রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৫
__________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
ঠোঁটে ঠোঁটে কথা দীর্ঘতর সময় যাবৎ না হলেও বক্ষপটে শিহরণ বইতে থাকল ওদের অনেকক্ষণ। আশফিকের সঙ্গে কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি। ছেলেটার সত্যিই এবার বেকায়দা অবস্থা৷ চুমু তো না যেন মহুয়া পান করল! যার নেশা তড়তড়িয়ে মাথায় উঠে নেচে বেড়াচ্ছে। এখন কী উপায়? চাইলেও তো দ্বিতীয়বার সুযোগ নেই এ নেশা কাটাবার।
ব্যস্ত সড়কের নির্জনতা এই বেসামাল স্বাধীন অনুভূতিকে আরও আশকারা দিতে চাইছে৷ আশফিকের ইচ্ছে হচ্ছে গাড়ির ড্রাইভারটাকে রাস্তার মাঝে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। ওদের উষ্ণ আর্দ্র চুমুতে ব্যাঘাত ঘটানোর দায়ে আর এই একান্ত মুহূর্তের শত্রু ভেবে। বাঁকা দৃষ্টিতে মাহিকে দেখল একটু। শীতে জমে বরফের মতোই স্থির হয়ে বসে আছে সে। অথচ একটু আগেও ওকে বিগড়ে দেবার জন্য কী নাটকটাই না করছিল! হাড়বজ্জাত মেয়ে একটা! ওকে নাকাল করবার জন্যই জন্ম এই মেয়ের।
অনেকটা পথ নিরিবিলিতে চলছে ওদের গাড়িটা। আশফিক চুমুটা সম্পূর্ণ করতে না পারার আফসোসে আর রাগে দুঃখে একটুও কথা বলছে না মাহির সঙ্গে। কিন্তু ওকে ওভাবে নিজের দিকে প্রলুব্ধ করে কষ্ট দেওয়া কি সমীচীন হলো? ওকে কেন এভাবে কষ্ট দেওয়া হবে? ও মানুষটা বাঁধনছেড়া পাগল আর নিয়ন্ত্রণহারা প্রেমিক কেবল এখানেই হয়। তা তো মাহিও জানে। এমন সংবেদনশীল বিষয়ে তবুও মজা করল কীভাবে?
মাহি পাশের মানুষটির তখন থেকে ভারিক্কি মুখটা দেখে মনেমনে সত্যিই খুব লজ্জিত আর অপরাধবোধটাও হচ্ছে। ও আসলেই ভাবেনি আশফিক দশ সেকেন্ডের জন্য হলেও অমন উদ্দাম বেগে চুমু খেয়ে বসবে। খানিকটা অনুভূতির অস্থিরতা বাড়াতে চেয়েছিল এই আর কী! কিন্তু যা-ই হোক, ভুলটা ছোটোখাটো লাগলেও আদতে গুরুত্বহীন নয়। পুরোনো দিনে আশফিকের লাগামছাড়া ভালোবাসার শিকার কি ও হয়নি? এই ব্যাপারে আশফিক ভীষণরকম অনুভূতিপ্রবণ। ওদের জীবনের প্রথম চুমুটাও তো এইরকম গাড়িতেই ঘটেছিল। তা ভুলে গেল কী করে? আশফিক নস্টালজিক হয়ে সেটা মনে পড়েই মন খারাপ করে আছে কি?
-‘স্যরি!’
অবিলম্বে ফিরল আশফিক মাহির পানে, ‘স্যরি? রিয়্যালি স্যরি? তুমি বলছ?’
-‘এরকমভাবে অবাক হবার নাটক করবে না বলে দিলাম! আমি তো এমনিই মজা করছিলাম।’
-‘করো। করবে না কেন? আমি তো এখন তোমার কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর হাসির পাত্রই।’
আচমকাই সাংঘাতিক চটে গেছে আশফিক। এমনটাই যে ঘটবে তা মাহি বুঝেছে বলেই সে এখন নতিস্বীকার। অনেকটা সরে এসে বসল আশফিকের কাছে। মৃদুস্বরে বলল, ‘তোমার বউ বেচারি যেন খুব স্ট্রং হয়। নয়তো তোমার ইন্টিমেসি সামাল দিতে পারবে না। আর বিয়ের রাতে বলেও দেবে এসব ব্যাপারে তুমি খুব সেন্সিটিভ।’
আশফিক নীরবে শুনল শুধু মাহির পরামর্শ। কথা বললেই অনেকরকম ক্ষোভ প্রকাশ পেয়ে যাবে এই মুহূর্তে। মাহির সঙ্গে প্রথম ও শেষবার উঁচু কণ্ঠে কথা বলেছিল সেই অভিশপ্ত দিনে। লন্ডন চলে যাবার পর সেই দিনের মাহির তিক্ত কথাগুলো অন্তরে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে জেদ, অভিমান আর অহংবোধে কাটিয়ে দিলো দেশের বাইরেই চারটা বছর। যেদিন অনুতাপের দহনে বুক পুড়তে শুরু করল সেদিন ওর আত্মার কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে, কোনোদিন আর ওর ক্রোধের মুখে ফেলবে না মাহিকে।
মাহি চিন্তায় পড়ে গেল কথা না বললে কীভাবে আশফিকের রাগটা নিশ্চিহ্ন করবে? এখন ওর কাছেও ড্রাইভারটাকে উটকো লাগছে। গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে পারলে খোলামেলাভাবে কথা বলতে পারত দু’জনে৷ কতক্ষণ কণ্ঠ দাবিয়ে কথা বলবে?
-‘তুমি কি ভেবে রেখেছ কথা না বললে জার্নিটা করবে আমার সঙ্গে?’
-‘একদমই না। সেটা তো সম্ভবই নয় আমার পক্ষে।’ মাহির চোখে চোখ রেখে এমন একটা আড়ালে রাখা অভিমান ভরা বাক্য বলবার ইচ্ছা ছিল আশফিকের। বলা হলো না ফোন কল আসায়। সৌরভ কল করেছে আশফিককে।
-‘হুঁ, বল। বেরিয়েছিস তোরা?’
সৌরভ বিছানাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তখনো। আশফিকের মুখে বেরিয়ে যাবার কথা শুনে আমতাআমতা করে শুধাল, ‘ভাই, তুই কি বেরিয়ে পড়ছিস?’
-‘তুই তো মনে হয় এখনো বিছানায় ছাড়িস নাই। ঘুমিয়েই যাচ্ছিস? তাহলে আসবি কখন?’
বেশ উচ্চস্বরেই বলে উঠল আশফিক। মাহি থমকে গেল। নাহ, মেজাজ সু্বিধার না ছেলেটার। ওর প্রতি সংবরণ রাখা রাগ এবার অনায়াসে নিরীহ বন্ধুগুলোর ওপর ঝাড়বে।
-‘ভাই, মাফ কর। একটা বিগ মিসটেক হয়ে গেছে। পরাগ ফোন না করলে সবার কাছে মার খেতাম। ফারহান সিরিজের লঞ্চটা বিকাল সাড়ে পাঁচটায়, ভোর সাড়ে পাঁচটা না।’
আশফিক চুপ করে রইল শুনে৷ হাত ঘড়িতে একটু আগে সময় দেখেছিল পাঁচটাও বাজেনি। ঢাকাতে শীতের কামড় গায়ে চড়াভাবে না পড়লেও ভোরবেলাতে মোটামুটি ঠান্ডাটা টের পাওয়া যায়৷ কথা সেটা নয়, আসল কথা নিজের ঘুম তো হয়ইনি গতরাতে। মাহিকেও ঘুমাতে দেয়নি সে। এমন মাথায় আগুন ধরানো ভুলের জন্য নিজের উত্তপ্ত মগজ তো এবার মাথা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাহিই বা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে এখন? শীতল কণ্ঠেই সৌরভকে বলল, ‘তুই চিরকালই পেটমোটার সঙ্গে মাথামোটা। এটা ভুলে যাওয়া আর তোর ওপর দায়িত্ব দেওয়া আমারই দোষ।’
-‘আজকে রাগব না ভাই৷ আরও কিছু গালাগাল দে তাও ভালো। কিন্তু ক্যাম্পিং ট্রিপটা ক্যান্সেল করিস না। নয়তো সাদিয়া এইবার সত্যি সত্যি সিরিয়াস ব্রেকআপ করে দেবে। ও মেলা এক্সাইটেড। পরাগ বের হওয়ার আগে কল করছিল ভাগ্যিস। ও ওর কলিগদের বলে দিছে। আমি হৃদয়রে জানাই দিচ্ছি। দিলিশারেও জানাই দিচ্ছি, সমস্যা নাই।’
-‘আসলেই সমস্যা নাই৷ ফোন রাখ।’
শেষে ধমকেই বলল। ফোনটা কেটে মাহিকে জানিয়ে দিলো, ‘বিকাল সাড়ে পাঁচটায় লঞ্চ ছাড়বে। সৌরভ বিকালের বদলে আমাদের সবাইকে ভুলবশত সকাল সাড়ে পাঁচটা বলেছিল। আসলে এই ভুলের দায়ভারটা আমারই৷ অ্যারেঞ্জমেন্টটা আমারই করা উচিত ছিল৷ তাড়াহুড়োর কারণে দায়িত্ব কিছুটা সৌরভের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। দেশে থাকতে সব জায়গাতে সফর হলেও নোয়াখালীর ওদিকেই কখনো যাওয়া হয়নি। তাই জানা ছিল না।’
নিচ ঠোঁটের সাহায্যে ওপরের ঠোঁট চেপে মাহি নির্বিকার চেয়ে রইল সামনে, ‘তাহলে এখন কী করার? ফিরে যেতে হবে তাইতো?’
ফিরেই যেতে হবে এমন কী কোনো বাধ্যতা আছে? মাহির চেপে ধরে রাখা ঠোঁটের দিকে চেয়ে ভাবল আশফিক। ক্ষণিক পূর্বের রাগটা সহসা দূর হয়ে গেল নতুন পরিকল্পনা মাথায় আসতেই।
-‘বেরিয়েই যখন পড়েছ লং ড্রাইভে থাকতে পারো আমার সঙ্গে। তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী এমন সময় তো আমাদের মধ্যে আর আসবে না কখনো। দু’টো দিনের পুরোটাই না হয় আমাকেই ডেডিকেট করলে।’
শান্তভাবপূর্ণ চাউনি বিদ্ধ করল মাহি আশফিককে। ‘আর দেখা হবে না’ সব কথাতেই এই ইঙ্গিত দিয়ে আশফিক নিজের বুকখানা খুঁচিয়ে ক্ষত করছে না কি ওকে ক্ষত করতে চাইছে?
-‘যেতে আসতেই আরও দু’দিন। চারদিন পেয়ে যাচ্ছ আমাকে।’
-‘পাবো তোমাকে?’ ঈষৎ আওয়াজে গাঢ় স্বরে শুধাল আশফিক।
মাহির চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে আশফিকের অপূর্ণ বাসনা বুঝে। ওকে নিবিড় করে পাওয়ার পুরোটা অধিকারই তো আছে এই মানুষটির। সেই অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে পাপ করছে কি? ঝটপট প্রসঙ্গ বদলাল, ‘চলো তবে। বহুদিন বাদে সেই পুরোনো দিনের ফিল নেওয়া হোক আজ।’
-‘তাই হোক।’
বেচারা ড্রাইভারটা অপরাধ না করেও এত সময় দুটো মানুষের থেকে কতগুলো গালিই না খেলো! আশফিক শেষমেশ তাকে গাড়ি থেকে নামিয়েই ছাড়ল। হাতে টাকা গুঁজে বাসায় ফিরে যেতে বলল তাকে। তারপর গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ছুটল ওরা। যেতে পথে রাস্তার পাশের হোটেল খোলা পেয়ে আজ তারা হোটেলের সাধারণ খাবার পরোটা, আলুভাজি আর ডিমভাজি নিয়ে নিলো সাথে। দুজনের এক সঙ্গে চলার সেই প্রথম দিনটাই না চাইতেও ফিরে এলো ওদের মাঝে।
দ্বিতীয় দিনের সাক্ষাতের পর সম্পর্কটাকে যতটা সহজ করা সম্ভব, সবটাই চেষ্টা করেছিল আশফিক। নিজের বন্ধুদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব জমিয়ে দিয়েছিল মাহির। তারপর একদিন প্রথমবারের মতো ওরা এক সঙ্গে দীর্ঘ যাত্রা করেছিল মাগুরার উদ্দেশ্যে। সেখানকার সকলে আশফিককে দেখতে চেয়েছিল। সেই সাথে সেটা ছিল ওদের প্রথম লং ড্রাইভও। কিন্তু পাশাপাশি বসেও মাহির অদৃশ্য দূরত্বটা আশফিক সুক্ষ্মভাবে টের পেয়ে একটু ব্যথিত হয়। তবে চট করে সেটা সামলেও নেয়। ওদের সম্পর্কের সময় তখন পনেরোদিন আর ধাপটা তখনো কেবল বন্ধুতে। প্রেমিক বা হবু স্বামী রূপে আশফিক আধিপত্য ফলায় সেদিনই। শান্তশিষ্ট মাহির মৌনতা হটাতে আশফিক জিজ্ঞেস করে, ‘কী মনে হয়? ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে কতটুকু হ্যাপি থাকতে পারবে?’
অচঞ্চল মেয়েটা চুপচাপ থাকলেও কথা বলবার সময় তার হেয়ালি থাকে না। স্বভাবগত স্পষ্টতার সাথে জবাব দেয়, ‘তুমি আমাকে হুটহাট ফেলে ফটোগ্রাফিতে বেরিয়ে না পড়লে সন্তুষ্ট হওয়ার মতোই হ্যাপি থাকব।’
ক্ষীণ হাসল আশফিক, ‘আমার ফটোগ্রাফি চর্চাটা তোমার খুব অপছন্দ, না?’
-‘যতটা আন্টি আমার আকাশ ভ্রমণকে করেন ততটাও না। আসলে অপছন্দই না৷ এই যে তুমি পড়াশোনাকালীন বলা নেই কওয়া নেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বেরিয়ে পড়ো দায়িত্বহীনের মতো, এটা পছন্দ নয়। বিয়ের পর এই বিরহ নিতে পারব না আমি।’
হাসিটা প্রাণবন্ত হলো এবার আশফিকের, ‘বিয়ের পর পুরুষরা বউছাড়া বাইরে রাত কাটাতে পারে?’
-‘পারে না সেটাই তো জানি। তোমার বেলাতে কেন যেন গ্যারান্টি পাচ্ছি না।’
মজা পেলো আশফিক কথাটা শুনে। ড্রাইভিংয়েই মনোযোগ রেখে বলল, ‘গ্যারান্টি পাওয়ার মতো সেরকম কিছু এখনো করেছি না কি?’
-‘তো করো না কেন? আমিও তো পূর্ণ বিশ্বাস করতে চাইছি তোমাকে।’
মুখে নিগূড় হাসি আশফিকের৷ গভীর দৃষ্টিতে মাহি সে হাসি দেখে ওর মনটা সন্দিগ্ধ হলো৷ কেমন ফন্দিবাজ লাগছে আশফিককে।
গাড়ি চালানোর ফাঁকে আশফিক প্রায় প্রায়ই দেখছে মাহিকে। এবার দেখে কৌতুক করে শুধাল, ‘ওরকম জহুরিদের মতো করে চেয়ে আছ কেন? ক্রিমিনাল লাগছে না কি আমাকে?’
-‘দেখার ভাবটা সেরকম লাগছে না কি?’
-‘অনেকটাই। একটু ভয়ও পাচ্ছি। কী ভাবছ কে জানে! এই চুপচাপ আছ। হঠাৎ দেখা গেল ধুমধাম মারতে আরম্ভ করলে। তবে একটু স্বস্তি পাচ্ছি গাড়িতে রড নেই।’
চমকিত দেখাল মাহিকে। কণ্ঠেও সেই ভাবটা প্রকাশ পেলো আর কিছুটা রাগও, ‘তুমি সেদিন তাহলে ফিরে যাওনি? আমার পিছু নিয়েছিলে?’
-‘আমি সত্যিই তার জন্য স্যরি। ওই সময় আসলে কৌতূহল চেপে রাখতে পারিনি তোমার ফেস এক্সপ্রেশন দেখে। তোমাকে সেইফ করার জন্য এগিয়ে যেতেই সেই রণমুর্তির স্বাক্ষী হলাম। তুমি যাবার পরই একটা কালো গাড়ি এসে ওদের দু’জনকে তুলে নিয়ে যায়। তারা প্রত্যেকেই ছিল বেশ মার্জিত, ফরমাল লুকআপে৷ মনে হয়নি তারা একই দলসদস্য। কে ছিল ওরা?’
