#এল_এ_ডেইস
পর্ব-১৫
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন
নিরব, নির্জন, শূন্য গ্যালারি। কোর্টে একটি মাত্র মানুষ ভিন্ন আর কেউ নেই। সকল বাতিগুলো নিষ্প্রভ হলেও একটি বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। মস্ত বাস্কেটবল কোর্টের একদিকের বড় বড় খোলা জানালা গুলো দিয়ে বাকি যা আলো আসছে তাই আলোকিত করে রেখেছে জায়গাটা। ফাঁকা গ্যালারির সামনের সারির একটি সিটে বিষন্ন মনে মাথা নত করে বসে আছে একটা ছেলে। কোর্টের বড় গেটটা হালকা একটু খুলে ভেতরে প্রবেশ করেছে একটা মেয়ে। ভেতরে ঢুকে নিঃশব্দে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। ছেলেটাকে এখানে একা একা বসে থাকতে দেখে মাহীন প্রথমে থমকে দাঁড়ালো। নিরবে কিছুক্ষণ ম্লান আলোয় তাকে পরখ করল। কিছুক্ষণ পর সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। প্রথমে নিজে যেখানে বসেছিলো আধা ঘণ্টা পূর্বে সেখানে গেল। ছেলেটা একবার মুখ তুলে চাইল ওর দিকে। তারপর আবার মাথা নিচু করে বসে রইল। মাহীন সেই সিটের আনাচে কানাচে খুঁজে দেখার পর পাশের সিটের নিচে পরে থাকতে দেখল ছোট ব্যাগটিকে। সেটা তুলে নিয়ে পকেটে ভরল। তারপর দৃষ্টি ফেরাল ওর থেকে দুই সারি পরে বসে থাকা ছেলেটার দিকে। ধীরে ধীরে সিট গুলো পেরিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। প্রথমে একটু ইতস্তত করে তারপর ছেলেটা থেকে দুই সিট দূরে বসলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। চারিদিকে নিরবতা এতটাই প্রখর যে একে অপরের নিশ্বাস ফেলার শব্দও কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে। অবশেষে মাহীন নিজের সিটে হেলান দিয়ে বসে শান্ত কন্ঠে বলল,
“একমাস পূর্বে যখন প্রথম স্কুলে আসলাম, সেই প্রথম দিনই সিক্রেট ট্রি থেকে একটা চিরকুট নিয়েছিলাম। সত্যি বলছি সিক্রেট ট্রি সম্বন্ধে আমার এর পূর্বে কোনো ধারণা ছিলো না। সেখানে প্রথমেই সেই চিরকুটে যা লেখা ছিলো, পড়ে বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিলো না।”
বলে থামল ও। তারপর আর কিছু বললো না। দৃষ্টি সামনের সিটের দিকে নিবদ্ধ। ক্ষণকাল পর ছেলেটাই মুখে তুলে চাইল এবং প্রথম কথা বলল,
“কি লেখা ছিলো?”
“লেখা ছিল একজনের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জবানবন্দি।”
ছেলেটা বিস্মিত হয়ে সরাসরি তাকাল ওর দিকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকল। ওর মুখভঙ্গি দেখে যে কারোও মনে হবে যেন পৃথিবী বুঝি ধ্বংস হতে চলেছে। সে উৎকন্ঠিত গলায় বলল, ”
ম্যাচ ফিক্সিং!? হোয়াট দ্যা হেল! আমাদের টিমের কেউ ম্যাচ ফিক্সিং করেছে?”
কথাটা একটু বেশিই উচ্চস্বরে বলে ফেললো। ফলে প্রতিটি শব্দ খালি হলে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজতে লাগল। মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছেলেটার দিকে। ওভাল আকৃতির মুখ, হালকা বাদামি চুল, ধূসর চোখ। সব মিলিয়ে যারপরনাই সুন্দর দেখতে।
মাহীন ভাবছে, ‘খুব চেনা চেনা লাগছে বিলকে। কিন্তু কোথায় দেখেছি? একই স্কুলে পড়ি আগে দেখে থাকতেই পারি। কিন্তু অনেক পরিষ্কার ভাবেই দেখেছিলাম। চেহারা সম্পুর্ণ মনে আছে।’
“হেই?” ছেলেটার ডাকে ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। তার কপালে গভীর ভাজ।
মাহীন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, “হ্যা ইয়ে আরকি ওই চিরকুট কত পুরনো জানি না। তবে আমার কাছে বেশিদিন আগের মনে হয়নি।”
ছেলেটা অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে নিজেকেই যেন বলল, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার টিমের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।”
মাহীন বলল, “আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের টিম হেঁড়ে গেলেও দোষটা তোমার একার নয়। তার জন্যে তুমি ব্যার্থ ক্যাপ্টেন নও। একটা টিম খেলায় জয় লাভ করলে ক্রেডিটটা খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচরাও নেয়। আর হেরে গেলেই সব দোষ ক্যাপ্টেনের? মোটেও না। এই যেমন ধরো কেউ এবার ম্যাচ ফিক্সিং করে থাকতে পারে। পারে না? একবার করলে আবারও পারে। তাহলে সেটা তোমার দোষ? সবসময় কি আকাশ একই রকম পরিষ্কার ও উজ্জ্বল থাকে? এক টুকরো মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিলেই ব্যস। তাহলে যেকোনো মানুষই সবসময় নিজের সেরাটা দিতে পারে না। কিন্তু দেখো কঠোর পরিশ্রম করলে আর কে থামায় তোমাকে?”
মাহীন অন্য দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কথা গুলো বলে গেল। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে। মাহীন এবার ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“বিল তোমার ভেঙ্গে পরলে তো চলবে না। কারণ তোমাকেই পুরো টিমকে সামলাতে হবে। আর সেই বিশ্বাসঘাতক কে নিয়ে এলার্ট করে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব ছিলো। এখন তুমিই ইনভেস্টিগেশন করে বের করো সেটা কে। নাহলে ওইযে একটা কথা আছে না, এক ঝুড়ি আপেলের মধ্যে একটি নষ্ট আপেল থাকলে সবগুলো আপেলই নষ্ট হয়ে যায়। সেই অবস্থা দাঁড়াতে বেশি দিন নেই।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর উঠে দাঁড়াল। বলল, “আসি তাহলে।”
তারপর ঘুরে দাঁড়াল। এবং গেটের দিকে এগিয়ে গেল। নিরব হলে পদশব্দের মৃদু ঝঙ্কার উঠল। গেটের সামনাসামনি পৌঁছে গিয়েছে সেই সময় পেছন থেকে ছেলেটা উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল,
“ধন্যবাদ!”
ওর কথাটা ফাঁকা গ্যালারিতে প্রতিধ্বনি তুললো। মাহীন আর একবার ফিরে না তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসল। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। যত বেলা বাড়ছে ততই রোদের তাপ বাড়ছে। চোখ ছোট করে তাকাতে হচ্ছে। স্কুল চত্ত্বর এখন একদম নির্জনই বলা যায়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা চলে গিয়েছে। কেউ থেকে থাকলেও সে বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকবে। কড়া রোদের নিচে বসে কপাল পোড়াবে না। মাহীন হাঁটছে ও ভাবছে, ‘এখন মনে পরেছে। এই বিল মুরেই কে কোথায় দেখেছি। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার সাথেই এমন কেন হয়? এখানে আসার পর প্রথমে রায়েদের সঙ্গে দেখা হলো স্বাভাবিক ভাবে। তারপর জানলাম ওকে নিয়ে মেলা গ্যান্জাম। তারপর দেখা হলো র্যবিটের সঙ্গে। তখন ওকে চিনতামই না। তারপর জানলাম ওই নাকি স্কুলের টপ ফাজিল। শুধু তাই নয় রাবিতের বাড়ি থেকেও ঘুরে এসেছি। ওহ না! আমি তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি ব্যাপারটা। রাবিত আর রায়েদ ভাই হলে তো ওটা রায়েদেরও বাড়ি। ওএমজি! তাহলে আমি রায়েদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। ওফ আমি তো ভেবেছিলাম রায়েদের বাড়ি হবে এডওয়ার্ড কুলিনের মতো ঠান্ডা নির্জন পরিবেশে। কিন্তু ঐ বাড়িটা তো দেখি উল্টা। ওর তো সুইট হোম সুইট টাইপের বাড়ি। এনিওয়েজ আর এই বিল মুরেইকে দেখে ভাবলাম হয়তো ওকে প্রথমই দেখছি। কিন্তু নাহ! আমার জীবন তো অনেক ড্রামাটিক। এই বিলই তো ওই ছেলেটা যে আমাকে প্রথম দিন C-2 নং কক্ষটা দেখিয়ে দিয়ে তাল গাছ নিয়ে বাণি দিয়েছিল। ওফ! কেন? কেন? কেন? আমার সাথে এত নাটকীয় ঘটনা ঘটে যে ভাইয়াকে বললে তো বিশ্বাসই করবে না। এর সাথে এত পরে পরিচয় জানাজানি হলেও সবার আগে ওর সাথেই দেখা হয়েছে। সাইলোহ আর নায়েল থেকেও আগে। কিন্তু আমার এই ব্যাপারটা কিছুতেই হজম হচ্ছে না যে ছোট বেলার বন্ধুরা কিভাবে একে অপরের চরম শত্রু হয়ে যেতে পারে? রায়েদের সাথে যে চার বছর আগে কি হয়েছিলো সে এক মস্ত বড় রহস্যই বলতে হবে। এমন রহস্য যে তিন গোয়েন্দা বা সার্লক হোমসকে দিয়ে যদি তা উন্মোচন করানো যায়। আর কি অদ্ভুত ভাবে এই তিনজনই একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। র্যবিট রায়েদের ভাই। ওহ হ্যা! এটা আমার মাথায় আসেনি কেন। র্যবিট যদি রায়েদের ভাই হয় তাহলে অবশ্যই ও বলতে পারবে যে রায়েদের সঙ্গে কি হয়েছিলো? কিন্তু এক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। ও তো নাও জেনে থাকতে পারে। কারণ রায়েদের পারিবারিক কোনো সমস্যা আছে বলে তো মনে হয় না। অবিশ্বাস্য হলেও রায়েদের বাড়ি থেকে তো ঘুরে এসেছি। ওর মা এবং ওর নানি…দাদি নাকি নানি ওফ যাই হোক তাদের ব্যবহার সবকিছু মিলিয়ে ওর ঘরের পরিবেশটা তো আসলে খুব সুন্দর। এবং আসলেই পারিবারিক কিছু ঘটনা থেকে থাকলে অবশ্যই র্যবিট জানতো। এবং এতদিনে ওকে জিজ্ঞেস করে অন্যরাও জানতো। কেউ অন্ধকারে থাকত না। আর যদি ব্যাপারটা পারিবারিক না হয় তাহলে র্যবিট নাও জেনে থাকতে পারে। হয় ও জানেই না কারণটা অথবা হয় ও জেনেও মুখ বন্ধ করে রাখে। এবং এটা কোনো ভাবেও বন্ধুদের জন্য হতেই পারে না। বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে মানুষ একেবারে এমন হয়ে যায় না। বরং কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে যার জন্য ওর বন্ধুত্বই নষ্ট হয়েছে। তাহলে কি এটা কোনো প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক সমস্যা হতে পারে? কিন্তু ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড কখনো থেকে থাকলে তো অন্যরাও দেখতো যদি সে এই স্কুলেরই ছাত্রী হতো। অন্য দিক থেকেও সে এসে থাকতে পারে তাই তাকে কখনো কেউ দেখেইনি। যাই হোক আমিই এখন ওভার থিংকিং করছি বোধহয়। রায়েদের ব্যাপারে আমারই বা এত মাথা ঘামানোর কি আছে? এত মাথা ঘামাই দেখেই না জেনেট ভাবে আমি নাকি ওকে পছন্দ করি। ওয়েল ও দেখতে সুন্দর সেটা আলাদা ব্যাপার। তবে আমি আর ওর লাইব্রেরির ধার দিয়ে যাচ্ছি না। অর্থাৎ আমাদের অফিসিয়ালি দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এবং আসলেই ওকে নিয়ে বেশি চিন্তা করাও উচিৎ না।’
মাহীন হাঁটতে হাঁটতে স্কুল থেকে অনেকক্ষণ পূর্বেই বেরিয়ে গেছে। এখন রাস্তার পাশের সাইড ওয়াক ধরে হাটছে। হঠাৎ একটা মেয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যালি গার্ল এক্সেন্টে বলল,
“হেই দেয়ার! ইওর হ্যান্ড ব্যাগ ইজ ওয়ান্ডারফুল!”
মাহীন চমকে উঠল। মেয়েটার দিকে চেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে স্মিত হেসে বলল,”থ্যাঙ্কস বিউটিফুল!”
মেয়েটা জবাবে মিষ্টি করে হেসে চলে গেল। মাহীন যখন ভালো ভাবে চারিদিকটা পরখ করল তখন ও রিতীমত বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেল। ও আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্যান্টা মনিকার বিখ্যাত রাস্তা “থার্ড স্ট্রিট প্রমোনেড” এ এসে থেমেছে। স্যান্টা মনিকা হাই স্কুল থেকে মাত্র পাঁচ ছয় মিনিটের দূরত্বে এই রাস্তা। থার্ড স্ট্রিট প্রমোনেড শুধু মাত্র পথচারীদের জন্য। এখানে কোনো যানবাহন চলে না। কারণ এটা এককথায় একটি শপিং মল যা রাস্তার ওপর তৈরি করা হয়েছে। এখানে বিশটির মতো সিনেমা হল আছে। একশোটির বেশি দোকান। এবং অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। তাছাড়া রাস্তার পাশে সাইড ওয়াকের মধ্যে মিউজিসিয়ান এবং সার্কাষ্টিক ওর্নামেন্টস নিয়ে তো অনেকে বসেই আছে। রাস্তার পাশে সাইড ওয়াকগুলোর গোড়ায় ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তাল গাছ। এবং তাল গাছের পত্র ছায়ায় আবার তার থেকে খাটো অসংখ্য গাছ বিস্তর ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব গাছগুলোকে আরোও একটু বেশি সুন্দর রুপ দিতে বেশির ভাগের ডাল পালায় বৈদ্যুতিক তাঁরওয়ালা বর্ণিল মরিচবাতি জড়িয়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় প্রচুর ভির। ঝকঝকে ছবির মতো জায়গাটা। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন বর্ণের মানুষরা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা ধরে। মাহীন মুগ্ধতায় কতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তা ও নিজেও বলতে পারবে না। আপনা আপনি কখন ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে তাও বলতে পারবে না। ও ধীরে ধীরে শুধু হাঁটছে ও চারিদিকে মণি ঘুরিয়ে সবকিছুকে একসাথে ধারণ করার চেষ্টা করছে। এদিক ওদিক প্রচুর রঙের সমারোহ। দোকানগুলো একেকটা একেক রঙ্গে রাঙানো। আবার এদিক ওদিক নানা রঙের ছোট ছোট তেকোনা পতাকা উড়ছে। দেওয়াল গুলোয় রঙিন মুরাল অর্থাৎ দেয়ালচিত্র আঁকা। পশ্চিমাদের ভিন্ন সংস্কৃতি পদে পদে ভাবতে বাধ্য করে। কি অদ্ভুত না এরা। এই তল্লাটে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে যাকে চেনেও না জানেও না তাকে হাসি মুখে গ্রিট করে যায়। একটা কমপ্লিমেন্ট দিয়ে যায়। তাতে হয়তো কোনো মানুষের সারাটা দিনও ভালো হয়ে যায়। মনে হয় যেন নাহ এখনো এমন মানুষ আছে যারা তোমাকে চেনেও না, স্টিল তোমাকে এপ্রিসিয়েট করবে। বাংলাদেশে থাকতে যখনই এর ছবি দেখত মাহীন তখনই ভাবত, ইশ বাবা ওই দেশটায় থাকে না শুধু, ওই স্টেটেই থাকে। আর আজ সবকিছু কত আলাদা। সে নিজেই এখানে চলে এসেছে। যেন নিজের স্বপ্নের মধ্যে অনপেক্ষিত ভাবে ঢুকে গিয়েছে। আহা হঠাৎ এখন ভাইকে অনেক মিস করছে। আগে যখন দেশে ছিল দুই ভাই বোন মিলে কত কত রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছে। সেই নীলক্ষেতে শুধু একটু বইয়ের দোকানের মামাদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার বাহানায় ঢুকা আর এক ডজন বই নিয়ে বের হওয়া। বাইরে বের হলেই ফুচকা খাওয়ার কম্পিটিশন তো মাস্ট ছিলো। বইমেলার সময় বারবার ভাইকে বিরক্ত করে টেনে নিজের সাথে বই মেলায় নিয়ে যাওয়া। দুনিয়ার বই কিনে সব ব্যাগগুলো নাইমের হাতে চাপিয়ে দিয়ে নিজে মুক্ত হস্তে ঘুরে বেড়াত। আর এখন? এখন তো নতুন বন্ধুদের পেয়ে ভাইয়াকে ভুলেই গিয়েছে প্রায়। আগে সুখ দুঃখের একমাত্র সাথী ভাইয়া ছিলো। যতই মারামারি কাটাকাটি করুক না কেন দিন শেষে ওর সামনেই দুনিয়ার সমস্যার কথা উগলে দিত। আর গত একমাসে কত কি ঘটে গেল মাহীনের জীবনে কিছুই জানানো হয়নি ভাইকে। আহ! যদি এখন ভাইয়াও এখানে থাকত ওর সাথে। কি মজাটাই না হতো! তখনই টেইলর সুইফটের ব্ল্যাঙ্ক স্পেস গানটা বেজে উঠল, অর্থাৎ ওর মোবাইল বাজছে। মাহীন চমকে উঠলো। তারপর তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনে দেখল, মা লেখা। সাথে সাথে কপাল কুঁচকে গেল। ভাবল, ‘ইয়া আল্লাহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম মায়ের মধু আর দুধের কথা। এখন কি বলবো মাকে?’ ভাবতে ভাবতেই একবার শুকনো ঢোঁক গিলে কলটা রিসিভ করল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে হুংকার দিয়ে মিসেস নাসরিন বললেন,
“মাহীন ফারুকি! তুই এত খামখেয়ালী কেন? কোনো আক্কেল জ্ঞান আদৌ আছে তোর? সেই এক ঘন্টা আগে বলেছিলাম মধু আর দুধ আনতে। তোর স্কুল থেকে বাসায় আসতে সাত আট মিনিট লাগে। সেখানে তুই একঘন্টা ধরে কোথায় আছিস? ”
মাহীন শুকনো কন্ঠে আমতা আমতা করে বললো,
” আসলে মা আমি স্কুল থেকেই মাত্র বের হলাম। তুমি যখন কল দিয়েছিলা তখনই বের হতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটা কাজে আটকে গেছিলাম।”
“ওহ তাই না? আমাকে কি ভেবেছিস তুই হ্যা? তোকে আমিই জন্ম দিয়েছি। ছোট বেলায় এসব বাহানা দেওয়ার বহুত এক্সপেরিয়েন্স আছে আমার। আর আমি তোর চালবাজি বুঝবো না।? যেখানেই আছিস দুই মিনিটের মধ্যে ঘরে আয় নাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।”
লাইন কেটে গেল। মাহীন হতবিহ্বল হয়ে রইল। ভাবল, ‘মার এগুলো বাহানা ইউজ করার অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে? তাহলে উনিও আমার মতোই ছোট বেলায় মিচকা শয়তান ছিলেন? বাহ নাহলে আমি এমন হলাম কি করে।’ ভেবেই মাহীনের ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ।