল না কিনে দেওয়া পর্যন্ত তুই কোথাও একা যাবি না।”
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ ভঙ্গিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। বাড়ির সামনেই স্যাকামোর গাছের ডালপালা হালকা বাতাসে দুলছে। গাছের পাতার ছাউনি ভেদ করেও ঝুড়িঝুড়ি হয়ে রোদ এসে পরছে। সামনের দিনগুলোতে এই অচেনা তল্লাটে একাই চলাফেরা করতে হবে। বাংলাদেশের মতো প্রতিমুহূর্তে সাথে সাথে কোতোয়ালগীরী করার মতো কারোও সময় নেই এখানে। সকলের সময়েরই দাম আছে। যার চলতে হবে সে নিজের ওপর নির্ভর করেই চলবে। তা জানা সত্ত্বেও নতুন এক অনুভূতি এই শহরের মাঝে। এই শহরে একা চলাফেরা করার এক অদম্য ইচ্ছা মাহীনের। যদিও তা কিছুদিন বাদেই অতি সাধারণ নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে যাবে। থাকবে না আর কোনো অদম্য উচ্ছাস। মি.মোর্শেদ নীল ক্যাডিলাক কে গ্যারাজ থেকে বের করে আনতে ছয় সাত মিনিট সময় ব্যয় করলেন। তারপর মাহীন গাড়িতে উঠে বসলো। আজ ও একটা হলুদ রঙের কুর্তি পরেছে সঙ্গে একই নীল জিনস এবং গলায় একটা ওড়না ঝুলিয়েছে। সবসময়ের মতোই চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। গাড়ি রাস্তা ধরে চলতে শুরু করেছে। বেশ কিছুক্ষণ মাহীন মুখ গোমড়া করে নিশ্চুপ বসে থাকলো। তারপর একসময় বলল,
“বাবা”। এতটুকু কন্ঠনালী হতে বের হওয়া মাত্র মি.মোর্শেদ বললেন,
” আচ্ছা মা ঠিক আছে। আমি আজকেই তোকে সাইকেলটা কিনে দেব, যেন তুই আগামীকাল থেকে একাই স্কুলে যেতে পারিস না। খুশি তো এবার? মাহীনের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠলো। সহাস্যে বলল,
“অসংখ্য ধন্যবাদ বাবা। তুমিই বেস্ট।”
মি.মোর্শেদ প্রতুত্তরে মুচকি হাসলেন। স্কুলে পৌঁছে মি.মোর্শেদ আর গাড়ি হতে নামলেন না। মাহীন বাবাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। তারপর দেখলো গতকালের মতোই ছেলে-মেয়েরা জনে জনে ভেতরে প্রবেশ করছে। মাহীন একবার শুকনো ঢোঁক গিলল। তারপর বিসমিল্লাহ পড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আজও রোদেলা দিন। গোল চত্ত্বরের অরিগন এস গাছগুলো রোদের আলোয় ঝলমল করছে। চত্ত্বরের চারিদিকে দেয়াল ঘেঁষে বেগুনি বেগুনী ডগলাস আইরিসের সমারহ দেখা যায়। মাহীন আজ ওসব দিকে মনোনিবেশ না দিয়ে সোজা এগিয়ে গেল প্রবেশ দ্বারের দিকে। মাঝে মাঝে প্রকৃতি দেখতে দেখতেই হারিয়ে যাওয়ার একটা অভ্যাস আছে ওর। তার ফাঁদে পরল না আজ। কারণ আজ ওকে সময়মত ক্লাসে পৌঁছতে হবে। ভেতরে ঢুকে সোজা করিডোর ধরে এগিয়ে গেল। প্রিন্সিপাল সেলটনের অফিস কক্ষের পাশেই একটি কাউন্টার রয়েছে। সেখানে যাবতীয় ফর্মাল কাজ করা হয়, যেমন বেতন পরিশোধ, কোনো বিষয়ের জন্য দরখাস্ত দেওয়া ইত্যাদি। কাউন্টারের পেছনে একজন লাল চুলো মহিলা গোমড়া মুখে বসে রয়েছে। মাহীন গিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। তারপর হালকা একটু কাসতেই মহিলা মুখ তুলে চাইলেন। তারপর কাঠখোট্টা কন্ঠে বললেন, ‘কি সমস্যা!’
মাহীম ভরকাল। মনে মনে ভাবল, কি সমস্যা ওনার? এত বিরক্তি কিসের জন্য।’ মুখে বলল, “আমি দশম গ্রেডের নতুন ছাত্রী। আমার ক্লাসরুমের তালিকাটা আমাকে দেবেন?”
মহীলা একই রকম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“এক্সট্রা ল্যাঙ্গুয়েজ কি?”
“ল্যাটিন।”
“মেজোর এবং অপশনাল?”
“সাইন্স এবং হায়ার ম্যাথস।” মহিলা আর কিছু না বলেই মাথা নিচে করে কাউন্টারের ওপাশে একটা ড্রয়ার খুললেন। কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটির পর একটা প্রিন্ট করা হলদে বর্ণের কাগজ বের করলেন। তারপর সেটা সামনে কাউন্টারের ওপর রাখলেন। তারপর ড্রয়ার থেকে একটা চাবি বের করলেন।
“এটা তোমার লকারের চাবি। ভুল করেও হারাবে না।” চাবিটা কাউন্টারে রেখে কঠোর স্বরে বললেন উনি। মাহীন কাগজটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর কাগজটা এবং চাবিটা নিয়ে এখান থেকে কেটে পরতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচল। ওর কাছে মনে হলো মহীলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। তারপর চাবিটা জিনসের পকেটে রেখে হলদে বর্ণের কাগজটির দিকে দৃষ্টিপাত করলো। প্রথমে ইংলিশ ক্লাস হবে দ্বিতীয় তলায়। কাজেই সময় নষ্ট না করে সোজা সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেল। C-2 নং কক্ষটা খুঁজে বের করতে হবে ওকে। প্রথমেই খোলা বারান্দার মত করিডোর। যেদিকে খোলা সেখান থেকে রোদ এসে মেঝেতে লুটপুটি খাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা আসা যাওয়া করছে। প্রথমের লম্বা করিডোরের সম্পূর্ণ ঘুরেও মাহীন কোথাও C-2 কক্ষটা খুঁজে পেল না। কাজেই করিডোরের শেষ মাথা থেকে বামে বাক নিয়ে পাশের করিডোরে গেল। একের পর এক একটা ক্লাসের ওপর ছোট করে লেখা রয়েছে কক্ষ নং। শেষে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পরলো। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস বুক ভরে নিতে লাগলো। যেই করা রোদ উঠেছে গরম কম নয়। বাতাসের আদ্রতা কম হলে এত ছোটাছুটি করার পর রীতিমতো ঘেমে নেয় উঠেছে মাহীন। শেষে করিডোর ধরে যারা যাওয়া আসা করছে তাদের কাউকেই জিজ্ঞেস করবে বলে স্থির করল। একটা ছেলে ধীর গতিতে হেঁটে যাচ্ছিল। মাহীন বলল,
“এক্সকিউজ মি?” ছেলেটা থমকে দাঁড়ালো। তারপর ওর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বলল,
“ইয়েস, আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” মাহীন অপ্রতিভ গলায় বলল,
“C-2 নং কক্ষটি কোথায় বলতে পারবে?”
এবার ছেলেটার চোখ ধীরে ধীরে উপরের দিকে প্রসারিত হলো। এমন ভাবে ওর দিকে চাইলো, মাহীনের মনে হলো যেন,ও ওকে এই মাত্র বলেছে, আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন। এবং এই কথা বললে প্রথমে যেমন ঠিক অবাক হত তেমনি অবাক হলো তারপর হেসে ফেলতো, ঠিক তেমনি ছেলেটা হেসে উঠলো। মাহীন ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“আমি কি কোনো হাস্যকর কথা বলেছি?”
ছেলেটা হাসি হাসি মুখেই মাহীনের কাঁধ আঁকড়ে ধরে ওকে অপর পাশে ঘুরে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর বলল, “ওপরের দিকে তাকাও।” মাহীন ওর কথা মতো ঠিক তেমনি করলো, এবং দেখতে পেল ও ঠিক যেই ক্লাস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই কক্ষ নং C-2। মাহীনের চোয়াল ঝুলে পরল এবং চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। ছেলেটা সহাস্যে বলল,
“ক্যালিফোর্নিয়া তাল গাছের স্বর্গরাজ্য। চলা ফেরা করার সময় মাঝে মাঝে একটু মাথা উপরে তুলে দেখিও তাল গাছে তাল ধরেছে কিনা। কাজে লাগবে।” বলেই হাঁটা ধরলো।
মাহীন হতবিহ্বল হয়ে অল্প কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পুনরায় পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লাসে প্রবেশ করলো। এখানকার ক্লাসে সকলের জন্য একক চেয়ার টেবিল রয়েছে। কেউ কেউ টেবিলের ওপর উঠে বসে আছে, আবার কেউ কেউ ভদ্র ভাবে নিজ নিজ চেয়ারে বসে গল্পগুজব করতে ব্যস্ত। মাহীন সামনে এগিয়ে যাবে তখনই সামনের টেবিল থেকে একটা পেন্সিল ব্যাগ নিচে পরলো। টেবিল থেকে ব্যাগটার মালিক যেই মেয়েটা সে উঠার পূর্বেই মাহীন ঝুঁকে ব্যগটা তুলে দিল। মেয়েটা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুমি কি ইন্ডিয়ান?”
মাহীনের অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,
“না আমি বাংলাদেশী।”
মেয়েটা বলল,
“ওহ আচ্ছা আরেকজন বাংলাদেশী।”
মাহীন জিজ্ঞেস করল,
‘কেন আরোও বাংলাদেশী আছে নাকি?’
মেয়েটা মুখ টিপে বলল,
‘দুই দিন ক্লারো। নিজেই বুঝতে পারবে।’
মাহীন মুচকি হেসে এগিয়ে গেল। গিয়ে ঠিক কোথায় বসবে বুঝতে পারছিল না।এখানে কম করে হলেও ত্রিশটা টেবিল ও চেয়ার রয়েছে। ঠিক জানালার পেছনের কিছুটা আগে জানালার পাশের একটা টেবিল মাহীনের পছন্দসই হলো। কাজেই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসলো। একদণ্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার পূর্বেই পাশের টেবিল থেকে একটা মেয়ে হালকা হেসে বলল,
“হ্যালো সুইট গার্ল, আমি সাইলোহ, সাইলোহ কার্নেল।” মাহীন মেয়েটার দিকে ভালো ভাবে চাইল। ঘাড় পর্যন্ত ছোঁয় না এত ছোট ডার্ক চকলেট রঙের চুল। গাড়ো বাদামি চোখ। ছোট চিকন ঠোঁট এবং চিকন নাক। ত্রিভুজ আকৃতির মুখ। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মিষ্টি একটা হাসি। আপনাআপনিই মাহীনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো এবং মনটা নিমিষেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বলল,
“আমি মাহীন ফারুকী।”
মেয়েটা বলল,
“তুমি নতুন মনে হয়। এশিয়ান?”
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
“তুমি সিক্রেট ট্রিয়ের সাথে দেওয়া নেওয়া করেছ?” জিজ্ঞেস করল সাইলোহ। মাহীনের ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
“মানে?”
সাইলোহ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল এবং মাহীনের একটা হাত ধরে বলল,
“চলো দেখাচ্ছি।” হাত ধরে মাহীনকে টেনে উঠিয়ে আনলো। এবং সোজা ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে হাঁটছে সাইলোহ। ভীড় অতিক্রম করে হাঁটতে হাঁটতে ওরা ক্যাফেটেরিয়ায় এসে পৌঁছল। সেখানে ছাদটা খোলা। বলা যায় আরেকটা খোলা চত্ত্বর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোলাকৃতির টেবিল। এক পাশে বড় একটা কৃত্রিম গাছ রয়েছে। ঠিক ক্রিস্টমাস ট্রিয়ের মতো। তবে এই কৃত্রিম গাছের ডাল পালা থাকলেও কোনো পাতা নেই। তার বদলে প্রতিটা ডাল থেকে ঝুলছে ছোট ছোট রঙিন চিরকুট। সাইলোহ মাহীনকে নিয়ে ঠিক সেই গাছটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মাহীনের দিকে ঘুরে বলল,
“এটাই হচ্ছে সিক্রেট ট্রি।আমি এই স্কুলে প্রথম গ্রেড থেকে পড়ি। এবং তখন থেকেই দেখছি এটা এখানে রয়েছে।”
“এটায় ঝোলানো এসব চিরকুট কিসের?” জিজ্ঞেস করল মাহীন।
“এগুলোই সিক্রেট। একেকজন মানুষ তাদের এমন সব সিক্রেট এখানে রেখে যায় যেটা হয়তো তাড়া অন্য কাউকে বলতে পারবে না। আবার চাইলে যেকেউ যেকোনো সিক্রেট নিয়ে খুলেও দেখতে পারে।” তারপর একটু বিরতি দিয়ে বলল,
“তুমিও তোমার কোনো সিক্রেট লিখে রাখতে পারো।” মাহীন দ্বিধান্বিত হয়ে ওর দিকে চাইল তারপর বলল, “আসলে আমার তো তেমন কোনো সিক্রেটই নেই।” সাইলোহ ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
“আমার সামনে বলে লিখতে চাচ্ছো না, তাই না? মাহীন ততক্ষণাৎ বলল,
“না, সত্যি বলছি।
সাইলোহ রশিয়ে রশিয়ে বলল,
“বুঝেছি, বুঝেছি। তাহলে এক কাজ করো তুমি চাইলে এখান থেকে তোমার ইচ্ছে মতো যেকোনো চিরকুট নিয়ে পড়তে পারো। মাহীন আবার দ্বিধান্বিত হয়ে পরল। ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। বলল,
“এটা কি ঠিক হবে। মানুষ তার ব্যক্তিগত সিক্রেট লিখে রেখেছে।
সাইলোহ বলল,
” মানুষ এখানে এমন সিক্রেটের কথাই লেখে যেটা সে কাউকে বলতে পারে না। এবং এখানে লেখার অর্থ হলো কেউ না কেউ হয়তো সেটা পরেছে এবং তাদের না চিনেও না জেনেও সিক্রেটটা জানে এটাই তাদের সান্তনা। এবং কেউ নিজের সিক্রেট এইভাবে না জানিয়ে দিতে চাইলে তো এখানে এইভাবে লিখতোই না।’ অকাট্য যুক্তি, মাহীন আর কিছু বলল না। সোজা বাদামি রঙের একটা চিরকুর ডাল থেকে খুলে নিলো। সেটা সুতার সাহায্যে বাঁধা ছিলো। তারপর খুলে পরতে লাগলো। লেখা আছে,
“আজ আমাদের বাস্কেট বল টিম হেরে গেল। এবং সম্পূর্ণ আমার কারণে। আমার যে জরুরি ভিত্তিতে টাকার খু্ব দরকার ছিলো। তাই অপর দল যখন হেরে যাওয়ার বদলে টাকার প্রস্তাব দিলো আমি কোনো ভাবেই না করতে পারলাম না। দুঃখীত।”
মাহীনের চিরকুটটা পড়ে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো। সাইলোরও একই অবস্থা।
“আমার স্কুলের বাস্কেট বল টিমের কেউ ম্যাচ ফিক্সিং করেছে।” উৎকন্ঠা প্রকাশ পেল মাহীনের কন্ঠে।
সাইলোহ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কত্তবড় নিমোক হারাম। কখনো একে খুঁজে পেলে গণপিটুনি দিব”। মাহীন আরোও কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সাইলোহ দূরে করিডোরের কোণায় কাউকে ইঙ্গিত করে বলল,
“আরেহ নায়েল দেখো কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু অপেক্ষা করো আমি ওকে ডেকে আনছি।” মাহীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাইলোহ সেদিকে হাঁটা ধরলো। মাহীন আবার গাছের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরক্ষ করতে লাগলো চিরকুট গুলো। এত এত রঙিন চিরকুটের মধ্যে একটা ব্যতিক্রম ধর্মী চিরকুটের ওপর নজর পরলো। সেটা একটা কালো চিরকুট। মাহীন সেটা খুলে নিলো। তারপর ভাজ খুলে দেখা গেল ভেতরে সাদা কালিতে লেখা,
“অবিশ্বাস্য হলেও আমার মা আমার সাথে এমন আচরণ করেন যা একজন সৎ মাও তার সৎ ছেলের সাথে করবে না। এ আচরণ সহ্য করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো কারণে আমার ধৈর্য্য শক্তি বেশিই তাই আমি সহ্য করে যাচ্ছি। আমার পরিবারকে সামনে থেকে দেখে কেউ সেটা ধরতে পারবে না। বরং একটি সুখি পরিবারকেই তাঁরা দেখবে। ছোট বেলা থেকে আমিও ছিলাম আমার মায়ের চোখের মণি। তবে একটা ঘটনা সবকিছু বদলে দিল। আমি যেন তার চোখের বিষ হয়ে উঠলাম। তার হৃদয়ে যেন আমার নামের অংশে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে বিষ ঢেলে দিয়ে সবকিছু বিষাক্ত করে দিল। শুধু মাত্র মায়ের ব্যবহারের সাথে সাথে আমার জীবনটাই পাল্টে গেল। এমনকি তাকে মা বলে ডাকার সৌভাগ্যটিও এখন আমার নেই।
এর চাইতে নিকৃষ্ট ঘটনা আর কি ঘটতে পারে একটা সন্তানের সাথে । তবুও এসব সহ্য করে আমি সেই ঘরে থেকেই বেঁচে আছি। আসলে আমি বেঁচে থেকেও সেদিনই মারা গিয়েছি যেদিন আমার মা আমাকে তার ছেলে বলেই অস্বীকার করলেন। আমার বাঁচার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। জীবনের কাছে কোনো আশা নেই। তবুও বেঁচে আছি কারণ, ‘আত্মহত্যা যে মহাপাপ’।
এতটুকুই লেখা চিরকুরটায়। মাহীন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে সাদা কালিতে লেখা, শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি টলমল করতে করতে হঠাৎ গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। এখানে এমন কিছু একটা পড়ে ফেলবে আশা করেনি। কোনোও মানুষ এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কেই বা সেটা ভাবতে পারে। মাহীন মনে মনে ভাবলো, কি হয়েছিল তার সাথে? কি এমন ঘটনা ঘটতে পারে একটা মানুষের সাথে যার জন্য একটা মা তার সন্তানের সঙ্গে এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করবে। এবং আমিই বা কি করতে পারি এটা নিয়ে? যখন এটাও জানি না সেই চরম দুর্ভাগা ব্যক্তিটি কে? ম্যাহীন! সাইলোর ডাকে চমকে উঠল মাহীন। নিজেকে সামলে নিয়ে গালটা একটু মুছে নিল। তারপর সাইলোর দিকে ফিরে চাইল। দেখল তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। ছেলেটির চিকন প্রসস্থ নাকের চারপাশে ও চোখের নিচ এবং সারা গালে হালকা লালচে ফ্র্যাকল রয়েছে। মনোলিড আকৃতির গাড়ো বাদামি চোখ। ওভাল আকৃতির মুখ ও ডার্ক চকলেট রঙের উসকোখুসকো চুল। সাইলোহ ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল,
“ম্যাহীন তুমি ঠিক আছ? তোমার চোখ মুখ এমন থমথমে হয়ে আছে কেন?”
মাহীন একটু কেসে নিয়ে নাক টানলো। চোখে পানি আসলে আপনা আপনি নাকেও পানি চলে আসে। মাহীন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “না না আমি একদম ঠিক আছি। আর আমার নাম কিন্তু মা..হী..ন।” সাইলোহ বিচলিত ভাবে হেসে বলল,
“এরপর থেকে সঠিক ভাবে উচ্চারণ করার চেষ্টা করব। মাহিন।” মাহীন ফেলে মুচকি হাসল।
“ছেলেটা ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমি নায়েল কলিমোর।”
মাহীনও হাসি মুখে করমর্দন করে বলল,
“মাহীন ফারুকী।”
নায়েল বলল,
“তুমি কোনো সিক্রেট লেখনি?”
মাহীন কিছু বলার পূর্বেই সাইলোহ বলল,
“নাহ আমাদের সামনে বোধহয় লিখতে চাচ্ছে না।” মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাইলোহ বলল,
“ও যেই চিরকুট নিয়েছে তার মধ্যে বাস্কেটবলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জবানবন্দি আছে।”
নায়েল বিস্মিত হয়ে বলল,
“বাস্কেটবলে কেউ ম্যাচ ফিস্কিং করেছে! এটা আর যেই হোক র্যাবিট না।
সাইলোহ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“নাহ র্যাবিট এত গরিব না যে টাকার জন্য নিমক হারামি করবে।”
মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“র্যাবিট টা আবার কে?”
নায়েল বলল,
“আমাদের স্কুলের এক নাম্বার ফাজিল। বেশিক্ষণ লাগবে না ওকে চিনতে।”
মাহীন হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাদের ক্লাস তো শুরু হবে বলে।”
সাইলোহ বলল, “হ্যা চলো ক্লাসের দিকে যেতে যেতে কথা বলি।” ক্যাফেটেরিয়া প্রায় খালি হয়ে এসেছে। একে একে সকলে ক্লাসের দিকে রওনা দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে নায়েল বলল,
“অনেকজনের দাবি তাঁরা প্রায় প্রতি সপ্তাহে র্যাবিটকে সিক্রেট ট্রিতে একটা করে চিরকুট বাঁধতে দেখে।” মাহীন অবাক স্বরে বলল,
“এতো সিক্রেট ওর।”
সাইলোহ বাঁকা হেসে বলল,
“হবে না আবার সারাদিন যেসব কান্ডকারবার করে বেড়ায়। আমার ধারণা সিক্রেট ট্রিয়ের অর্ধেক চিরকুটই নিশ্চিত ভাবে র্যাবিটের।” নায়েল হেসে উঠলো। মাহীন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো, এখানকার মানুষের নাম যে কি হবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যার যা ইচ্ছে রেখে দেয় তাই বলে র্যাবিট? ক্লাসে প্রবেশ করতে করতে সাইলোহ বলল,
“আচ্ছা মাহীন আমাদের আরেকজন বান্ধবী আছে জেনেট। বেচারি দুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে বলে স্কুলে আসতে পারেনি। আমি আজ স্কুলের পর জেনেটের বাড়ি যাবো। তুমিও চলো আমার সাথে। বলে থামলো।
মাহীন এক প্রকার আঁতকে উঠল। সাইলোহ নায়েলকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,
“এবং নায়েল তুমিও।”
নায়েল ইতস্তত করে বলল, “আসলে মা আজকে স্কুলের পর আমাকে সাথে ধরে নিয়ে একটা ইয়োগা সেমিনারে যাবে।”
সাইলোহ বলল, “আহারে কি ভাগ্য তোমার।” মাহীনকে কিছুটা বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল। মাহীন জানালার পাশে নিজের সেই টেবিলটায় বসলো। সাইলোহ পাশের টেবিলে। নায়েল বলল, “আচ্ছা তো আমি গেলাম। আমার এখন বাইওলজি ক্লাস আছে।” বলেই দরজার দিকে রওনা দিল। সাইলোহ মাহীনের দিকে ঘুরে বলল,
“তো তোমার মতামত কি?”
মাহীন জিজ্ঞেস করল,
“কি নিয়ে?”
“এই যে যাওয়া নিয়ে।”
এবার মাহীন ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমার মনে হয় না আমার মা রাজি হবেন।উনি খুবই কড়া মানুষ”। সাইলোহ প্রথমে অবাক হলো। বলল,
‘তোমার কেন রাজি হবেন না? কোনো সমস্যা আছে?’
মাহীন অপ্রতিভ ভাবে বলল,
‘না সমস্যা তো নেই। কিন্তু হঠাৎ করে স্কুলের প্রথম দিনই কারোও বাসায় চলে যাবো,তিনি ঠিক অনুমতি দিবন না।’
রহস্যময় ভাবে হেসে বলল,
“তোমার মোবাইল টা দাও।”
মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার মোবাইল নিয়ে কি করবা?”
“আগে দাও তারপর দেখবা।” মাহীন পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সাইলোর হাতে দিল। সাইলোহ মোবাইল অন করেই বলল,
“পাসওয়ার্ড?”
মাহীন বলল,
“৯২২৯।” তারপর অস্থির ভাবে ভাবতে লাগল, ‘আল্লাহ জানে মেয়েটা আমার মোবাইল নিয়ে কি করছে। কোন ঝামেলায় ফেসে গেলাম!’ সাইলোহ এবার সেলফোন কানে ধরলো। মাহীম আরোও অবাক হয়ে চাইল। কয়েক মুহূর্ত পরে সাইলোহ বলে উঠলো, “হ্যালো, আমি সাইলোহ বলছি মাহীনের বান্ধুবী। মাহীন ততক্ষণাৎ বুঝতে পারলো ও কাকে ফোন দিয়েছে। এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শোনার পর সাইলোহ হাসি মুখে বললো,
“জ্বী আন্টি আমি অনেক ভালো আছি। আসলে আমি আজ ছুটির পর মাহীনকে নিয়ে আমার এক বান্ধুবীর বাসায় যেতে চাই যদি কোনো সমস্যা না থাকে। এবং ওর নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার।” কথাগুলো কিছুটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। তারপর কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ফোন কেটে দিয়ে মাহীনের হাতে তুলে দিল। মাহীন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সাইলোহ বলল, এখন কোনো চিন্তা নেই। আন্টি রাজি। মাহীনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ও কাশ্মীনকালেও ভাবতে পারেনি মা ওর এককথায় এমন প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। তারপর অবাক কন্ঠে বলল,
“তুমি সত্যি অবিশ্বাস্য।” ঠিক তখনই টিচার ক্লাসে প্রবেশ করলেন। এবং সকলে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
ছুটির ঘন্টা বাজতে বাজতে বেলা সাড়ে বারোটা বাজলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে গোটা স্কুলে হৈচৈ পরে গেল। সকলে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে লকার করিডরের দিকে ধেয়ে আসছে। পশ্চিমা দেশের এই এক ব্যাপার। স্কুলে ঢুকে এবং স্কুল থেকে বের হওয়ার পূর্বে একবার নিজেট লকারের মুখদর্শন না করলেই নয়। মাহীন ও সাইলোহ একসাথেই গেট থেকে বের হচ্ছে। ইংলিশ ক্লাসের পর জিওগ্রাফি ক্লাস ভিন্ন আর কোনো ক্লাসেই ওরা একসাথে ছিলো না। মি. মোর্শেদের এখন আর মাহীনকে নিতে আসার কথা নয়। কারণ এখান থেকে সাইলোহ ওকে নিয়ে সোজা জেনেট এর বাড়ি পৌঁছবে যা ও পূর্বেই মিসেস নাসরিন কে জানিয়ে দিয়েছে। স্কুলের বাইরে অপেক্ষামান হলুদ বাস শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেবে নিজ নিজ বাড়িতে। তবে সকলেই বাস যাত্রা বেছে নেয় না। অনেকেই পায় হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়। সাইলোহ পার্কিং থেকে নিজের সাইকেলটা বের করল। মাহীন ওর সাইকেলের পেছনে বসল। এর পূর্বে কখনো কারোও সাইকেলের পেছনে বসেছে কিনা মনে পরে না। সাইলোর ভাষ্য, জেনেটের বাড়ি খুব একটা কাছে নয়।তবে সাইকেল চালিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না।’ মাঝে ওরা স্টারবাক্সে একবার ঢু মারলো। এই গরমে কড়া রোদের নিচে যানবাহনের তীব্র ভির এড়িয় এগিয়ে যেতে দুজনেরই কাহিল অবস্থা।তাই দুজনেই ঠান্ডা কিছু নিয়ে নিল। তারপরও বিশ মিনিট পর ওরা পৌঁছল গন্তব্যে।
জেনেট দের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহীন এবং সাইলোহ।বড় ডুপ্লেক্স মডার্ন বাড়ি। সামনের বাগানটা ছোট তবে নানা রঙের ফুলগাছে ভরা। এর মাঝে দুধ সাদা সাদা ফ্রেসিয়া ফুলই বেশি দেখা গেল। দেখেই ধারণা করা যায় খুব ব্যয়বহুল বাড়ি।গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে কলিং বেল বাজাল সাইলোহ।ক্ষণকাল পরেই একজন এপ্রন পড়া মহিলা দরজা খুললেন।ওরা ভেতরে ঢুকে দাঁড়াতেই তিনি বিনিত কন্ঠে বললেন,
“জেনেট ম্যাডাম তার কামরায় আছেন।আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছেন।”
সাইলোহ মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ।” তারপর দুই তলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। সাথে সাথে মাহীনও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।একটা কামরায় সাইলোর সাথে সাথে মাহীন প্রবেশ করল।খুব ছিমছাম ভাবে সাজানো কামরাটি।দেওয়াল গুলো হালকা নীলচে রঙের। মাঝে বিছানায় একটা মেয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।ডিম্বাকৃতির মুখ।লম্বা সোনালি চুল এবং ধূসর চোখের মণি।তবে এখন মুখটা অত্যন্ত মলিন দেখাচ্ছে।ওরা দুজন বিছানার কাছে এগিয়ে যেতেই মেয়েটার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।বিনয়ী গলায় বলল,
“হ্যালো মাহীন! আমি জেনেট এলার্ড।” মাহীন বিছানার একপাশে বসতে বসতে মুচকি হেসে বলল,
“নিজের পরিচয় আর কি দেব? তুমি তো মনে হয় আগে থেকেই চিনে বসে আছ আমাকে।”
জেনেট বলল,
“সবই সাইলোর কল্যাণে।” মাহীন অবাক হয়ে হাসল।মনে মনে ভাবলো, কি অদ্ভুত তো সাইলোহ এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আসলেই আমাকে এত ভালো বন্ধু বানিয়ে নিল? তারওপর ওর আরেক বান্ধবীকেও আমার সম্পর্কে বলাও হয়ে গিয়েছে? কিন্তু বললো কখন?”
সাইলোহ জেনেটকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি কি কালকে স্কুলে আসতে পারবা?”
জেনেট মুখটা বেজার করে বলল,
“নাহ মা কাল যেতে দিবে না। তবে আমি জেদ টেদ করলে দেখা যাক কি হয়। তবে পরশু দিন থেকে নিশ্চিত ভাবে আসবো।” তারপর মাহীনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জেনেট বলল,
“আগামীকালের ক্রিয়েটিভ ইভেন্টে তুমি নাম দিবা?
মাহীন কামরা দেখতে ব্যস্ত। ওর কথায় চমকে তাকাল। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট?”
সাইলোহ বলল,
“আহা আমি তো বলতেই ভুলে গিয়েছি। আগামীকাল সকাল নয়টা পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশনের শেষ সময়। এই সপ্তাহে মোট তিনটি স্কু্লে ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট শুরু হয়েছে। শুধুমাত্র হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারবে।”
মাহীন বলল,
“কিন্তু এই ইভেন্টে কি হবেটা কি? এবং আমি কেন জয়েন করবো?”
জেনেট উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
“এখানে যত্তসব ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম হয়। আমার অনেক ভালো লাগে। কারণ গত বছরের আগের বছরের ইভেন্টটা আমার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।”
সাইলোহ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“জীবনে তো দেখলাম না কোন ক্রিয়েটিভিটর ধার দিয়ে যেতে। আর ওই বছর নামটাও আমিই জোর করে দিয়ে দিয়েছিলাম।”
জেনেট বলল,
আমি কখন বললাম আমার ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম ভালো লাগে? আমি শুধু বলেছি আমার এই ইভেন্টটা ভালো লাগে।”
মাহীন বলল,
“তো এমন কি ঘটনা ঘটেছিল যে তোমার এর আগের বছরের আগের বছরটা অতি স্মরণীয়?”
জেনেট উদ্ভাসিতমুখে বলতে লাগলো,
“সেই বছর আমার ইভেন্ট পার্টনার হিসেবে ছিল লিও আর… সাইলোহ মাঝখান দিয়ে বলল,
” আরেহ থামো তো।তোমার এই ম্যাক্সিকান প্রেম কাহিনী শুনাতে শুনাতে ক্লান্তি লাগে না হয়তো।কিন্তু শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি।মাহীনেরও মাথা খারাপ করো না।”জেনেট মুখ গোমড়া করে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই মাহীন বলে উঠলো,
“আচ্ছা হাই স্কুলের নিচের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হবে না?”
সাইলোহ বলল,
“না।আমাদের স্কুল সহ আরোও ছয়টা স্কুলে গত মাসেই প্রাইমারি স্কুলের ইভেন্ট হয়ে গিয়েছে।
“মাহীন বলল,
“আচ্ছা এখনো এটা বললে না যে এতে কি কি ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম হবে?”
সাইলোহ বলল,
“তুমি যেকোনো টপিকের ওপর প্রজেক্ট তৈরি করতে পারো। কোনো গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা বা কোনো ইনফরমেটিভ আর্টিকেল লিখতে পারো। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পারুক আর না পারুক এই লেখালেখির অংশেই নাম দেয়। কারণ এগুলোর মধ্যে স্কুলের মধ্যে সেরাগুলো বাছাই হবে তারপর সেগুলো “টিনেজ গ্লোরি”
ম্যাগাজিনে পাঠানো হবে। এবং সেখান থেকে সবচাইতে ভালো লেখাটা ওরা ম্যাগাজিনে ছাপাবে।
মাহীন দ্বিধানিত্ব হয়ে বলল,
“এটাই আমার প্রথম দিন স্কুলে। তোমাদের ছাড়া কাউকে চিনি না। কিভাবে দ্বিতীয় দিনই একটা ক্রিয়েটিভ ইভেন্টে নাম লিখিয়ে নেই?”
জেনেট বলল,
“আরেহ এত চিন্তার কিছু নেই।এটা কোনো পরীক্ষা নয়। আর তুমি একা তো কিছু করবা না, তোমার সাথে তো একজন পার্টনার থাকবে।
” কয়জন?” জিজ্ঞেস করল মাহীন।
জেনেট বলল,
“দুই জন যদি তুমি রাইটিং পার্টে নাম লেখাও তাহলে। কারণ এটা একটা গ্রুপ ওয়ার্ক ইভেন্ট।”
সাইলোহ বলল,
” আর পেইন্টিং পার্টেও তিনজন থাকে। শুধু বিভিন্ন ধরনের সাইন্টিফিক প্রোজেক্ট বা এমন ধরনের প্রোজেক্ট গুলোয় চার, পাঁচ বা ছয়জন করে সদস্য থাকে।”
মাহীন জিজ্ঞেস করল,
‘তোমরা কিসে নাম দাও?’
জেনেট গম্ভীরমুখে বলল,
“প্রথমবার সাইলোহ জোর করে আমাকে পেইন্টিং পার্টে দিয়ে দিয়েছিল যেখানে আমি আঁকিবুঁকির ধার ধরেও যাইনা।
সাইলোহ বলল,
“আমি প্রতিবছর পেইন্টিং পার্টে নাম দেই।” ওর কথা শেষ হতেই জেনেট বলল,
“ওর বাসায় গেলে তোমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে। এমন অদ্ভুত ছবি আঁকে, যে আগা গোড়া কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।”
সাইলোহ মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
“হুহ ছবির সম্বন্ধে কিছু জানলে তো বুঝবা। ছবি সম্বন্ধে না জানলে প্রকৃত ছবিকে কাকের ঠ্যাঙ্গ বকের ঠ্যাঙ্গই মনে হবে।”
মাহীন বলল,
“আমি আজ ভেবে দেখবো কোনো অংশে আমি নাম দিতে পারি কিনা। তবে কোনো প্রকার প্রজেক্টে আমি কোনো ভাবেই নাম দেবও না।”
সাইলোহ হালকা হেসে বলল,
“এইতো লাইনে এসেছ।’
চলবে ইনশাআল্লাহ।