‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৩২.
হরি কাকার থেকে ওনার নাম্বার নিয়ে নিয়েছি। আদিত্যর খবর ওনার থেকেই নেবো, এমনিতেও উনি আমাকে সত্যি কথা বলবেন বলে মনে হয় না। হরি কাকার সাথে কথা বলে উপরে উঠতে গেলেই দেখলাম কোয়েল নীচে নেমে আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘চলে এলি যে?’
‘ভার্সিটিতে যেতে হবে তাই। তুই চাইলে থাকতেই পারিস।’
‘হ্যাঁ? না না। আমিও যাবো তোর সাথেই।’
কথাটা নিস্তেজ হয়ে বললাম। ওনার ঘরের দিকে একনজর তাকিয়ে কোয়েলর দিকে অসহায় মুখ করে বললাম,
‘আরেকটু থেকে গেলে হতো না?’
‘কেন? এখন তো আদিত্যদা রেস্ট নেবে। আমরা থেকে কি করবো?’
‘ওহ, হ্যাঁ তাই তো। ঠিক আছে চল। কিন্তু আমার ব্যাগটা ওনার ঘরে আছে। নিয়ে আসছি দাঁড়া।’
কথাটা বলেই ছুট লাগলাম ওনার ঘরের দিকে। ওনার ঘরে ঢুকে দেখলাম উনি চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। ওনাকে একটু ভালো ভাবে দেখে নিয়ে ওনার পাশে রাখা আমার ব্যাগটার উপর হাত দিয়ে ওটা নিতেই উনি আমার হাতের উপর হাত রেখে হুট করেই জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমিও চলে যাচ্ছো?’
‘হ..হ্যাঁ। কেন?’
‘না মানে, জিয়া আছে তাই বলছিলাম।’
‘ওহ। কিছু হবে না। ওকে অতো ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। ও কোনো ক্ষতি করতে পারবে না আমার। আপনি রেস্ট নিন, আমি আসছি।’
আমার কথার পরিবর্তে আর কোনো কথা বললেন না উনি। আমিও বেরিয়ে এলাম ব্যাগটা নিয়ে। আসার সময় আড় চোখে দেখলাম উনি আমার দিকে মুখ ছোটো করে তাকিয়ে আছেন। কেন যে এমন আবভাব ওনার জানি না। ফুলশয্যার রাতের ব্যবহারের সাথে ভার্সিটি আসার পর থেকে করা ব্যবহারের সাথে কোনো মিল নেই। এসব ভাবতে ভাবতে নীচে এসে দেখলাম কোয়েল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন ঘাটছে।
‘চল।’
কোয়েল আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে এগিয়ে গেলে আমিও এগিয়ে যাই। ওনাকে তো বড়ো মুখ করে বলে এলাম জিয়া আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কিন্তু এখন তো নিজেরও নার্ভাস লাগছে। জিয়া তো আমার পিছনে হাত ধুয়ে পরে আছে। একেকদিন একেকরকম কান্ড ঘটাচ্ছে আমাকে ফাঁসানোর জন্য। এতদিন তাও আদিত্য ছিলেন, উনি হেল্প করতেন কিন্তু এখন..?? না জানি কি হবে।
‘কি ভাবছিস এতো?’
কোয়েলের কথায় ওর দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়লাম।
‘তুই তো থেকে যেতে পারতিস আদিত্যদার কাছে। চলে এলি কেন?’
‘তুই না থাকলে আমি থেকে কি করবো?’
‘তুই আর আমি কি এক?’
‘ম..মানে? আমি একা একটা মেয়ে ওনার সাথে থাকলে লোকে কি বলবে?’
‘নিজের স্বামীর সাথে থাকবি এতে লোকে কি বললো না বললো ভাবছিস কেন?’
কোয়েলের কথা শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। অনেক্ষন ধরেই কোয়েলের ব্যবহার আমাকে ভাবাচ্ছিলো। কিন্তু ও? ও কি করে জানলো এই বিষয়ে? হরি কাকা বলে দিয়েছেন? নাকি…
‘কি হলো? ওহ এবার আমি জানি তুই কি ভাবছিস। তোর আর হরি কাকার কথা শুনে নিয়েছিলাম ডাক্তারবাবু কে ছেড়ে ঘরে ঢোকার সময়।’
‘আ..আসলে….
‘থাক। আর কোনো মিথ্যে অজুহাত দিতে হবে না। আমার মনে আছে তোর স্বামী তোকে ফুলশয্যার রাতে কি বলেছিলো। তুই সেটাই পালন করেছিস।’
আমি অবাক হয়ে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘তুই রেগে নেই আমার উপর?’
‘আমি কেন রেগে থাকবো?’
কোয়েলের কথা শুনে কোয়েলকে জড়িয়ে ধরলাম। ও ছাড়া এখানে আমার কেউ নেই। ও’ও যদি এখন রেগে আমার সাথ ছেড়ে দেয় তাহলে তো আমি বড্ড একা হয়ে যাবো। কোয়েল আমাকে সোজা করে আমার চোখের জল মুছিয়ে বললো,
‘এতোই যখন ভালোবাসিস বরকে তাহলে তো থেকেই যেতে পারতিস।’
কোয়েলের কথায় মাথাটাই গরম হয়ে গেলো। আমি ওর থেকে দূরে সরে উত্তর দিলাম,
‘আমি ভালোবাসবো! তাও কাকে? আদিত্যকে? যে কি না আমার সাথে বিয়ের রাতে অতো খারাপ ব্যবহার করেছে? আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অন্য মেয়ের সাথে রিলেশন রেখেছে? অসম্ভব। ওনাকে আমি কোনদিন ভালোবাসতে পারবো না।’
‘আচ্ছা? তাহলে এই সাদ সকালে আমাকে ঘুম থেকে তুলে এভাবে ছুটে এলি কেন? কাল সারারাত না ঘুমিয়ে ওরকম ছটফট করছিলি কেন?’
‘কৃতজ্ঞতার জন্য।’
‘কিহ?’
‘হ্যাঁ। তা নয়তো কি? উনি যদি আমার কপিটা ঠিক সময় না নিয়ে আসতেন তাহলে আমাকে জিয়া ফাঁসিয়ে দিতো। ম্যাডামের কাছে আমাকে অনেক কথা শুনতে হতো, সারা ক্লাসের সামনে হ্যারাস হতে হতো। উনি ওনার ওই অবস্থায় আমার কথা ভেবেছেন তাই তো ওনার শরীর খারাপ করেছে। সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই এতো কিছু করেছি। আমি যদি এখন মুখ ফিরিয়ে থাকতাম তাহলে সেটা আমার বিবেকে বাঁধত।’
কোয়েল আমার কথা শুনে হাসলো,
‘তুই হাসছিস কেন? হাসির কি বলেছি আমি?’
‘হাসির কিছু বলিসনি বলছিস? আচ্ছা মেনে নিলাম এইগুলো সব কৃতজ্ঞতার খাতিরে করেছিস কিন্তু কম্পিটিশনে জিয়ার সাথে আদিত্যদা কে দেখে গ্রীন রুমে কান্নার কারণ?’
‘ও..ও..ওটা তো আমি আমার পরিবারের জন্য কাঁদছিলাম। তুই ওটাকে এখানে কেন টানছিস? ওনার যার সাথে ইচ্ছা হয়েছে তার সাথেই পারফর্ম করেছেন। এখানে আমি বলার কে? আমি তো ওনার কেউ হইনা। আমি ওনার জন্য যা করেছি তা কৃতজ্ঞতা, ব্যাস এটুকুই! এখন চল। দেরী হয়ে যাচ্ছে আমাদের।’
আমি আর কোনো কিছু না বলে হেঁটে চলে এলাম ওখান থেকে। কি সব উল্টো পাল্টা যে বলছে না এই কোয়েল টা। আমি নাকি ওনাকে ভালোবাসি? হুহ! কোনোদিনও না।
‘হায় ভগবান! আমি ভেবেছিলাম শুধু আদিত্যদা নিজের ফিলিংস বোঝে না বাট এখানে তো দেখছি এরও একই অবস্থা। দেবা-দেবী দুজনেই এক প্রকার। যাক একদিকে ভালোই হলো, দুটোতে একসাথেই যা বোঝার বুঝবে। নাহ যাই, ওদিকে তো এখন আবার জিয়া আছে। আজব জ্বালা মাইরি!’
আমি ভার্সিটিতে ঢুকে সোজা ক্লাসে চলে গেলাম। ক্লাসে ঢুকে দেখলাম জিয়া নিজের কাজে ব্যস্ত। আজকে তো সবার অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করার কথা ওর, তাই হয়তো এরকম নাজেহাল অবস্থা। আমি কিছু না ভেবে নিজের জায়গায় বসলাম। কিছুক্ষণপরেই কোয়েল এসে জিয়ার দিকে তাকিয়ে আমার পাশে এসে বসলো।
‘একি রে? এর অবস্থা তো গুরুতর।’
‘সেটাই তো দেখছি। কমপ্লিট করতে পেরেছে?’
‘সেটা তো ম্যাডাম আসলেই বোঝা যাবে। উনি আসছেন দেখলাম ত..
কোয়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন। যেহেতু উনি খুব স্ট্রিক্ট তাই চুপ করে বসে রইলাম আমরা।
‘জিয়া! তোমার কাজ কমপ্লিট করেছ?’
‘ই..ইয়েস ম্যাম।’
‘ভেরি গুড। সাবমিট করো রাইট নাও।’
জিয়া কাচুমাচু মুখ করে আস্তে আস্তে সব কটা কপি সাবমিট করে দিলো ম্যাডামের কাছে। ম্যাডাম ক্লাস নিতে শুরু করলেন। মাঝে মধ্যেই আমার আদিত্যের কথা মনে পড়ে গেলে কোয়েলের কথাগুলোও মনে পড়ে যাচ্ছে তাই তৎক্ষনাৎ ক্লাসে মন দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই এক কথাগুলো মাথায় চলে আসছে। এই করতে করতেই ক্লাস শেষ হলো।
‘এই কোয়েল? চল হস্টেলে ফিরে যাই। আর ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না।’
‘কেন? তোর আবার কি হলো?’
__’কেন তুই জানিস না কোয়েল মৌমিতার কি হয়েছে? আজকে আদি আসেনি তো তাই ওর কোনো কিছুই ইচ্ছা করছে না।’
আমাদের কথার মাঝখানে জিয়া এভাবে কথা বলবে ভাবিনি। আমি ওকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও আবার বললো,
‘কি ব্যাপার বল তো তোর? সব সময় এভাবে আদির আগে পিছে কেন ঘুরিস?’
‘তোর কি চোখে কোনো সমস্যা আছে জিয়া? নাকি এতোগুলো অ্যাসাইনমেন্ট একসাথে করায় চোখে পাওয়ার এসে গেছে কোনটা?’
‘হোয়াট?’
‘হ্যাঁ। তা নয়তো কি? একমাত্র তুইই দেখতে পেয়েছিস আমি আদিত্যের পিছনে সারাক্ষন ঘুরি। যেখানে সবাই আমাকে ক্লাস করতে দেখে ভার্সিটিতে।’
জিয়া আবার কিছু বলতে নিলে আমি ওকে আটকে বলি,
‘আচ্ছা তুই আদিত্যকে কি মনে করিস বল তো? ও কি সূর্য নাকি যে ওর আগে পিছে সবাই গ্রহ হয়ে ঘুরে বেড়াবে? ও তোর কাছে সূর্য হতে পারে আর তুই ওর গ্রহ হতে পারিস যে কি না সারাক্ষন আদিত্য আদিত্য করে কিন্তু আমার কাছে সেটা নয়। সো নিজের এই ননসেন্স কথাগুলো নিজের কাছে রাখ।’
‘খুব কথা বলছিস তাই না কয়েকদিন আদির আশকারা পেয়ে? এখন আমিও দেখবো তোকে কে বাঁচায়?’
