#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ বাইশ
#মম_সাহা
মায়ের বুকের মাঝে যত্নে লেপ্টে থাকা চিত্রার লতার মতন দেহখানি, চোখো অশ্রুদের সমাহার, কণ্ঠে অভিযোগের তুমুল মি* ছিল। মুনিয়া বেগম হাসলেন, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কে বলেছিস শুনতে পাই নি, আবার বল।”
“ওরা আমায় ভালোবাসে নি, আম্মু। তোমার মতন কেউ ভালোবাসতে পারে না।”
“ভালোবাসবে কী করে? সবাই তো আর মা না।”
চিত্রা মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। যেন কত সহস্র বছর পর দেখতে পেলো মায়ের মুখখানা! কি ভীষণ মিষ্টি!
বাহার তখনও পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে লেপ্টানো মিষ্টি হাসি। চিত্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বললো,
“তুমি কেনো গেলে আম্মু? তুমি যাওয়ার সাথে সাথে সুখ গুলোও তো আমায় ছেড়েছে।”
“কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ হারানো উত্তম, মানুষ হারালে বাস্তবতা বুঝা যায়। তাই গিয়েছিলাম। তোমার বাহার ভাইকে তো রেখে গিয়েছিলাম, যেন তোমায় আগলে রাখে তুহিন ভাইজানসহ। কিন্তু ভাবি নি তোমার বাস্তবতা এতটা নিষ্ঠুর।”
“বাহার ভাই জানতো তুমি কোথায়!”
চিত্রার চোখে-মুখে তুমুল বিষ্ময়। মুনিয়া বেগম মাথা নাড়ালেন। কোমল কণ্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ, জানতো। আমি প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম, কাউকে বলে যাই নি কেবল তোমার মাথার ভূ* ত ছাড়ানোর জন্য। কে জানতো, সুখও তোমায় ছেড়ে যাবে!”
শেষের কথাটায় দীর্ঘশ্বাসের ছোঁয়া। চিত্রা বাহার ভাইয়ের দিকে তাকালো। অভিমানীনির অক্ষি দ্বয়ের ভাষা যেন বুঝলো বাহার ভাই, তাই তো দু’কম এগিয়ে এলো, চিত্রার সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ছোট্টো কণ্ঠে বললো,
“আন্টিকে বুদ্ধিটা দেওয়ার জন্য আমি কোনোরকমের গিল্টি ফিল করছি না। তোমার বিয়ের সাধ ছাড়ানোর জন্য ই বুদ্ধি।”
চিত্রা মুখ ভেংচি দিলো। বাহার হাসতে হাসতে ফিসফিস করে বললো,
“চিন্তা কিসের মেয়ে? মনে রেখো, আমি তোমায় আলো দেবো, সূর্য ডোবার পরেও।”
চিত্রা তৃপ্তির শ্বাস ফেললো। বাহার তাদের রিক্সায় উঠিয়ে পাঠিয়ে দিলো গন্তব্যে। রিক্সার বিপরীতে হাঁটা ধরলো সেও, গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,
“ভুলভাল ভালবাসি,
কান্নায় কাছে আসি
ঘৃণা হয়ে চলে যাই থাকি না
কথা বলি একা একা,
সেধে এসে খেয়ে ছ্যাঁকা
কেনো গাল দাও আবার বুঝি না।”
(৫৭)
আফজাল সওদাগর যখন বাড়ি ফিরলেন, বাড়ির এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সে প্রায় হতভম্ব। ছোটোবেলা থেকেই পরিবারকে আগলে রাখার এক অদম্য শখ তার মনে ছিলো। ভাই-বোনদের সে খুব ভালোবাসতেন তাই তাদের আগলিয়ে রাখার নিখুঁত এক চেষ্টা চলতো তার ভেতর। আর তার চেষ্টাকে সবসময় সাহায্য আর সম্মান করেছে তার অর্ধাঙ্গিনী। একমাত্র এ পরিবারটাকে এক রাখার জন্য কত কিছু সে মনের মাঝে দাফন করেছেন, আর আজ সেই রোজা সওদাগর কিনা কারো ভেঙে যাওয়ার কারণ!
ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আফজাল সওদাগর বসে আছেন তার রুমের আরাম কেদারায়। চোখেমুখে তার ভেসে উঠেছে কালো অতীতের কিছু স্মৃতি। জীবনে উপরে উঠার জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য কম পাপ করেন নি। ক্ষমতার কারণে সে ধামাচাপা দিয়েছে কত পাপ! বাহিরের দুনিয়ার সাথে সে যতটা শক্ত, পরিবারের জন্য ঠিক ততটাই কোমল। কিন্তু আজ! কি হলো অবশেষে? পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না।
আফজাল সওদাগরের সামনে ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোজা সওদাগর। মুখে তার কথা নেই। গম্ভীরতা পুরো মুখ জুড়ে।
আফজাল সওদাগর লেবুর শরবত টা নিলেন না, বরং অদ্ভুত কণ্ঠে বললেন,
“আমার যুবক বয়সের পাপের শাস্তি কি তুমি, এখন দিচ্ছো?”
স্বামীর গম্ভীর কণ্ঠে কাঁপলেন রোজা সওদাগর। কিন্তু কথা বললেন না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ।
আফজাল সওদাগর অনেক বছর পুরোনো প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন এক নিমিষেই। স্ত্রীর হাতের শরবতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। ঝনঝন শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হলো গ্লাসটা। সাথে ভীত হলো রোজা সওদাগরও। মিনিট ব্যবধানে সশব্দে চ* ড় পড়লো তার গালে। সে তাজ্জব,হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইলো স্বামীর পানে। আজ থেকে তেইশ-চব্বিশ বছর আগে দেওয়া কথাটা ভেঙে ফেলেছে তার স্বামী, তা যেন সে মানতে পারলো না।
আফজাল সওদাগরের তখন চোখ দিয়ে ঝরছে অগ্নি। সেই আগুনে সে যেন জ্বালিয়ে দিবে তার অর্ধাঙ্গিনীকে। কণ্ঠে তার তুমুল ক্ষোভ, চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
“তোমার সাহস হলে কীভাবে, আমার অবর্তমানে আমার পরিবারটাকে এক ছিন্ন বিছিন্ন করার? ফকিন্নির বাচ্চা।”
রোজা সওদাগর নিরুত্তর। অনেক দিন পর স্বামীর পুরোনো রূপ দেখে প্রায় সে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। মানতে কষ্ট হচ্ছে তার যে এটাই তার স্বামী। আফজাল সওদাগরের মুখের ভাষা বিশ্রী থেকে বিশ্রী হলো। ক্রোধ ঝরে পড়লো সারা শরীর উপচে। টিকতে না পেরে রোজা সওদাগরের চুলের মুঠি টেনে ধরলেন। বা’গালে আরও একটা চ* ড় বসিয়ে বললেন,
“ফকিন্নির মেয়ে হুট করে রাজার আসনে বসলে তো এমনই হবে। তুই আবার আমার ভাইয়ের মেয়ের গায়ে হাত তুলিস। তোর সাহস দেখে আমি অবাক।”
“আপনার সাহস দেখেও আমি অবাক। ভুলে যাচ্ছেন, আমার কাছে আপনার ইজ্জত আমানত আছে? এমন কিছু করবেন না যে আমার সবটা মেলে দিতে হয় সবার সামনে।”
রোজা সওদাগর যে খুব নিবিড় একটা হুমকি দিলো তা বুঝতে বাকি রইলো না আফজাল সওদাগরের। তার রাগ তখন সীমা পেরিয়ে গেলো। অনবরত আঘাত করতে থাকলো তার স্ত্রীকে।
তাদের ঘরের এমন হৈচৈ শুনে অবনী বেগম, অহি, চাঁদনী সহ সবাই ছুটে আসে। এমন বিরল ঘটনা ঘটতে দেখে তারা রীতিমতো অবাকে হা হয়ে রইলো। লতা বেগম আর অবনী বেগম এসে হাত ছুটানোর চেষ্টা করলো কিন্তু আফজাল সওদাগরের পুরুষ শক্তির কাছে তাদের জোড়াজুড়িটা খুবই স্বল্প। চাঁদনীর শরীর তখনও দুর্বল, কণ্ঠে অসুস্থতার ছোঁয়া, তবুও সে এই ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“আব্বু, কি করছো? আম্মুকে ছাড়ো।”
মেয়ের দুর্বল কণ্ঠ কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই হাতের চাপ ঢিলে করে দিলো আফজাল সওদাগর। ছেড়ে দিলেন অর্ধাঙ্গিনীকে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। তাকে নিয়ে সবার মনে যে সম্মানের জায়গা ছিলো, আজ সে জায়গাটা কেমন যেন হালকা হয়ে গেলো। রোজা সওদাগরও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। সেও চায় নি তার স্বামীর সম্মান কিঞ্চিৎ কমুক। তাই তো ঘটনা ধামাচাপা দিতে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“সবাই বের হও, উনি মাত্র এসেছেন তো তাই মাথা গরম। তোমরা যাও এখন।”
সাথে সাথে সবাই বেরও হয়ে গেলো বিনা প্রতিবাদে। অহি চাঁদনীকে ধরে নিয়ে গেলো। আফজাল সওদাগরও আবার বসে পড়লেন আরামকেদারা খানায়। সে তার জীবনে ভাই, ভাইদের ছেলে-মেয়ে,বোন, বোনের ছেলেকে অনেক বেশিই ভালোবেসেছে। আর চিত্রাকে বোধহয় একটু বেশিই ভালোবেসেছে কারণ সে চিত্রার মাঝে তার অতীতের খুব গোপনের মায়া-মায়া, আদুরে সেই কন্যার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। যার প্রতি দায়িত্বহীন হয়েছিল বিধায় তার অগোচরে সে কন্যা ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর মুখে। সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে নি। না প্রায়শ্চিত্ত করতে পেরেছে সে পাপের, তন্মধ্যেই রোজা সওদাগরের এহেন আচরণ তাকে আরও ভেঙে দিয়েছে, তাই তো সে হারিয়ে ফেললো নিজের এতদিনের ব্যাক্তিত্ব কিংবা বলা যায় খোলশ।
(৫৮)
তপ্ত দুপুরে ঘামে ভিজে একাকার অহির শরীরখানা। কি মারাত্মক রোদ উঠেছে পহেলা অক্টোবরের আকাশে!বিরক্তের আকাশে হুট করে মুগ্ধতা নিয়ে হাজির হলো নওশাদ। সাদা শার্ট, গলায় টাই, কালো প্যান্টে মারাত্মক সুন্দর লাগছে লোকটাকে। অহি যখন নওশাদের এমন রূপ দেখলো, সে বেশ অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো নওশাদের পানে।
অহিকে দেখেই হাসি খুশি নওশাদ হেলেদুলে চলে এলো অহির পাশে। মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“কি হে মিস, আজ রোদ বোধহয় আপনাকে বেশিই উত্যক্ত করেছে!”
অহি ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছলো, বিরক্তের স্বরে বললো,
“হ্যাঁ বেশিই উত্যক্ত করেছে, আর এখন আপনি নিশ্চিত তার চেয়েও বেশি করবেন।”
নওশাদ হেসে দিলেন। মাথার পেছনে চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে বললেন,
“তা আপনি মিছে বলেন নি। হুট করে আপনার কথা মনে হলো, তাই চলে এলাম উত্যক্ত করতে।”
“আপনি নাকি কাজ করেন? তা সারাদিন মেয়েদের পিছনে ঘোরা ছাড়া তো কোনো কাজ আপনার নেই দেখছি।”
“মেয়ের পিছনে ঘুরি ঠিক তবে মেয়েদের পিছে না। আর এখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে মিস।”
নিজের ঝাঁঝালো কথার বিপরীতে নওশাদের হাসি খুশি উত্তরে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো অহির। তাই সে আর কিছু না বলেই হাঁটা ধরলো। নওশাদও সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি মিস।”
অহি ভ্রু কুঁচকালো। চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি জিনিস?”
নওশাদ তার পকেট থেকে তৎক্ষনাৎ কালো গোলাপ টা অহির সামনে ধরলো। চোখের মাঝে আনন্দের চিলিক খেলিয়ে বললো,
“কালো গোলাপ, ভালোবাসার বিষাদময় প্রতীক। পছন্দ তো আপনার?”
অহি মিনিট দুই ফুলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে তুমুল মাথা ব্যাথায় তার চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। কেমন যেন শিরা-উপশিরায় আ* ন্দোলন চালালো রাগ। নওশাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো গোলাপটা এবং ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে কয়েক টুকরো করে ছুঁড়ে মারলো তা দূরে। নওশাদ কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখলো সবটা। সে যেন কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। অহির কাছে এমন একটা আচরণ সে ঠিক আশা করে নি বলা যায়।
অহি তুমুল রাগে হেঁটে চলে গেলো কয়েক পা। নওশাদ তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এই গোলাপটা কেনার জন্য সে অফিস ছুটি নিয়েছে, ফুলের দোকানের কর্মচারীটার সাথে কথা কাটাকাটি করেছে, অথচ যার জন্য এটা কেনা হলো, সে কি করলো!
অহি কয়েক পা এগিয়ে আবার থেমে গেলো। ফিরে তাকালো নওশাদের থমথমে মুখটার দিকে। খারাপ লাগায় ছেয়ে গেলো তার মনের আঙিনা। সে আবার পিছু ফিরলো, পিছুটান টেনে নিয়ে গেলো তাকে নওশাদ অব্দি। অহি ক্ষীণ স্বরে মাথা নত করে বললো,
“মন খারাপ করবেন না। আমি আসলে ফুল পছন্দ করি না। ফুল দেখলেই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। বলা যায় এটা আমার একটা মানসিক রোগ যা কেউ জানেনা। খুব ছোটোবেলার বিদঘুটে ঘটনার প্রভাবে আমার এই মানসিক রোগ, যা মাঝে মাঝে মানুষ খু* ন করার ইচ্ছে জাগাতেও সাহায্য করে।”
#চলবে