#ভৌতিক_গল্পঃ “সিহির” [শেষ পর্ব]
(গল্পটা দুর্বল হার্টের লোকেদের জন্য নয়)
***
রাকিবদের এ শহরটাকে আদৌ কোনো শহর বলা যায় কি না- সেটা নিয়ে রাকিবের সন্দেহ আছে! এখনো এর গা থেকে মফস্বলের গন্ধ যায় নি। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতই ছিমছাম, নিস্তরঙ্গ একটা এলাকা। খ্রিস্টান অধ্যুষিত বলা না গেলেও এ ধর্মাবলম্বী মানুষের অনুপাত এখানে তুলনামূলকভাবে বেশি। মুসলমানদের পাশাপাশি দীর্ঘকাল যাবত খ্রিস্টানদের একটা বড় অংশই এ শহরে বসবাস করে আসছে; অন্তত রাকিব জন্মের পর থেকে সে তা-ই জানে।
এমন নির্ঝঞ্ঝাট শান্তিপূর্ণ একটা শহরেই সেদিন গুরুতর একটা ঘটনা ঘটে গেলো। চার্চের বয়োবৃদ্ধ যাজক- ফাদার রবিনের মরদেহ পাওয়া গেলো গির্জার বারান্দায়। কে বা কারা যেনো উনাকে মেরে ফেলে রেখে গেছে। পুলিশ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো- “আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?”
ফাদার বেঞ্জামিন কোনো উত্তর না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুধু। তাঁর হঠাত গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেলো ……
চার্চ এখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে লোপার ওপর কিছু একটা ভর করেছে। বিশপের অনুমতি নিয়ে তিনি শয়তান তাড়ানো বা ‘এক্সরসিজম’ যেটাকে বলে- তাও শুরু করে দিয়েছেন। গতকাল ছিলো সেই এক্সরসিজমের প্রথম দিন। ফাদার বেঞ্জামিন তাঁর শিষ্য হিসেবে ফাদার প্রতাপকেও সাথে রাখলেন এবারে। এম্নিতেও এক্সরসিজম একা করার নিয়ম নেই। তাছাড়া প্রতাপের যেহেতু শয়তান তাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহ আছে, তাই এখন থেকেই অল্প অল্প করে শিখে রাখুক ব্যাপারটা !
সেদিন রাতে লোপাদের বাসায় তুলকালাম কান্ড হলো। ফাদার বেঞ্জামিনকে দেখে লোপা কখনো হাসছিলো, কখনো কাঁদছিলো। কখনো পুরুষদের মত গলায় হুংকার দিচ্ছিলো ফাদারকে। ওদিকে বেঞ্জামিন কস্তা অচঞ্চল, প্রশান্ত ভঙ্গিতে আওড়ে যাচ্ছিলেন একের পর এক প্রার্থনা। কখনো কখনো গসপেল থেকে বাছাই করা অংশ পড়ছেন লোপার পাশে বসে। প্রথম দিকে ফাদার প্রতাপ অল্প অল্প ভয় পেলেও একসময় তারও সয়ে এলো সবকিছু। শুধু একটা পর্যায়ে গিয়ে উনি আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাও স্বল্প সময়ের জন্য……
লোপার ওপর ভর করা পিশাচ আর ফাদার বেঞ্জামিনের মধ্যে তর্কাতর্কির তেজ শুরুর দিকে অনেক বেশি ছিলো, কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে সেটা স্তিমিত হয়ে এলো। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে তর্কাতর্কি চলার পর ফাদার প্রতাপ দেখেছিলেন- উত্তর দিকের বারান্দা থেকে ক্যাথলিক নানের অবয়বে কিছু একটা তাঁর দিকে উড়ে আসছে। একটু কাছে আসার পর সবাই দেখতে পেলো- সেটা সিস্টারদের খ্রিস্ট-ধর্মীয় পোশাক। দেখে মনে হচ্ছে- অদৃশ্য কিছু একটা যেনো নানের পোষাকটা পরে বাতাসের গায়ে ভাসছে, আর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাঁদের দিকে। দ্রুত মন্ত্রোচ্চারণের মত সেটার ভেতর থেকে ল্যাটিন শ্লোক ভেসে আসছে…… সব মিলে- দৃশ্যটা এতোই অতিপ্রাকৃতিক যে ফাদার বেঞ্জামিন পর্যন্ত কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠেলেন কিছু সময়ের জন্য। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে মনযোগ ফেরালেন প্রার্থনায়।
এমন মুহূর্তে কথা নেই বার্তা নেই পরিস্থিতি হঠাতই স্বাভাবিক হয়ে এসেছিলো একদম। অদ্ভুত, অলৌকিক সবকিছু মিলিয়ে গেলো বাতাসে। শুধু লোপা করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো ফাদার বেঞ্জামিনের দিকে। ফাদার গম্ভীর গলায় মেয়েটার চোখে চোখ রেখে বললেন-
“তোর পরিচয় দে!”
“আমি ‘বিলজিবাব’, ফাদার !”
প্রতাপ চমকে উঠে ফাদার বেঞ্জামিনের দিকে তাকালেন। বেঞ্জামিন একপলকে তাকিয়ে আছেন লোপার দিকে। হঠাতই মেয়েটা হেসে উঠলো ভারী শ্লেষাজড়িত, বলশালি পুরুষের গলায়। খলখল করে হাসতে হাসতে রক্ত বেরিয়ে এলো মেয়েটার মুখ থেকে।
“হে পাপীষ্ঠ শয়তান, আমি তোকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নামে আদেশ করছি। নিষ্পাপ মেয়েটাকে আর কষ্ট দিস না……”
লোপা আগের মতই পুরুষালি গলায় কথা বলে উঠলো জবাবে। তবে এবারে তাঁর কন্ঠস্বরে অনুনয় ঝরে পড়ছে- “বেঞ্জামিন ! আমাকে ছেড়ে দে। দেখ, তোদের উপকার হবে !”
“বাজে কথা বলিস না ! তোর উপকার কে নিতে চেয়েছে !”
“ফাদার রবিনের জীবন ঝুঁকিতে আছে। ওনাকে ডক্টর ইলিয়াস মেরে ফেলবে……”
ফাদার বেঞ্জামিন লোপার কথা শেষ করতে দিলেন না। কঠিন গলায় বলে উঠলেন- “আমি তোর কাছ থেকে জানতে চাইছি না কিছুই ! তুই এক্ষণ, এই মুহূর্তে মেয়েটাকে ছেড়ে চলে যাবি !”
“আহ বেঞ্জামিন, আর কষ্ট দিস না আমাকে। দোহাই লাগে তোর ঈশ্বরের ! আমি চলে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি……”- বলতে বলতে লোপার কন্ঠস্বর ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হয়ে এলো। ফাদার ক্লান্ত গলায় সুমনের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “ওকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিন। আজকের মত আর বিরক্ত করবে না।”
অন্যরা রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর ফাদার প্রতাপ জিজ্ঞেস করলোঃ “ও যা বলে গেলো, সেটা কি ঠিক? উদ্বিগ্ন হবার মত কোনো কারণ কি আমাদের আছে, ফাদার?”
“হ্যাঁ আছে, উদ্বিগ্ন হবার কারণ আছে ! আমি ফাদার রবিনের জীবন নিয়ে শঙ্কিত, কিন্তু ডক্টর ইলিয়াসের ব্যাপারে ও যা বললো, তাঁর পুরোটাই ভুয়া !”
“ডক্টর ইলিয়াস কে, ফাদার?”
“খুব বড় একজন মুসলিম স্কলার। উনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। রাস্তার ওপারে যে মাদ্রাসাটা আছে, ওখানকার উপদেষ্টা বোর্ডে আছেন উনি।”- এটুকু বলে ফাদার বেঞ্জামিন হাপাতে থাকেন। খুব ধকল গেছে তাঁর উপর দিয়ে।
“শোনো প্রতাপ, এক্সরসিজম খুব ভয়ংকর একটা খেলা। খুব স্পর্শকাতরও। এ খেলায় আমাদের প্রতিপক্ষ কিন্তু যে সে কেউ নয়, স্বয়ং শয়তান অথবা তাঁর সঙ্গীসাথীরা। বিভিন্নভাবে তাঁরা তোমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাবে। এতো কৌশলে সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে তোমাকে বিভ্রান্ত করে দেবে, ভাবতেও পারবে না ! এ কারণেই……”- ফাদার কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বললেন- “সব যাজককে শয়তান তাড়ানোর অনুমতি দেন না বিশপ। যারা একই সাথে ধার্মিক, জ্ঞানী, সতর্ক আর জীবনযাপনে সদাচারী- তাদেরকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়! সুতরাং বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না কখনো। হঠকারী কোনো সিদ্ধান্তও নেয়া যাবে না, বুঝেছো !”
***
“আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?”- পুলিশের কথায় আবার বর্তমানে ফেরত এলেন ফাদার। তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে, সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতাপকে বলে উঠলেন- “এই মুহূর্তে ‘হলি ওয়াটার’ রেডি কর। আজ আর রাতের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। এখনি যেতে হবে লোপাদের বাসায় !” তারপর পুলিশের দিকে ফিরে বললেন- “অনুগ্রহ করে আমাদের ও আশপাশের চার্চগুলোতে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করবেন। এ মুহূর্তে কাউকে আমি সন্দেহ করছি না, তবে আশংকা করছি আরো প্রাণহানি হতে পারে !”
ফাদারের আশংকা সত্যি প্রমাণ করে সেদিন রাতেই আরেকটা খুন হলো। তবে এবারে ভিক্টিম চার্চের কেউ ছিলো না, বরং এক অল্পবয়েসী স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্র মারা গেলো ছুরিকাঘাতে। ডক্টর ইলিয়াস ঐ মাদ্রাসরই উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য। তিনি খুনের খবর শুনে দৌড়ে গেলেন……
ছেলেটাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে- এটা তিনি জানতেন। তবে মার্ডারের পর কে বা কারা যে ওর পিঠের ওপর সোনালি কালি ব্যবহার করে ক্রশ এঁকে দিয়েছিলো- তা মাদ্রাসায় পৌঁছে জানতে পারলেন।
গভীর দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় ইলিয়াস সাহেবের বাকি রাতটুকু কাটলো। ভোরে ফজরের নামাজের পর তিনি আর ঘুমালেন না। আটটা বাজতেই ফাদার বেঞ্জামিনের নাম্বারে ফোন দিয়ে বললেন- “ফাদার, আমি একটু জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে চাই আপনার সাথে। প্লিজ আমাকে সময় দিন একটু !”
৬
শয়তান যখন কারো ওপর ভর করে, তখন প্রথমদিকে সে ছদ্মবেশ ধরে থাকে। যার উপর ভর করা হলো- সে ব্যক্তির ছদ্মবেশ। এ কারণেই সে সময়টাতে শয়তান আর শয়তান আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য করাটা খুব শক্ত। খুব সাবধানে এ সময়টাতে পিশাচের সাথে কথোপকথন চালাতে হয়……
ঐ ধাপ অবশ্য ফাদার বেঞ্জামিন পার হয়ে এসেছেন অনেক আগেই। এখন কোন কোন সময়ে লোপার ওপর শয়তান ভর করে আছে, আর কোন সময়টাতে লোপা স্বাভাবিক আছে- সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন দু’জনই। ফাদার বেঞ্জামিন বলে এসেছেন- আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন। কিন্তু প্রতাপ সাহেবের মনে হলো- আজ বুঝি শয়তানটা আরো শক্তিশালী অবস্থায় আছে।
“এভাবে একের পর এক যাজক মেরে ফেলা হচ্ছে আর আপনারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন !”
“চুপ কর শয়তান !”
“আমি বললাম তো- গির্জার সবগুলো খুনের পেছনে ডক্টর ইলিয়াসের হাত আছে।”
প্রতাপ অবাক হয়ে বললেনঃ “গির্জায় তো খুন কেবল একটাই হয়েছে ……” ফাদার বেঞ্জামিন ইশারায় লোপার সাথে কথা বলতে মানা করলেন প্রতাপকে। তারপর হলি ওয়াটার ছিটিয়ে দিলেন মেয়েটার গায়ে।
লোপা প্রথমে আর্তনাদ করে উঠেছিলো, তারপরই মৃদু গলায় ফাদার প্রতাপের দিকে তাকিয়ে বললো- “আরেকটা খুন হবে চার্চে! আর ডক্টর ইলিয়াস ফাদার বেঞ্জামিনের বন্ধু হয়। তাই বেঞ্জামিন কিছুই করবে না এ ব্যাপারে। যা করার তোকেই করতে হবে……”
ফাদার বেঞ্জামিন শান্ত ভঙ্গিতে বললেনঃ “আমি এখন লোপার শরীরে ক্রশ ছোঁয়াচ্ছি। ঈশ্বরের চূড়ান্ত ইচ্ছায় তুই এখন বেরিয়ে আসবি। নিশ্চই ঈশ্বরের সিদ্ধান্তই সবকিছুর ওপর জয়ী !”
ফাদারের এ কথা শুনে লোপা পাগলের মত করতে লাগলো। যেনো মনে হচ্ছে- সে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু কোন একটা অদৃশ্য শক্তি বেঁধে রেখেছে তাকে। ক্রশ ছোয়ানোর ঠিক আগ মুহূর্তে লোপা দ্রুত উচ্চারণে, ফাদার প্রতাপের দিকে ফিরে বললো- “তোকে যেটা বললাম, মনে রাখিস। ডক্টর ইলিয়াস আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা চার্চের শত্রু। আমার কথা বিশ্বাস না হলে বাইবেলের ‘বুক অফ ১ স্যামুয়েল’, পনেরোতম চ্যাপ্টারের তিন নাম্বার ভার্স খুইলা দেখিস কি লেখা আছে …”
ফাদার বেঞ্জামিন লোপার শরীরে ক্রশ আঁকছেন, আর বাইবেল থেকে পড়ছেন জোরে জোরে। লোপা প্রথম প্রথম গগনবিদারী চিৎকার করে উঠেছিলো। কখনো ওর কন্ঠস্বর মনে হচ্ছিলো- পুরুষের, কখনো বা নারীর। কখনো আবার ওর চিৎকার অসংখ্য কাকের ‘কা কা’ শব্দের মত শোনাতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে গোঙ্গাতে আরম্ভ করলো মেয়েটা। একসময় সেটাও স্তিমিত হয়ে আসে ধীরে। মাতাল, নেশাগ্রস্ত যুবতীর মত টলে পরে গেলো সে সোফার উপর। ঘুমাতে লাগলো গভীর প্রশান্তির ঘুম।
কেমন কেমন জানি ফুরফুরে মনে হতে থাকে পুরো পরিবেশটুকু। ফাদার প্রতাপ অনুভব করলেন, সারা ঘর যেনো অপূর্ব একটা সুগন্ধীতে ভরে উঠেছে। বাতাসে বাতাসে আনন্দ। শুধু বেঞ্জামিন কস্তা ক্লান্ত, অবসন্ন অবস্থায় পাশের সোফায় বসে আছেন চুপচাপ। একটু সময় চুপ থেকে ফাদার প্রতাপকে তিনি জানালেন- “‘বিলজিবাব’ চলে গেছে! মেয়েটাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিন আপনারা। আশা করি, ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে সুস্থ হয়ে উঠবে। আর ফাদার প্রতাপ, আমাকে ধরে ধরে চার্চে নিয়ে চলো। ডক্টর ইলিয়াসকেও খবর দাও। অনেক কাজ আমাদের সামনে !”
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তার গলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ।
৭
রাকিবের নাম্বারে প্রায় এক সপ্তা’ বাদে একটা ফোন এলো। অপরিচিত নাম্বার ।
প্রথমে অচেনা নাম্বার দেখে সে ফোনটা ধরে নি, কিন্তু একই নাম্বার থেকে ক্রমাগত ফোন আসতেই লাগলো। তৃতীয় বারের বেলায় রাকিব ফোনটা রিসিভ করে-“হ্যালো !” বললো।
“আমি জামাল। জাদুকর জামাল!” – ওপাশ থেকে লোকটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে ওঠে।
“জ্বি বলেন !”
“আমার একটা উপকার করেন। ” রাকিবের মনে হলো জাদুকর জামালের কথা বলতে বুঝি কষ্ট হচ্ছে। যেনো কেউ বজ্রহাতে লোকটার গলা চিপে ধরে আছে ওপাশে।
“আগে বলেন, শুনি !”
“ভাই, আমাকে এখনি কেউ হাসপাতালে নিয়া না গেলে আমি বাঁচবো না! শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ আমার !”
যদিও রাকিব খুবই বিরক্ত লোকটার উপর, তবে একটা মানুষ এভাবে সাহায্য চাইলে আর না করা যায় না। তছাড়া উনার কথা শুনে সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছিলো লোকটার অবস্থা খারাপ। রাকিব ফোন রেখে ছুটলো।
এখনো সেই থার্ডক্লাস আবাসিক হোটেলটাতেই আছে সে। রাকিব বিস্মিত হয়ে দেখে- সত্যি সত্যি লোকটা খুবই অসুস্থ। সারা শরীর লাল হয়ে গেছে। রাকিব জাদুকরের শরীর ধরে দেখলো সেটা আগুনের মত গরম।
অনেক ছোটাছুটি করে নিকটস্থ একটা ক্লিনিকে জাদুকরকে ভর্তি করালো সে। ডাক্তাররা প্রথমে খুব অবাক হয়েছিলো রোগির এমন অবস্থা দেখে। রাকিব জিজ্ঞেস করলোঃ “কিভাবে এমন অবস্থা হতে পারে ডক্টর !?”
“আসলে…… আমি ঠিক নিশ্চিত নই। তীব্র রেডিয়েশনে কোন কারণে মানুষের শরীর এক্সপোজড হয়ে গেলে এমনটা হয়। তবে এতো শক্তিশালি রেডিয়েটিং সোর্স কোনোভাবেই আশেপাশে থাকার কথা না……”
“তাহলে?”- রাকিব বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো।
“এ জন্যই তো কনফিউজড আমি !”- এতোটুকু বলে ডাক্তার চলে গেলেন।
এতোক্ষণ জামাল বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে রাকিব আর ডাক্তারের কথোপকথন শুনছিলো, ডাক্তার চলে যাওয়ার পর রাকিবকে ইশারায় কাছে ডাকলো।
“আপনে আমার অনেক বড় উপকার করলেন। বিনিময়ে আমি আপনেরে কিছু তথ্য দিয়া যাইতেছি…”
“আপনি অসুস্থ। এখন কথা বলার দরকার নাই……”
“অসুবিধা হবে না, আমাকে আর না-ও পাইতে পারেন। হয় আমি মারা যাবো, অথবা একটু সুস্থ হইলেই এই শহর ছেড়ে রওনা দিবো ভিন্ন কোনো গন্তব্যে।”
জামাল জাদুকর বলে যেতে থাকে- “আপনাদের এলাকায় জয়নাল নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আমারে ভাড়া করছিলো। উনি চাইতেছিলো- আমি যেনো আমার জাদুমন্ত্রের মাধ্যমে এইখানে একটা সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করি।”
রাকিব চিন্তিত গলায় বললো- “আমি জয়নাল সাহেবকে চিনি। এলাকায় তাঁর রেপুটেশন খুব একটা ভালো না। শুনেছিলাম সে নাকি স্বতন্ত্র কাউন্সিলর ইলেকশন করবে…… এনিওয়ে, এসব গ্যাঞ্জাম করার তার উদ্দেশ্য কি?”
“আমি টেকা নিয়া কাজ করি। পার্টির উদ্দেশ্য নিয়া আমার কোনো কৌতূহল নাই, মাথাব্যথাও নাই। তাই জিজ্ঞাসও করি নাই। তবে……” জামাল একটা শ্বাস নিয়ে বললো- “…… সম্ভবত একটা দাঙ্গার মত পরিস্থিতি তৈরি কইরা জয়নাল সাহেব সেটার পূর্ণ ফায়দা লুটতে চাইতেছে। ভাই, সামনে কিন্তু আপনাদের এলাকার ঘোর বিপদ ! ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ যাইতে পারে……”
জামাল জাদুকরের কথা শুনে রাকিব আকাশ থেকে পড়লো। ইদানিং তাঁদের এলাকায় একটা চাপা অস্বস্তি বিরাজ করছে- এ কথা ঠিক। গির্জার একজন ফাদার, আর একজন নান মারা গেলো। বাজারে জোর গুঞ্জন উনাদেরকে নাকি এলাকারই কয়েকটা মসজিদের খাদেমরা মিলে খুন করেছে। মাঝে আবার দুই জন মাদ্রাসাছাত্রের মৃতদেহ পাওয়া গেলো পিঠে ক্রশ আঁকা অবস্থায়। নাহ, রাকিব আর ভাবতে পারছে না! তাহলে কি জাদুকর যা বলেছে, সবই সত্যি !? রাকিবের রাগ হঠাত গিয়ে পড়লো জাদুকরের উপর।
“এর বিনিময়ে কি পেলেন আপনি?”
জামাল একটু হাসার মত ভঙ্গি করে বললো- “বিনিময়ে কি পেলাম সেটা তো চোখের সামনেই দেখতেছেন ! আমি টাকার বিনিময়ে এসব কাজ করি- ঠিক ! তবে তাতে আমার জানের রিস্কও থাকে। এই যেমন আপনাদের এলাকায় অস্থিরতা তৈরি করার জন্য এক পিশাচ ডাইকা আনছিলাম। সত্যি বলতে খুনগুলা সব সে-ই করছে। কিন্তু মিথ্যা কথা বইলা, বিভিন্ন কৌশলে উসকায়া দিতে চাইতেছে খ্রিস্টান আর মুসলমানদের। এই দুই পক্ষকে মুখোমুখি দাঁড়া করায় দিতে পারলেই সে সফল হয়া যাবে……”
একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে জামাল একটু বিশ্রাম করে নিলো। তারপর আবার বলে চললো- “এইসব পিশাচ ডাইকা আনার বিভিন্ন শর্ত থাকে। তার মধ্যে একটা হইলো- পিশাচটা চইলা যাওয়ার সময় আহবানকারীর কিছু না কিছু ক্ষতি কইরা যায়। শয়তানটারে যত বেশি কষ্ট দিয়া আর লাঞ্ছিত কইরা তাড়ানো হয়, আহবানকারীরও ক্ষতি হয় তত বেশি। আমার ডাকা পিশাচটার সম্ভবত চইলা যাওয়ার টাইম হইছে। তাই আমার এই অবস্থা……”
উত্তরটা যদিও রাকিব জানে, তারপরো আবার জামালকে জিজ্ঞেস করলো- “এসব কথা আপনি আমাকে বলে দিলেন যে…!”
“আসলে এর পিছনে কারণ দুইটা আছে। ইদানিং জাদুবিদ্যার এসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখি না কারো। বিশ্বাস তো নাই ই! এগুলা হারায়া যাইতে বসছে প্রযুক্তির দাপটে। তবে আপনি ব্যতিক্রম ছিলেন। আপনার ইউটিউব চ্যানেলটা দেখছি আমি। তাতে মনে হইলো- উনাকে কথাগুলা বললে উনি যে শুধু মনোযোগ দিয়া শুনবে- তাই না, বিশ্বাসও করবে আমাকে। এ কারণেই আপনার সাথে শেয়ার করা …… তাছাড়া সময়মত হাসপাতালে আইনা আপনি আমার যে উপকারটুকু করলেন, তারও প্রতিদান দেওয়ার একটা ব্যাপার ছিলো …… ”
ততক্ষণে রাকিবের মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সে জামালকে কথা শেষ না করতে দিয়েই জিজ্ঞেস করলো- “আপনি নিজে পিশাচ ফেরত পাঠাতে পারেন না?”
“নাহ। আমার কাজ শুধু একজন বাহক খুইজা বাইর কইরা পিশাচ ডাইকা আনা। পিশাচ তখন ঐ বাহকের উপর ভর করে……”
“আমাদের এখানে সেই বাহক কে ছিলো?”
“লোপা রোজারিও নামের একটা মেয়ে !”- এটুকু বলে জামাল ভয়ংকর ভঙ্গিতে কাশতে লাগলো। রাকিবের ধারণা হলো বুঝি লোকটার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।
অনেক কষ্টে জামাল কাশতে কাশতেই বললো- “আপনে দ্রুত এলাকার গণ্যমান্য লোকেদের সাথে পরামর্শ করেন। দেরি কইরেন না। অন্যথায় কিন্তু বড়সড় কোনো দুর্ঘটনা ঘইটা যাবে !”
ডাক্তার সাহেব রাউন্ডে চলে এসেছেন ততক্ষণে। জামালকে দেখে কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। রাকিব নিচের ফার্মেসি থেকে ওষুধগুলো এনে নার্সের হাতে বুঝিয়ে দিয়েই ছুট লাগালো। জামাল ঠিকই বলেছে, আর দেরি করা যাবে না। পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে আবার নতুন কিছু ঘটে গেলো নাকি, সেটাই বা কে জানে !
৮
গির্জার দোতলায় একটা বৈঠকের মত বসেছে। উপস্থিত আছেন মোট নয়জন। এলাকার তিনটা গির্জা থেকে মোট চারজন পাদ্রি, আর মুসলিমদের পক্ষ থেকে ডক্টর ইলিয়াস সহ তিনজন স্কলার, আর বাকি দুই জন স্থানীয় দুই মসজিদের ইমাম।
ডক্টর ইলিয়াস সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। ফাদার বেঞ্জামিনকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ “প্রথমেই আমি আপনাদের দু’জন যাজকের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করছি। ফাদার বেঞ্জামিন, আপনি এ খুনগুলোর পেছনে কাকে সন্দেহ করছেন?”
বেঞ্জামিন কস্তা জবাব দেয়ার আগেই কথা বলে উঠলো ফাদার প্রতাপ। তীব্র গলায় বললো- “সেটা আমরা পুলিশকে জানাবো।”
“অবশ্যই। শুধু খেয়াল রাখবেন যেনো আমাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝির তৈরি না হয় !”
এবারো ফাদার প্রতাপ ঝাঁঝালো গলায় বললোঃ “ভুল বোঝাবুঝির আর বাকি আছে কি !”
ফাদার বেঞ্জামিন এতোক্ষণ অবাক চোখে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর ইশারায় উনাকে চুপ থাকতে বলে নিজের স্বভাবসুলভ শান্ত গলায় বললেনঃ “মাফ করবেন ডক্টর ইলিয়াস এবং সম্মানিত উপস্থিতি। আপনার জানেন- এর মধ্যে আমরা আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন দুই যাজককে হারিয়েছি। তার উপর সন্ধ্যায় খবর পেলাম- এলাকার কিছু খ্রিস্টান পরিবারের ওপর নাকি হামলা হয়েছে। এ সব মিলিয়ে সম্ভবত আমাদের ফাদার প্রতাপ কিছুটা ডিস্টার্বড অবস্থায় আছেন !”
একজন ইমাম সাহেব এ পর্যায়ে ফাদার প্রতাপের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “আমরাও তো আমাদের দুইজন মাদ্রাসা ছাত্রকে হারিয়েছি। ওদের কি অপরাধ ছিলো ! তাছাড়া কয়েকটা খ্রিস্টান পরিবারের ওপর হামলার তথ্য জানেন, অথচ এটা জানেন না যে- ডক্টর ইলিয়াস নিজে তাঁর মাদ্রাসার ছাত্রদের কয়েক জায়গায় পাহারায় বসিয়ে এসেছেন। যেনো নিরপরাধ কোনো খ্রিস্টান পরিবারের ক্ষতি না হয়……”
এবারে ডক্টর ইলিয়াস ইমাম সাহেবকে থামালেন। তারপর বললেনঃ “আসলে যা হবার তা তো হয়েছেই, এখন ঝগড়াঝাটি করে বা পরস্পর দোষারোপ করে তো কোনো লাভ হবে না। বরং সম্মিলিতভাবে চেষ্টা চালাতে হবে, যেনো আর কোনো বড় দুর্ঘটনা না ঘটে। কি বলেন আপনারা?”
শুধু ফাদার প্রতাপ ছাড়া বাকি যাজকেরা সব মাথা নাড়লেন। এবেলা ডক্টর ইলিয়াস ফাদার বেঞ্জামিনের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “রাকিব নামের একটা ছেলে আমার কাছে এসেছিলো। ও বললো- এক জাদুকর নাকি পিশাচ ডেকে এনেছে এখানে। ঘটনা কি সত্য?”
“হ্যাঁ। ‘বিলজিবাব’কে আহ্বান করা হয়েছিলো। রাস্তার ওপারেই সুমন রোজারিওর বাসা, ওনার মেয়ের ওপরই………”
“‘বিলজিবাব’ মানে কি বাইবেলের সেই দুর্ধর্ষ শয়তান? ম্যাথিউ’স গসপেলে উল্লেখ আছে যার?”- ডক্টর ইলিয়াস অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেন।
ফাদার বেঞ্জামিন আর উপস্থিত যাজকেরা সবাই উপর-নিচে মাথা নাড়লেন শুধু।
ইলিয়াস সাহেব বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলতে লাগলেন- “আমার যতদূর মনে আছে, এই বিলজিবাব এর আরেকটা নাম হলো ‘মৃত্যু উত্থানকারী’। মানুষ মারতে উস্কে দেয় এই শয়তান ..।”
ফাদার বেঞ্জামিন শান্ত গলায় বললেন- “আপনি ঠিকই বলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা- এ তিনটা খুনের পেছনেই বিলজিবাব এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে…”
ফাদার প্রতাপ বেঞ্জামিন কস্তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো। বললো- “একটা পিশাচ কিভাবে মানুষ খুন করবে ফাদার? এর পেছনে নিশ্চই আরো বড় কোনো ষড়যন্ত্র আছে ……”
প্রতাপ কথা শেষ করে উঠতে পারলেন না, নিচে কিসের হৈ চৈ শোনা গেলো। কোলাহল শুনে নয়জনই দ্রুত নেমে আসেন গির্জার দোতলা থেকে।
নিচে এ অল্প সময়ের মধ্যেই কোথা থেকে অনেক মানুষ এসে জুটেছে। সেখানে জয়নালের লোকজনকেও দেখা গেলো। লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সব। রাজু নামের একটা ছেলে খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছিলো। খ্রিস্টান যাজকদের নামে আজেবাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে। ভীড়টাকে উস্কে দিচ্ছে। ডক্টর ইলিয়াস রাজুর দিকে তাকিয়ে ধমকের গলায় বললেন- “আপনি এসব ফালতু কথা বলা বন্ধ করবেন ?!!…”
“কেন? বন্ধ করবো কেন? আমাদের দুই দুইটা মাদ্রাসার ছাত্র মাইরা ফেললো আর আমরা চুপ কইরা থাকবো?”- রাজু তাঁর কোমর থেকে পিস্তল বের করলো।
“আমাদেরো তো দু’জন যাজককে মেরে ফেলা হয়েছে……”- ফাদার প্রতাপ ডক্টর ইলিয়াসকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।
“কত্ত বড় সাহস, মুখে মুখে কথা কস !”- এই বলে রাজু প্রতাপের দিকে পিস্তল তাক করলো। পেছনে মব আরো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ডক্টর ইলিয়াস এ পর্যায়ে কেউ কিছু বোঝার আগেই দু’হাতে ছড়িয়ে ফাদার প্রতাপের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা যাচ্ছে। ভীড় পাতলা হচ্ছে মানুষের। রাজু একটা গুলি ফুটিয়ে দ্রুতই ভীড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
শেষ কথাঃ
মুসলিম এবং খ্রিস্টান উভয় পক্ষেরই ধর্মীয় নেতাদের আন্তরিকতা আর এলাকাবাসীর ইতিবাচক মানসিকতার কারণে গাজিপুরের ঘটনাটা খুব বেশিদূর গড়ালো না। পুলিশ রাজুকে গ্রেফতার করার পর সে স্বীকার করেছিলো- জয়নাল মিয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে চাচ্ছিলেন। এলাকার নিরীহ খ্রিস্টানদের বাড়িঘরে হামলাও তাঁর লোকেরাই করেছিলো বেশিরভাগ। পুলিশ আপাতত জয়নাল মিয়াকে খুঁজছে। ঐদিন রাতের পরই নাকি সে গা ঢাকা দিয়েছে শহর ছেড়ে। পুলিশের ধারণা- তাকে ধরতে পারলে এলাকার খুনগুলোর রহস্যও উদ্ধার হবে।
জাদুকর জামালকে পরে আর খুঁজে পায় নি রাকিব। শুধু ক্লিনিকে গিয়ে জানতে পারলো- সেদিনই নাকি চিকিৎসার বিল মিটিয়ে দিয়ে জাদুকর চলে গেছিলো। শহরের ঐ থার্ডক্লাস আবাসিক হোটেলটাতেও খবর নিলো সে, কিন্তু জাদুকর নেই ! রাকিবের আফসোস হতে লাগলো। জাদুকরের কাছ থেকে আরো কিছু তথ্য বের করতে পারলে ওর ইউটিউব চ্যানেলটা অসাধারণ কিছু কনটেন্ট পেতো !
লোপা এখন পুরোপুরি সুস্থ। ওদের বাসাতেও এরপর থেকে কোনো অশুভ, অলৌকিক ঘটনা ঘটে নি আর। মাঝে মাঝে অতীতের কথা মনে হলে মেরী রোজারিও আতংকের একটা নিঃশ্বাস ফেলেন। কি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতই না দিনগুলো কেটেছে তাঁদের। অথচ আজকাল লোপাকে দেখলে কে বলবে ওর ওপর দিয়ে এরকম একটা ঝড় বয়ে গেছে ! কি সুন্দর-চঞ্চল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটা মেয়ে ! সম্প্রতি বান্ধবীরা মিলে অনলাইনে বুটিকের ব্যবসা শুরু করেছে ; মেয়ের দিকে তাকালেই মেরীর মনটা ভালো হয়ে ওঠে।
ডক্টর ইলিয়াসকে ঢাকার একটা হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। গুলি তাঁর কাঁধে লেগেছিলো। এ যাত্রা তাই ভালোয় ভালোয় বেঁচে গেলেন তিনি। ফাদার বেঞ্জামিন আর ফাদার প্রতাপ দু’জনই গাজিপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন একদিন। উদ্দেশ্য- ডক্টর ইলিয়াসকে এক নজর দেখে যাওয়া, তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর…… ফাদার প্রতাপ অবশ্য আসতে চান নি প্রথমে। ওনার কথা হলো- “আমি ইলিয়াস স্যারের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি, এখন কোন মুখে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো !” ফাদার বেঞ্জামিন জোর করে প্রতাপকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
ডক্টর ইলিয়াস হাসপাতালের বেডে আধশোয়া হয়ে ছিলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ফাদার বেঞ্জামিন। প্রতাপ ডক্টর ইলিয়াসের হাতে একগোছা ফুল দিয়ে বললোঃ
“স্যার, অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনার ব্যাপারে আমি খুব ভুল ধারণা করেছিলাম !”
ইলিয়াস সাহেব মুচকি হাসলেন শুধু, কিছু বললেন না।
“আচ্ছা, আমার একটা কৌতূহল ছিলো, স্যার ! আপনার সাথে এতো উগ্র আচরণ করার পরও আপনি কেন আমাকে বাঁচাতে গেলেন? এরকম একটা লাইফ রিস্ক তো আপনি না নিলেও পারতেন !?”
এবারো ডক্টর ইলিয়াস কিছু না বলে অল্প হাসলেন। তবে ফাদাররা দু’জনই বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে প্রতাপকে ডেকে বললেনঃ
“পবিত্র কুরআনে অসম্ভব শক্তিশালি একটা আয়াত আছে। আয়াতটা হলো- যে বিনা কারণে একজন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করলো, সে যেনো গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করলো। আর যে কি না একজন মানুষেরও জীবন বাঁচালো, সে যেনো সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচালো !
ফাদার প্রতাপ, আশা করি আপনার উত্তরটা পেয়েছেন !”
কেন জানি ডক্টর ইলিয়াসের কথা শুনে ফাদার প্রতাপের চোখদু’টো টলমল করে উঠলো। ডক্টর ইলিয়াস মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেন- এলোচুলের কমবয়েসী এক যাজককে জলভর্তি চোখে কি অপূর্ব লাগছে দেখতে !
***
(সমাপ্ত)
পুনশ্চঃ
***এই গল্পের সব চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই।
***গল্পটা লিখার সময় বেশ কিছু অনলাইন সোর্স আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টো হলো-
১। Mount Holyoke College, MA, USA এর ‘Demonology’ কোর্সের কিছু ম্যাটেরিয়াল।
২। United States Conference of Catholic Bishops- থেকে প্রাপ্ত তথ্য।