‘সিক্ত সুভানুভব’
[৩২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
রোদ পুলিশ স্টেশনে গিয়ে কিছু তথ্য জানালো পুলিশদেরকে,সাথে ছবি। তারপর আরো কিছু কথাবার্তা বলে রোদ রিসোটে ফিরলো।রোদ রিসোর্টে ফিরে রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো আলো বিড়বিড় করে কি যেন বলছে? রোদ দরজা লক করে আলোর কাছে এগিয়ে গেল, আলোর কাছে গিয়ে বসলো আর ভালো করে খেয়াল করে দেখছ আলো কাঁদছে।
–
রোদ একবার ডাকতেই আলো আম্মু বলে চিৎকার করে ওঠে, রোদ আলোকে জড়িয়ে ধরে,আর কপালে হাত দিয়ে দেখে প্রচন্ড জ্বর এসেছে, অতিরিক্ত টেনশন আর ভয় পেয়ে আলোর জ্বর চলে এসেছে।রোদ আলোকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয়। রোদ বুঝতে পারে আলো ভয়ঙ্কর কোন স্বপ্ন দেখে এত ভয় পেয়ে গেছে, আলো কি বিড়বিড় করে বলতেই আছে ? আলো খুব কাপছে, রোদ পাশের সেন্টার টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে আলোকে পানি খাইয়ে দেয়,,,
–
আলো ওর আম্মুকে নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন করার জন্য, এরকম একটা স্বপ্ন দেখেছে। কারণ আমরা যখন কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত বেশি চিন্তা করি , বা ভাবি তখন আমরা স্বপ্নে সেটাই দেখি। আর আলো ওর আম্মুকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আর অতিরিক্ত টেনশনের কারণেই এমন স্বপ্ন দেখেছে। আলো বিড়বিড় করে কি বলছে রোদ সেটা বোঝার চেষ্টা করছে? আলোর কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে এই কারণে রোদ ওর কথাগুলো বুঝতে পারছে না,,,,,, রোদ আলোকে ডেকে যাচ্ছে কিন্তু আলো থম মেরে বসে আছে, কোন কথা বলছে না। রোদ আলোকে একটু জোরে ধাক্কা দেয় আর আলোর রোদের দিকে তাকিয়ে.., কান্না মাখা মুখ নিয়ে রোদ কে বলে।
–
আলো: রোদ আম্মু মারা গেছে !আমার আম্মু আমার বাবার মতো আমাকে ছেড়ে ওই দূর আকাশের হয়ে গেছে। আমি আর আমার আম্মুকে আর দেখতে পাবো না( কেঁদে কেঁদে)
রোদ: ছি! এসব উদ্ভট কথা তুমি কোথা থেকে পেলে? কে বলল তোমাকে এসব কথা? আল্লাহ না করুক এমন কিছু হবে না, তুমি মে বি খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছ এই কারণে তুমি এত ভয় পেয়েছো? তোমাকে বলছি না তুমি টেনশন করো না ,আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না আলো, নিজেকে শক্ত করো।কারণ আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে আছি,,,
আলোঃ আম্মু মরে গেছে আমি জানি,আমি দেখছি।
রোদঃআলো এত হাইপার হলে হবে না,বোঝার ট্রাই করো।আমাদের ভেবে চিন্তা আমাদের এক একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । বাট তুমি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়ো তাহলে কি করে আমি তোমার আম্মুকে খুঁজে বের করবো বলো ?তোমাকে সামলাবো নাকি তোমার আম্মুকে খুজে বের করব?
আলো: ওকে আমি আর টেনশন করব না আমি আর কাঁদবো না তুমি প্লিজ আমার আম্মুকে খুঁজে দাও, প্লিজ রোদ!প্লিজ!( চোখ মুছে)
রোদ: এইতো গুড গার্ল! তুমি একদম টেনশন করো না আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব, কারণ ওটা শুধু তোমার আম্মু নয়, আমারও আম্মু। তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে আমারও তেমন কষ্ট হচ্ছে।
আলো:হুম! আমি আমার আম্মুকে চাই শুধু,আমি আর কিচ্ছু চাইনা,,,( কথাগুলো বলছে আর আলোর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে)
–
রোদ আলোকে ধরে আবার শুইয়ে দেয়, আর রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে থাকে,ওর ফাস্ট এইডের বক্স থেকে একটা মেডিসিন নিয়ে আলোকে খাইয়ে দেয়।আর এক পাশে শুয়ে আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকে, আলো রোদকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে রোদের বুকে মাথা দিয়ে, আলোর চোখের পানি রোদের বুকে গিয়ে জমা হচ্ছে, রোদ আলোর মাথা তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে কিস করে, আর ইশারায় কাঁদতে না করে। একটা সময় আলো ঘুমিয়ে পড়ে, রোদ উঠে ড্রেস চেঞ্জ করে তারপর আবার শুয়ে পড়ে।
–
প্রায় 2 দিন পর,,,
পুলিশ স্টেশন থেকে ওদের কাছে ফোন আসে,আর পুলিশ জানায় আলোর আম্মুকে খুঁজে পাওয়া গেছে। রোদ আর আলো এই খবর পাওয়ার পর, ওরা দুজনেই পুলিশ স্টেশনে যায় । তারপর আলোর আম্মুর বাসার অ্যাড্রেস নিয়ে ওরা বেরিয়ে গেলো পুলিশ স্টেশন থেকে, আলোর মুখে এখন একটা খুশির ছাপ, এই খবর পাওয়ার পর প্রায় 2 দিন পর আলোর মুখে হাসি ফুটেছে, রোদ মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছে, যাতে আলোর মুখে এই হাসিটা থাকে, আর এবার যাতে আলোকে খালি হাতে ফিরতে না হয়। আলো ওর আম্মুর সাথে কথা বলার জন্য উতলা হয়ে গেছে
–
প্রায় দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করার পর ওরা সেই এড্রেসে পৌঁছালো।আলোর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। আলো কাপা কাপ গলাতে রোদের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
আলো: আমি আমার আম্মুকে পেয়ে গেছি,আর হারাতে দিবো না।
রোদ:হুম! চলো আমরা ভেতরে যায়, আর আম্মুর সাথে গিয়ে কথা দেখা করি
আলো: চলো!!
–
রোদ আর আলো বাসার ভিতরে ঢুকলো, আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো।একটা মাঝ বয়সী মহিলা সোফাতে বসে পেপার পড়ছিল।রোদ আর আলোকে দেখে ওনি কথা বলে, এবং ওদেরকে সোফাতে বসতে বলল
মহিলা: কাকে চাই ? আপনাদের তো ঠিক চিনলাম না?
আলো: আন্টি আমি আমার আম্মুর সাথে দেখা করতে এসেছি, আমি জানি এখানে আমার আম্মু আছে( উত্তলা হয়ে)
রোদ: আলো আমি কথা বলি কেমন ওয়েট প্লিজ,
আসলে আন্টি কালকে যখন আপনি গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন তখন আপনার সাথে একজন মহিলা ছিল।
আমরা ওনার সাথে একটু দেখা করতে চাই।
মহিলা: কে আপনারা? আর আমার সাথে কে ছিল ,না ছিল আপনারা কিভাবে জানলেন?
আলো: আন্টি আপনি সব উত্তর পেয়ে যাবেন, শুধু একবার উনাকে একটু ডেকে দেন , আমরা সব বুঝিয়ে বলব আপনাকে।
মহিলা:হুম
–
মহিলাটি একটা সার্ভেন্ট কে ডেকে আলোর আম্মুকে ডাকতে পাঠালো,আলো এতটা এক্সাইটেড যে ওর হাত পা কাপাকাপি শুরু করে দিয়েছে ।আজকে চারটা বছর পর আম্মু কে দেখবে,আলো আর তর সইছে না মনে হচ্ছে এক একটা সেকেন্ডের কাঁটা প্রায় একটা বছরের সমান। আলো সিঁড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে, অনেক প্রতিক্ষার পর আলোর আম্মুকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল, আলো ওর আম্মুর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ,কারণ এখনকার আলোর আম্মুর আর আগের আলোর আম্মুর ফেস এর মধ্যে অনেক তফাৎ, আগের মত পুরনো শাড়ি পড়ে নেই এখন অনেক দামী শাড়ি পড়ে আছে, মুখটা শুকনো নেই এখন মুখে একটা সৌন্দর্য বিরাজ করছে।
–
আলোর আম্মু সিঁড়ি দিয়ে নেমে , নিচে পা না রাখতেই আলো দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি হয় যে আলোর আম্মু হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, রোদ আর ওই মহিলা টাও দাঁড়িয়ে যায়, আলো ওর আম্মুকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে থাকে, আজ কত দিন পর আলো ওর আম্মুকে কাছে পেয়েছে।
-,
আলো: আম্মু !ও আম্মু !তুমি আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিয়ে কি করে থাকতে পারলে? আম্মু! আম্মু গো তোমাকে আমি কত মিস করছি তুমি সেটা জানো না আম্মু? আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি আম্মু ,আমি আর তোমাকে কখনো হারাতে দেবো না আম্মু ,,, এই চারটা বছর আমি এত ভাল থেকেও তোমার শূন্যতা আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে আম্মু, আর আমাকে দুরে সরিয়ে দিও না আম্মু!আমাকে তোমার কাছে রাখো আম্মু! আমি তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও আর থাকতে চাই না। আম্মু তোমার আদর কতদিন পাইনি, তোমার হাতে কত খাইনি, তোমার মিষ্টি মিষ্টি বকা গুলোকে খুব মিস করি আম্মু!ও আম্মু আমাকে একবার রাজকন্যা বলে ডাকো না।
( আলো চিৎকার করে কাঁদছে আর কথাগুলো বলছে,চারটা বছরের জমে থাকা কষ্টগুলো আলো ওর আম্মুকে জড়িয়ে সেই কষ্টটা মুছে ফেলতে চাইছে)
–
আলোর কান্না দেখে রোদও আর নিজেকে সামলাতে পারছে না , বারবার নিজের চোখের পানি সবার অগোচরে মুছে ফেলছে।কি করে পারবে দুইদিন ধরে নিজের কলিজাকে এভাবে কাঁদতে দেখতে,এমন একটা পরিস্থিতিতে ওদের পড়তে হবে,এটা কেউ কল্পনা করে নি।রোদ আলোকে নিজের সাধ্যমত আগলে রেখেছে,রোদ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে,আলোর এভাবে কান্না করা দেখে বাসার সার্ভেন্ট গুলো অবাক চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে, সাথে ওই মাঝবয়সী মহিলাও।আলো এভাবে কাঁদছে বাট আলোর আম্মু কোন রেসপন্স করছে না,এমনকি আলোকেও জড়িয়ে ধরে নি,কেমন রোবটের মত দাড়িয়ে আছে।আলোও অবাক হয়ে ওর আম্মুকে ছেড়ে দিয়ে দুইহাত দিয়ে ওর আম্মুর মুখ ধরে।
–
আলো: আমার সাথে কথা বলছ না কেন আম্মু? একবার আমাকে তোমার রাজকন্যা বলে ডাকো না, একবার আমাকে আলোমনি বলে ডাকো?আম্মু আমিতো তোমার কলিজা আমাকে তুমি জড়িয়ে ধরবে না? আমার সাথে কথা বলবে না?আমাকে আদর করবে না।ও আম্মু তুমি কথা বলছো না কেন?আম্মু আমাকে বকা দাও মারো,তবুও আমার সাথে একটু কথা বলো আম্মু,তোমার কথা শোনার জন্য আমি উওলা হয়ে আছি আম্মু গো!আম্মু কথা বলো!আর কষ্ট দিও না রে আম্মু, আমি আর কষ্ট সহ্য করতে পারছিনা।( কাঁদতে কাঁদতে)
–
এরপর আলোর আম্মু আলোর দিকে তাকিয়ে, যে কথা বললো, তাতে আলোর আর রোদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো,আলো ওর আম্মুর কথা শুনে আমার অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেঝেতে ওর আম্মুর পায়ের বসে পড়ছে,
ওর মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলছে,একোন গোলকধাঁধাতে পড়লো এটা বুঝতে পারছে না।আলোর আম্মুর সেই চিরচেনা কন্ঠে আলোকে বলছে,,
আলোর আম্মু: তুমি কে?তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না?আর আম্মু! আম্মু! বলে আমাকে ডাকছো কেন? আমিতো তোমার আম্মু না?আমার তো কোন মেয়ে নাই,আমি তোমাকে চিনি না,কখনো দেখিও নি।তুমি এভাবে কাঁদছো কেন?
চলবে,,!!