এল_এ_ডেইস পর্ব – ১০

0
369

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ১০
লেখনী – মাহীরা ফারহীন

“চি চি” শব্দে ডাকছে হ্যামস্টার। মাহীন বলল,
“হ্যা হ্যা এইতো চলে এসেছি। তুই মনে হচ্ছে অনেক এক্সাইটেড।”
বলে মুচকি হাসল ও। মাহীন ওর চুনোপুঁটিকে নিয়ে সাইকেলে চেপে স্কুলে যাচ্ছে। সাইকেলের ঝুড়িতে চেপেছে চুনোপুঁটি। প্রাইমারি গ্রেডে প্রাণী যত্ন নেওয়া শেখানো হয় প্রতিমাসে কয়েকদিন করে।সেজন্যেই আজকে মাহীন নিজের চুনোপুঁটিকে সাময়িক সময়ের জন্য স্কুলে দিয়ে দিবে। রাস্তা ভর্তি গাড়ির লম্বা বহর। পরিষ্কার আকাশের পটভূমিতে পেলব সাদা মেঘরাশি ধীর গতিতে বাতাসের সঙ্গে ভেসে চলেছে। রাস্তায় রোদের ঝাপটায় চকচক করছে স্কুলের হলুদ বাসগুলো। স্কুলে পৌঁছেই সাইকেলটা পার্কিং-এ রেখে আসল। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল, নায়েল ও লিও একসাথে লম্বা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মাহীন দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে গেল। রাস্তার দুধারে অরিগন এস গাছের ঝাকড়া ডালপালা ভেদ করে ঝুড়ি ঝুড়ি রোদ পরে চিকচিক করছে রুপালি রাস্তা। লিও ও নায়েল থেমে গিয়েছে। লিও উল্লসিত চিত্তে বলল,

“আরেহ হ্যামস্টার। ওকে হাতে নেই মাহীন?”

মাহীন ওর ওয়েস্ট ব্যাগ থেকে চুনোপুঁটিকে বের করে হাতে নিল। লিও ওকে হাতে তুলে নিলো। নায়েল বলল,

“হাউ কিউট! কি নাম ওর?”

“চুনোপুঁটি।”

নায়েল ভ্রু কুঁচকে চাইল। বলল,”কি বললা বুঝিনি। আবার বলো।”

মাহীন এবার ধীরে ধীরে বলল,”চুঁ..নো..পু…টি”। নায়েল এখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

লিও সহাস্যে বলল,”চিঁনপুটি সিম্পল। এটা বুঝতে এত সময় লাগতেসে?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”না, চুঁনোপুটি।”

নায়েল বলল,”চিয়ানপটি?”

মাহীন বলল, “আহা যেমন তোমাদের সুবিধা হয় তেমনই ডাকো।”
‘এমনিতেই এমন অদ্ভুত নাম তোমরা সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারবে না। শেষে নামটাকে আরোও গোঁজামিল দিয়ে জটিল বানিয়ে ফেলার চেয়ে এটাই ভালো।’ বিড়বিড় করে বলল মাহীন।
লিওর হাত থেকে নায়েল চুনোপুঁটিকে নিতে যাচ্ছে তখন হঠাৎ সে লাফ দিয়ে হাত থেকে নেমে গেল। এবং গেটের দিকে ছুটে গেল। মাহীন সঙ্গে সঙ্গে হ্যামস্টারটির পিছু নিলো। গেটের বাইরে বের হতে চুনোপুঁটিকে আরোও ছয় সাত গজ এগিয়ে যেতে হবে। সেই সময় গেট দিয়ে একটা সাইকেল প্রবেশ করছিল। মাহীন উচ্চস্বরে বলল,

“এই থামো!”

কিন্তু সাইকেলের মালিক বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইল। তবে সাইকেল থামালো না। নায়েলও উদ্বিগ্ন গলায় উচ্চস্বরে বলল,

“এই সাইকেল থামাও নাহলে চিয়ানপোটী তোমার সাইকেলের নিচে চাপা পরবে।”

হ্যামস্টারকে মাহীন কিছুতেই হাতের নাগালে পাচ্ছে না। উল্টাপাল্টা ছুটে যাচ্ছে। এবং সেটা হঠাৎ করে ঠিক সাইকেলের চাকার নিচে পরল। সজোড়ে ব্রেক কোসল মেয়েটা। হ্যামস্টার এতক্ষণে আর জীবিত নেই। মাহীন স্তব্ধ হয়ে মেয়েটার সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেলে বসে থাকা মেয়েটা হতবিহ্বল হয়ে গেছে। আশেপাশে যারা যাওয়া আসা করছিল তারাও থেমে গিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে এদিকে চেয়ে আছে। মাহীনের কষ্টে চোখের কোণায় উষ্ণ নোনা জল জমা হলো। সুন্দর রোদৌজ্জ্বল পরিবেশটা হঠাৎ করেই বিষাদে ছেয়ে গেল। সাইকেলার মেয়েটার জন্য রাগে গা রি রি করে উঠল। ঝাঁঝাল কন্ঠে বললো,

“বাহ এত বার করে বোললাম সাইকেলটা থামাও, সাইকেলটা থামাও কিন্তু তুমি তো কানে তালা দিয়ে বসে আছো। শুনবা কি করে!”

নায়েল ও লিও দুইজনই ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা সাইকেল থেকে নামল। লাল চুল, গাড়ো বাদামি চোখ। ত্রিভুজ আকৃতির সুন্দর মুখখানা। ফর্সা গড়ন এবং গালে সামান্য হালকা ফ্রেকল রয়েছে। তার মিষ্টি সৌন্দর্যটা ধারাল। মেয়েটা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নরম কন্ঠে বলল,

“আসলে আমি তোমার হ্যামস্টারকে চাপা দিতে চাইনি। আমি তো ওকে দেখতেই পাইনি। যখন শুনলাম হ্যামস্টারের কথা ততক্ষণে দেড়ি হয়ে গিয়েছে।”

মাহীন কঠিন স্বরে বলল, “চুপ করো। তোমার ফালতু কথা আমি শুনতে চাই না। আর এসব বাহানা দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমরা এতবার সাইকেল থামানোর কথা বলার পরও না থামানোর কি কারণ থাকতে পারে?”

লিও বলল,”দেখো মাহীন একটু শান্ত হও। অবশ্যই ওর দোষ আছে কিন্তু তাই বলে ও এটা ইচ্ছে করে করেনি।”

নায়েল মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলল,”দেখো হয়তো তুমি হঠাৎ করে বুঝতে পারোনি কি হয়েছে। তবে আমরা বলা মাত্রই তোমার সাইকেলটা থামানো উচিৎ ছিলো।”

মেয়েটা সামনে এগিয়ে এসে ক্লেশপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“ম্যাহিন আমাকে ক্ষমা করে দাও। যেটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে সেটা পূরণ তো করতে পারব না। তোমার হ্যামস্টারকে ফিরিয়ে তো আনতে পারব না। কিন্তু তুমি যা বলবা আমি তাই করব।”

মাহীন মেয়েটার প্রতিটা কথা শুনে যেন আরোও রেগে উঠছে। রাগে চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গিয়েছে। নিতান্তই এক ছোট প্রাণী হলেও তার প্রতি বুক ভরা ভালোবাসা ছিলো মাহীনের। বাবা বিদেশে চলে আসার পর থেকে এই ছোট্ট নরম নিষ্পাপ প্রাণীটিই মাহীনের সর্বক্ষণের সাথী ছিল। বুকে জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপে কঠিন স্বরে বলল, ”

আমার নাম তোমার মুখে নিবা না। তাও আবার ভুল উচ্চারণ করছো। আর আমার জন্য কিছু করতে চাইলে আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। তাহলেই আমি সবচাইতে বেশি খুশি হবো।”

বলেই উল্টো ঘুরে দ্রুত গতিতে গটগট করে স্কুল বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল। তখন সাইলোহ ও জেনেট স্কুলে প্রবেশ করছিলো। এখানে কয়েকজন কে জট পাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসল। জেনেট জিজ্ঞেস করল,

“এই এখানে কি ঘটছে?”

লিও ম্লান স্বরে বলল,”মাহীনের হ্যামস্টার মারা গেছে।”

সাইলোহ চোখ ছোট করে বলল,”হ্যামস্টার? মানে যেটাকে স্কুলে দেওয়ার জন্য আজ আনার কথা ছিলো?”

নায়েল সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। জেনেট উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কিন্তু কিভাবে?”

লিও লাল চুলো মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল,”এই মেয়েটার সুবাদে। তোমরা এখনো ওর সাইকেলের নিচে চুনপুঁটির লাশ দেখতে পারো।”

এটা বলা মাত্র ওরা সাইকেলের দিকে চাইল। এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সাইলোহ মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তুমি, তোমার জন্য এসব কান্ড ঘটেছে। কি নাম তোমার?”

মেয়েটা মিনমিন করে বলল,”ক্যারোল।”

“তুমি কি এখানে নতুন?” জিজ্ঞেস করল সাইলোহ।

“হ্যা আমি জুনিয়র গ্রেডে। এবং এটাই আমার স্কুলের প্রথম দিন।”

জেনেট বলল,”ওয়াও এর চাইতে খারাপ ভাবে আর কোনো কিছুর শুরু কিভাবে হতে পারে।”

ক্যারোল অসহায় ভঙ্গিতে আকুতি ভরা গলায় বলল,
“প্লিজ দেখো আমি জানি আমার দোষ আছে কিন্তু আমার তো ম্যাহিনের সাথে কোনে শত্রুতা নেই। এমনকি এটা আমার স্কুলের প্রথম দিন। কাউকে চিনিও না। দয়া করে তোমরা তোমার বান্ধবীকে বোঝাও, ও যেন আমাকে মাফ করে দেয়।”

স্কুলে প্রবেশ করে চত্ত্বর ধরে হাঁটতে হাঁটতে রায়েদ এগিয়ে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে দেখল লম্বা রাস্তার একপাশে একটা সাইকেল পরে আছে। সেই সাইকেলকে ঘিরে পাঁচজন ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়েদ যখন হাঁটতে হাঁটতে আরেকটু কাছাকাছি আসল তখন শুনতে পেল লিও বলছে,

“আহ আমরা জানি না। তবে নিশ্চয়ই কোথাও গিয়ে কানছে ও।”

সাইলোহ বলল,”আমাদের ওকে খোঁজা দরকার।”

ক্যারোল বলল,”আমি কি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি?”

জেনেট চিকন কন্ঠে বলল,”না বোন, মাহীনের চ্যনপটি কে খুন করেছো এটাই কম কিছু না। তুমি এখন ওর থেকে দূরে থাকো। এটাই তোমার জীবনের জন্য ভালো।”

নায়েল বলল,”ওফ মাহীন ওর চিয়ানপটিকে খুব ভালোবসতো। ক্যারোলের জন্য সে মারা গিয়েছে সেজন্য চরম রাগ তো হবেই। এখন কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে।”

সাইলোহ বলল,”ও যেরকম মেয়ে ও আমাদের সামনে কাঁদবে না। কোথাও বসে কাঁদছে বোধহয়। চলো ওকে খুঁজি।”

লিও বলল, “এক মিনিট চনপোটিকে উঠাতে হবে না?”

“হ্যা চলো আমরা ওকে তুলে এনে চত্ত্বরেই কোথাও কবর দেই।” বলল নায়েল।

বাকিরা ওর কথায় সায় জানাল। ক্যারোল তাড়াহুড়ো করে নিজের সাইকেলটা তুলে ওদের পিছু পিছু ছুটে গেল। ওরা চলে যেতেই রায়েদ আবিষ্কার করল যে, ও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এবং ওদের কথা শুনছিল এতক্ষণ যদিও এটা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। কোথায় কী হচ্ছে, কে কে কথা বলছে সেদিকে কখনোই দৃষ্টিপাত করে না ও। আবার হাঁটা ধরল। এখনো ক্লাস আরম্ভ হতে দেড়ি আছে। কাজেই রায়েদ হাঁটতে হাঁটতে স্কুল বিল্ডিংয়কে পাশ কাটিয়ে লাইব্রেরির দিকে চললো। মাহীনের হ্যামস্টার মারা যাওয়ার ব্যাপারটা ওর মনে সাময়িক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও সেসব নিয়ে আর ভাবতে চাইল না। তবে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালো। কড়া রোদের ঠেলায় উপরে চোখ মেলে তাকানো দায়। স্যকামোর গাছটার বিস্তর ডালপালার ছায়ায় দাঁড়িয়ে কোনোক্রমে চোখ পিট পিট করে চাইল ওপরের দিকে। দেখলো চারতলা উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে কনক্রিটের চওড়া প্রসস্থ রেলিঙের ওপর কেউ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সেই ক্ষুদ্র মানুষটি সহ গোটা বিল্ডিংটিকেই সূর্যের আলোর বিপরীত দিক থেকে আগাগোড়া কালো লাগছে। রায়েদ প্রথমে শুধু একটা অবয়ব দেখতে পেল। তাতেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই মাথা চাপড়ালো। তারপর দ্রুত গতিতে বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠলে লাগল। অথবা দৌড়ে যাচ্ছেও বলা যায়। বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। এক রত্তি অজানা আশঙ্কার অবকাশ হলো মনে। চিন্তা এবং অস্থিরতা কপালে গভীর রেখার সঞ্চার করেছে। ভাবছে, ‘এই মাহীন মেয়েটা পাগল আছে কিন্তু তাই বলে এতটা। যতই পাগলামি করুক দেখে যতটা শক্ত মনে হয়েছিলো, শুধু হ্যামস্টার মারা যাওয়াতেই এই অবস্থা! তাই বলে প্রেমিকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেও বেশির ভাগ মানুষ সুইসাইড করতে যায় না। আর ওকে দেখো।’ ভাবতে ভাবতেই একদম উপরের তলায় এসে পৌঁছল। ছাদের দরজা হা করে খোলা। রায়েদ ভেতরে প্রবেশ করলো। একদম কড়া রোদে উত্তপ্ত ছাদ এর মধ্যে মাহীন কিভাবে বসে আছে সেটাই ও ঠাহর করতে পারল না। রোদের তোরে চোখ পিট পিট করে দেখল বাম দিকে ওর দিক থেকে উল্টো ঘুরে বাইরে পা ঝুলিয়ে রেলিঙের ওপর বসে আছে মাহীন। রায়েদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে থেকে ভাবল, ‘ওফ ওকে এখন কি বলে কি করব? মেয়েটাকে দেখে মনে হয় যেন কেউ ভেঙ্গে পরলে ও সামলাতে পারবে। সেখানে ওর নিজেরই করুন দশা। ওকে দেখে যা মনে হয় আসলেও ও তেমন কিনা এ ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে এখন। তবে আমি এখন ওকে কি বলবো? কাউকে কমফোর্ট করা তো দূরের কথা, কারোও সাথে ভালো ভাবে কথাও বলি না আমি। কত বছর আগে কবে কাকে সান্তনা দিয়েছিলাম তা তো মনেও নেই। সান্তনা কিভাবে দিবো সেটাও ভাবতে হচ্ছে এমনই মানুষ আমি। আর আমিই এখানে এসে হাজির হয়েছি মাহীন তোমার ভাগ্য এতটাই খারাপ।’ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। তারপর সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে মাহীন থেকে দুই হাত দূরে রেলিঙের ওপর উঠে বসল। তারাহুরো করে সেখানে গিয়ে পৌছায়নি, ফলে মাহীন চমকে উঠতে পারে বলে। তারপর নিচে পরতে আর কতক্ষণ দেরি। মাহীন একবার আঁড়চোখে এদিকে চাইল। চোখে মুখে চমক খেলে গেল। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ওর চোখ মুখ কিছুটা ফুলে আছে এবং নাকে লালচে আভা। তবে ও কাঁদছে না। হঠাৎ রায়েদকে এখানে দেখে আবারও সেই অস্বস্তি বোধটা ধরে বসল। রায়েদকে দেখলেই হৃদপিণ্ডে স্বাভাবিক ভাবে চলতে যেন মহা সমস্যা হয়। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল মাহীন। রায়েদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বলল,
“তোমার হ্যামস্টার মারা গিয়েছে জানি। কিন্তু তুমি এই চারতলা বিল্ডিংয়ের ছাঁদে রেলিঙের ওপর কি করছ? সুইসাইড করার এত শখ?”

শান্ত কন্ঠেই কথাটা বলতে চাইলেও শোনালো তা টিটকারির মতো। মাহীন ভ্রু কুঁচকে চাইল ওর দিকে। বলল,
“মনে আছে, সেই যে আমি বলেছিলাম তোমার বোধহয় ওভার থিংক করার বদঅভ্যেস আছে। সেটা আসলেই আছে। তোমাকে কে বলেছে আমি এখানে সুইসাইড করতে এসেছি?”

রায়েদ তিক্ততা সঙ্গে বলল, “সারা দুনিয়ায় এত জায়গার অভাব পরেছিলো যে তোমাকে এই রেলিঙের ওপর উঠে বসতে হলো। এখান থেকে তো তুমি পরেও যেতে পারো।”

“এখন আমরা দুজনেই পরে যেতে পারি।” মুখ বাঁকা করে উত্তর দিল মাহীন।

“আর অন্তত তোমার এতটুকু আক্কেল জ্ঞান থাকা উচিৎ যে এই কড়া রোদের নিচে বসে থাকলে সান বার্ন হবে। এর মধ্যে কিভাবে বসে থাকতে পারো তুমি?”

“আমার কিছুই হবে না, আমি সানস্ক্রিন লাগিয়ে আছি। কিন্তু সান বার্ন তোমার হবে।”

রায়েদ এটা শোনা মাত্র ভাবল, আসলেই তো আমি সানস্ক্রিন লাগিয়ে নেই। সান বার্ন হলে আমারই হবে।”

মাহীন অন্য দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। রায়েদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে যেন মুখ থেকে অন্তত কয়েকটা শান্তনার বাক্য বের হয়। হৃদয়টাও কেমন সবসময় দ্রিমদ্রিম শব্দ করেই চলেছে। ওহ না সবসময় নয়, যখন এই মেয়েটা আশেপাশে থাকে শুধু তখন। গুছানো কথাগুলোও অগোছালো হয়ে যায়। এমনটা তো কখনো হতো না। এত অগোছালো তো রায়েদ ছিলো না। লম্বা নিঃশ্বাস বুক ভরে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

“ওই মেয়েটা ক্যারোল মানে যার সাইকেলের নিচে চাপা পরেছে তোমার হ্যামস্টার সে এই স্কুলে নতুন। এমনকি আজই তার প্রথম দিন।”

মাহীন অবাক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে। রায়েদ বলে গেল, “এবং না ও তোমাকে চিনতো না তোমার সাথে কোনো শত্রুতা ছিলো। হয়তো ওর দোষ ছিলো কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছুই করেনি।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “দয়া করে ওই মেয়েটার গুনগান গেও না।”

“ঠিক আছে। কিন্তু এটা তো মানছো যে তোমার ছোট চ্যানপোটি…মাহীন মুখ গোমড়া করে থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ হেসে ফেললো।
তারপর হাসি হাসি মুখেই বলল,”তুমি নামটা না উচ্চারণ করলেই ভালো।”

রায়েদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভাবল,’অন্তত ওর মুখে হাসি তো ফুটল।’ হঠাৎ শুধু ওকে হাসতে দেখেই ভালো লাগার এক চিলতে পরশ ছুঁয়ে গেল ওকে। বুকের ওপর থেকে এক অস্থিরতার ভার নেমে গেল এক নিমিষেই।
মুখে জিজ্ঞেস করল,

“আচ্ছা এটার মানে কী?”

মাহীন বলল,”কোনটার?”

“এইযে তোমার হ্যামস্টারের নামটার।”

মাহীনের ভ্রু দুটো সূচালো গলো। দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, “চুনোপুঁটি মানে…উম..মানে ওই যে ছোট খাটো জিনিস পত্র”।

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,”হুম বুঝেছি।” তারপর মনে মনে ভাবল, ও সম্ভবত নিজেই জানে না এই অদ্ভুত নামটার মানে কি।”

মাহীন এতক্ষণে নিজে থেকে বলল,”আর তুমি এখানে কি করছ? আমাকে খুঁজে পেলে কি করে?”

“তোমাকে হারিকেন দিয়ে খুঁজে বের করার তো মতলব ছিলো না আমার। তবে তোমার কপাল খারাপ যে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করার সময় তোমাকে আমারই চোখে পরেছে।”

মাহীনের কেন জানি কথাটা শুনতে ভালো লাগল। মিষ্টি মিষ্টি অনুভূতিরা মনের আঙ্গিনায় এসে জড়ো হলো। ও সুইসাইড করবে ভেবে ছুটে এসেছে ও। হাসিহাসি মুখে বলল,
“আর তুমি ভেবেছ আমি সুইসাইড করতে এসেছি এবং তাই ছুটে এসেছো।”

রায়েদ কিছু বললো না। হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, “ক্লাস তো শুরু হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। চলো যাই। আর তোমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে কাহিল হয়ে গিয়েছে।”

মাহীন রেলিঙ থেকে নামতে নামতে বলল, “তাই ওরা আমাকে খুঁজছে?” বলে একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল,”আর আসলেই এখানে বেশিক্ষণ বসা তোমার জন্য ভালো হবে না। সান বার্ন হলে তো আবার আমার দোষ দিবা।”
রায়েদের বুক ফেড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here