‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~২১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৩৬.
ক্লাসে ম্যাডাম বোর্ডে লিখে পড়া বোঝানোর সময় হুট করেই কোয়েল আমাকে আলতো করে ধাক্কা মারলো। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়েই আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি হয়েছে?’
‘ডানদিকে একবার তাকিয়ে দেখ। রণিত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তোর দিকে।’
কোয়েলের কথা শুনে বোর্ডের থেকে চোখ সরিয়ে কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েল ইশারা করলো চোখ দিয়ে। আমি আস্তে আস্তে ওদিকে আড় চোখে তাকাতেই দেখি সত্যি রণিত আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। একটু পর ভালো ভাবে তাকাতেই দেখলাম ও গালে হাত দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই ও হাত নেড়ে হাসলো ফলে আমিও হালকা হেসে আবার বোর্ডের দিকে তাকালাম। কোয়েল কে কুনুই দিয়ে খোঁচা মারলে ও আমার দিকে কান এগালো আর আমি আস্তে করে বললাম,
‘সত্যি তো, আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে।’
‘হম। মনে হয় তোর প্রেমে পড়েছে।’
‘ধুর, বাজে কথা বলিস না তো।’
‘ওই দেখ, আবার তোকে ডাকতে বলছে। তাকা ওদিকে।’
কোয়েলের কথা শুনে যেই না রণিতের দিকে তাকাতে যাবো ওমনি ম্যাডাম রণিতের নাম ধরে ডাকলো। আমি সহ সবাই তাকালাম রণিতের দিকে কিন্তু রণিত তখনও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে কারণ ওর বন্ধুরা ডাকলেও ও সাড়া দিচ্ছে না। ম্যাডাম ওর চোখের সামনে এসে দাঁড়ালেই ও চমকে উঠে দাঁড়ালো।
‘কি ম্যাডাম? কিছু বলবেন?’
‘ক্লাসে মন না দিয়ে অন্যদিকে মন কেন তোমার? চুপচাপ ক্লাসে মন দাও, আমি জানো আর না দেখি এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকতে। পড়া ধরবো কিছুক্ষণ পর।’
আমি আর কোয়েল একটু অবাক হলাম ম্যাডামের বিহেভিয়ারে। ম্যাডাম যেমন রাগী তাতে এতক্ষনে দু-চারটে কড়া কথা শুনিয়ে রণিত কে ক্লাস থেকে বার করে দেওয়ার কথা ওনার। কিন্তু উনি তেমন কিছুই বললেন না, কেন?
‘এখনও তোর দিকে তাকিয়ে আছে।’
কোয়েল আমাকে কানে কানে বললে আমি ওকে রেগে বলি,
‘বাদ দে তো। ও ছাড় পেয়েছে বলে কি আমরাও পাবো নাকি? চুপচাপ পড়ায় মন দে নাহলে ক্লাস থেকে বার করে দেবে।’
আমার কথা শুনে কোয়েল চুপ করে ক্লাসে মন দিলো। এরপর রণিত কি করেছে না করেছে তা আমরা জানি না কারণ ওর দিকে আর আমি বা কোয়েল কেউই তাকাইনি। ক্লাস শেষ করে কমন রুমের দিকে যাচ্ছি এমন সময় আমি আর কোয়েল পিছন থেকে রণিতের গলা পেলাম, আমার নাম ধরেই ডাকছে। কোয়েল পিছন ফিরতে নিলেই আমি ওকে বাঁধা দিয়ে বললাম
‘একদম পিছন ফিরবি না। চল এখান থেকে জলদি।’
এই বলে পা চালিয়ে জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই হুট করে কিছু একটার সাথে পা বেজে আমি পরে গেলাম।
‘আহহ!’
_’উপস, স্যরি, স্যরি! ব্যাথা লাগলো বুঝি পায়ে?’
আমি পায়ে হাত দিয়ে মাথা তুলতেই দেখলাম জিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তারমানে ও ইচ্ছা করেই এটা করেছে। ও আবার বললো,
‘হিলস যখন ইউস করতে জানিস না তখন ইউস করিস কেন? এখন পা টা যদি ভেঙে গিয়ে থাকে কি হবে বল তো?’
__’কি আবার হবে? আমার কোলে করে ঘুরে বেড়াবে। আমি আছি কি জন্য?’
আমি পিছন ফিরবো তার আগেই দেখি রণিত এসে আমার পাশে বসলো। আমি রণিতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনে তাকালাম কারণ জিয়ার পিছন দিয়ে আমি আদিত্যকে দেখেছি। উনি আমার দিকেই এগিয়ে আসছিলেন কিন্তু রণিতকে দেখে থেমে গেলেন।
‘কি ম্যাডাম? এভাবে আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে হেঁটে আসছিলেন কেন? এখন হলো তো?’
আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উপস্থিত আমাকে সহ সকলকে অবাক করে দিয়ে রণিত আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে জিয়ার দিকে তাকালাম আর তারপর ওর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আদিত্যের দিকে। ওনার হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে আজকেই আমার আর রণিতের দুজনের শেষ দিন। ধ্বংস করে দেবে উনি আজকেই সব। আমি একটা শুকনো ঢোঁক গিলে কোয়েলের দিকে তাকালে কোয়েল ইশারায় দেখায় আজকে শেষ!
‘আ, আ! প্লিজ জিয়া সব বিষয়ে নিজের পা আগে বাড়ানোটা বন্ধ কর। কোনদিন দেখবি নিজের পা টাই ভেঙে গেছে এইচক্করে।’
রণিত আমাকে নিয়ে এগোতে গেলে জিয়া ওকে কিছু বলতে যায় আর তখনই রণিত এই কথাটা জিয়াকে থামিয়ে বলে দেয় আর হাঁটা শুরু করে।
৩৭.
কমন রুমে ঢুকে আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে রণিত আমার পায়ে হাত দিতে গেলেই আমি বাঁধা দিয়ে বলি,
‘অনেক হয়েছে। এবার তুই যা এখান থেকে। আমি ঠিক আছি।’
‘আচ্ছা তাই নাকি? তাহলে হেঁটে দেখা তো আমাকে।’
রণিতের কথায় চুপ করে গেলাম কারণ হেঁটে দেখানো তো দূর। দাঁড়াতেও পারবো না আমি। সত্যি, সত্যি পা-টা ভেঙে গেলো না তো? এইবার তো আমারই ভয় লাগছে। আমি এসব ভাবছি সেসময় নিজের পায়ে কাওর হাতের স্পর্শ পেলাম।
‘রণিত প্লিজ…
‘চুপ। একদম চুপ। দেখতে দে আগে আমায়।’
রণিত আমার পা ধরে কিছুক্ষণ নাড়াচারা করে হুট করেই ঘুরিয়ে দেয় আর আমি ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে রণিতের কাঁধ খামচে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠি।
‘আহহ! লাগছে ভীষণ।’
রণিতের কোনো উত্তর না আসায় আস্তে আস্তে চোখ খুলে ওর দিকে তাকাতেই ওর চোখে চোখ পড়ে গেলো। ও একভাবে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
‘কি হচ্ছে এখানে?’
হঠাৎ কাওর গম্ভীর গলার স্বর শুনে পাশ ফিরে তাকালাম। তাকাতেই আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আদিত্য গম্ভীর ভাবে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
‘রণিত, ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়াটা উচিত আমার মনে হয়।’
‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। মৌ, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা কর তো একবার।’
রণিত আমার দিকে হাত বাড়ালে আমি আবার আদিত্যের দিকে তাকাই। আদিত্যের পিছনে দাঁড়িয়ে কোয়েল সমানে না বোধক মাথা নাড়ছে। আমিও তাই রণিতের হাত না ধরে নিজে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি আর তাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নিই। সঙ্গে সঙ্গে রণিত আমাকে ধরে নেয়।
‘বলেছিলাম হাতটা ধরতে? আবার কোলে নেবো?’
‘ন..না, না। তার আর দরকার নেই।’
‘তাহলে চুপচাপ হাত ধরে রাখ ছাড়বি না। নাহলে আরেকটা পা-ও যাবে।’
‘কোয়েল, হস্টেল যাওয়ার আগে একবার ডক্টর দেখিয়ে নিস।’
আদিত্য কথাটা বলে আমাদের দিকে একবার তাকালো। স্পেশালি রণিত যে আমার হাত ধরে রয়েছে সেদিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রণিত আস্তে আস্তে আমাকে নিয়ে এগোতে থাকলে কোয়েল বলে,
pপ
‘রণিত, আমি নিয়ে যাই ওকে? ও আর আমি তো একই হস্টেলে থাকি তাই।’
‘হ্যাঁ নো প্রবলেম বাট তুই একা পারবি নাকি আমিও যাবো?’
_’নাহ, তার আর দরকার পড়বে না। আমি আর কোয়েল ওকে নিয়ে যাবো তুই আসতে পারিস। থ্যাংক ইউ হেল্প করার জন্য।’
অঙ্কিতের রিয়াকশন দেখে আমি একটু অবাক হলাম। ও এসে আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললো। উত্তরে রণিত বললো,
‘আরেহ, কি যে বলো অঙ্কিত দা। মৌ আমার ফ্রেন্ড, ওর জন্য করবো না তো কার জন্য করবো? আমি আসছি, ওকে সাবধানে নিয়ে যেও। সাবধানে থাকিস মৌ।’
‘হ্যাঁ।’
রণিত চলে গেলে কোয়েল বলে,
‘অঙ্কিত তুমি এগিয়ে যাও মৌকে নিয়ে। আমি ওর ব্যাগটা নিয়ে আসি, ওটা মনে হয় ওখানেই পরে আছে।’
কোয়েল চলে গেলে অঙ্কিত আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো। আমি একবার তাকাচ্ছি ওর দিকে আরেকবার আর একবার চোখ নামাচ্ছি। বুঝতে পারছি না আমার পড়ে যাওয়া নিয়েই কি ও এতো রেগে আছে? নাকি অন্য কারণে?
‘ক..কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘একটু দেখে শুনে চলা যায় না? আর রণিত যখন কোলে নিলো তখন ওকে আটকাতে পারলি না? অন্য সময় তো খুব ফটোর ফটোর করিস রণিতের বেলায় কি হলো?’
‘আরে, তুই এতো রাগ করছিস কেন? ও হুট করেই আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে।’
‘সেই, তুই তো বাচ্চা তাই।’
‘অঙ্কিত! আমার পায়ে ব্যাথা ছিলো তাই জন্যেই তো ও নিয়েছে। তুমি কোথায় ছিলে তখন? থাক, লাগবে না আমার কাওর সাহায্য।’
কথাটা বলে আমি অঙ্কিতের হাত ছাড়িয়ে নিলে অঙ্কিত আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার একটা হাত শক্ত করে ধরলো। আমি কিছু বলতে নিলেই অঙ্কিত আমাকে বলতে না দিয়ে বললো,
‘রণিতের বেলায় যখন কোনো কথা বলিসনি আমার বেলায়ও বলবি না। আমি তোকে কোলে তুলিনি জাস্ট শক্ত করে ধরেছি যাতে পরে না যাস। কোয়েল আসলে ও ধরবে।’
অঙ্কিত আমাকে কথাটা বলে চুপ করে সামনের দিকে তাকালে আমিও সামনের দিকে তাকাই।
‘আদি তুই?’
আদিত্য কখন এলেন? আমি তো টেরও পাইনি ওনার আসার। এই রে, আজকে যে কি হচ্ছে আমার সাথে। প্রথমে রণিত আর এখন অঙ্কিত। কিন্তু এতটা শান্ত কেন আদিত্য? ঝড় ওঠার আগের পূর্বাভাস না তো? না না, আমি এসব কেন ভাবছি তখন থেকে? উনি তো আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেন না তাহলে উনি কেন রাগ করতে যাবেন আমাকে অন্য কোনো পুরুষ স্পর্শ করলে। ওনার তো কোনো যায় আসার কথা নয়। কিন্তু ওনার চোখ তো সে কথা বলছে না। কম্পিটিশনের দিনের মতো আজকেও ওনার চোখে মুখে অভিমান আর একরাশ কষ্টের ছাঁপ।
‘কি হলো আদি? তুই তো চলে গেছিলি দেখলাম।’
‘হ..হ্যাঁ। আসলে আমার গাড়ির চাবি টা দিতে এসেছিলাম। তুই আছিস, ভালোই হলো। কোয়েল একা পারতো না। তুই মৌমিতা আর কোয়েলকে আমার গাড়িতে নিয়ে যা ডক্টরের কাছে।’
‘থ্যাংকস ভাই। ভালোই হবে।’
আদিত্য ম্লান হেসে অঙ্কিতের হাতে চাবিটা দিতে গেলে দেখতে পেলো অঙ্কিত আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে।
‘মৌ, তোর ওই হাত দিয়ে চাবিটা নে।’
আমি কিছু না বলে আদিত্যের দিকে হাত বাড়ালে আদিত্য আমার হাতে চাবিটা দেন আর একঝলক আমার কোমরে থাকা অঙ্কিতের হাতের দিকে তাকান।
‘সাবধানে থাকবে।’
‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন এখন?’
‘কোথাও না।’
আমার কেন জানো খারাপ লাগছে আদিত্যের কথা শুনে। কান্না আসছে কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম। ওনার হাতটা ধরে রেখেছি আমি, চাবি নেওয়ার বাহানায়। উনি আস্তে করে বললেন,
‘আমি বরং আসি। তোমাকে হেল্প করার অনেক লোক আছে।’
উনি কথাটা বলে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিথ হাসলে আমার আর সেটা সহ্য হলো না। আমি ওনার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বললাম,
‘আপনি নিজের গাড়িটা দিতে পারছেন আর নিজে নিয়ে যেতে পারছেন না?’
উনি কিছু না বলে অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালে আমি সঙ্গে সঙ্গে অঙ্কিতের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। অঙ্কিতকে বললাম,
‘অঙ্কিত আমাকে একটু ছাড়ো আমার অসুবিধা হচ্ছে। আর আমি পঙ্গু হয়ে যাইনি যে আমাকে এভাবে কোমর জড়িয়ে ধরতে হবে তোমায়।’
অঙ্কিত আমার কথা শুনে আমায় ছেড়ে দিলে আমি ওকে আবার বলি,
‘তোমার আজকে এক্সট্রা ক্লাস আছে বলেছিলে না? তুমি বরং সেটা এটেন্ড করো। আদিত্য যখন গাড়ি দিতে পারছেন তখন নিজেও যেতে পারবেন। আর ইউনিয়ন লিডার হিসাবে ওনার তো এটা দায়িত্ব তাই না? তাই..
‘ঠিক আছে। আদি, তুইই নিয়ে যা। আমি আসলাম। আমার ক্লাস আছে।’
অঙ্কিত চলে গেলে আমি আদিত্যের দিকে তাকালাম। উনি চুপ করে মাথা নিচু করে রইলে আমি ধমক দিয়ে বললাম,
‘হাতটা ধরতে পারছেন না? আমার একা দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে তো নাকি?’
আমার ধমক শুনে উনি সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা ধরে আমার কোমরে হাত রাখলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেললাম। একটা আলাদাই অনুভূতি হলো আমার যা রণিত বা অঙ্কিতের স্পর্শে হয়নি। ওনার নিশ্বাস আমার ঘাড়ে পড়তেই আমি কেঁপে উঠে ওনার শার্ট খামচে ধরলাম।
‘কিভাবে পড়লে?’
‘আব, আমি আর কোয়েল তাড়াহুড়ো করে আসছিলাম তখনই কিছু একটার সাথে পা বেজে পরে যাই। পরে বুঝতে পারি জিয়ার পায়ের সাথে পা বেজেই পরে গেছি।’
‘রণিত একটু বেশিই আগে পিছে ঘুরছে না তোমার?’
আমি নিচের দিকেই তাকিয়ে উত্তর দিচ্ছিলাম এতক্ষন। কিন্তু এই প্রশ্নের আর কোনো উত্তর দিলাম না। আদিত্য আমাকে আরেকটু কাছে টানতেই সঙ্গে ওনার কাঁধে হাত দিয়ে ওনার দিকে তাকালে উনি বলেন,
‘দ্বিতীয় দিন থেকে জানো রণিতের সাথে সব সময় না দেখি। যতটুকু দরকার ততটুকুই কথা বলবে। বুঝেছো?’
আমি শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম। উনি আমার চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকলেও আমি তাকিয়ে থাকলে পারলাম না চোখ নামিয়ে নিলাম আর উনি আমাকে হুট করেই কোলে তুলে নিলেন।
‘আরে কি ক..করছে….
আমি কথা শেষ করার আগেই উনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। ওনার গাড়ির সামনে এগোচ্ছেন এটুকু বুঝতে পেরে বললাম,
‘সবাই কি ভাববে?’
‘রণিত যখন কোলে নিয়ে এসেছিলো তখন যা ভেবেছে এখনও তাই ভাববে। যাতে আমার বা তোমার কাওর কোনো যায় আসে না।’
‘কোয়েল ব্যাগ আনতে গেছিলো। আসেনি তো এখনও, খুঁজবে আমাদের।’
‘দেখা যাবে।’
‘ইশ, কিছুক্ষণ আগেই ভিজে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছিলো। আর এখন দেখো? ভুতুম প্যাঁচা একটা।’
মনে মনে কথাগুলো বলে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিতেই দেখলাম জিয়া আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে আর রাগে কটমট করছে। এটা দেখে মনে মনে হাসলাম। ওর তো এটাই করার কথা কারণ ও যা চেয়েছে তার উল্টোটা হয়ে গেছে কি না। গাড়ির সামনে যেতেই দেখলাম কোয়েল আমার ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনি আমাকে নামালে আমি কোয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুই এখানে এলি কিভাবে? আই মিন জানলি কি করে?’
‘আমি তো গেছিলাম ওখানে। তারপর দেখলাম তোরা বর বউ প্রেম করছিস তাই ভাবলাম কাবাব মেইন হাড্ডি হয়ে কি লাভ? তোর অঙ্কিত কে বলা কথা শুনে নিয়ে এখানে চলে এলাম। চল, চল ওঠ গাড়িতে।’
আমি আর আদিত্য ওকে বকতে যাবো তার আগেই কোয়েল কানে হেডফোন লাগিয়ে নিলো আর গাড়িতে উঠে পড়লো। আদিত্য আমাকে গাড়িতে বসতে হেল্প করে ড্রাইভ করা শুরু করলেন। ডক্টরকে দেখিয়ে আমাদের হস্টেলে ড্রপ করে উনি চলে যান।
রাতে,
‘কি রে? কোলে চড়ে কেমন লাগলো? স্যরি, স্যরি কার কোলে চড়ে ভালো লাগলো?’
‘হয়ে গেছে? শেষ আমার লেগপুল করা?’
‘শেষ? কি বলিস এসব? সবে তো শুরু। এখনও তো অনেক কিছু হওয়া বাকি।’
কোয়েল আমাকে চোখ টিপ দিলে আমি ওর দিকে আমার হাতে থাকা বই ছুড়ে মারি। ও সেটা ক্যাচ করে বলে,
‘তোর ফ্যান ফলোয়িং বিশাল এখন। কি একটা বেশ নাম পোলাটার, আমার থেকে তোর নাম্বার চাইছিলো।’
‘দিয়ে দিয়েছিস নাকি?’
‘দেইনি কিন্তু দিয়ে দেবো আমাকে ট্রিট না দিলে।’
‘কুত্তি।’
‘হিহি। বায় দ্য ওয়ে, এই রণিতের কি ব্যাপার বল তো?’
‘খারাপ না ছেলেটা।’
‘উহুম, উহুম।’
‘তেমন কিছুই না। ঘুমা।’
কথাটা বলেই এপাশ ফিরে আমি শুয়ে পড়লাম নাহলে কোয়েল থামতো না।
৩৮.
বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। এখন আমার পা-ও পুরো ঠিকঠাক। এই কয়দিন রণিত আমার পিছন একদম ছাড়েনি বললেই চলে। নোটস দেওয়া থেকে শুরু করে হাজার একটা বাহানায় আমার কাছে এসে বসে থেকেছে আর আমাকে হাসানোর চেষ্টা করেছে। বন্ধুত্বটা তাই ভালোই হয়ে গেছে ওর সাথে। নাও, যার নাম করছিলাম সে এসে হাজির।
‘কি করছিস এখানে বসে? পা ঠিক আছে তো?’
‘উফ! আমার পা অনেক আগেই ঠিক হয়ে গেছে। সামান্য মচকে গেছে ভাই…
‘এই, এই, এই। একদম ভাই না। কতবার বলবো তোকে?’
রণিত বেশ রেগে কথাটা বললে আমি হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। এই কয়েকদিন বেশ কয়েকবার আমাকে বারণ করেছে ভাই বলে ডাকতে কিন্তু আমার অভ্যেস কি করে ছাড়ি?
‘সাইলেন্ট হয়ে গেলি কেন?’
‘নাহ, কিছু না। ম্যাডাম এর পড়া করেছিস?’
আমার এই প্রশ্নটাতেই রণিতের মুখ চুন হয়ে গেলো। আর আমি হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে শুয়েই পড়েছি আমি বেঞ্চে।
‘ম্যাডাম কোনো পড়া দেয়নি। তুই আমাকে ভয় দেখালি তাই না?’
আমি উত্তর কি দেব, রণিতের রিয়াকশন দেখে হেসেই চলেছি। হাসতে হাসতে থেমে গেলাম রণিতের পিছনে এসে দাঁড়ানো একজোড়া পা দেখে। আদিত্য! উনি আবার এখানে এসেছেন কেন?
‘রণিত, আমার মৌমিতার সাথে কিছু কথা আছে প্রাইভেট।’
রণিত পিছনে তাকিয়ে আদিত্যের কথা শুনে একবার আমার দিকে তাকালো তারপর বেরিয়ে গেলো আমাকে বলে। রণিত বেরিয়ে গেল আমিও আমার বইপত্র গোছাতে থাকি কমন রুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
‘এই কয়েকদিন আমার ফোন ধরনি কেন?’
আদিত্যের প্রশ্ন শুনেও আমি তার উত্তর দিলাম না। বলা যায় প্রয়োজন মনে করলাম না। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘ভার্সিটিতে কতবার কথা বলার চেষ্টা করেছি আমি তোমার সাথে?’
আমি এইবারও উত্তর না দেওয়ায় উনি আমার হাত ধরে বাঁধা দিয়ে বললেন,
‘আমাকে ইগনোর করার কারণটা কি? অন্য ছেলেদের সাথে তো খুব হেসে কথা বলা যায় তাহলে আমার সাথে কথা বলতে কোথায় বাঁধে?’
আমার মাথাটা চট করেই গরম হয়ে যাওয়ায় আমি ওনার হাতটা ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে বললাম,
‘কেন কথা বলবো আমি আপনার সাথে? কে হন আপনি আমার যে আপনার সাথে কথা বলবো আমি?’
‘আচ্ছা? রণিত, অঙ্কিত এরা তোমার কে হয় দ্যান?’
‘বন্ধু হয়। ওদের সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে কিন্তু আপনার সাথে তাও নেই। আপনি নিজেই সেটা রাখেননি, ভুলে যাবেন না।’
আমি কথাটা বলে আমার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই আদিত্য আমার দু-বাহু চেপে ধরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আমি জানো দ্বিতীয় দিন থেকে রণিতের আশেপাশে তোমাকে না দেখি। এই নিয়ে সেকেন্ড টাইম বলছি। আমার কথার অবাধ্য হলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।’
আমি আদিত্যের চোখের দিকে তাকিয়েই ওনার বুকে দু-হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ওনাকে সরিয়ে বললাম,
‘কোন অধিকারে আপনি আমাকে এই কথাগুলো বলছেন? স্বামীর অধিকারে? যা আপনি আমাদের ফুলশয্যার রাতে অস্বীকার করেছেন? আপনার জন্য, আপনার বিয়ে না মানার কনসেপ্টএর জন্য আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি সেদিন তার কোনো খোঁজ আপনি রেখেছেন? বরং পরেরদিনই নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চলে এসেছিলেন আমাকে একা ফেলে। একবারও ভাবেননি আমার কি হবে। আপনার জন্য যে আমার স্বপ্ন ভেঙেছে তার কি হবে। এইখানে আসার পর আমি প্রত্যেকটা মুহূর্তে আপনার গার্লফ্রেন্ডের থেকে নানানভাবে কথা শুনেছি, অপমানিত হয়েছি তখন কোথায় ছিলেন আপনি? তখন কোথায় ছিলো আপনার এই অধিকারবোধ? এই যে কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন না, কিসে বাঁধে আপনার সাথে কথা বলতে? বিবেকে বাঁধে আমার। সেই মানুষটার সাথে কথা বলতে আমার বিবেকে বাঁধে যে কি না নিজের জন্য আমাদের বিয়ে অস্বীকার করেছে। বৌভাতের পরেরদিন নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য নিজের স্ত্রী কে ফেলে চলে আসে। দিনের পর দিন নিজের স্ত্রীর সামনে গার্লফ্রেন্ডের সাথে হাত ধরে ঘোরে। নিজের স্ত্রীর অপমান সহ্য করে। আপনি যেমন নিজের রাস্তা নিজে বেছে নিয়েছেন আমিও নিজের রাস্তা নিজে বেছে নিয়েছি। এক বছর হলেই ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবেন আপনি আর প্লিজ, আমার লাইফে একদম ইন্টারফেয়ার করবেন না।’
‘রণিত এখানকার নাম করা পলিটিশিয়ানের ছেলে। ও চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে ভার্সিটির স্যার ম্যাডামরাও তাতে কিছু করতে পারবে না। তাই ওর থেকে দূরে থাকাটাই বেটার। তোমার ব্যাপার এবার তুমি কি করবে। আর আমি, আমি সবটা নতুনভাবে শুরু করতে চেয়েছিলাম। অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে যেগুলো মিটাতে চেয়েছিলাম তাই কথা বলার জন্য বলছিলাম। স্যরি, স্যরি ফর এভরিথিং। জানি ক্ষমা করা সম্ভব নয় বাট আমি ইচ্ছা করে কিছুই করিনি। পারলে ক্ষমা করে দিও।’
আদিত্য আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন। আমি আমার কথা শেষ করে চলে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ করে উনি কথা বলা শুরু করেন আর তা শেষ করেই চলে যান। কিন্তু যাওয়ার সময় উনি চোখে হাত দিলেন, ওনার চোখে কি জল ছিলো? কথাগুলো বলার সময়ও কেমন গলাটা ধরে আসছিলো মনে হলো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমি ওখানেই বসে পড়লাম।
‘সব কিছু নতুনভাবে শুরু করতে চেয়েছিলেন? আমাদের মধ্যে কি এমন ভুল বোঝাবুঝি আছে যা ক্লেয়ার করতে চেয়েছিলেন? আমি কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম?’
‘কি রে? একা একা কি কথা বলছিস?’
‘কোয়েল তুই এখানে?’
‘তা কি করবো? ক্লাস শুরু হবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে। কতবার ফোন করলাম, তুই তো রিসিভই করছিস না। কি হয়েছে?’
‘প..পরে বলবো সব। এখন চল।’
কোয়েলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি চলে গেলাম। মাথার মধ্যে আদিত্যের কথাগুলোই খালি ঘুরছে। আজকে মনে হয় না ক্লাসে মন বসবে। ক্লাস কোনোরকমে শেষ করে কাওর সাথে কথা না বলে সোজা হস্টেল চলে গেলাম।
সন্ধ্যায়,
আদিত্য বাংলোর বাগানে বসে আছে একা একা। মাঝেমধ্যেই গাল মুছছে হাত দিয়ে কারণ, কারণ আদিত্য কাঁদছে। হ্যাঁ, আজ মৌমিতার কথাগুলো তার একটু বেশিই খারাপ লেগেছে। মৌমিতার কিছু কথায় যেমন রাগ হচ্ছে তার থেকে বেশিরভাগ কথায় সে কষ্ট পাচ্ছে। আদিত্য কোনোদিনও খুব না কষ্ট পেলে কাঁদে না, আজ পর্যন্ত নিজের বাবার ব্যবহার ছাড়া কাওর ব্যবহারে সে কাঁদেনি। এমন সময় কেউ একজন আদিত্যের কাঁধে হাত দেয়। আদিত্য পাশ ফিরতেই অবাক হয়ে বলে ওঠে,
‘তুই এখানে?’
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
বি:দ্র: আজকের পর্ব প্রায় তিন হাজার পর্বের যেখানে আমি হাজার পর্বের গল্প দেই। তাই আশা করছি গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।
#হ্যাপি_রিডিং 😊❤️
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী