#ভৌতিক_গল্পঃ “সিহির” (১ম পর্ব)
#রূবাইয়াত_হোসাইন
(গল্পটা দুর্বল হার্টের লোকেদের জন্য নয়)
১
প্রথমে সবাই মনে করেছিলো- লোপা বুঝি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পরে দেখা গেলো সে ধারণা ভুল……
অনেকক্ষণ ধরে সেদিন ওর ঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না। ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ। ভরা বয়সের একটা মেয়ের রুম ভেতর থেকে লক থাকা মানে চিন্তিত হওয়ার মতই ব্যাপার। মেরী উদ্বিগ্ন মুখে লোপার বাবাকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে-
“এই একটু ওঠো তো ! লোপা রুমের দরজা খুলছে না !”
সুমন ডি রোজারিও স্ত্রীর ওপর কিছুটা বিরক্তই হলেন। ছুটির দিনে হালকা ভাতঘুম দিয়েছিলেন, এখন কাঁচা ঘুমটা ভাংলো। তাছাড়া মেরীর এম্নিতেও অল্পে ঘাবড়ে যাওয়ার অভ্যাস। তিনি পাশ ফিরে শুতে শুতে বললেন-
“যাও। আসছি!”
“প্লিজ এখনি ওঠো, আমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে!”
সুমন বিরক্ত মুখে ঘুম থেকে উঠে নিজেও অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালেন। লোপার ফোনটাও বন্ধ। প্রায় আধাঘন্টা ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার করার পর সিদ্ধান্ত হলো মেয়ের রুমের দরজা ভাঙ্গা হবে। ততক্ষণে পাশের বাসা থেকে মার্লিন, হেমন্ত ওরাও সবাই ছুটে এসেছে। মেরী কাঁদছেন খুনখুন করে।
দরজা ভেঙ্গে একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখা গেলো……
ততক্ষণে দিন শেষ হয়ে এসেছে গাজিপুরের ছোট্ট শহরটাতে। বিকেলের আলো অল্পই অবশিষ্ট আছে আর। সেই নিভে যাওয়া আলোয়, আবছা আবছা অন্ধকারেই সবাই দেখতে পেলো- লোপা গলায় ফাঁস নিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলে আছে। ফাঁস নিয়েছে বোধহয় ঘন্টাখানেক আগেই, ওর দু’পাশে হাত দু’টো ঝুকে আছে অসারের মত। কিন্তু লোপার চোখ দু’টো খোলা, জিভ এক সাইডে বেরিয়ে সাপের লেজের মত নড়ছে একটু পরপর। ওহ, মানুষের জিভ এতো লম্বা হয় নাকি ! মা হয়েও মেরী সেই দৃশ্য দেখে ভয় পেলেন। এমন অবস্থায় হালকা ডানে-বামে দুলতে দুলতে, হাসিমুখে একটুও ঠোঁট না নাড়িয়ে লোপা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো-
“এতোক্ষণে আসলি তোরা সবাই ! ফাঁস তো নিয়েছি সে-ই কখন !!”
উপস্থিত সকলে আতংকে বুকে ক্রশ আঁকা শুরু করলো। মেরী বেশি উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে পরে গেলেন মাটিতে।
২
লোপা যে বেঁচে আছে, সেটা এখনো বিশ্বাস করতে পারে না অনেকে……
সেদিন তড়িঘড়ি করে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর তিনি জানালেন- মেয়েটার পালস তখনো আছে। খুব ক্ষীন, কিন্তু একেবারে নিস্পন্দ হয়ে যায় নি। সম্ভবত ফাঁস নেয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই দরজা ভেঙ্গে তাঁকে নামিয়ে ফেলার কারণে মেয়েটাকে বাঁচানো গিয়েছিলো। দরজা-ভাঙ্গা-পরবর্তী ভৌতিক ব্যাপারগুলোকে তিনি হ্যালুসিনেশন বলে উড়িয়ে দিলেন। সুমনকে বললেন- “আপনারা প্রত্যেকে তখন ‘ওভারহোয়েলমড’ অবস্থায় ছিলেন। কি দেখতে কি দেখছেন ! এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আপাতত মেয়েটাকে বাঁচানো গেছে- এটাই বড় বিষয়!”