-‘সেটাও ওদের গাড়ি ফলো করে দেখতে।’
-‘আচ্ছা সত্যিই দুঃখিত৷ এমন আর হবে না কখনো।’
মাহি বক্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। দুঃখী দুঃখী স্বরে বলল না কি স্বাভাবিকভাবেই বলল আশফিক তা সঠিক বুঝল না ও।
-‘হলেও আপত্তি নেই৷ তোমার উচিত ছিল এ ব্যাপারে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা।’
গাড়ি চালানোর ফাঁকেই আশফিক ওর দিকে সরাসরি তাকাল কিয়ৎ পল। আবার ড্রাইভিংয়ে মনোযোগী হয়ে বলল, ‘আমার ধারণা ছিল তুমি নিজে থেকেই কখনো শেয়ার করবে। করোনি বলেই আজ প্রসঙ্গটা ওঠালাম।’
কোনো অভিশঙ্কা ছাড়াই মাহি স্পষ্টাস্পষ্টিভাবে জানিয়ে দিলো, ‘আমি ছোটোখাটো স্পাই আমার মনিকাকুর। তিনি এনএসআই সংস্থার কাউন্টার টেরোরিজম উইং এ জয়েন্ট ডিরেক্টর। প্রথম স্বপ্ন ছিল আমার এই সংস্থাতেই প্রবেশ করা। নানারকম প্রতিকূলতায় সুযোগ হারালাম। শেষে চেষ্টা করলাম সামরিক পাইলট হতে৷ সেখানেও এখন ব্যর্থতা আসবে। তবে মেনে নিয়েছি। সব ভালোই এক সঙ্গে পাওয়া যায় না।’
-‘সব ভালো মানে?’
-‘মানে তোমাকে আবার আমার সৈনিক হবার স্বপ্নকে এক সঙ্গে জয় করতে পারব না আমি। আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি।’
অনেকটা পথ পেরিয়ে অচেনা কোনো ব্রিজের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করাল আশফিক৷ কী অনায়াসে দুস্তোষ্য কষ্ট গিলে নিলো মাহি! আশফিক অপরিমেয় স্নেহময়, শ্রদ্ধা চোখে দেখতে থাকল ওকে। নারী অধিকার সচেতনতার যুগে মাহির মতো মেয়েকে স্বামীবাধ্য বা স্বামীভক্ত ব্যক্তিত্বে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এ ব্যক্তিরূপ তার সঙ্গের মেয়েটির মাঝে একদমই মানায় না। আদুরে মুখখানির মতোই ধারণাতীত কোমল ওর মনখানিও। কিন্তু সে এও চায় না এতটা সরলও থাকুক মাহি৷ কষ্ট লাগছে এই ভেবে ওর মতো ছেলে মাহিকে পাবার যোগ্য নয়৷ ওই স্বাধীন অন্তরীক্ষে ওকে যে ডানা মেলতে সমর্থন করবে, এমন কোনো সুপার হিরো যোগ্যতা রাখে মাহিকে পেতে। সে তো সুপার হিরো নয়। সে পরিবারের সিদ্ধান্তে জীবনগঠন করা নগন্য এক পুরুষ। নিজেকে নিজের কাছেই মেরুদণ্ডহীন লাগে ওর। যেখানে নিজের লালিত স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হয় সেখানে অন্যের ঘরের মেয়েকে তার স্বপ্ন ছুঁতে সাহায্য করবে কীভাবে? তবে এই মুহূর্ত থেকে একই বিসর্জন সেও দিলো৷ তাকে পেতে মাহি যদি স্বপ্ন পূরণের দোরমুখে গিয়েও ফিরে আসতে পারে সেও অন্তরে দাফন করে রাখতে পারবে তার স্বপ্নকে।
-‘গাড়ি থামালে কেন এখানে?’ আশেপাশে দেখতে দেখতে বলল মাহি। রাস্তার দু’ধারে পাটক্ষেত আর শস্যক্ষেত্র। যে ব্রিজটা সামনে সেই ব্রিজের নিচে জলাশয়ে পাট ডুবিয়ে রাখা। নোংরা, পচা দুর্গন্ধ বাতাসে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাও গ্রাম্য প্রকৃতিকে অবমাননা করার উপায় নেই। দেহ, মন অফুরান শান্তিতে ছেয়ে গেছে এই গোধূলি বেলা। জানালার কালো কাচটা নামাতে চাইলে আশফিক বারণ করল, ‘খুলো না। কথা বলি আগে। তুমি কেন স্যাক্রিফাইজ করছ, মাহি? আমার আম্মুর জন্য?’
-‘না তো, তোমার জন্য।’
-‘আমার দিকে তাকিয়ে বলো, মাহি।’
কিছুতেই তাকাল না মাহি৷ আশফিকের সামনে সরাসরি সত্য বলা বা ভাবনা চিন্তা না করে স্বীকারোক্তি দিয়ে ফেললেও পরবর্তীতে লজ্জা, অস্বস্তি জেঁকে ধরে ওকে। কেমন করে নিষ্পলক চোখে আশফিক চেয়ে থাকে বলেই লজ্জায় হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে যায় ওর। প্রথমবার কথাতে ভালো লাগা এলেও প্রথম দেখাতে যে ভালোবাসায় হাবুডুবু খেতে হবে ওকে, তা কে জানত? আশফিক বোঝে কিনা জানে না ও। বুঝলে ও বিন্দু পরিমাণ সময় নেবে না তা প্রকাশ করতে। অন্য সব লাজুক নারীদের মতো ও পারে না মনের কথা, মনের হালচাল আড়াল রাখতে। বলতে দ্বিধা, লজ্জা না পেলেও বলা শেষে বেগতিক হয়ে যায় ওর মনের দশা।
আশফিক তো সেই দ্বিতীয়দিনেই বুঝে নিয়েছিল মাহির অপ্রকাশ্য প্রণয় আবেগকে। কিন্তু সেদিনের থেকেও আজ খুব বেশি আনন্দ হচ্ছে ওর। অপ্রত্যাশিত নিখাদ ভালোবাসা পেয়েছে সে, আনন্দ হবে না?
-‘ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলে কথা বলব কীভাবে? তাকাও রে বউ।’
-‘কী? কী বললে?’ চকিতে ফিরল মাহি।
খোলা হাসিতে মাতোয়ারা আশফিক। বলল, ‘ফেঁসে তো গেছ আমার চক্করে৷ তাহলে আর গ্যারান্টি দিয়ে কী হবে? তোমাকে এমনিতেও পাচ্ছি আর অমনিতেও।’
-‘আচ্ছা তাই?’
-‘তা-ই না?’
-‘ফেঁসে গেছি বলে কি মাথায় চড়িয়ে রাখব মন্দ পেলে?’
-‘আমরা একটু পর রওনা করি। আগে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটা সেড়ে নিই। বলো, কী গ্যারান্টি পেলে আমাকে বিশ্বাস করবে?’
-‘আমি তোমাকে যতটা চাই তুমি আমাকে ততটাই চাও কি না আগে সেই নমুনা দাও।’
হাসিতে মজে ছিল আশফিক৷ কথাটা শুনে মৃদ্যুহাস্য মুখটার সুন্দর অধরের এক পাশ কামড়ে ধরল। আশফিকের নজরে পড়া সুন্দরতার প্রথম আকর্ষণ কিন্তু ওর পাতলা সরু ঠোঁট আর ঠোঁটের মাঝের টোলটা। বেহায়া ইচ্ছা জাগে মাহির সেই ঠোঁটে নজর গেলে। চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত। চাইল আশফিকের চোখে। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে ওর দিকেই চেয়ে আছে সে। তাই খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা গেল না। নিশ্চয়ই কোনো অভিসন্ধি আঁটছে আশফিক। ছেলেটা দারুণ চতুর ধারার। মাহি তা বেশ বুঝে গেছে।
-‘কী নমুনা চাও বলো?’
-‘প্রশ্নপত্র দিলাম। উত্তরপত্রও দেবো?’ ফিচলেমি গলায় বলল মাহি।
-‘আমি কিন্তু সিরিয়াসলিই আমার মতো করে দেবো নমুনা। তা গ্রহণ করার সহ্যক্ষমতা থাকতে হবে তোমার।’
কেমন নমুনা? আশফিকের বিভোর চাউনি দেখে মাহি একটু একটু অনুমান করতে পারছে বোধ হয় তা। আবার তা সঠিক নাও হতে পারে৷ তবে অনুমান সঠিক হয়ে গেলে ওর কী প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত হবে তখন?
-‘ওহ ওকে। আমরা তাহলে এখন রওনা করি?’
-‘করব। আগে নমুনা দিই।’
অনেকটা ঘাবড়ে গেল মাহি, ‘মানে গাড়িতে?’
স্টিয়ারিংটা এখনো ধরে রাখা আশফিকের হাতে, ‘হুঁ গাড়িতেই। হঠাৎ ভয় পাচ্ছ কেন?’
-‘কই ভয় পাচ্ছি?’
-‘কাছাকাছি না বসে জানালার সঙ্গে অমন সেঁটে বসে আছ যে?’ মিটিমিটি হাসি আশফিকের।
পিঠ সোজা করে স্থির হয়ে আশফিকের কাছে এসে বসল মাহি। কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল, ‘ভয় পাবার কী আছে? তুমি কেমন সুরাসক্ত ছেলেদের মতো চোখ করে চেয়ে আছ তাই একটু বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম।’
-‘চোখে লাগা সুন্দর চোখের নেশাও ধরিয়ে দেয়।’
-‘আচ্ছা।’ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল মাহি।
আশফিক এবার ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো ওর কাছে, ‘য়্যু আর ব্লাশিং অ্যান্ড স্মাইলিং নার্ভাসলি।
যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো মাহি, ‘আহা তেমন কিছুই না। আমি তোমাকে অবজার্ভ করছিলাম একটু।’
-‘কী অবজার্ভ করলে আমাকে?’
নিজের দৃঢ়তার জোর দেখাতে আশফিকের গোপন অভিসন্ধি থেকে খানিকটা বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে বসল ও, ‘তোমার মাইলড্ রোজিয়েট লিপস খুব অ্যাট্রাকটিভ। অবশ্য তুমিই খুব সুন্দর।’
সেই ঠোঁটে দু’আঙুল ছুঁইয়ে রেখে মুচকি হাসতে থাকল আশফিক, ‘সবাই-ই বলে। আমার কাছে কিন্তু ঐশ্বরিয়ার মতো ওই পুরু ঠোঁট বেশি আকর্ষণীয়।’
-‘কিন্তু তুমি তো ছেলে। মেয়েদের ঠোঁটের সঙ্গে তোমার ঠোঁটের তুলনা কেন?’
-‘আমি কি আমার ঠোঁটের সঙ্গে তুলনা করলাম? করলাম তো আমার জাদুকারীর ঠোঁটটার সঙ্গে।’
-‘জাদুকারী কে আবার?’ কৌতুহল গলায় মাহির। সঙ্গে একটু চিন্তাও।
-‘প্রথম ডেটে যে আমাকে বশ করে ফেলল, সে। আমার তো তার ওই সুন্দর পুরু ঠোঁটটাই টানে।’
তখন থেকে বেড়ে যাওয়া বক্ষঃস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করতে মাহি বুকের বাঁ পাশ চেপে না ধরে বুকের মাঝটা চেপে ধরল, ‘আমাদের বোধ হয় এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাওয়া উচিত।’
-‘মাহি? সামনে কী দেখছ? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো। তুমি কি শায় হচ্ছ?’
মাহি আর না পেরে রুদ্ধশ্বাসে বলে দিলো, ‘তুমি এত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বুক ধকধক করা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো বলছ বলেই আমার নাকাল অবস্থা। যা বলতে চাইছ তা সরাসরি বলে দিলেই তো হয়।’
মাহির কুণ্ঠিত, লজ্জিত মুখটা দেখে আশফিকের হাসি আটকে রাখা দায়।
-‘আচ্ছা। মূলত বলতে চাইছি না কিছু। করতে চাইছি। করে ফেলব?’ চাপা হাসিতে বলল আশফিক।
বুকের মাঝে তীব্র উত্তেজনায় মাহি ঘনঘন চোখে পলক ফেলতে থাকল ওর দিকে চেয়ে, ‘কী করবে?’
প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ হাস্য চেহারায় আশফিক মাদকতায় চেয়ে থাকল খানিকক্ষণ। মাহির দৃষ্টি সামনে থেকে ঘুরেফিরে আড়চোখে আশফিকের দিকেই যাচ্ছে। খুব বোঝা হয়ে গেছে ওর উদ্দেশ্য। কিন্তু নিজের স্নায়বিক দৌর্বল্যতার কারণে ঝড় গতিতে বুক কাঁপছে, প্রেম আদরে অনভিজ্ঞ মন কান্নাকাটি করছে। আশফিককে জলদি থামিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ওর মুখে পূর্ণ চাহনি নিবদ্ধ করে বলল, ‘তুমি এখন সত্যিই কিছু করবে না, আশফি। ঠিক আছে?’
-‘আমি এখন সত্যিই কিছু করব, মাহি। আমার অনুভূতি বিপর্যস্ত।’
গভীর আবেগঘন গলাতে অপারগতা জানিয়ে আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়া প্রখর বৃষ্টির মতো তৎক্ষণাৎ মাহির অধর ওর ওষ্ঠমাঝে সিক্ত করল আশফিক।
কতক সেকেন্ড গড়াতেই চারপাশ মুখোরিত করে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। অবিলম্বে ছেড়ে দেয় আশফিক। কিন্তু প্রথম অবর্ণনীয় লাজুক মিষ্টি অনুভূতির আচ্ছনতায় মাহি চোখ খুলল না। অবনত মুখটা দেখে আশফিক মুচকি হেসে টেনে নিলো ওকে বুকে। অবশেষে মুখটা লুকিয়ে রাখবার জায়গা মিলল মাহির। আজান শেষ হওয়ার পর জানালার বাইরে তাকাতেই দেখা পাওয়া গেল ব্রিজের অপর পাশে রাস্তার ধারে খোলা জায়গা৷ সেখানে ছোটোখাটো একটা মসজিদ। সামনে এগোলে বাড়িঘরও মিলবে। দু’তিন মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে সামলে উঠল মাহি। গাড়ির মাঝের এই দুষ্কর পরিবেশ স্বাভাবিক করতে মাহিই উদ্যোগ নিলো৷ বলল আশফিককে, ‘মসজিদ দেখা যাচ্ছে। নামাজ পড়ে এসো। তারপর রওনা হই।’
আশফিক নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গাড়ি থেকে নামল। চারপাশে তাকিয়ে অদূরে কতগুলো বাড়ি দেখে বলল, ‘চলো, তোমাকেও ব্যবস্থা করে দিই। গাড়িতে একা বসে থাকতে হবে না হলে।’
মাহি মৃদুস্বরে জানাল, ‘আমার আপাতত নামাজ নেই।’
আর কথা বাড়াল না আশফিক। মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবের পিছে দাঁড়িয়ে তাঁকে অনুসরণ করে সালাত আদায় করে নিলো। বেরিয়ে আসার মুহূর্তে মসজিদে ঢুকল এক জোড়া নব বরবধূ। বিয়ে পড়ানো হবে তাদের। কৌতূহলী আর বিস্ময় নিয়ে আশফিক সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল আবার। দেখতে থাকল তাদের বিয়ে পড়ানো। কিছুক্ষণ পরই অব্যাজে ওর মস্তিষ্ক তাড়া দিলো মাহিকে এইক্ষণেই আপন করে নিতে হবে ওরও। তিন মাস অপেক্ষা হবে ওর জন্য শাস্তিস্বরূপ। আর দেরি কীসের? ছুটে গেল গাড়ির কাছে। মাহিকে তাড়াহুড়ো করে নেমে আসতে বলল। মাহি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চরম উত্তেজনা নিয়ে নেমে এলো ওর কাছে, ‘কী হয়েছে?’
বিনা বাক্যে আশফিক মাহির খয়েরী ওড়নাটা মাথায় তুলে দিয়ে ওর হাতটা ধরে মসজিদের পানে এগিয়ে চলল। মাহি ওর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে চলতে আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাও তুমি? কী হয়েছে বলবে তো?’
আশফিক চলন্ত পায়েই ওর দিকে একবার চেয়ে জানাল, ‘বিয়ে করছি আমরা।’
ইসরাত জাহান দ্যুতি
(তাড়া নিয়ে লেখার কারণে আমি কাহিনির অনেক জায়গাতেই বিস্তারিত আলোচনা, স্পষ্ট বর্ণনা ছাড়া লিখে গেছি। কিছু বিষয় বাদও পড়ে গেছে। চেষ্টা করব বইয়ে সুন্দর আর গোছাল উপস্থাপন রাখবার)