দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ৬
তামান্না জেনিফার
বারান্দায় বসে ফেসবুকে স্ক্রলিং করছিলো রিমশা ৷ আবার ঐ গ্রুপটা সামনে পড়ে তার ৷ রিমশা মোবাইল বন্ধ করে রাখে ৷ এই গ্রুপ দেখলেই তার অস্বস্তি হয় ৷ মনে হয় সবাই ওর মনের কথা বুঝে ফেলছে ! সবাই বোধহয় সবটা জানে !
রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে রিমশা চোখ বন্ধ করে ফেলে ৷ তারপর মনে মনে ভাবতে থাকে সে আসলে ঠিক কি কারনে সুইসাইড করতে চায় ! সে ভীষণ একা , বাবার স্নেহবর্জিত …এটাই কি একমাত্র কারন ? না , এর সবচেয়ে বড় কারন অপরাধবোধ ৷ একটা গোপন পাপে পাপী রিমশা ৷ নিজেকেই তাই নিজে ক্ষমা করতে পারে না সে …যতবার ঐ দূর্ঘটনার কথা মনে পড়ে , ততবার রিমশার নিজেকে সড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই পৃথিবীর বুক থেকে ৷ ব্যাপারটা কি ভোলার চেষ্টা রিমশা করেনি ! করেছে…বহুবার করেছে… কিন্তু পারেনি , আজকাল রিমশার মনে হয় পারবেও না ৷
শোভন …. ফর্সা গোলগাল মুখ , বড় বড় কবিতা বলা চোখ ..কোকড়া চুল , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোফ .. আচ্ছা এমন একটা ছেলের ছেলের প্রেমে পড়া কি খুব অন্যায় ছিলো ! শোভনের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলো রিমশা .. আর শোভন ! সে ছিলো সঞ্চিতার প্রেমে অন্ধ ৷ দুজন ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পরিচিত জুটি ৷ দুজনকে বেশ মানাতো ৷ সবার প্রিয় ছিলো ওরা , শুধু রিমশা বাদে ! রিমশা সহ্য করতে পারতো ওদের .. অসহ্য লাগতো রিমশার ! তারপরও সহ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো ৷
কিন্তু সেদিন যখন লাইব্রেবীর পেছনে শোভনের বুকের মধ্যে লতার মতো করে লেপ্টে থাকতে দেখলো সঞ্চিতাকে , সেদিন নিজেকে আর কনট্রোল করতে পারেনি রিমশা ! যে গল্পটা তার হবার কথা সে ভেবে আসছে শয়নে স্বপনে , সেই গল্পের নায়িকা যখন অন্য কেউ হয় তা ঠিক কতক্ষন সহ্য করা যায় ? সারা সহ্য করতে পারে তারা বোধহয় মহান মানুষ , রিমশা সাধারন মানুষ ৷ রিমশা পারেনি …
অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে রিমশার ৷ ভয়াবহ সেই গোপন পাপের স্মৃতি রিমশাকে বাঁচতে দিচ্ছে না ৷ নিজেকে নোংরা মনে হয় ওর .. আচ্ছা তার কি ঐ সুইসাইড ব্যুথটা দরকার ? এর আগেও সে চেষ্টা করেছে কয়েকবার , সফল হতে পারেনি , এই সুইসাইড ব্যুথ কি তাকে নিশ্চিত মৃত্যু দিতে পারবে ! সেখান থেকেও ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসতে হবে না তো !
********
ছোট্ট একটা পরীর মতো মেয়েকে নিয়ে মারিয়া আফরোজ দেখা করতে এসেছেন ৷ এ বয়সের মেয়েরা হবে ছটফটে ফড়িং এর মতো , অথচ মারিয়া আফরোজের কন্যাটি বড্ড বেশিই চুপচাপ ৷
আমাকে দেখে মারিয়া আফরোজ বললেন
—আপনিই আঁধার ?
—জি
—আপনার আসল নামটাকি বলা যাবে ?
—আমার ডাক নাম রুমা ৷ আপনি আমাকে রুমা বলতে পারেন ৷
—আচ্ছা ৷ আমার ব্যুথটি কি এনেছেন ? আমি টাকা নিয়ে এসেছি ৷
—আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই ৷ আপনি যদি আমাকে বোন ভাবেন , আমি কি কথাগুলো আপনাকে বলতে পারি..যদি আপনি অভয় দেন ৷
—বোন ভাবলে আর আপনি বলছো কেন ? তুমি বলো ৷ আর তুমি আমার বেশ ছোটই হবে ৷ আমি বেশিক্ষন কাউকে আপনি আপনি করতে পারিনা ৷
—আপু , আমি আসলে কোন সুইসাইড ব্যুথ বিক্রি করি না ৷ আমি চেষ্টা করি মানুষদের সুইসাইড থেকে ফেরাতে ৷ টাকার কথাটা বলি যাতে মানুষ কিছুদিন সুইসাইডের চিন্তা বাদ দিয়ে টাকার চিন্তায় থাকে ৷ আপনি বলেন এই কয়দিন আপনার মাথায় কোন চিন্তাটা ছিলো ?
—টাকা জোগারের চিন্তা ৷ কিন্তু রুমা আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম ! তুমি এভাবে আমাকে ঠকালে !
—আপু , আমার কথাটা শেষ করতে দাও প্লিজ ৷ তারপর যা বলবে আমি মাথা পেতে নেবো ৷
—বলো , কত মানুষের কত কথাই তো শুনলাম ! তুমিও বলো ৷
—আমি সাধারণত কোন কেস সল্ভ করার জন্য তার আপনজনদের সাহায্য নেই ৷ কিন্তু এইবার আমি আমার সেই পুরোনো পদ্ধতিতে কাজ করতে পারিনি ৷ আপু আমি খুঁজে পেতেও আপনার কোন আপনজন খুঁজে পাইনি ৷ কিন্তু আপু , আপনার এই ছোট্ট শান্তু টুনটুনিটার আপনজন খুঁজে পেয়েছি , যে ওকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে , যে ওর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে ..
—কে ! কে !
—আপু , আপনি
—হা হা হা ! রুমা , হাসালে তুমি আমাকে .. ঠাট্টা করতেছো তুমি আমার সাথে !
—আপু , ঠাট্টা আমি করি না .. যা বলছি ভেবেই বলছি ৷ আপু , মেয়ের জন্য ঢাল হয়ে তোমাকেই দাঁড়াতে হবে ৷ একটাবার চিন্তা করে দেখো … এই মাসুম বাচ্চাকে তুমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে ? একটাবার যুদ্ধের চেষ্টাও করবে না ?
—আমার কি করার আছে রুমা !
—আমি ভেবে রেখেছি ৷ বলছি শোনো , তোমার হাতে আছে দশহাজার টাকা ৷ প্রথমে তুমি মামনিকে নিয়ে ঐ বাড়িটা ছাড়বে ৷ একটা সাবলেট বাসা আমি দেখে রেখেছি ৷ একটা বয়স্ক দম্পতি থাকে ৷ একটা রুম সাবলেট দেয় ৷ সুন্দর রুম , রুমের সাথে বাথরুম আর বারান্দা আছে ৷ ভাড়া পাঁচহাজার টাকা প্রতিমাসে ৷ উনারা এক মাসের ভাড়া এডভান্স রাখেন ৷ কিন্তু আমি উনাদের বুঝিয়ে দুই হাজার এডভান্স দিবো বলছি ৷ এরপর তোমার কাছে থাকলো আট হাজার টাকা ৷ এর ভেতর থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তুমি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করবা ৷ কিছু কাপড় এনে তাতীদের থেকে আরো ছবি নিয়ে আসবা ৷ অনলাইন প্লাস অফলাইনে বিভিন্ন স্কুলের সামনে গিয়ে গার্জিয়ানদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করবা ৷ আমরা প্রথমেই নিবো একদম কমের মধ্যে বাটিক , ব্লক , স্ক্রিন প্রিন্টের থ্রিপিস ৷ লাভও রাখবো খুব সীমিত ৷ এগুলো এখন বেশ ভালো চলে ৷ আমি সব খোঁজ খবর এনেছি ৷ ছয়টা মাস তুমি শুধু আমাকে বিশ্বাস করো , দেখো …তারপরও কিছু না হলে তুমি যা বলবে মাথা পেতে নিবো ৷
—যত সহজে বললে , এত সহজে কি সম্ভব !
—নিশ্চয় সম্ভব ৷ এখন উঠো , তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো ৷
—কোথায় ?
—আমাদের বাড়িতে ৷ আমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করতেছে ৷
আমি মারিয়া আফরোজের জন্য অপেক্ষা করে আছেন ৷ মা এতকিছু জানেন না ৷ মা কে শুধু বলেছি একজন বিপদগ্রস্থাকে সাহায্য করছি মা , তুমি পাশে থেকো ৷
মারিয়া আপুর মেয়ের নাম তোতন ৷ আমার মায়ের সাথে তোতনের বেশ ভাব হয়ে গেলো ৷ আমাদের বাড়ির দোতলাতেই মারিয়া আপুর জন্য বাসা দেখেছি ৷ আপুকে সে বাসাও দেখিয়ে আনলাম … তারপর আপু একসময় চলে গেলেন … যাবার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “বসার ঘরের ছবিটা কি কম্পিউটারে ফটোশপ করেছো ? দারুণ হয়েছে…পাশাপাশি দুটো তুমি ! ”
আমি বললাম “আপু , ওটা আমার জমজ বোনের ছবি ৷ ও দু’বছর আগে সুইসাইড করেছে ৷ ওর জন্যই আমি আঁধার ! ওর মৃত্যু ঠেকাতে পারিনি , তাই চেষ্টা করে যাই যতটা সম্ভব মানুষের সমস্যার সমাধান করতে …”
মারিয়া আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন , “রুমা , তুমি পারবে ..নিশ্চয় পারবে … আগামীকাল আমি চলে আসবো ৷ সকাল সকালই চলে আসবো ৷ পাশেই থেকো আমার ৷ তুমি থাকলে তোতনের ভার আমি নিতে পারবো , তোতনের ঢাল আমিই হতে পারবো…ইনশাআল্লাহ পারবো ..”
আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মারিয়া আপু ৷ আমার আবার মনে হলো আমাকে জড়িয়ে ধরেছে সুমা !
আচ্ছা ওপারে বসে কি সুমা দেখতে পায় , আমি , মা , আমরা যে সারাক্ষন ওকে মিস করি ! পাগলের মত মিস করি !
*************
রিমশার বাবা গেছেন দেশের বাইরে ৷ তার কি নাকি জাহাজ নিয়ে সমস্যা হয়েছে , সেই জাহাজের পেছনেই ছুটছেন তিনি ৷ রিমশা আজ এসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু মন ভালো করার চেষ্টা করছে ৷
মায়ের আলমারি খুলে একটা লাল শাড়ি বের করে রিমশা ৷ তারপর রান্নাঘরে গিয়ে বাবুর্চিকে বলে আসে গরুর মাংস , বুটের ডাল আর ভাত রান্না করতে ৷ সাথে টমেটোর সালাদ ৷ বলে এসে নিজের ঘরে না গিয়ে মায়ের ঘরেই ঢোকে ৷ মায়ের ঘরটা এখনও আগের মতই আছে ৷ মায়ের ড্রেসিং টেবিল , তার সাজ গোজের জিনিসপত্র .. অবশ্য সাজগোজের জিনিস বলতে শুধু কয়েকটা কাজল , আর একটা হালকা কালারের লিপস্টিক ৷ এসবের মেয়াদ থাকার কথা না ৷ রিমশা জানে মর্জিনা তার আশেপাশেই আছে , তাই মর্জিনাকে ডেকে তার ঘর থেকে তার কাজল আর লিপস্টিকটা আনতে বলে ৷ আজ সে মায়ের মত করেই সাজবে ..
সময় নিয়ে সাজে রিমশা ৷ সুন্দর করে শাড়ি পড়ে , চোখে কাজল দেয় , ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দেয় …তারপর মুগ্ধ হয়ে নিজেকে দেখে ৷ ওর বেশ ভালো লাগতে থাকে ৷ এভাবে সেজেগুজেই দীর্ঘদিন পর সে ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের সব পছন্দের খাবার তৃপ্তি করে খায় ৷
তারপর ঘরে এসে নিজেকে এলিয়ে দেয় বিছানায় ….
ঠিক তখন ওর মনে হয় শাড়িটা জঞ্জাল লাগছে …শাড়ি খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে ফেলে সে ৷ তারপর আবার ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পরে সে … এই রিমশা একটু আগে আনন্দে থাকা রিমশা না..বরং এ সেই পুরোনো ডিপ্রেসড রিমশা..
সাজগোজ বা খাওয়া দাওয়া ডিপ্রেশন কমায় না ৷ যখন কাউকে বলা হয় খুব মন খারাপ হলে আপনি কি করেন ? বেশিরভাগ মেয়েই উত্তর দেয় , আমি তখন সাজি , বা আমি তখন খাই … এসবই আসলে নিজেই নিজেকে ধোকা দেওয়া ৷ সাময়িকভাবে নিজেকে ডাইভার্ট করা ৷ কিন্তু পরিপূর্ন সমাধান এটা নয় ৷ আসলে আমরা কজনই সমস্যার পরিপূর্ন সমাধান চাই ! আমরা বোধহয় দুঃখবিলাস করতেই বেশি ভালোবাসি ….
চলবে