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলেও খচখচে ভাবটা মন থেকে পুরোপুরি কাটে নি সুমন-মেরী দম্পতির। তাছাড়া আশ্চর্যজনকভাবে লোপাও মনে করতে পারছিলো না সেদিন ওর সাথে কি ঘটেছিলো আসলে। এমনকি মেরী যখন লোপাকে বললেন যে সে গলায় ওড়না পেচিয়ে ফাঁস নিয়েছিলো, তখন লোপা রীতিমত অবাক হলো !
“কি বলছ এগুলো মা ! আমার শুধু মনে আছে আমি দুপুরে খাওয়ার পর শুয়েছিলাম একটু। এরপর ঘুম ভাঙ্গার পরই দেখি পাড়া-প্রতিবেশী, ডাক্তার, তোমাদের হৈ-চৈ… তাছাড়া, তুমি তো আমাকে চেনো ! আমিই বা শুধু শুধু ফাঁস নিতে যাবো কোন দুঃখে !”
লোপা যে ফ্যান থেকে ঝুলতে ঝুলতে কথা বলেছিলো, ওর জিভটুকু যে বিকৃত হয়ে গেছিলো সাপের মত- সেগুলো ইচ্ছা করেই লোপার কাছ থেকে গোপন করা হলো। ডাক্তার সুমনকে বলে দিয়েছিলেন- এসব ব্যাপার নিয়ে এই মুহূর্তে ওর সাথে কথা বলার দরকার নেই।
তবে এটা ঠিক, সেদিনের ঐ ঘটনার পর থেকেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিলো লোপাদের বাসায়। এই যেমন একদিন মেরী গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে দেখেন- পুরো বাথরুম ছোপ ছোপ রক্তে সয়লাব হয়ে আছে। আর এক পাশে স্তুপ করে রাখা অনেকগুলো মহিষের কাটা মাথা……
মেরী চিৎকার করে বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। মায়ের চিৎকার শুনে লোপা ভয়ে ভয়ে বাথরুমে ঢুকে দেখে- সেখানে কিছুই নেই। মেঝেতে রক্তের দাগ, স্তুপ করে রাখা মহিষের কাটা মাথা- কিচ্ছু না। একদম টিপটপ, পরিষ্কার বাথরুম।
রাতে আরেকটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটলো। লোপা আর মেরী দু’জনে একই ঘরে ঘুমায়। সেদিন রাত বারোটার দিকে খাটের নিচ থেকে খচমচ শব্দ আসছিলো। মেরী ভাবলেন ইঁদুর-টিদুর হবে বোধহয়। আজকাল ইঁদুর ভীষণ উৎপাত শুরু করেছে। শব্দটাকে পাত্তা না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিলেন তিনি।
তবে ভীতিকর ব্যাপারটা ঘটলো এর মিনিট পনেরো পরেই। ঘুমে মেরীর চোখটা প্রায় লেগে এসেছিলো তখন, হঠাতই শুনতে পেলেন খাটের নিচ থেকে কেমন গোঙ্গানোর মত একটা শব্দ আসছে। যেনো কারো গলা টিপে ধরেছে কেউ একজন। এবার মা-মেয়ে দু’জনই খুব ভয় পেয়ে গেলো সত্যি সত্যি। বিছানার নিচে কোনো কিছু অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিলো স্পষ্ট। মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে লোপা খাট থেকেই চিৎকার দিয়ে বাবাকে ডাকলো। মেরী ততক্ষণে ঘরের সব বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছেন। আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো ঘর……
সুমন এম্নিতেও একটু দেরি করে ঘুমান রাতে, মেয়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে এলেন পাশের রুম থেকে। গোঙ্গানোর শব্দ থেমে গেছে ততক্ষণে, ইদুরের খচমচ, দৌড়াদৌড়িও নেই। তারপরো নিশ্চিত হবার জন্য বিছানার নিচে উঁকি দিলেন তিনি। মেয়ে আর স্ত্রীর কাছে ঘটনা শুনে সুমনের কিছুটা ভয় ভয় লাগছিলো ঠিক, কিন্তু সত্যি সত্যি যে এমন কিছু একটা দেখবেন সেটা কল্পনাতেও আনেন নি। সুমন আতংকিত চোখে দেখলেন- সেখানে অনেকগুলো মানুষ গাদাগাদি করে শুয়ে আছে, আর খাটের তলার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে একজন আরেকজনকে পেছনে ফেলে। কেউ বলে না দিলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে- এগুলো আসলে মানুষ নয়, বরং মানুষের লাশ। কারণ জীবিত মানুষ কখনো এতো বিবর্ণ কিংবা এরকম বোধশক্তিহীন জন্তুর মত হয় না। হতে পারে না ! ঐ অল্প মুহূর্তের জন্যই এক ঝলকে সুমন দেখতে পেলেন – এদের কারো কারো চেহারা প্রচণ্ড বিকৃত। কারো চোখ গলে পড়ছিলো কোটর থেকে, কারো ঘাড় পেছন দিকে মোচড়ানো, কারো আবার শরীর পোড়া……
সেদিন রাতটা আর তেমন ঘুম হলো না কারো, যদিও অল্পক্ষণ পর ধ্বস্তাধ্বস্তি কিংবা গোঙ্গানোর শব্দ থেমে এসেছিলো পুরোপুরি। মেরীর শুধু মনে হচ্ছিলো- ওদের বাসায় বুঝি সাক্ষাত কোনো শয়তান নেমে এসেছে।
সুমন রোজারিও তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন- পরদিনই গির্জার ফাদারের কাছে পরামর্শের জন্য যাওয়া হবে।
৩
রাকিবের একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে। নাম- “লৌকিক নয়, অলৌকিক”। বিভিন্ন ভৌতিক ঘটনা জোগাড় করে শেয়ার করা হয় ওখানে। খুব বেশি একটা লাইক, সাবস্ক্রাইবার না থাকলেও রাকিবের চ্যানেলটা অন্য আর আট-দশটা চ্যানেল থেকে আলাদা। কারণ এখানে পোস্ট করা প্রতিটা ঘটনা নির্ভরযোগ্য, একেবারে প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের কাছ থেকে শোনা। তাছাড়া সে বেশ প্রফেশনালি কাজ করে। বেশ সময় দেয় চ্যানেলের পেছনে। ইনভেস্টমেন্টও কম না। প্রচুর সোর্স/ গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখতে হয় আশেপাশে, যেনো অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটলেই সাথে সাথে খবর চলে আসে। সত্যি বলতে- এদের পেছনেই বাজেটের একটা বড় অংশ চলে যায় তাঁর। এ কারণেই সারা দেশব্যাপী পেইজের কাজ ছড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও ফান্ডের অভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না অনেকদিন যাবত। চ্যানেলটাও তাই আপাতত গাজিপুর ভিত্তিক।
এই শহরটা ছোটখাট হলেও মাঝে মাঝেই কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। এই যেমন কয়েকদিন আগে লোপা রোজারিও নামের একটা মেয়ে আত্মহত্যা করলো। সবাই দেখেছে- তাঁর লাশ ফ্যান থেকে ঝুলছে। ডেডবডি নাকি কথাও বলেছিলো ! রাকিবের ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করার মত উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনাই বটে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর তিনি বললেন- ওসব নাকি চোখের ভুল। এম্নিতে লোপা হয়তো সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু মারা যায় নি। সেদিনই ক্লিনিক থেকে বাবা-মা’র সাথে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফেরত এসেছিলো বাসায় !
রাকিব লোপাদেরকে না চিনলেও মার্লিন আন্টিদেরকে চেনে। উনার ছেলের কাছ থেকে পরবর্তী ঘটনা জানলো। ঐ ‘সো কলড’ আত্মহত্যার পর থেকেই নাকি মেরী রোজারিওদের বাসায় অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে। গত রবিবার নাকি সুমন রোজারিও গির্জার ফাদারের কাছেও গিয়েছিলেন……
আজও রাকিব মার্লিন আন্টিদের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যেই বের হলো। লোপার ঘটনাটার আপডেট নেয়া দরকার। ভেবেছিলো- যাওয়ার পথেই জামাল জাদুকরের সাথে দেখা করে যাবে। তাঁর খুব নির্ভরযোগ্য একজন সোর্স জামাল জাদুকরের খবর দিয়েছে। লোকটা নাকি গত সপ্তাহে এ শহরে এসে উঠেছে। সোর্স ছেলেটা খুব জোর দিয়ে বললো- “জামাইল্যা কিন্তু ডেঞ্জারাস জাদুকর। ওরে বুজরুক ভাইবা ভুল কইরেন না। ও সত্যি সত্যি প্রাচীন জাদুবিদ্যায় পারদর্শী !”
সেই ‘খাঁটি'(!) জাদুকরের সাথে দেখা করে অবশ্য আশাভঙ্গ হলো রাকিবের। চেহারায় কোনো রহস্য নেই। আর আট-দশজন মানুষ থেকে কোনোভাবেই আলাদা করা যায় না লোকটাকে। তবে চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত ধুর্ত। এখানেই একটা থার্ড ক্লাস আবাসিক হোটেলে এসে উঠেছে।
জামাল জাদুকর রাকিবের সাথে দেখা করলো ঠিকই, কিন্তু তেমন কোনো কথা বলতে রাজি হলো না কেন জানি। রাকিব প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেছিলো, কিন্তু কোনো জবাব পেলো নাঃ
“শুনলাম আপনি নাকি বাতাসে ভেসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারেন?”
“আপনি পিশাচ সাধনা করেন- এ কথা কি সত্যি?”
“অনেকে নাকি আপনাকে কবরস্থান, শ্মশান ঘাট এসব জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে? ওখানে নাকি আপনি অদৃশ্য কার সাথে কথা বলেন……”
জামাল স্রেফ মুখে কুলুপ এটে রাখলো। শেষমেষ রাকিব যখন অনুরোধ করলো তাঁকে শূণ্যে ভেসে দেখাতে, তখন চার লাখ টাকা চাইলো সে রাকিবের কাছে। বললো- টাকা দিলে বাতাসে ভেসে দেখাবে।
“আমি আপনাকে দুই হাজার টাকা দিবো। যদি মনে করেন- এই টাকায় কখনো দেখাতে পারবেন, তাহলে আমাকে ফোন দিয়েন। আমি আমার ফোন নাম্বার দিয়ে যাচ্ছি !”
মনটাই বিষিয়ে গেলো রাকিবের। উড়ে দেখানোটা তো হাত সাফাই এর ম্যাজিকও হতে পারে ! সেটা যে সত্যিই কালোজাদু তারই বা নিশ্চয়তা কী আছে। আর এ জিনিস দেখানোর জন্যও এই লোক চার লাখ টাকা চাইছে ! তবে জাদুকরকে খুব পড়ুয়া বলে মনে হলো। ঘরময় একগাদা কাগজপত্র, পুরানো দিনের পুঁথি আর বিভিন্ন বইখাতা ছড়ানো। আজকাল শহরে মোম খুব একটা দেখা যায় না, কিন্তু রাকিব দেখলো জামাল জাদুকর এই দিনের বেলাতেই ঘরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রঙের মোম জ্বালিয়ে রেখেছে……
বিরক্ত মেজাজে রাকিব জামাল জাদুকরের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে সেদিন। শুধু শুধুই তাঁর দুপুরটা নষ্ট হলো !
৪
লোপার একেবারে প্রথম দিনের ঘটনা থেকে শুরু করে খাটের নীচে অশরীরি উপস্থিতি- সবই স্থানীয় চার্চের প্রধান ফাদার বেঞ্জামিন কস্তাকে খুলে বলা হয়েছিলো। সাগর রোজারিও নিজে স্ত্রীসহ চার্চে গিয়েছিলেন সেদিন। ওখানেই ফাদারকে সবকিছু বিস্তারিত জানালেন তিনি।
মেরী উদ্বিগ্ন গলায় ফাদারকে জিজ্ঞেস করলো- “আমার মেয়েটার ওপর কি শয়তান ভর করেছে ফাদার?”
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তার পুরো শরীর কালো আলখাল্লায় মোড়ানো। উনি চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে নরম গলায় বললেন- “আরেকটু পর্যবেক্ষণ না করে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না আসলে। তাছাড়া আগে প্রমাণিত হতে হবে ঘটনাগুলো আসলেই অতিপ্রাকৃত কিছু কি না ! যদি দেখা যায় যে- সমস্যাটা আসলে লোপার মানসিক, তাহলে এক্ষেত্রে তো চার্চের করণীয় কিছু নেই। ”
“কিন্তু সেদিন আমিও যে খাটের নীচে কি কি সব দেখলাম? তাহলে কি আমাদের পুরো বাসাটাই……”- সুমন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলো।
ফাদার সাথে সাথে বললেন- “চিন্তা করবেন না, আমি কালই আপনাদের ওখানে একজনকে পাঠাবো !”
“আমার একটাই মেয়ে, ফাদার ! ওর কিছু একটা হয়ে গেলে……”- সুমন কথাটা শেষ করতে পারলেন না। দু’জনই চোখ মুছতে লাগলেন অসহায়ের মত।
ফাদার বেঞ্জামিন সুমনের কাঁধে হাত রেখে অভয় দিলেন। নরম গলায় বললেন- “আমি আজই বিশেষ প্রার্থনা করবো মেয়েটার জন্য! চিন্তার কিছু নেই। ”
পরদিনই ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ফাদার প্রতাপকে পাঠালেন। ভদ্রলোকের বয়স খুব একটা বেশি না। এখনো কিশোর কিশোর চেহারা। সুমন যদিও উনার ওপর খুব একটা ভরসা করতে পারছিলেন না, কিন্তু কি আর করার ! চার্চ নিজে পাঠিয়েছে উনাকে। ঠিক হলো- ফাদার প্রতাপ সে রাতটা লোপাদের বাসায় থেকে যাবেন।
***
লোপাদের বাসায় আসার পর থেকেই ফাদারের কেমন যেনো একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো। অশরীরি একটা কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করছিলেন তিনি। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কেসে ভিক্টিমের মানসিক সমস্যাটাই ধরা পরে শেষমেষ। ফাদার প্রতাপও মনে মনে তেমনই একটা কিছুর জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে পরিস্থিতি খুব একটা ভালো ঠেকছে না। বিশেষত রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে বাড়ির অস্বাভাবিকতা যেনো বাড়তেই লাগলো শুধু।
এই যেমন একটু আগেই তিনি দেখলেন- ঘরের পর্দার পেছনে কে যেনো দাঁড়িয়ে আছে। রাত বাজে বারোটা। বাসার সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে এরই মধ্যে। এতো রাতে পর্দার পেছনে কে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে ভাবতে ভাবতেই ফাদার স্বাভাবিক গলায় প্রশ করলেন- “কে ওখানে !”
কেউ কোনো জবাব দিলো না, শুধু পর্দাটা দুলে উঠলো একটু। পর্দার নীচ দিয়ে শুধু পায়ের পাতাটুকু বের হয়ে আছে। ফাদার আতংকিত চোখে দেখলেন- চোখের নিমিষে সেগুলো হঠাত মুরগীর হলুদ পায়ে পালটে গেলো। মানুষের পায়ের সমানই বড়, শুধু দুই পায়ে তিনটা করে মোট ছয়টা আঙ্গুল……
ফাদার চোখ বন্ধ করে বুকের উপর ঝুলে থাকা ক্রশটা স্পর্শ করলেন। চোখ খোলার পর দেখলেন- পর্দার পেছনে কেউ নেই, কিন্তু লোপা তাঁর সামনে ফ্যান থেকে ঝুলছে। ওর জিহবাটা গলায় ওড়নার মত করে প্যাচানো। লোপা সেই অবস্থাতেই পুরুষদের মত ভারী গলায় গলায় হাসতে হাসতে বললো- “তোরে পাঠাইছে কেন ! আমি তো চাইলেই এখন তোরে টিপ্যা মাইরা ফালাইতে পারি। তোর বাপরে আসতে কইছ ! বেঞ্জামিনরে দেখি না অনেক দিন হা হা হা !”
ফাদার প্রতাপ কাঁপা কাঁপা গলায়, পিতলের ক্রশটাকে শক্ত করে ধরে বললো- “Adjure te, spiritus nequissime, per Deum omnipotentem.” (“I adjure thee, most evil spirit, by Almighty God.”/”হে পাপীষ্ঠ শয়তান, আমি তোকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নামে আদেশ করছি……”)
লোপা হাসছে হা হা করে। কোথায় যেনো কাক ডাকছে হাজার হাজার। এতো রাতে কাক ডাকবে কেন ! ওহ, পর্দার পেছনে ঐ জিনিসটা কি ফিরে এসেছে আবারো ! কিসের যেনো নাড়িভুড়ির উৎকট গন্ধ আসছে একটা। ফাদার প্রতাপের কপাল ঘামতে লাগলো।
তিনি বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে আবার বললেন- “Adjure te, spiritus nequissime, per Deum omnipotentem….”
***
চলবে