আধারে_তুমি,০৩,০৪

0
449

#আধারে_তুমি,০৩,০৪
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ০৩

শান পুলিশের চাকড়ি পাওয়ার পর থেকে মুসফিক চৌধুরী তার সঙ্গে কখনো তার কাজ নিয়ে কথা বলেনি।
সকালের ডিউটি শেষ হতেই শান লাঞ্চ করে গাড়ি নিয়ে সোহার বাড়িতে চলে যায়। ইমতিয়াজ রহমান আর রিয়ানা রহমান শানকে আপ্যায়ন করার জন্য উঠে পড়ে লাগে।
সেইদিনের পর আজ এক মাস হয়েগিয়েছে। মুসফিক চৌধুরী, সোহাকে তাদের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সোহার সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য নিয়ে যেতে পারেনি। তাই ইমতিয়াজ রহমানের সাথে কথা পরীক্ষা শেষ হতেই আজই শানকে পাঠিয়ে দিয়েছে সোহাকে সেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুসফিক চৌধুরী শানের কাজ নিয়ে এখনও পর্যন্ত নারাজ থাকায় শান সব সময় চেষ্টা করে তার বাবা যেনো অন্য কাজ নিয়ে তার উপর রাগ না করে তাই বিনা শব্দে শান গাড়ি নিয়ে এসে পরেছে সোগাকে নেওয়ার জন্য।
প্রায় অনেক সময় ধরেই শান, ইমতিয়াজ রহমানের সাথে গল্প করতে করতে সোহার জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে কিন্তু সোহার এখনও দেখা মেলেনি। শান সোহার জন্য বসে বসে বিরক্ত হয়ে গেলো। রিয়ানা রহমানও এবার সোহার রুমে ছুটলো। সোহার এতো দেড়ি দেখে রিয়ানা রহমান নিজেই রেগে রয়েছেন। সোহার রুমে ঢুকতেই দেখে সোহা ফ্লোরে বসে রয়েছে কোলে টমিকে নিয়ে কিছু একটা করছে। রিয়ানা রহমান সোহার কাজ দেখে রেগে বললো
” সোহা কি শুরু করেছিস তুই ? ছেলেটা প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গিয়েছে এসে বসে আছে তোর জন্য কিন্তু তুই এখনও বসে আছিস ? তোর জন্য কি ছেলেটা সারাদিন এখানেই বসে থাকবে নাকি !”
সোহা তার কাজ করতে করতে মুখ ফুলিয়ে বললো
” আহ আম্মু ! আমি জানি আজকে উনার হাফ ডিউটি তাই তো তাড়াহুড়ো করছি না। আজ সারাদিন আমাদের বাড়িতে বসে থাকলেও কিছু হবে না।” সোহার মা সোহার পড়ার টেবিল থেকে সোহার স্কেল হাতে নিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো
” তুই উঠবি ? নাকি এখন মার খাবি আমার হাতে ? আর টমিকে নিয়ে গুঁতোগুতি করছিস কেনো তুই ? এই কুকুরকেও নিয়ে যাবি নাকি সাথে ?” টমিকে কুকুর বলার সোহা ক্ষেপে গেলো। বসা থেকে উঠে রেগে বলে
” তুমি আবারও টমিকে কুকুর বলছো ? তোমাকে কতোবার না করবো আর ! কারোর কোনো কথা শোনো না তুমি।”
রিয়ানা বেগম তেড়ে এসে বলে
” তুই এখন আমাকে শেখাবি ? আমি কার কথা শুনবো আর কার কথা শুনবো না ! গেলি এখনই নাকি এবার সত্যিই মারবো ?” সোহা মুখ ফুলিয়ে টমিকে কোলে নিয়ে সাইড ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে লাগেজ নিয়ে নিচে চলে যায়।
শান সোহাকে নামতে দেখেই হাফ ছেড়ে বাচে। ইমতিয়াজ রহমান সোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে
” মনে রাখবে ওটা সিমি শশুড় বাড়ি। সেখানে গিয়ে কোনো উল্টোপাল্টা কাজ করবে না যাতে সিমির মান-সম্মানে আঘাত করে, বুঝেছ ?”
সোহা সুন্দর মতো মাথা নাড়ালো। সবার আড়ালেই শান মুচকি হাসলো সোহাকে দেখে। বিদায় নিয়ে শান গাড়িতে উঠে বসতেই সোহার কোলে টমিকে খেয়াল করে চেঁচিয়ে উঠে। সোহা চমকে বলে
” কি হয়েছে আপনার ? মেয়েদের মতো চেঁচাচ্ছেন কেনো আপনি ?” শান রেগে বলে
” তুমি একে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছো নাকি ?” সোহা ঠোঁট উল্টে মাথা নেড়ে সায় দিলো। শান চোখ বড় বড় করে সানগ্লাস খুলে নেয়। অন্য হাতে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। সোহা দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” সমস্যা কি আপনার ? আমি এতোদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছি ! আমি কি একা যাবো নাকি ? টমি তো যাবেই আমার সাথে ! এটা সবারই জানা কথা। আপনি আবার কোন আকাশ থেকে টপ করে পড়েছেন ?”
সোহার কথা শুনে শান ক্ষেপে সোহার দিকে ঝুকে বলতে থাকে
” এই মেয়ে তুমি জানো না ? আমার এসব পশুপাখির পশমের সংস্পর্শে আসলেই এলার্জি হয় ! তুমি জেনেও একে সাথে নিয়ে যাচ্ছো ! তোমার কোনো কমন সেন্স নেই ? একে তো এতোগুলো দিন তুমি নামক বাদরকে আমার সহ্য করতে হবে তার উপর আবার এই টমি ! কখনোই না। আমি তো টমিকে নেবোই না।” সোহা হা করে তাকিয়ে থেকে নিজের দিকে আঙুল তাক করে অবাক স্বরে বলে
” কিহহ ! আমি বাদর ! আমি বাদর ! ঠিকাছে এবার আমিও দেখছি আপনি টমিকে ছাড়া আমাকে কি করে নিয়ে যান বাড়িতে ! আমিও দেখছি কি করে, কি করেন আপনি !” সোহা গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিলেই শান চটজলদি গাড়ি লক করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। সোহা দরজায় বারি দিতে দিতে চেঁচিয়ে বলে
” এই দরজার লক খুলুন ! লক খুলুন বলছি !”
শান বাকা হেসে বলে
” এবার গাড়ি থেকে নামুন আপনি। আমাকে হুমকি দিয়েছো না ! এবার শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকো। তোমাকে তো নিয়ে যাবোই আর তোমার এই টমিকেও রেখে যাবো আমি। এমনি এমনি পুলিশ হয়নি আমি !” সোহা তাচ্ছিল্য হেসে বলে
” হ্যা আমিও এবার দেখবো কি করেন আপনি ! আর আপনাকে কতোবার বলবো ? আপনার এই তুমি, আপনির কনফিউশন দূড় করুন ! যে কোনো একটা ডাকুন।”
শান উত্তর না দিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে গাড়ি চালানোতে মনযোগী হয়। সোহা ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তার কোলে টমি আড়ামে ঘুমোচ্ছে। শান ড্রাইভ করতে করতেই আড়চোখে সোহাকে দেখে বিড়বিড় করে বলে
” এভাবে ফোন দেখার কি আছে ? ফোনের ভেতর ঢুকে পড়লেই তো পারো।” সোহা ভ্রু কুঁচকে শানের দিকে তাকিয়ে বলে
” কিছু বলেছেন আপনি ?” শান সোহার দিকে তাকিয়ে বলে
” আমি কি বলবো আপনাকে ? ড্রাইভ করছি চোখে দেখছো না !” সোহা আবারও শানের তুমি, আপনির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে বোমের মতো ফুলতে থাকে। সোহা কোনো কথা না বলেই পূর্বের মতো ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো শান তাদের বাড়ির সোজা রাস্তায় না গিয়ে অন্যরাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সোহা কিছু বলতে চেয়েও বললো না। অনেক্ষণ পর হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করতেই সোহার হুশ আসে। সোহা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে লেকের পারে গাড়ি থামিয়েছে। সোহা ভ্রু কুঁচকে বলে
” এখানে গাড়ি থামিয়েছেন কেনো বলুন তো ! এই যে আপনার মাথায় উল্টোপাল্টা কোনো ধান্ধা চলছে না তো !” শান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সোহার দিকে তাকায়। সোহা শানের এমন তাকানো থেকে থতমত খেয়ে যায়। শান গম্ভীর গলায় বলে
” ফুচকা খাবো তাই থামিয়েছি এখানে। ফুচকা খাওয়ার জন্য ধান্ধা করতে হয় সেটা জানতামই না আমি।” সোহা চোখ বড় বড় করে চারপাশ ভালো করে লক্ষ করে। ফুচকার দিকে একদমই খেয়াল ছিলো না তার। সোহা খুশি হয়ে শানকে কিছু না বলেই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো কিন্তু বেরিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। টমি এখনও ঘুমাচ্ছে তাকে নিয়ে খেতে পারবে না আর শানের ভয়ে রেখেও যেতে পারছে না। শান বুঝতে পেরে বলে
” আমি নিজেও ফুচকাই খেতে যাচ্ছি। তোমার টমির জন্য আমি আমার ফুচকা মিস করতে পারবো না। আর টমিকে কিডন্যাপ ফিডন্যাপ করে আমার কোনো লাভ নেই। ওকে ? যা করার করো তাড়াতাড়ি। গাড়ি লক করে যেতে হবে আমাকে।” সোহা টমিকে সুন্দর করে সিটে রেখে চলে গেলো।
সোহা গিয়েই ফুচকা ওয়ালাকে বলে বেশি করে ঝাল দিয়ে তার জন্য ফুচকা দিতে আর শান কিছুক্ষণ পর আসলো। সোহা শানকে দেখে সন্দেহীবাজের মতো প্রশ্ন করে
” গাড়িটা জাস্ট লক করতেই এতোক্ষণ লাগলো আপনার ?” শান দাঁত কিড়মিড় করে সোহার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে
” তোমার সাহস তো কম না ! আমাকে সন্দেহ করার অধিকার কোথায় পেয়েছো তুমি? আমি কি করবো, কতোক্ষণ সময় নিয়ে করবো এসবের উত্তর কি তোমাকে দিতে হবে আমার ? ইম্পরট্যান্ট কল এসেছিলো তো কথা বলছিলাম। নেক্সট টাইম একদম আমাকে কোনো প্রশ্ন করবে না। মাইন্ড ইট !”
সোহা বড়সড় একটা ঢোক গিলে মাথা নাড়ালো। ফুচকাওয়ালা সোহার প্লেট দিতেই সোহা খাওয়া শুরু করে আর শান ঝাল ছাড়া খাবার দিতে বলে তার জন্য। সোহা মিটমিট করে হেসে বিড়বিড় করে বলে
” এতোবড় ছেলে হয়ে ঝাল খেতে পারেনা আবার আমাকে পুলিশগিরি দেখায় !” শান আধো কথা শুনতে পেয়ে রেগে বলে
” কি বললে তুমি ? আমি ঝাল খেতে পারি না !”
সোহা ঘনঘন মাথা নেড়ে বলে
” না, না আমি কিছু বলিনি।” শান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সোহা দূড়ে দাঁড়িয়ে খেতে থাকে।
অনেক্ষণ পর শান, সোহার ফুচকা খাওয়া শেষ হতেই দুজন গাড়ির কাছে আসে। গাড়ি আনলক করতেই সোহা গাড়ির ভেতর তাকিয়েই চেঁচিয়ে উঠে। শান বিরক্ত কন্ঠে বলে
” চেঁচাচ্ছ কেনো তুমি শুধু শুধু ?” সোহা ইতিমধ্যে কেঁদে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে
” আমার টমি ! আমার টমি নেই গাড়িতে।” শান রাগ দেখিয়ে বলে
” মজা করার জায়গা পাচ্ছো না ? টমিকে কে নিয়ে যাবে ? তাও আবার আমি গাড়ি লক করে গিয়েছিলাম। ভালো করে খুঁজে দেখো।” সোহা, শান দুজনই টমিকে খুঁজতে থাকে কিন্তু খুঁজে পেলো না তাকে। গাড়ির কিছুদূড়ে দাঁড়ানো ঝালমুড়ি ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো
” একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছি একটা বাচ্চা কুকুর কোলে করে নিয়ে যেতে।”
সোহার কান্না একদমই থামছে না। শানও সোহাকে কোনোভাবে থামাতে পারছে না। সোহা টমিকে ছাড়া কোথায় যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। শান জোড় করে সোহাকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে
” কান্না থামাও তোমার টমিকে খুঁজে দেবো আমি। চুপ করো এখন।”
বাড়িতে আসতেই সোহাকে পেয়ে সবাই খুশিতে মেতে উঠে কিন্তু সোহার কান্না দেখে সবই মাটি হয়ে যায়। শান সব বলতেই সবাই মিলে সোহাকে বোঝাতে থাকে কিন্তু সোহা এক নাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে।

বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এখন প্রায় রাত ৯টা বাজে। কিন্তু সোহার কান্না এখন পর্যন্ত এক মিনিটের জন্য কমেনি। অনেক চেষ্টা করেও কেউ সোহার কান্না থামাতেই পারেনি। এবার শানেরও মায়া হতে লাগলো সোহার উপর। শান ভেবেছিলো কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে থেমে যাবে কিন্তু এই মেয়ে টমিকে না পেলে সারাজীবনই কেঁদে যাবে। শান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে একবার সোহার রুমে চক্কর দিয়ে দেখলো সবাই এখনও সেখানেই বসে আছে। শান ধপাধপ পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাতে গ্লাভস আর মুখে রুমাল দিয়ে বাধা অবস্থায় টমিকে কোলে নিয়ে চুপিসারে নিজের রুমে ঢুকে গেলো।

চলবে……..

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ০৪

কিছুক্ষণ পর হাতে গ্লাভস আর মুখে রুমাল দিয়ে বাধা অবস্থায় টমিকে কোলে নিয়ে চুপিসারে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। টমিকে রুমে রেখে সোহার রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শান।
সোহার এতো কান্না দেখে সবাই এবার হতাশা ভরা মন নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। শান সুযোগ বুঝে টমিকে নিজের রুমে থেকে এনে সোহার রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। সোহা দরজা বন্ধের শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠে। সোহা কান্না বন্ধ করে দৌঁড়ে শানের কাছে গিয়ে টমিকে কেড়ে নিজের কোলে তুলে নিলো। সোহা টমিকে চুমু কে খেয়ে বলে
” কোথায় গিয়েছিলি টমি ? জানিস না তোকে ছাড়া থাকতে পারি না আমি! আমাকে না বলে কেনো চলে গিয়েছিলি তুই ?” শান বিরক্তিমাখা স্বরে বললো
” এই এবার তো করো, মেরি মা ! এই পাঁচ ছয় ইঞ্চি একটা কুকুরের জন্য আর কতো কাঁদবে বলো তো ! তোমার ফ্যাচফ্যাচানি কান্না শুনে শুনে আমার মাথা ব্যাথা করছে।”
সোহা চোখের পানি মুছে টমিকে নিয়ে বসে থাকে। কান্নার হিচকি এখনও কমেনি কিন্তু সোহার মুখে হাসি দেখে শানের মনে হলো অনেক দিন পর আকাশ থেকে কালো মেঘ সরে গিয়েছে। শান অপলক চাহনি দিয়ে সোহার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সোহার মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আসতেই সোহা ভ্রু কুঁচকে তীরের মতো সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকালো। শানের চাহনি দেখলেও সেটা খেয়াল না করে টমিকে রেখে সোহা অগ্নিদৃষ্টিতে শানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সোহাকে হঠাৎ এতো কাছে দেখে শানের হুশ আসে। শান মনে করে এভাবে তাকিয়ে থাকায় সোহা বোধয় রেগে গিয়েছে তাই হচকচিয়ে বলে
” আমি আমার রুমে যাচ্ছি।” সোহা শানের পথ আটকে বলে
” দাঁড়ান কথা আছে আমার। আপনি টমিকে কোথায় পেয়েছেন ? আচ্ছা আপনিই ওকে লুকিয়ে রাখেননি তো ?” শান গম্ভীর গলায় বলে
” আমাকে কি নিজের মতো মনে করেছো ? ছোট একটা কারণে এই কুকুরকে আমি লুকিয়ে রাখতে যাবো ! তোমার মতো মানুষ দেখিনি আমি। কোথায় আমি ইমনকে দিয়ে এতো কষ্ট করিয়ে টমিকে খুঁজে বের করেছি আর তুমি আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে সন্দেহ করছো !” শানের ধমক শুনে সোহা ভয়ে কেঁপে উঠে। সোহা মুখটা ইনোসেন্ট বানিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে
” সরি ! আর ধন্যবাদ টমিকে খুঁজে বের করে আনার জন্য।” সোহার ইনোসেন্ট ফেস দেখে বড্ড হাসি পেলো কিন্তু শান একদমই হাসলো না। গম্ভীর গলায় উত্তরের বললো
” হুমমম।” শান দরজা খুলে চলে যেতে নিলে আবারও পেছন থেকে সোহা তাকে ডাকলো। শান ভ্রু কুঁচকে বলে
” কি হয়েছে ?” সোহা শানের দিকে ইশারা করে বলে
” আপনি এমন গ্লাভস, রুমাল এসব পড়ে সং সেজেছেন কেনো ?” শান রেগে চোখ বন্ধ করে নেয়। সোহা শানের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। শান ঠাস করে চোখ খুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” আমার এলার্জি আছে কতোবার বলবো তোমাকে ? তোমার টমির পশমের থেকে বাঁচার জন্য এসব পরেছি। এবার যাবো আমি !”
সোহা দাঁত কেলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় শানের কথায়। শান ধুপধাপ পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। সোহা টমিকে নিয়ে নিচে চলে যায় সবাইকে বলতে।
শান গ্লাভস, মাস্ক সব খুলে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। ব্যালকনির ফুল গাছ গুলোর কাছে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। শান গিল্টি ফিল করে কিছুটা নিজের কাজের জন্য। শানই টমিকে লুকিয়ে রেখেছিলো গাড়ির ডিঁকিতে। শান ভেবেছিলো সোহা কিছুক্ষণ কান্না করে ঠিক হয়ে যাবে আর শান কালকে টমিকে সোহার বাড়িতে রেখে আসবে কিন্তু সোহার এতো কান্না দেখে শান আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। তাই টমিকে সোহার কাছে ফিরিয়ে দিলো।
দরজায় নক হতেই শান ভেতরে আসতে বলে। সালমা এসে শানের কফি দিয়ে চলে যেতে নিলে শান বললো
” শোনো সোহাকে বলে দেবে ওর কুকুর যেনো কোনোমতেই আমার রুমে না আসে।”
সালমা আমতা আমতা করে বলে
” ভাই আমি বললে কি আপু শুনবে ? উনি তো কারোর কথা শুনবে না।”
শান বিরক্তি চাহনি দিয়ে বলে
” কে বলেছে শুনবে না ? বলে দেখেছো কখনো ? যাও ! আর ওকে বলবে আমার সাথে যেনো দেখা করে যায় আমিই বলে দেবো সব।” সালমা মাথা নেড়ে চলে গেলো।
শান কফি খেতে খেতে গাছের ফুল গুলোকে ছুঁয়ে দিতে থাকে।

শান তার রুমের সোফায় বসে বসে থানার কিছু ফাইল দেখছিলো। তখন সোহা হুরমুর করে রুমে ঢুকে বলে উঠে
” আমাকে ডেকেছেন কেনো ?” শান চমকে চোখ বড় বড় করে সোহার দিকে তাকিয়ে থাকে। সোহা রুমে ঘুরতে ঘুরতে গান গাইতে থাকে
” লালালালা লালালা লা লা লালা।” শান ধমক দিয়ে বললো
” চুপ একদম ! এটা কেমন ভদ্রতা ? রুমে ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হয় জানো না ! আর রুমে ঢুকেই গান গাইছ কেনো ? এটা কি তোমার পারফর্মেন্স সো পেয়েছো ? নাকি তোমার রুম এটা ?”
সোহা নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো
” এই একদম আমাকে ভদ্রতা শেখাতে আসবেন না। আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো এই বাড়িতে। আর পারমিশন নেওয়ার কি আছে ! আপনি কি বিবাহিত নাকি ? বিবাহিত লোকরা বউ এর সাথে রোমেন্স টোমেন্স করে তাই পারমিশন নেওয়া দরকার। কিন্তু আপনি তো বিবাহিত না তাহলে আপনার পারমিশন নেওয়ার কি আছে ?”
শান সোহার কথা শুনে থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে সোহার কাছে দাঁড়িয়ে বলে
” বিবাহিত না হলেও আমি একটা ছেলে। ওকে ? নেক্সট টাইম পারমিশন না নিয়ে ঢুকলে হাত পা বেধে রেখে দেবো।” সোহা রেগে বলে
” গেস্ট এর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে ? ছি! ছি! ছি! আমি আন্টি কে বলবো। এবার আসল কথায় আসুন। আমকে কেনো ডেকেছেন এখানে ?” শান গম্ভীর গলায় বলে
” তোমার টমি যেন আমার রুমে না আসে সেদিকে ভালো করে খেয়াল রাখবে। শুধু টমি কেনো তুমিও আসবে না এই রুমে। আমি পারমিশন ছাড়া আমার রুমে তোমরা কেউ আসবে। গড ইট ?”
সোহা এক ভ্রু উঁচু করে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে বললো
” কেনো কেনো ? এই রুমে কি এমন জিনিস আছে যে এখানে আসা যাবে না ?”
শান চোখ রাঙিয়ে বলে
” যা বলেছি শুধু সেটুকুই শুনবে। আমার রুমে কিছু থাকুক আর না থাকুক সেটা একান্তই আমার পারসোনাল ম্যাটার। যাও এবার নিজের কাজে যাও।”
সোহা শানকে ভেংচি দিয়ে মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। শান সোহার কাজ দেখে আলত হাসলো।
ডিনার টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসে। শাহানাজ বেগম আর নিলা, সোহা কি খাবে সেই নিয়েই ব্যস্ত। আর সবাই গল্প করছে আর খাচ্ছে। সোহা সবার সাথেই মজা করছে। শুধুমাত্র শান গম্ভীর হয়ে বসে আছে। মুসফিক চৌধুরী গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করে
” সোহা ? পড়াশোনা শেষ করে কি করতে চাও তুমি ?” সোহা দাঁত কেলিয়ে বলে
” কি আর করবো বলুন আংকেল ! মেয়েদের তো বিয়ের পিরিতে বসতে হয় তাই ভেবেছি যেকোনো সময় বিয়ে করে ফেলবো তারপর নিজে পড়বো আর বাচ্চা, হাজবেন্ড কেও পড়াবো।” সোহার কথা শুনে শান আর সিমি বাদে সবাই অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে উঠে। সোহা নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। সিমি সোহার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে
” বাবা তোকে তোর স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করছে আর তুই মজা করছিস ?” সোহা সিমির দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। সিমি এবার রেগে তাকায়। ইশান হেসে সিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে
” আরে সিমি থাক। একটু আধটু মজা তো করবেই এটা ব্যাপার না।”
সোহা এবার সিরিয়াস হয়ে বলে
” আমি একটা NGO খুলতে চাই। ” সবাই অবাক হলো সোহার কথা শুনে। সোহা সবার চাহনি দেখে ইনোসেন্ট ফেস করে বলে
” আমি মজা করছি না এবার। সত্যিই আমার ইচ্ছে একটা NGO খুলবো আমি। আর কোনো ইচ্ছে নেই।” সামির মাথা নেড়ে বলে
” বাহ অনেক ভালো একটা কাজ।” নিলা আলতো হেসে সোহার মাথায় হাত রেখে বলে
” তুমি সামলাতে পারবে এসব ?”
সোহা মুচকি হেসে উত্তরে বললো
” চাইলে তো সবই সম্ভব। আমি যখন চাই NGO খুলতে। তাহলে সেটা ভালোভাবে সামলানোর দায়িত্বও আমার হবে।” সোহার কথাটা শুনে সবার ভালো লাগলো। শান মনে মনে বলে
” বাদর হলেও কাজে কোনোদিক থেকে কম না।”

পরদিন সকাল হতেই সবাই যার যার কাজে চলে গেলো। শানও থানায় চলে গেলো। শান বেরিয়ে যেতেই সোহা চুপিচুপি শানের রুমে ঢুকে পড়ে। তাও আবার টমিকে নিয়ে। টমি তো তার ছোট ছোট চোখ দিয়ে পুরো রুমে চোখ দিয়েই চক্কর কেটে নিলো। সোহার আদেশ মেনে চলছে টমি। সোহা ঢোকার আগেই টমিকে সাবধান করে দিয়েছে চুপচাপ তার পেছন পেছন আসার জন্য। তাই তার জন্য আপাতত এটাই সবচেয়ে বড় কাজ। সোহা শানের ব্যালকনিটা আগে ঘুরে দেখলো তারপর একে এক রুমের আগা টু গোরা সব দেখলো। শান মানুষটা খুবই গোছালো এবং শান্ত, গম্ভীর একজন মানুষ।
সোহা দরজা আলতো ভাবে চাপিয়ে নেয় তারপর কিছু না ধরে গিয়ে সোজা আলমারি খুলে বসলো। আলমারি খোলাই ছিলো তাই সুবিধা হলো। সোহা একে একে সব জায়গা খুঁজে নিলো কিন্তু শানের পারসোনাল এর মতো তেমব কিছু খুঁজে পেলো না। তবে সব খুঁজে শেষে একটা লক করা ড্রয়ার খুঁজে পেলো। সোহা তার সব শক্তি দিয়ে টেনে টেনে খোলার চেষ্টা করে কিন্তু বিফলে গেলো। সোহা আবারও টানতে টানতে বিরবির করে বলে
” ড্রয়ারের বাচ্চা খোল বলছি ! এতো কষ্ট করছি আমি আর আমার জন্য একটু খুলতে পারবি না তুই ? কেমন বেইমানি এটা ! আরে কেমন লক দিয়েছে উনি ! বাড়িতে কোনো চোর আসলেও এটা খুলতে পারবে না। চোরের চুরি করা সফল হবে না। আরে এমন হলে আমার কৌতূহলও ক্লিয়ার হবে না কখনও।”
” চোরের আর আসার দরকার কি ? তুমি নিজেই তো চোর হয়ে এসেছো। বাদর চোর কে দেখলে আসল চোরও পালিয়ে যাবে।” সোহা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে যায়। সোহা ঢোক গিলে সামনে তাকাতেই শানকে দেখে তার হাত পা কাপাকাপি করতে থাকে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here