__’আমি বাঁচাবো!’
আমরা তাকিয়ে দেখলাম অঙ্কিত দাঁড়িয়ে আছে। অঙ্কিত আমাদের দিকে এগিয়ে এসে জিয়ার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
‘তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস আদিত্যের অবর্তমানে আমি ইউনিয়নের হেড। আমার কাছে কিন্তু তোর এই উৎপাত চলবে না। আর আশকারা আদিত্য একমাত্র তোকেই দিয়েছে আর কাউকে নয়। যা, নিজের ক্লাসে যা।’
অঙ্কিতের কথা শুনে জিয়া রেগে কটমট করে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো। কোয়েল অঙ্কিতকে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি একদম ঠিক সময়ে হাজির হলে কি ভাবে?’
কোয়েলের কথা শুনে আমিও অঙ্কিতের দিকে একই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।
ফ্ল্যাশব্যাক……………………………
‘কি ব্যাপার? স্বয়ং আদিত্য ব্যানার্জী আমাকে কল করেছেন?’
‘দেখ অঙ্কিত। আমি তোর সাথে কোনো তর্কে যেতে চাইছি না। আমি তোকে কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা বলতে কল করেছি।’
‘ওয়াও! আমার সাথে তোর ইম্পরট্যান্ট কথা? গ্রেট! তা বলে ফেল কি কথা।’
‘শোন, আমি কদিন ভার্সিটি যেতে পারবো না। আমার জায়গায় তুই হেড হবি ইউনিয়নের তাই…
‘কি হয়েছে তোর? কেন আসতে পারবি না?’
‘ওই ছোট একটা একসিডেন্ট হয়েছে। তাই ডক্টর রেস্ট নিতে বলেছেন।’
‘ওকে। তুই রেস্ট নে আর তোর অবর্তমানে তো আমারই হেড হওয়ার কথা।’
‘হ্যাঁ। দেখ, মৌমিতা কে একটু দেখে রাখবি কারণ জিয়া আর সৌভিক ওর পিছনে হাত ধুয়ে পড়েছে। ওরা ওর ক্ষতি করতে চাইবে, আমি এটা বলার জন্যেই তোকে কল করেছি।’
‘সৌভিক এর মধ্যে এলো কি করে?’
আদিত্য অঙ্কিতকে প্রথম থেকে ফ্রেশারস পার্টির ব্যাপারে সবটা বললো। সবটা শুনে অঙ্কিত বললো,
‘শুধুমাত্র তোর জন্য ওরা এতটা বার বেড়েছে। তুই ভালো ভাবেই জানতিস তোর নাম করে ওরা এসব বাঁদরামি অনেকদিন ধরে করছে, স্পেশালি জিয়া। আর তুই তো নাকি ফাস্ট দিন এটাও বলেছিস যে জিয়া মৌমিতা কে যা বলেছে ঠিক করেছে। আমিও যখন এসব আটকাতে চেয়েছিলাম তুই বাঁধা দিয়েছিলি তাহলে এখন কি হলো?’
‘সেসব নিয়ে আমি আর কথা বলতে চাইছি না।’
‘আমি জানি তুই জিয়ার বাবার জন্য চুপ করে আছিস। কিন্তু এভাবে আর কতদিন আদি?’
‘বেশিদিন না। খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করবো আমি। উনি ভার্সিটির ডিরেক্টর হয়েছেন তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক আছে। এই জন্যে আরো বেশি সাবধান থাকিস। আর কাউকে জানবি না আমি তোকে কল করেছিলাম।’
‘ওকে, তুই রেস্ট নে।’
প্রেসেন্ট……………………………….
‘এই অঙ্কিত! কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?’
‘হ্যাঁ? কোথাও না। বল।’
‘সঠিক সময়ে এন্ট্রি মারলে কি ভাবে?’
‘ওটাই তো আমার কাজ বেবি!’
অঙ্কিত কোয়েলকে একহাতে জড়িয়ে কথাটা বললে কোয়েল ধাক্কা মেরে অঙ্কিত কে সরিয়ে দু-ঘা বসিয়ে দেয়।
‘সবসময় মারিস কেন আমায়?’
‘বেশ করি।’
ওরা দুটিতে মিলে ঝগড়া করতে থাকলো আর আমি হাসতে থাকলাম ওদের দেখে।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী