#এল_এ_ডেইস
পর্ব-৯
লেখনী- মাহীরা ফারহীন
সকাল পৌঁনে দশটা বাজে। সকাল হলেও অদ্ভুত ভাবে স্কুলে এই সময় লাঞ্চ ব্রেক চলছে। মিসেস রেয়ের কাউন্টারের সামনে বেজায় ভির। আজ সতেরো তারিখ, সকলের ইভেন্ট প্রজেক্টগুলো জমা দেওয়ার দিন। হৈ-হুল্লোড়ে গমগম করছে ছোট্ট করিডোরটা। মাহীন ওদের তৈরি আর্টিকেলটা নিয়ে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। লাইব্রেরি থেকে একটু আগে এটা নিয়ে এসেছে। রায়েদ সেখানে ছিলো না, তবে আর্টিকেলটা সযত্নে টেবিলের ওপর রাখা ছিল। লিম জু আসতে চায়নি, কাজেই ও একাই চলে এসেছে। কাউন্টারের সামনে ছেলে মেয়েদের ভিড়ে তিল ধারণের স্থান নেই। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে একসময় বিরক্ত হয়ে মাহীন বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ রোদের নিচে চত্ত্বরে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে গরম লাগায় পুনরায় ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন ওর জমা দেওয়ার সুযোগ আসল ততক্ষণে ভিড় বলতে কিছুই নেই। অল্প কয়েকজন মাত্র দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন মাত্র ওর আর্টিকেলটা জমা দিল তখন মনিটর ডেক্সটার কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা খাম। মুখে এক রাশ বিরক্তি এবং ক্লান্তিমাখা ছাপ। মিসেস রে মাহীনের আর্টিকেলটার ওপর সীল মেরে মনিটরের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কি ব্যাপার রাবিতকে খামটা দাওনি কেন?”
“ওকে হাতে পেলে তো দেব। ও স্কুলে আসেইনি।”
মিসেস রে কঠিন স্বরে বললেন, “আশ্চর্য ছেলেটাকে হাতের নাগালে পাচ্ছিই না। আজ ওর মায়ের হাত পর্যন্ত এই খামটা পৌঁছতেই হবে। ওর ভাই কোথায়?”
“ওর ভাইও আসেনি। দুইজনই আজ উধাও।”
মাহীন কাউন্টারে ঠেস দিয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্তিতে চোখের মণি ঘুরাল। এই অপেক্ষা বড় বিরক্তিকর জিনিস বটে। মিসেস রে বললেন,
“তাহলে তুমি ওর বাসায় খামটা পৌঁছে দিয়ে এসো।”
মনিটর কপাল কুঁচকে বলল, “ওফ আপনি জানেন তো আমার প্রোজেক্ট নিয়ে এখনো ঝামেলায় আছি। সেটার কাজ শেষ করে তো এক ঘন্টার মধ্যে জমা দিতে হবে।”
মিসেস রে চিন্তিত স্বরে বললেন, “আহা কিন্তু এটা মিসেস রহমানের কাছে দিয়ে আসা প্রয়োজন।”
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মিসেস রে, আমার আর্টিকেলের সংখ্যা নম্বরটা কি আর দেবেন?”
মিসেস রে ওর দিকে এতক্ষণে দৃষ্টি ফেরালেন। আশেপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা গল্প জুড়ে দিয়েছে। মিসেস রে বললেন,
“ওহ হ্যা তোমার নম্বর। থামো।”
মনিটর হঠাৎ মাহীনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা মাহীন এরপর তোমার কি ক্লাস আছে?”
মাহীন ওর দিকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলল,”হিস্টোরি।”
“ওহ তাহলে মিসেস রে, মাহীন কিন্তু খামটা দিয়ে আসতে পারে রাবিতের বাসায়।’ এবার মিসেস রেকে উদ্দেশ্য করে উদ্ভাসিতমুখে বললো ডেক্সটার।
মাহীন চোখ কপালে তুলে বলল, “মানে কি? আমি কেন যাবো! আমি তাকে চিনিও না।”
মনিটর শান্ত ভাবে বলল, “আহা রাবিতের বাড়ি বেশি দূর নয়। এই হেঁটে যেতে ষোলো সতেরো মিনিট লাগবে। এবং সাইকেল নিয়ে গেলে নয় দশ মিনিট লাগবে।”
মাহীন কাটখোট্টা ভাবে বলল, “মশকরা করছ আমার সাথে! আমি যেতে রাজি কখন হলাম যে ওর বাড়ি যেতে কতক্ষণ লাগবে সেটা বলছো? আর বেশি দূর না মানে? সাইকেল নিয়ে যেতেও নয় দশ মিনিট লাগবে!”
মিসেস রে তার কম্পিউটারের মনিটরের দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়ে বললেন,
” ডেক্সটার ওকে কেন বলছো? ও তো মনিটর না। এটা তোমার দায়িত্ব।”
মাহীন তিক্ত কন্ঠে বলল, “আর বাকি মনিটররা কোই? তাদের পাঠাও! আমার পিছনে লেগে আছো কেন?”
ডেক্সটার নিচু গলায় বলল, “আরে বাবা এটাই তো সমস্যা! এটা আমার কাজ। ওরা অন্য কাজ হলে সামলে নিত এখন একজনের বাসায় যেতে হবে সেটা কেউ করতে চাইবে না। আর এমনিতেও ওরা কেউ আমাকে দেখতে পারে না। আর অন্য সময় হলে আমি ওদের জোর দেখিয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু এখন তো আমি অমন আচরণ করা ছেড়ে দিয়েছি।”
শেষের কথাটা অসহায় ভঙ্গিতে বলল। মাহীন একটু গললো না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গাঢ় কন্ঠে বলল,
“তাতে আমি কী করব? ওরা তোমাকে দেখতে পারে না সেটা তোমার দোষ। এখন নিজের ঝামেলা কিভাবে সামলাবা সেটা শুধুই তোমার মাথা ব্যথা।”
ডেক্সটার অনুনয়ের স্বরে বলল,”দেখো মাহীন হিস্টোরি ক্লাস তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওটা একদিন বাদ দিলেও কিছু হবে না। এবং তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমি তোমার কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব।”
মাহীন মুখ বাঁকা করে বলল, “হিস্টোরি ক্লাস গুরুত্বপূর্ণ নয় তাই না? তাহলে এর ক্লাসও না নিলেই পারত। এবং আমার কি দায় পরেছে আমি তোমাকে সাহায্য করব?”
“কারণ গতবার আমি তোমাকে সাহায্য করেছিলাম।
মাহীন বিদ্রুপ করে হাসল। বলল বলল, ” তাই না? তুমি আমাকে নিজে থেকে সাহায্য করলে অবশ্যই আমি এখন তোমাকে সাহায্য করতাম। কিন্তু আহা তোমাকে তো আমার ব্ল্যাকমেইল করা লেগেছিল তাই না? এবং সেই প্রমানাদি কি আমি মুছে ফেলেছি ভেবেছ? অবশ্যই না।”
মনিটর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে বলল,”আমি জানি। তবে বিশ্বাস করো মাহীন, আমি সেইসব বাজে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছি। তুমি কি এর মধ্যে একবারও কাউকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শুনেছ?”
মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল। ভাবল, এ-তো এত সহজে ভালো হবার পাত্র লাগে না। ভালো ভালো আচরণ করছে কারণ এখনো আমার হাতে ভিডিও টা আছে। ভিডিও টা শুধু না থাকলেই যেই লাউ সেই কোদু। আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দি না? নাহলে এত শিক্ষার্থী থাকতে আমাকেই কেন ধরল? আর যাই হোক আমার মন গলাতে পারবে না।’
তখনই মিসেস রে একটা ছোট কাগজ কাউন্টারে রেখে বললেন, “মাহীন তোমার নম্বর।”
মাহীন কাগজটা নিজের পকেটে রেখে মনিটরের উদ্দেশ্যে বলল,
“তো আমি কি করব? আর এই রাবিতকে তোমার এখনই কেন খামটা দেওয়া লাগবে? স্কুল ছুটির পরও তো দিতে পারো।”
“না,না খামটা এখনই ওর বাসায় পৌঁছতে হবে। স্কুল যখন ছুটি হয় সেই সময় ওর মা বাসায় থাকে না। গত তিনদিন ধরে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ওই বদটাকে হাতের নাগালে পাচ্ছিই না।” শেষের কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
মাহীন জিজ্ঞেস করল, “এটা কিসের খাম?”
“অভিযোগের। ওই ফাজিল ছেলেটা সারা স্কু্লের সকলকে জ্বালিয়ে বেড়ায় বলে, ভাইস প্রিন্সিপাল ওর মায়ের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছেন।”
“ও যদি ফাজিল হয় তাহলে তুমি কি? মিসেস হকিংস কেও তো অভিযোগ করে চিঠি লেখা উচিৎ।”
“ওহ মাহীন, আমি তো আর ওমন নেই। নিজেকে শুধরে ফেলেছি। দয়া করে আমাকে সাহায্য করো। নাহলে আমি আমার প্রোজেক্টই শেষ করতে পারব না।”
মাহীনের কপালে এবার চিন্তার ভাজ পরল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। মনে মনে ভাবল, ভাইয়ের শেখানো চার রুলস ফলো করতে হবে। চারটা নেগেটিভ না কারণ দাঁড় করাতে হবে। এক নম্বর আমি চিনি না জানি না মানুষের বাসায় যাবো না। দ্বিতীয় হলো…দ্বিতীয় কী হবে..উম…ওহ হ্যা ডেক্সটার কে সাহায্য করবো না। আর কী? বাকি দুটো কারণ কী হতে পারে?’ বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরও আর কোনো কারণ পেলো না। যেহেতু চারটা কারণ পুরো হলো না কাজেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক আছে আমি যাবো কিন্তু যদি তুমি আমাকে একটা সেরকম কারণ দেখাতে পারো যার জন্য আমার তোমাকে সাহায্য করা উচিৎ তাহলে।”
মনিটরকে বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল। সেও কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বলল,
‘স্টিভ জবস বলেছিল, ” যখন তুমি স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাও তখন সবকিছুকে খাপছাড়া লাগে। কিন্তু যখন তুমি সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে ঘুরে তাকাও তখন সব বিন্দুগুলো অবিশ্বাস্য ভাবে একে অপরের সাথে মিলে যায়।”
মাহীন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অবাক কন্ঠে বলল, “অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে তোমার মত ধড়িবাজ আবার স্টিভ জবসের বাণীও দিতে পারে।” তারপর একটু থেমে বলল,”যা হোক। ঠিকানা দাও আমাকে।”
“কিসের ঠিকানা?
“যেখানে আমাকে পাঠানোর জন্য এত কাঠখড় পোড়ালা তুমি”।
এবার মনিটর ওর কথা বুঝতে পেরে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “ঠিক আছে। লিখে দিচ্ছি।”
বলে পকেট থেকে নোট প্যাড ও কলম বের করে একটা ঠিকানা লিখে মাহীনের হাতে ধরীয়ে দিল। মাহীন মিসেস রেকে ঠিকানাটা দেখিয়ে একবার যাচাই করে নিলো যে আসলেই সঠিক ঠিকানা ও দিয়েছে কিনা। ডেক্সটার কে মোটেও বিশ্বাস নেই।
প্রায় পনেরো মিনিট পর মাহীন কড়া রোদের নিচে স্যান্টা মনিকার রাস্তার ধারের সাইড-ওয়াক ধরে হাঁটছে। কড়া রোদ থেকে নিস্তার নেই। ফুটপাথের ধারে সারি সারি রঙবেরঙের পেতুনিয়া ফুল ঝলমল করছে।
ভাবছে, ‘আমি সত্যিই বেশি দয়া দেখাতে গিয়ে একদিন ডুবে মরবো। কি থেকে কিসে ফেঁসে যাই তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমার কি এখন ক্লাস বাদ দিয়ে এই রাস্তায় থাকার কথা? কোন ছাত্র কি করসে না করসে, চিনি না জানি না তার বাসায় চলেছি অভিযোগ পত্র দিতে। সত্যিই ভাই ঠিক বলে আমার থেকে বড় নমুনা এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা থাকতে পারে না। পরিষ্কার ভাবে সবকিছু জানার পর বুঝার পরও ওই অসভ্য বদ ছেলেটাকে আমি দয়া দেখিয়েছি। সাইলোহ, নায়েল শুনলেও হাসবে।’
ভাবতে ভাবতেই বুক চিরে এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সকলে ব্যস্ত পায়ে একে অপর কে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চলার পথে চোখাচোখি হয়ে গেলে অনেকেই আন্তরিকভাবে হাসছে। মাহীন অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ঠিনাকা অনুযায়ী এটাই সেই ছাত্রের বাড়ি। নেমপ্লেটে বাড়ির নম্বর ছাড়া আর কিছু লেখা নেই। মোটামুটি বড় দুইতলা সাদা বাড়ি। লাল কনক্রিটের টালি বসানো ডরমার ধাঁচের ছাদ। সামনের লোহার গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। সামনে এগিয়ে গিয়ে সাদা কাঠের দরজায় কড়া নাড়ল। অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে দরজা খুলে গেল। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন একজন গোলাপি ফর্সা চেহারার মহিলা। তবে তার চেহারায় শেতাঙ্গদের মতো রুক্ষ ভাবটা নেই। কেমন মায়া মায়া একটা ভাব। গোল চেহারা, টানা চোখ এবং চোখা নাক। মাহীন সালাম দিল। তিনি ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটিয়ে সালামের উত্তর দিলেন। তারপর সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পথ করে দিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,
“আসো মা ভেতরে আসো। তুমি নিশ্চয়ই সামোহি থেকে? কতদিন কেউ আসে না ওখান থেকে।”
মাহীন হালকা হাসল তবে ভেতরে প্রবেশ করতে দ্বিধা বোধ করছে। হয়তোবা মহিলা বুঝতে পেরেই বললেন,
“ভেতরে এসো, কোনো সমস্যা নেই।” এবার মাহীন ধীর পায় ভেতরে প্রবেশ করে জুতা খুলে রাখল। মহিলা দরজা লাগিয়ে দিলেন।
মাহীন বলল, “আপনি মিসেস দিলারা রহমান?”
মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন,
“তুমি বোধহয় নতুন মনিটর। রাবিতের ব্যাপারে কিছু?”
মাহীন মাথা উপরে নিচে ঝাকিয়ে খামটা মিসেস রহমানের দিকে বাড়িয়ে ধরল। মিসেস রহমান খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“বুঝেছি, রাবিত আবার কোনো বদমায়েশি করেছে স্কুলে। এই ছেলেটাকে আর শুধরাতে পারলাম না।” তারপর একটু থেমে মাহীনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার বললেন, “আচ্ছা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো বসো। এবং তোমার নামটা কি?”
মাহীন বলল,”আমি মাহীন ফারুকী। এবং আসলে আমি বসতে পারব না। স্কুলে ফিরে যেতে হবে।”
মিসেস রহমান হাসি মুখে বললেন,”কিছুটা দেরি হলে সমস্যা কি? তুমি কি প্রতিদিন আসো আমার বাসায়? আজই তো প্রথম এলে।”
মাহীন ইতস্তত করে বলল,”কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে…” ওর কথার মাঝখান দিয়ে মিসেস রহমান বললেন,
“আসো আসো। আমি স্টাফড গ্রেপ লিফস বানাচ্ছি। তোমাকে খেয়ে যেতে হবে।”
মাহীন কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে এগিয়ে গেল ওনার পিছু পিছু। গিয়ে রান্নাঘরের সামনে ডাইনিং টেবিলে বসল। ডাইনিং ও রান্নাঘর আলাদা বলতে কিছু নেই। দুটো একই সাথে। ড্রইংরুমের পাশ দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠার সিঁড়ি। ঘরের সবকিছু সাদা এবং সোফা,পর্দা ও কার্পেট নেভি ব্লু রঙের। মিসেস রহমান সিঁড়ির পাশ দিয়ে কোনো একটা কামরায় চলে গেলেন। মাহীন একা বসে রইল ডাইনিং টেবিলে। কিছুক্ষণ পর মিসেস রহমান একজন বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন। বলতে লাগলেন,
“আম্মা এটা মাহীন, রাবিতের বান্ধবী ও মনিটর। তবে ও ঘুরতে আসেনি। রাবিতের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র দিয়ে পাঠিয়েছে স্কুল থেকে।”
বৃদ্ধা সামনে এগিয়ে এসে নিরাশ কন্ঠে বললেন,
“আহা এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। এতটা ফাজিল তোর আশকারা পেয়েই হয়েছে।”
মিসেস রহমান নিজের চেয়ারে বসে বললেন,”আর আপনি যেন ওকে খুব শাসন করেন।”
বৃদ্ধা মাহীনের পাশের চেয়ারে বসে বললেন,”তো মা তুমিও কি সোফোমোর?”
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “জ্বী।”
মিসেস রহমান বললেন, “তো এবার রাবিত কি অকাম করেছে?”
মাহীন ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমি রাবিতের বান্ধবী নই। এমনকি ওকে কখনো দেখিও নি। এবং মনিটরও নই। মনিটর একটা কাজে আটকে যাওয়ায় আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।”
বৃদ্ধা মিসেস রহমানের উদ্দেশ্যে বললেন, “দেখেছিস তাই তো আমি ভাবছিলাম রাবিত তো ওর কোনো বন্ধু বান্ধবকে বাড়ির ত্রিসীমানায়ও আনে না। সেখানে ও বাড়ি পর্যন্ত চলে এলো কি করে।”
মিসেস রহমান ভাবালু কন্ঠে বললেন, “সেটা অবশ্য আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছে।”
মাহীন হঠাৎ করে বলল,”আপনারা দোলমা বানাচ্ছেন। আপনারা কি টার্কিশ?”
মিসেস রহমান মুচকি হেসে বললেন, “না আমার স্বামী টার্কিশ। আমি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূতত।” মাহীন মাথা নাড়ল।
বৃদ্ধা বললেন, “তুই দোলমা খেয়েছিস কখনও?”
মাহীন বলল, “হ্যা, রেস্টুরেন্টে একবার খেয়েছিলাম। তবে ঘরে বানানো কখনো খাইনি।”
বৃদ্ধা ফোকলা দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন,
“তাহলে আজ না খেয়ে যেতে পারবি না।”
মাহীন ইতস্তত হাসল। তারপর জিজ্ঞেস করল,”আচ্ছা আজ রাবিত স্কুলে আসেনি কেন?”
মিসেস রহমান বললেন,”ও স্যাক্রামেন্টোতে গিয়েছে ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। গতকাল রাতে ওর বন্ধুর এক্সিডেন্ট হয়েছিল।”
মাহীন কিছু বললো না। মিসেস রহমান আবার বললেন,”আচ্ছা তুমি সম্ভবত অন্য কোনো দেশ থেকে এসেছো। তোমার জন্মভূমি কোথায়?”
মাহীন বলল,”বাংলাদেশ।”
বৃদ্ধা মিসেস রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”বাহ রে তোর প্রতিবেশী দেশের মেয়ে।”
মিসেস রহমান হাসি মুখে বললেন,”ভালোই তো। আমি অবশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে অতটা জানি না। কারণ আমার জন্ম পাকিস্তানে হলেও কয়েকবছর পরই সেই যে এখানে চলে এসেছি তখন থেকে এখানেই আছি।”
মাহীন মাথা নাড়ল। তারপর বৃদ্ধার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আমি আপনাকে কি বলে ডাকব?”
বৃদ্ধা হেসে বললেন,”কি আবার, বাবান্নেম।”
মাহীন উৎসুকভাবে বলল,”টার্কিশ ভাষা?”
মিসেস রহমান বললেন,”হ্যা টার্কিশ ভাষায় এটার অর্থ দাদি।”
মাহীন মুচকি হেসে বলল,”ঠিক আছে বাবান্নেম।” বৃদ্ধা এবং মিসেস রহমান দুজনেই হাসলেন।
তারপর আধাঘন্টা প্রায় সেখানেই বসেছিলো মাহীন। দোলমা না খাইয়ে মিসেস রহমান ছাড়েননি ওকে। পৌঁনে এগারোটার সময় ও বাড়ি থেকে বের হলো ও। সে বের হওয়ার পূর্বে মিসেস রহমান ও বৃদ্ধা এমন ভাবে মাহীনকে বিদায় দিলেন যেন আর দেখা হবে না। সাথে দোলমাও প্যাকেট করে ধরিয়ে দিয়েছেন। মাহীন সেই প্যাকেট হাতে রাস্তার পাশের সাইড-ওয়াক দিয়ে হাঁটছে। মনে হলো যেন চোখের পলকে অনেক কিছু ঘটে গেল। আজ সকালেও এমন কিছু হতে পারে তা ও স্বপ্নেও ভাবেনি। এমন সময় “উই আর নেভার এভার গেটিং ব্যাক টুগ্যাদার” গানটা বেজে উঠল। মাহীন ওর সেল ফোনটা পকেট থেকে বের করে হাতে নিলো। নায়েল কল দিচ্ছে। ফোনটা ধরে কানে দিতেই ওপাশ থেকে নায়েল উৎকন্ঠিত গলায় বলল,
“মাহীন তুমি এই মাঝ স্কুলের সময় কোথায় গিয়ে বসে আছো? স্কুলের কোথাও তোমাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
মাহীন বলল,”আমি স্কুলে থাকলে তবে তো আমাকে খুঁজে পাবা। আমি এক ছাত্রের বাড়িতে গিয়েছিলাম।”
নায়েল বিস্মিত স্বরে বলল, “কি একটা ছাত্রের বাড়ি? হঠাৎ কেন?”
মাহীন বলল, “আরেহ সেই ছাত্র দুনিয়ার ফাজিল। কোনো এক অকামের জন্য তার মাকে অভিযোগ পত্র দিতে গিয়েছিলাম।”
“সিরিয়াসলি মাহীন, আর ইউ ইনসেইন? মনিটরের এসব কাজ তুমি কেনো করতে যাবা?”
নায়েল থামতেই ওপাশ থেকে হুটোপুটির খটখট শব্দ হলো তারপর সাইলোর কন্ঠস্বর শোনা গেল। সম্ভবত নায়েলের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছে ও।
সাইলোহ উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “মাহীন! হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুইং? তোমার কাছে না সেই ভিডিওটা এখনো আছে? তাহলে কিভাবে মনিটর তার কাজ তোমার ওপর চাপালো?”
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”ইটস কমপ্লিকেটেড। আমি এখন স্কুলেই ফিরে আসছি। এসে সব বলবো। এবং হ্যা ভিডিওটা এখনো আনার কাছেই আছে। আমি নিজে থেকেই এসেছি।”
সাইলোহ ওপাশ থেকে বলল, “ওফ তোমার এই উদারতা যাকে ইচ্ছা তাকে দেখাও। তাই বলে মনিটর! সেকি উদারতার মানেও বোঝে?”
মাহীন তীব্রভাবে বলল,”ওফ সাইলোহ আমি ছোট বাচ্চা নই। যা করেছি বুঝেশুনেই করেছি। আর আমি বললাম তো এসে সবকিছু খুলে বলবো।”
বলেই লাইন কেটে দিলো। তারপর ওর বুক ফেড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সেল ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে আবার ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। এখন ওকে কিছুটা বিষন্নতা ঝেকে ধরল। সেই বিষন্নতা কাটানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। কাজেই মলে ঢুকে একটা মার্শমেলোর প্যাকেট কিনল। হাঁটতে লাগল কোনো ছোট বাচ্চার খোঁজে। কিন্তু রাস্তায় কোনো ছোট বাচ্চাকে একা পাওয়া গেল না। স্কুলের কাছাকাছি আসতেই একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখল স্কেট বোর্ড নিয়ে ধীরে ধীরে ফুটপাথ ধরে যাচ্ছে। কাছে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। ছোট মেয়েটা নীল চোখে উৎসুক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে। মাহীন মার্শমেলোর প্যাকেটটা সামনে বাড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি তোমাকে এটা গিফট করলে কিছু মনে করবা না তো?”
ছোট মেয়েটা কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। হয়তো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না বুঝতে পেরে মাহীন ওর হাতে প্যাকেট টা ধরিয়ে দিয়ে ঝুঁকে বসল ওর পাশে। তারপর বলল,
“তোমার নাম কী?”
“লিলি।”
“অও! নামটা কি সুন্দর স্নিগ্ধ তোমার মত। আচ্ছা আমার না খুব বিরক্ত লাগছে। মন একদম ভালো নেই। কি করব বলোতো?”
মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মাহীনের দিকে। তারপর ওর গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে মুখে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে বলল,
“এখন মন ভালো লাগছে?”
মাহীন হেসে বলল, “অনেক!”
চলবে ইনশাআল্লাহ।