‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৩১.
‘সকাল থেকে জলপট্টি দেওয়ায় খুব ভালো হয়েছে। জ্বরটা অনেকটা কমে গেছে। আমি তো বলেছিলাম ওনাকে রেস্ট নিতে তাহলে?’
ডাক্তারবাবুর করা প্রশ্নে আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম,
‘আ..আসলে উনি একটু বেরিয়ে ছিলেন।’
‘এই অবস্থায়?’
‘হ..হ্যাঁ। নিজেই ড্রাইভ করেছেন ওই অবস্থায় আর রোদের মধ্যে অনেকটা হাঁটাও হয়েছে।’
আমি কথাটা বলেই মাথা নিচু করে নিলাম। ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে কথা বলা অসম্ভব কারণ উনি যে রাগ করেছেন তা বোঝাই যাচ্ছে। উনি ওনাদের ফ্যামিলি ডক্টর! রাগ করাটা স্বাভাবিক।
‘আমার আর কিছু বলার নেই। জাস্ট কিচ্ছু বলার নেই। আদিকে বারবার বলেছিলাম বেরোতে না এই অবস্থায়। ওরকম বাজে ভাবে একসিডেন্ট করেছে তারপর এভাবে…ভাবা যাচ্ছে না। ও নিজেকে নিয়ে ভাবে না জানতাম বাট এতটা কেয়ারলেস? কি এমন কাজ ছিল কে জানে?’
‘আদিত্যদার আর জ্বর আসবে না তো?’
কোয়েলের প্রশ্নে উনি কোয়েলের দিকে বড়ো বড়ো করে তাকালেন। কোয়েল অসহায় ভাবে ওনার দিকে তাকালে উনি উত্তর দেন,
‘রাতের দিকে আসতেই পারে। ব্যাথা থেকে জ্বর আসছে, ব্যাথা যতদিন থাকবে ততদিন আসতেই পারে। এইবারও যদি রেস্ট না নিয়ে বেরিয়ে যায় আমি আর আসবো না ওকে দেখতে। কোনোসময় কাওর কথা শোনেনা। চললাম আমি।’
ডাক্তারবাবু চলে গেলে কোয়েলও ওনার পিছু পিছু যায়। হরি কাকা আমায় বলেন,
‘ডাক্তারবাবু আদি বাবাকে নিজের ছেলের মতন ভালোবাসে। ওনার তো নিজের কোনো সন্তান নেই তাই। ছোটো থেকেই আদি বাবা একটু বদমেজাজি।’
‘একটু?’
আমি প্রশ্নটা করতেই হরি কাকা হাসলেন। আমিও হাসলাম। তারপর উনি আবার বললেন,
‘আদি বাবা কখনই কাওর কথা শুনে চলতে পছন্দ করেন না। শুধু কর্তামার কথা একটু যা শুনতেন। কর্তা বাবার কথার তো ভীষণ অবাধ্য ছিলেন কিন্তু তারপরেও কর্তা বাবা আদি বাবাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আসলে, আদি বাবা কখনও অন্যায় করেননি তাই হয়তো অতো বেশি বকাবকি আদি বাবাকে করতেন না কিন্তু এই ডাক্তারবাবুই একমাত্র মানুষ যে আদি বাবাকে বকাবকি করতেন। আদি বাবা খেলতে গিয়ে কতবার হাত-পা ভেঙেছেন তার ঠিক নেই। তারপর নাচের কারণেও পায়ে চোট পেয়েছেন আর রইলো বাকি একসিডেন্ট..এটা নিয়ে না বলাই ভালো।’
‘উনি কি আগেও এমন করেছেন? যার জন্য ডাক্তারবাবু এতো রেগে গেলেন?’
‘তা আর বলতে? আদি বাবা রেগে গেলে কাওর কথা শোনেন না, একা থাকতে পছন্দ করেন তাই সবার থেকে দূরে থাকেন। প্রথমবার একসিডেন্ট করার পর কর্তা মা আর কোনোদিন আদি বাবাকে বাইরে যেতে দেননি রাগ হলে। এইখানে আসার পর প্রত্যেকদিন কর্তা মা ফোন করে আমার থেকে খোঁজ নেন যে আদি বাবা কোনো কারণে রাগ করেনি তো? কালকেও করে ছিলেন।’
‘কি বললেন আপনি?’
‘মিথ্যে বলেছি। আদি বাবা বারণ করেছিলেন কিছু বলতে। আদি বাবা কর্তা মার সাথে কথা বলার পরেই গিয়ে ঘুমিয়েছেন। আচ্ছা বউমা, আদি বাবা রেগে কেন ছিলেন?’
হরি কাকার প্রশ্নে আমি আদিত্যের দিকে তাকালাম। মনে পড়ে গেলো সেই দৃশ্যটা যখন অঙ্কিত আমাকে ওনার কাছ থেকে টেনে এনেছিলো। আমি হরি কাকা কে মাথা নিচু করে বললাম,
‘আমি জানি না।’
‘ও, আসলে আদি বাবার রাগটা মারাত্মক। কিন্তু ও সব বিষয়ে রাগ করে না। নিজের লোকের বিষয়ে হলেই এতটা রাগ করে। আগে যতবার রাগ করেছে কর্তা বাবার উপর। কর্তা বাবা চাইছিলেন আদি বাবা জানো ওনার সাথে ওনার ব্যবসায় সাহায্য করে আর আদি বাবা নিজের পড়াশোনা করে নিজে কিছু করবে বলে ঠিক করেছিলো, এই নিয়েই সেই রাগারাগি কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে। সেটাই প্রথমবার, খুব বাজে ভাবে একসিডেন্ট হয়েছিলো।’
‘তারপর? তারপর আর এমন কিছু হয়নি?’
‘হতো যদি কর্তা মা না আটকাতেন। ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে এই যা। আমি ভাবছি, কি নিয়ে এতো রাগ করলেন? কোয়েল মা কে নিয়ে কিছু কি?’
হরি কাকার শেষ কথাটা উনি খুব আসতে বললেও আমি শুনতে পেয়েছি। হরি কাকাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই ওনার গলার আওয়াজ পেলাম।
‘জ..জল।’
আমি ওনার কাছে বসে জল খাইয়ে দিতেই উনি আলতো চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
‘মৌ!’
আমার নাম ধরে ডেকে আবার চোখ বুঁজে নিলেন। এরপর বারবার চোখ খুলছেন আর বন্ধ করছেন। মনে হয় বোঝার চেষ্টা করছেন এটা বাস্তব নাকি স্বপ্ন। এমন সময় কোয়েল পিছন থেকে বললো,
‘শুধু মৌ না, আমিও আছি।’
এইবার জানো আদিত্যের টনক নড়ল। কোয়েলের দিকে একঝলক তাকিয়েই উনি আমার দিকে তাকালেন। উঠে বসতে নিলেই আমি বাঁধা দিলাম,
‘আরে উঠছেন কেন?’
‘তু..তুমি এখানে? কখন এলে?’
‘যখন তুমি জ্বরের ঘোরে বেঘোর ছিলে তখন। মৌ আমাকে ঘুম থেকে তুলে ছুটিয়েছে। কেন এমন করো বলো তো তুমি? নিজের একটু খেয়াল রাখলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে নাকি?’
‘আ..আমি তো…
‘থাক। আপনাকে আর কথা বলতে হবে না। ডাক্তারবাবু বলেই গেছেন রেস্ট না নিলে উনি আর আসবেন না।’
আমার কথা শুনতেই উনি কোয়েল মুখ বেজার করে তাকালেন। কোয়েল মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
‘আমার দোষ নেই। তুমি করেছো কেন ওমন কাজ? জানো কতটা খারাপ হয়েছিলো তোমার অবস্থা?’
আদিত্য মাথা নিচু করে নিলেন কোয়েলের কথায়। আমি উঠতে নিলেই উনি আমার হাত ধরে বললেন,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘আব, আসছি।’
আমি নীচে নেমে এলাম হরি কাকার সাথে কথা বলতে। ওনার থেকেই এখন থেকে খবর নিতে হবে আমায়। আমার মনে হয় না আদিত্য শরীর খারাপ হলেও আমাকে জানাবে বলে তাই একমাত্র উপায় হরি কাকাই।
অন্যদিকে,
‘কোয়েল।’
‘কথা বলবে না একদম।’
‘আরে শোন তো। আমি ইচ্ছা করে জ্বর এনেছি নাকি?’
‘হ্যাঁ। কে বলেছিল ওই অবস্থায় ড্রাইভ করে ভার্সিটি যেতে?’
‘আমি না গেলে জিয়া মৌমিতাকে ফাঁসিয়ে দিত। আমি কি করে ওর ক্ষতি হতে দিতে পারি? সবার সামনে ওকে হ্যারাস হতে হতো যেটা আমি মানতে পারতাম না।’
‘কেন? কে হয় মৌমিতা তোমার?’
আদিত্য চুপ করে গেলো কোয়েলের কথায়। কোয়েল আবারও বলতে শুরু করলো,
‘কি কারণে তোমার রাগ হয়েছিল? মৌ আর অঙ্কিতকে একসাথে দেখে?’
আদিত্য অবাক হয়ে কোয়েলের দিকে তাকালে কোয়েল সামান্য হাসে। আর বলে,
‘মৌকে অঙ্কিতের সাথে ক্লোজ হয়ে ডান্স করতে দেখে কেন এতো রাগ হচ্ছিলো তোমার? আমি কিন্তু সবটা দেখেছি আদিত্যদা।’
‘আমি জানি না।’
আদিত্য মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলে কোয়েল বলে ওঠে,
‘নিজের স্ত্রীকে অন্য একটা ছেলের সাথে ক্লোজ হতে দেখে রাগ হচ্ছিলো তাই না?’
আদিত্য চমকে উঠে কোয়েলের দিকে তাকায়। দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় আদিত্য অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে নেয়।
‘ভেবো না মৌ আমাকে জানিয়েছে। তুমি যেমন ওকে বিয়ের রাতে বলেছিলে কাওকে জানাতে না ও তেমনটাই করেছে কাওকে কিছুই জানায়নি আর এখানে এসেও তোমার সাথে ওর কি সম্পর্ক সেটা বলেনি। আজ ডাক্তারবাবু কে ছেড়ে দিয়ে এসে তোমার ঘরে ঢুকবো সে সময় হরি কাকার ”বউমা” ডাকটা শুনতে পাই। বুঝতে সময় লাগেনি আমার, একে একে সব হিসেব মিলে গেছে।’
আদিত্য চুপ করে রয়েছে কিছু বলছে না। কোয়েল আবার বললো,
‘এটা আমি তোমার থেকে আশা করিনি আদিত্যদা। তুমি যদি নিজের ভালো টা এখনই বুঝে যাও তাহলে তো ভালোই নাহলে অনেক কষ্ট পেতে হবে তোমায়। নিজের পরিস্থিতি, অবস্থা মাথায় রেখে নিজের অনুভূতিটা বোঝার চেষ্টা করো। আসলাম।’
আদিত্য কোয়েলের শেষ কথাগুলো ভাবতে লাগলো। কেমন যেনো খটকা লাগলো ওর, এটা কি কোয়েল মৌকে নিয়ে ওর অনুভূতির কথা বলে গেলো? ভাবছে আদিত্য। কোয়েল বেরিয়ে যাচ্ছে হুঁশ আসতেই আদিত্য জোরে বললো,
‘আমি যতদিন ভার্সিটিতে যেতে পারবো না ততদিন মৌমিতার খেয়াল রাখিস। ওই জিয়া জানো কোনো সুযোগ না পায়।’
ধরাম! করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো কোয়েল। আদিত্য সেটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এদিকে কোয়েল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মনে মনে হাসছে আর বলছে,
‘তোমার এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা। মৌকে ভালোবেসে ফেলেছো তুমি নিজের অজান্তে। ব্যাপারটা আমার জন্যও খুবই আশ্চর্যের কারণ আমি ভাবিনি তুমি কোনোদিন কোনো মেয়েকে ভালোবাসবে। আসলে, এটাই হয়তো বিয়ের বন্ধন। আর মৌয়ের মতো মেয়েকে না ভালোবেসে থাকা যায় না কিন্তু তুমি তো ওর সাথে থাকনি তাহলে কীভাবে ভালোবাসলে? আমি জানি এই প্রশ্নটাই ভাবাচ্ছে তোমায় আদিত্যদা। এসবই বিয়ের কারণে, তুমি মনে মনে এটা জানো মৌ তোমার বিয়ে করা বউ। ওর উপর শুধু তোমার অধিকার আছে, তাই তো অন্য কোনো ছেলের সাথে মৌকে দেখলে তুমি সহ্য করতে পারছো না। মৌকে কেউ হ্যারাস করলে মানতে পারছো না, শুধুমাত্র ও তোমার স্ত্রী দেখে। মুখে বলে দিয়েছো মানো না এই বিয়ে কিন্তু মনে মনে কখন যে মৌকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছো বুঝতে পারো নি। এটাই তোমাকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে তুমি এই বিয়েটা মেনে নিয়েছো, তুমি ভালোবেসে ফেলেছো মৌকে। মৌয়ের উপর তোমার অধিকার, তোমার যত্ন, ওকে নিয়ে ভাবা, জেলাসি সবকিছু সেটার প্রমান।’
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী