#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু 🍁🍁
#Written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_31
তিতিক্ষা যত্ন সহকারে নক্ষত্রের ট্রলিটা গুছিয়ে দিলো। এরপর একরাশ মন খারাপ নিয়ে নিচে চলে গেল। রাতে খাবারের সময় সবাই একসাথে খেতে বসেছে। তিতিক্ষা খেতে বসেছে ঠিকই, কিন্তু ওর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। ওর চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষাকে বললো,
–“কি রে আম্মু, তুই কাঁদছিস কেন? মনটা কি বেশি খারাপ?”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। কিন্তু ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মিঃ আবরার সহ সবাই তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষা মাথা নিচু করে আছে। নক্ষত্র পানি খেয়ে গ্লাসটা রেখে মুচকি হেসে বললো,
–“আমি দুই সপ্তাহের জন্য বাইরে যাচ্ছি। একথা শুনে এভাবে কাঁদছে।”
নক্ষত্রের আব্বু-আম্মু একেঅপরের দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে হো হো করে হেসে দিলো। নক্ষত্রও মিটিমিটি হাসছে। তিতিক্ষা অসহায় মুখ করে চোখ ছলছল করে তাকালো৷ নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রের পিঠে থাবড় দিয়ে তিতিক্ষাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“পাগলি মেয়ে, তুই ওই ফাজিলের কথা শুনে কাঁদছিস? তোরা দু’জনেই একসাথে যাচ্ছিস। ওই ফাজিলটা তোর সাথে মজা করছে।”
তিতিক্ষা একথা শুনে অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকালো। তারমানে নক্ষত্র এতক্ষণ মজা নিলো।
ইস! কি লজ্জা, কি লজ্জা। মান-সন্মান সব শেষ! আব্বু-আম্মুর সামনে ওনাদের ছেলের জন্যই এতক্ষণ কাঁদছিল। ও যে বরপাগল একটা মেয়ে আবার প্রমান করলো। ইস! তিতিক্ষার এবার সত্যি খুব লজ্জা লাগছে। আব্বু-আম্মুর কাছে এভাবে ধরা পড়ে গেল। উনারাই বা কি ভাবছে কে জানে? তিতিক্ষা লজ্জাতে আর মাথা তুলে তাকাতে পারলো না। ওর গালদুটো লাল হয়ে গেছে। উনাদের সামনে আর বসে না থেকে তিতিক্ষা ওখান থেকে দৌড়ে পালালো। তা না হলে উনাদের সামনে থাকলে ও লজ্জাতেই মরে যাবে। তিতিক্ষার আম্মু হাসতে হাসতে বললো,
–“ওরে বরপাগলী মেয়ে, খাবারটা তো খেয়ে যা।”
নক্ষত্রের আব্বু নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্রের চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে একরাশ সুখের ঝলক। মুখের আছে মিটিমিটি হাসির রেখা। চোখের চাহনি বলে দিচ্ছে সে কতটা খুশি। মিঃ আবরার মনে মনে দোয়া করলেন যাতে ওরা সারাটা জীবন এমনই থাকে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে এভাবে লজ্জা দিতে চাইনি। শুধু দেখতে চেয়েছিলো ওর যাওয়ার কথা শুনে তিতিক্ষার ঠিক কি করে। কিন্তু সে
ওর বোকামির জন্য নিজেই লজ্জা পেলো। তবে একদিক থেকে ভালোই হলো, বাবা-মা জেনে নিলো ওর বউটা ওর জন্য কতটা ব্যাকুল হয়ে থাকে। তবে এখানে নক্ষত্রের লাভ হলো তিতিক্ষার লজ্জামাখা মুখটা দেখতে পেয়ে। তিতিক্ষা যাওয়ার পর নক্ষত্রের আব্বু-আম্মু নক্ষত্রকে পচালো। নক্ষত্র শুধু উনাদের কথা শুনে হাসছিলো। নক্ষত্র নিজে খেয়ে তিতিক্ষার জন্য খাবার নিয়ে উপরে চলে গেল। নক্ষত্রের আব্বু-আম্মুও ওর এই কাজে খুব খুশি হলো।
নক্ষত্র রুমে গিয়ে দেখলো তিতিক্ষা চুপ করে বসে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার সামনে বসে ওর মুখে সামনে খাবার তুলে ধরলো। তিতিক্ষা চুপটি করে খাচ্ছে। তিতিক্ষাকে চুপ করে থাকতে দেখে নক্ষত্র মুচকি হেসে বললো,
–“অভিমানিনী! আপনি কি আপনার ডাক নামের অর্থ টা জানেন?”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–“হুম! তিতিক্ষা নামের অর্থ আলো।”
নক্ষত্র পূর্ণ দৃষ্টিতে তিতিক্ষার দিকে তাকালো। তিতিক্ষা সাথে সাথে চোখটা সরিয়ে নিলো। নক্ষত্র মৃদু হেসে আদুরে কন্ঠে বললো,
–“তুমি আমার জীবনের অদ্ভুত এক আলো। যে আলো কখনোই শেষ হবার নয়। তুমি শুধুমাত্র আমার অনুভূতির শীর্ষবিন্দু হয়ে তোমার অনুভূতিগুলোর পূর্ণতা প্রয়াসের আলো।”
তিতিক্ষা মুচকি হাসলো। নক্ষত্র জানালো কালকে সকালে ওরা দু’জনে কোথাও একটা যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে বললো না। নক্ষত্র নিচে গিয়ে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে উপরে আসলো। তিতিক্ষা উশখুশ করছে কিছু একটা বলার জন্য। সে না পারছে বলতে আর না পারছে চুপ থাকতে। নক্ষত্র তিতিক্ষার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের চুলে হাত ডুবালো। নক্ষত্র চোখ বন্ধ করে শান্ত কন্ঠে বললো,
–“ডেট কি ওভার নাকি সামনে?”
–“সামনে।”
তিতিক্ষা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ইস! এই ব্যাপারটা নক্ষত্র এত সহজে বুঝে যাবে এটা সে ভাবেনি। যাক তাও বাঁচা গেল। মুখ ফুটে ওর কিছু বলা লাগলো না। নক্ষত্র শুয়ে থেকেই তিতিক্ষার মুখটা ধরে চোখ চোখ রাখলো। তিতিক্ষা চোখ বন্ধ করে নিলো। ওর অবস্থা দেখে নক্ষত্র মুচকি হাসলো। নক্ষত্র বুঝলো তিতিক্ষা কেন এখন লজ্জা পাচ্ছে। এটা তো ন্যাচারাল। নক্ষত্রের মনে করে এটা লজ্জা পাওয়ার মত কোনো ব্যাপার না৷ বিশেষ করে হাজবেন্ডের কাছে তো নয়ই। তিতিক্ষা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নক্ষত্রকে বললো,
–“তুমি কি এখন ফার্মেসীতে যেতে পারবে?”
নক্ষত্র তিতিক্ষার কথার মানে বুঝে উঠে বসলো। নক্ষত্র আলাদা ভাবে কিছু বলে তিতিক্ষাকে লজ্জা দিতে চাচ্ছে না। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বললো,
–“হুম পারবো। তুমি শুধু নামটা লিখে দাও। আমার খুব একটা ধারণা নেই এই ব্যাপারে।”
তিতিক্ষা উঠে একটা কাগজে নাম লিখে দিলো। নক্ষত্র রেডি হয়ে তিতিক্ষার থেকে কাগজের টুকরোটা নিলো। নক্ষত্র ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে তিতিক্ষাকে সাবধানে থাকতে বলে দরজায় দিকে পা বাড়ালো। কিছু একটা ভেবে কাপজটা খুলে ন্যাপকিনের নামটা দেখে দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কাগজটাতে খুব সুন্দর করে লিখা,
( ******* sanitary Napkins)
নক্ষত্র পেছনে ঘুরে তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“নামটা এর আগে শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না।
এটাই লাগবে? যদি এটা না পাই?”
তিতিক্ষা মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বললো,
–“আমি এটাই ব্যবহার করি। আমি এটাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এটা চায়না প্রোডাক্ট। কোনো একটা ফলের রস দিয়ে এটা বানানো হয়। এটা ব্যবহারের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ব্যাথা উপশম। এই স্যানিটারি ন্যাপকিনটা ব্যাথা যতটা সম্ভব কমাতে কিছু বিশেষ উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এটা আনলেই ভালো হয়।”
নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। সে বুঝলো তার বউয়ের এটাই চাই। তাই এখন যেখান থেকে পারুক এটাই আনতে হবে। নক্ষত্রকে চুপ করে থাকতে দেখে তিতিক্ষা মৃদু স্বরে বললো,
–“সবার পছন্দ তো এক না। যে যেটাতে অভ্যাস্ত। ভাল নাকি মন্দ জানি না। তবে আমার এটাই পছন্দ। এটা সব দোকান/ফামের্সীতে পাবেন না। একটু খুঁজতে হতে পারে।”
নক্ষত্র আর কিছু বললো না। মুচকি হেসে রুম ত্যাগ করলো। তিতিক্ষা আর না দাঁড়িয়ে ওর ড্রেস বের করে গুছাতে লাগলো। তবে নক্ষত্রের একটা জিনিস ভালো লাগলো; অগ্রিম প্রস্তুুতি নিয়ে রাখার ব্যাপারটা। এটা অবশ্যই বুদ্ধিমতী মেয়ের কাজ। নক্ষত্র খুঁজে খুঁজে দশটা ভেনাসের প্যাক একেবারে এনেছে। তিতিক্ষাকে একটা প্যাক নিজের সাথে রাখতে বললো। আর বাকি গুলো তুলে রাখতে বললো।
পরেরদিন সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট করে আম্মু-আব্বুর থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বের হয়ে গেল। তিতিক্ষা এখনো জানে না আসলে ওরা ঠিক কোথায় যাচ্ছে। তবে নক্ষত্রের সাথে বের হতে পেরে মনটা খুব ভালো লাগছে। নক্ষত্র বাস ষ্ট্যান্ডে এসে টিকিট অনুযায়ী ওদের বাসে উঠে বসলো। তিতিক্ষা খুব খুশি; অনেকদিন পর বাস জার্নি করবে। একটু পর সাফওয়ান আর জেসিকা এসে বাসে উঠে বসলো। ওদের দেখে তিতিক্ষা হেসে হেসে ওদের সাথে কথা বললো। সাফওয়ান নক্ষত্রের থেকে তিন সিট পেছনে বসলো। নক্ষত্র ইচ্ছে করেই এভাবে টিকিট কেটেছে। যাতে ওদের জন্য তিতিক্ষা লজ্জা পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে না রাখে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে নিচে নামলো। ফুড ভিলেজে গিয়ে কিছু খাবার প্যাক করে নিলো। যা নিলো সব দুইটা করে দুই জায়গায় প্যাক করতে বললো। তিতিক্ষা আশে পাশে চোখ বুলাতে ব্যস্ত। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিচে বাসে উঠলো। একটা খাবারের ব্যাগ সাফওয়ানকে দিলো আর একটা নিজেদের কাছে রাখলো। বাসে ওঠার দুই মিনিট পরেই বাস ছাড়লো। লোকাল বাস না, এজন্য গ্যাদারিং নেই। তিতিক্ষা পড়েছে অরেঞ্জ কালার স্টাইলিশ কুর্তির সাথে ব্ল্যাক জিন্স, ব্ল্যাক নেক রেপ স্টাইলে ওড়না। চুল গুলোলো উঁচু করে ঝুঁটি করে রাখা। চোখে কাজল ঠোঁটে হালকা ভাবে চ্যাপস্টিক। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দেওয়া সেই নোজ পিনটা পড়েছে। এসব মামনির বাসায় ছিলো। তনুকা তিতিক্ষাকে দেখতে এসে ওর প্রয়োজন জিনিস গুলোও দিয়ে গেছে। নক্ষত্র সাদা শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স পড়েছে। নক্ষত্র খেয়াল করছে, তিতিক্ষার নাকের নোজ পিনটাতে রোদ পড়াতে জ্বলজ্বল করছে। নোজপিনটা নক্ষত্র আকৃতি হওয়াতে তিতিক্ষার গোলাকৃতির মুখের সাথে খুব মানিয়েছে। মনে হচ্ছে নোজপিনটা ওর সৌন্দর্য এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে মৃদু ভাবে বললো,
–“তুমি কি আমাকে ভদ্র থাকে দিবে না বলে পণ করেছো?”
তিতিক্ষা অবাক হওয়ার সুরে বললো,
–“আমি আবার কি করলাম?”
নক্ষত্র তিতিক্ষার নাকটাতে জমে থাকা মুক্তর দানার মতো বিন্দু বিন্দু জমে থাকা ঘামটা মুছে দিলো। এরপর তিতিক্ষার আর একটু কাছে গিয়ে আদুরে সুরে বললে,
–“তোমার ঘামার্ত নাকটা আমাকে ভদ্র থাকতে দিচ্ছে না। আমাকে চুম্বুকের মত খুব টানছে।”
তিতিক্ষা মুচকি হেসে জানালার দিকে তাকালো। এই ছেলেটা পারেও বটে। সাফওয়ান আর জেসিকা কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করছে। নক্ষত্র ওর এক কানে ইয়ার ফোন গুঁজে আরেকটা তিতিক্ষাকে দিলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের এক কাঁধে মাথা রেখে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে জানালার দিকে তাকালো। বেশ কয়েক ঘন্টা জার্নি করার পর সে বুঝলো যে ওরা এখন সাজেকের পথে যাচ্ছে। তিতিক্ষার খুশি যেন আর ধরে না।
প্রকৃতির সৌন্দর্যের মোহে সে বরাবরই নেশাগ্রস্ত। মনের প্রশান্তির জন্য এই ভ্রমণের বিকল্প আর অন্য কিছু হতেই পারে না। মাথার উপর মেঘের ভেলা আর পায়ের নিচে সবুজের চাদর বিছানো। তিতিক্ষা ছবিতে এসব অনেক দেখেছে। কিন্তু সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু এমন সুযোগ যে পাবে সে ভাবতেও পারেনি। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে কৃতজ্ঞতাসূচক দৃষ্টি তাকালো। নক্ষত্র মুচকি হেসে বললো,
–“বলেছিলাম না, আমি বেঁচে থাকলে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্যের সাথে তোমাকে আবার সাক্ষাৎ করাবো!”
তিতিক্ষা মুচকি হাসলো। সিগ্ধ মুখটানে এসে জমা হয়ে অসীম খুশির আভা। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে যখন ওদের বাসটা শোঁ শোঁ করে দীঘিনালার দিকে এগিয়ে চলছে, তখন থেকেই ওরা প্রকৃতির অভ্যর্থনা বুঝতে পেরেছে। সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো সাপের মতোই ভয়ংকর। একটু অসাবধানতা কিংবা দুর্ঘটনা মুহূর্তেই খাদে ফেলে চিরতরে ঘুম পারিয়ে দেবে। যেটা নিয়ে অনেকটা ওর মনে ভয় কাজ করছিল। তিতিক্ষা একবার সাফওয়ানের দিকে তাকালো। সাফওয়ান ঘুমাচ্ছে আর জেসিকা ওর কাঁধে মাথা রেখে প্রকৃতি দেখছে। নক্ষত্র আর তিতিক্ষা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছে আর হালকা কিছু না কিছু খাচ্ছে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা নেমে সেখানে একটা হোটেলে গিয়ে চারজন আগে খেয়ে নিলো। একটা দোকান থেকে পানি কিনে চান্দের গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িটাও একটু পরে সাজেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। ওরা বসেছিলো চান্দের গাড়ির পেছনের সিটে, ছাদের ওপরে। যে কারণে বাইরের প্রকৃতিটা পুরোপুরি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। নক্ষত্র ইচ্ছে করেই তিতিক্ষাকে নিয়ে এখানে বসেছে। সাফওয়ান আর জেসিকাও সাথে আছে। ওরা পিক তুলতে ব্যস্ত। নক্ষত্র প্রাইভেট ভাবে সব ব্যবস্থা করতে পারতো। কিন্তু নক্ষত্র চেয়েছে একদম স্বাভাবিক ভাবে তিতিক্ষাকে নিয়ে ঘুরে ফিরে সময় কাটাতে। পরিপাটি চলাফেরার জীবন থেকে মাঝে মাঝে অগোছালো চলাফেরা করলে মন্দ হয় না। বরং জীবনটাকে নিখুঁত ভাবে উপলব্ধি করা যায়।
নক্ষত্র শক্ত করে ধরে আছে তিতিক্ষার হাত। চারজনেই ডুবে আছে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের অতলে। তিতিক্ষার চুল গুলো উড়ছে অবাধ্য হয়ে।
চারদিকে উঁচুনিচু পাহাড় আর সবুজ মিলে একটা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারে। গাড়িটা কখনো সোজা ভাবে ধোঁয়া ছেড়ে ওপরের দিকে উঠছে, আবার কখনো খাড়াভাবে নিচের দিকে নেমে এক দম বন্ধকরা পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। উচু নিচু রাস্তায় উঠা-নামা করার সময় তিতিক্ষা ভয়ে চোখ বন্ধ করে শক্ত করে নক্ষত্রের শার্ট খামছে ধরছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। একটু পর চোখ খুলে আবার সামনে তাকাচ্ছে। দূরের উঁচু পাহাড়গুলো মনে হচ্ছিল যেন ওর কাছে চলে আসছে। আবার চোখ বড় বড় দেখে না সবটা ঠিক আছে। এমন একটা ভ্রম তৈরি হচ্ছে ওর চোখে। নক্ষত্র তিতিক্ষার কানে কানে বললো,
–“এমন মনোমুগ্ধকর চাহনি নিয়ে আমাকে দেখলেও তো পারো। আমি কিন্তু মোটেও রাগ করবো না।”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরালো। কিছু একটা ভেবে নিজেই নক্ষত্রের আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল রেখে মৃদু স্বরে বললো,
–“আমার বয়েই গেছে।”
তিতিক্ষার কথা শুনে নক্ষত্র হাসলো। সাফওয়ান জেসিকার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। গাড়িটা অতি দ্রুত চলছে যার কারণে জিসিকার আইলেস উঠছে৷ সাফওয়ান আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। সে আতংকিত কন্ঠে বললো,
–“জান, তোমার চোখের পাতা এভাবে নড়ে উঠে কেন? কতদিন বলেছি এসব কালি কুলি দিবা না। হলো তো এবার, চোখের পাতা খুলে যাচ্ছে, এখন কি হবে?”
সাফওয়ানের কথা শুনে জেসিকা দাঁত কড়মড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র আর তিতিক্ষা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসছে। ওরা দু’ জন সাফওয়ানের কথা শুনে আরো হাসছে। জেসিকা অগ্নি দৃষ্টিতে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“এটা এক্সটা আইলেস। চোখে খুব বাতাস লাগছে এজন্য এভাবে নড়ছে৷”
সাফওয়ান বুঝতে পেরে বোকা বোকা হাসি দিলো। সাফওয়ানের ভ্যাবলা হাসি দেখে তিতিক্ষা নক্ষত্রের কাঁধে মুখ লুকিয়ে হাসছে। তিতিক্ষার হাসি দেখে নক্ষত্রেও হাসি পাচ্ছে। নক্ষত্র শব্দ করে হাসতেও পারছে না বন্ধুর মান-সন্মানের কথা ভেবে। জেসিকা আর কথা না বাড়িয়ে চোখে সানগ্লাসটা পড়ে নিলো।
গাড়িটা একটু পর বিরতি নিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাত ধরে ওকে নিচে নামালো। জেসিকা আগে নেমে সাফওয়ানকে ধরে নামালো। চারজনে তাকিয়ে আছে দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। ওরা যেন অসম্ভব সুন্দরের মোহে পড়েছে গেছে। একটু পরে ওখানকার স্থানীয় উপজাতি একটা বাচ্চা ওদের দিকে এগিয়ে আসলো। বাচ্চাটা হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে উষ্ণ অভিবাদন জানাচ্ছিল ওদেকে। ওরাও হেসে বাচ্চাটার সাথে কথা বললো। বাচ্চাটার হাতে নিজেদের চাষ করা কমলা, আখ, পেঁপে, বাদাম আছে । প্রয়োজনের তাগিদে শেখা ভাঙা বাংলায় ডেকে ডেকে বলছে ‘দছ তাকা, বিছ তাকা, পচিছ তাকা।
নক্ষত্র ওর থেকে পেঁপে, কমলা, ভাজা বাদাম কিনে নিলো। নক্ষত্র বাচ্চাটাকে ওর বলা দামের চেয়ে একটু বেশিই দাম দিলো। উপজাতিরা দাম কম রাখে। সত্যি বলতে এখানকার ফল গুলো যেমন স্বাদের হয়। আমরা চড়া দামে জিনিস কিনি ঠিকই তবে ভেজাল যুক্ত। আর ওখানে ভেজাল মুক্ত জিনিসপাওয়া যায় সীমিত দামে। তিতিক্ষাসহ সবাই বাচ্চাটার সাথে ছবি তুলে নিলো। ওরা নিজেদের কাপল পিক তুললো। এরপর সবাই গাড়িতে গিয়ে বসলো। গাড়িতে বসেই ওরা খাবার গুলো খাচ্ছিলো। পেঁপেটা খেতে অসম্ভব মিষ্টি। সত্যিই এমন পেঁপে ওদের ওখানে পাওয়া যায় না। তিতিক্ষার পেঁপে পছন্দ না। শুধু নক্ষত্রের বলাতে সে টেস্ট করতে গিয়ে এখন লোভে পড়ে গেছে। এমন মিষ্টি পেঁপে তিতিক্ষা এর আগে কখনো খায়নি। সাফওয়ান তো হালুম হালুম করে খাচ্ছে৷ জেসিকা পেঁপে খেলো না লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে৷ তবে তিতিক্ষা খুব মজা করে খাচ্ছে ওর খুব ভালো লেগেছে। নক্ষত্র হাসলো তিতিক্ষার খাওয়া দেখে।
যথা সময়ে ওরা ওদের বুক করা রিসোর্টে পৌঁছে গেল। সাজেকের রিসোর্ট গুলো ভিন্ন ভিন্ন সাজে সজ্জিত করা। কোনোটা সম্পূর্ন বাঁশের তৈরী, কোনোটা কাঠ, আবার কোনোটা খড়ের তৈরী। সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন আকষর্ণীয় সৌন্দর্যের দাবিদার। নক্ষত্ররা বাঁশের তৈরী রিসোর্টে উঠেছে। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ওরা যে যার রুমে চলে গেল। সারাদিন জার্নি করে সবাই খুব ক্লান্ত। তিতিক্ষার কাছে তো সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। নক্ষত্র ওদের ট্রলি রেখে রুমের দরজা আটকে দিলো। তিতিক্ষার চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। খুব সুন্দর করে মানানসই ভাবে রুমটা সাজানো। বেডশীর থেকে শুরু করে জানালার পর্দা গুলোও সাদা। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিলো। এরপর নিজেও ফ্রেশ হয়ে আসলো। আসার আগে ওদের রুমে খাবার দিতে বলেছিলো। এজন্য একজন এসে খাবারটা ওদের দিয়ে গেল। এত জার্নি করে আসার পর তিতিক্ষার খেতে ইচ্ছে করছে না। এজন্য চালাকি করে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
–“আমার নিজে হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না৷ কেউ যদি একটু খাইয়ে দিতো।”
নক্ষত্র টাওয়াল দিয়ে ওর মাথা মুছতে মুছতে একবার তিতিক্ষার দিকে তাকালো। বারান্দায় টাওয়ালটা মেলে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
–“হুহ আমার বয়েই গেছে।”
তিতিক্ষা বুঝলো ওর কথা ওকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। তিতিক্ষা মনে মনে খুশি হয়ে ঝপাং করে শুয়ে পড়লো। তখনই নক্ষত্রের ফোনটা বেজে উঠলো। নক্ষত্র কিছুক্ষণ কথা বললো। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার সাথে কথা বলতে চাইলো। নক্ষত্র ফোনের স্পিকার অন করে তিতিক্ষাকে ইশারা করলো কথা বলতে।
–“হ্যা আম্মু। কেমন আছো? কি করছো? আব্বু কোথায়, বাসায় কি ফিরেছে?”
–“ওরে বাবা রে এতগুলো জবাব কিভাবে দিবো। আমরা ভাল আছি। তোর আব্বু কেবল ফিরলো; ফ্রেশ হচ্ছে। তা তোরা কেমন আছিস? খেয়েছিস?”
–“হুম ভাল আছি। খায়নি এখন খাবো।”
–“আম্মু আসার সময় আমাদের জন্য গেস্ট নিয়ে আনিস। আমি অপেক্ষায় রইলাম।”
–“আম্মু কোন গেস্ট? ”
–“যে গেস্ট আমার পুরো বাসাটা মাথার করে রাখবে। হাউকাউ, চেচাঁমেচি, অবদার, দুষ্টুমি দিয়ে বাসাটা মাতিয়ে রাখবে। যার অত্যাচারে তুই অতিষ্ঠ হয়ে আমার কাছে নালিশ করবি। যার দন্তহীন দাঁতে হেসে দেখে আমাদের কলিজা ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমি সেই গেস্টের কথায় বলছি।”
তিতিক্ষা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। নক্ষত্র নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। এই অসভ্য ছেলেটা দিন দিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। নক্ষত্রের আম্মু ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথায় বললো। তিতিক্ষা শুধু হু হ্যা করে উত্তর দিচ্ছে। কথা বলে তিতিক্ষা ফোনটা রেখে দিলো। নক্ষত্র এখনো মিটিমিটি হাসছে। তিতিক্ষা লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। দুই সপ্তাহ হলো নক্ষত্রের সাথে থাকে। তবুও ওদের সম্পর্কটা আগের মতই সীমাবদ্ধতায় আটকে রয়েছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ইচ্ছে করেই ওর কাছে টানে নি। কারণ ওদের উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল। এজন্য নক্ষত্রের মনে হয়েছে তিতিক্ষাকে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন। বউ তো ওরই, কোথাও তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আর তখন জোর করলেও তিতিক্ষার মনেও ওর প্রতি নেগেটিভ চিন্তা আসতে পারতো। নক্ষত্রের কোন তাড়াহুড়ো নেই। কারণ তাড়াহুড়োর কাজ কখনোই সুমিষ্ট হয় না।
নক্ষত্র কথা ঘুরানোর জন্য তিতিক্ষার মুখে খাবার তুলে দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
–“আমার বেড রুমটা পরিপূর্ণ ভাবে সাজানোর কাজটা অবশেষে সমাপ্ত হলো।”
তিতিক্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্রের কথা মানে তিতিক্ষা বুঝতে পারেনি। তাই নক্ষত্র নিজে থেকেই বললো,
–“একটা ছেলের রুম বউ ছাড়া কখনোই পরিপূর্ণ সাজে সজ্জিত হয় না। তোমার আগমনে আমার রুমটা নয় বরং আমি নিজেও পরিপূর্ণ হয়ে গেছি।”
To be continue….!!