রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩০.১
___________________________
এই প্রতিটা কথায় নির্ভুল। কোনো যুক্তিতর্কে আশফিক আসতে চায় না। সে তো মাহির এই অব্যক্ত মনঃকষ্ট, রোষাবেশের মুখোমুখিই হতে চেয়েছিল। ফিরতি জবাব দিতে চাইলে প্রথম প্রশ্নই তো চলে আসবে, মাহি কি পারত না ওর শখ বা পেশাকে মর্যাদা দিতে? সেদিন নাহিয়ানের কাছে ওর ভাবমূর্তি, ওর চরিত্রকেই বা কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করতে পারলই বা কী করে? ওর অন্যায়টা না হয় ছিল হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে দিলিশার উপস্থিতি ভুলে গিয়ে মাহির গায়ে হাত তুলে ওকে অপমান করা। সেখানে মাহি হয়তো বিপরীতে ওর গায়ে হাত না তুললেও নিজের পরিবারের কাছে ওকে কদর্য, চরিত্রহীন রূপে পরিচয় করিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আজও নাহিয়ান তাকে তেমন চোখেই বিচার করে। মূল রাগ আর অভিমানটাই তো তৈরি হলো এই থেকে। ও তো বিসর্জন দিতেই চেয়েছিল আজকের এই সাফল্যকে৷ দশ বছর বুকে আগলে রাখা স্বপ্নকে, লক্ষ্যকে ঘিরে যে ভালোবাসা ছিল সেই ভালোবাসাকে বলিদান করতে চেয়েছিল তিন মাসের ভালোবাসার কাছে। লন্ডন চলে যাবার পর মাহির কলটা আসলেই প্রচণ্ড অভিমানে ফোনটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখত।
নিজেদের অনিচ্ছাতেই ওরা নিজেরাই দিলিশার মতো তৃতীয় ব্যক্তি মানুষটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিল৷ অথচ সেখানে সব থেকে জরুরি ছিল ওদের মাঝে বিশ্বাস আর পরিণত বুঝটা৷ কারও মাঝেই এই বিশেষ গুনদু’টি ছিল না তখন৷
স্রেফ একটা মাস পরই ওরা ধীরে ধীরে নিজেদের কর্মজীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যায়। আশফিকের সফলতার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি জরুরি ছিল ধৈর্য আর মনোনিবেশ। এবং সেই সাথে বন্য জীবনটাতে মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ। একটা নিখুঁত ছবি ক্যামেরাতে বন্দি করতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন এমনকি মাসের পর মাসও অপেক্ষা করতে হয়৷ এই অপেক্ষাটায় ধৈর্যের পরিচয়৷ যার মাঝে অন্য কোনো চিন্তাভাবনার জায়গায় নেই৷ মাহিকে ভুলে থাকতে এই কর্মজীবনটাই যথেষ্ট ছিল ওর জন্য। সেক্ষেত্রে মাহির বেলাতে ওকে ভুলে থাকা আরও বেশি সহজ ছিল। একের পর এক ট্রেনিং, মিশন, এক দেশের আকাশ থেকে আরেক দেশের আকাশে বিচরণ। আশফিককে মনে করার ফুরসৎ কই ওর জন্য? তবে চাইলেই সম্ভব ছিল দু’জনের বেলাতেই। কেউ-ই দিন শেষে ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে এক সময়কার প্রিয় মুখটি মনে করেনি শুধুই নিজেদের আত্মগরিমাকে অগ্রাধিকার দিয়ে। এই আত্মগর্ব আর অভিমানের খেলাতে একটুখানি হলেও মাহিই এগিয়ে ছিল৷ বছর ঘুরে যখন ওদের বিবাহের দিনটা দেওয়ালপঞ্জিকাতে দেখত আশফিক– একটু ক্ষণের জন্য হলেও সকল মান, গরিমা, দ্বিধা ছেড়ে মাহির কাছে মনটা ছুটত ওর৷ ওদিকে মাহি বিবাহ বার্ষিকীর প্রতিটা দিনই ভুলে বসে দিব্যর সঙ্গে গল্পে মেতে থাকত, নয়তো মুক্ত আকাশে বিচরণ করত। আশফিক ক্ষণিকের জন্য ম্মৃতিকাতর হলেও ফটোগ্রাফি ক্যারিয়ার তখন তুঙ্গে ওর। সেই মুহূর্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য ওয়াশিংটন ছেড়ে দেশে চলে আসলে তবে সকল কষ্টই বৃথা যেত। বলা জরুরি, লন্ডন থেকে ফটোগ্রাফির ওপর কোর্স সম্পূর্ণ করে নিজের লক্ষ্যের পিছে দিবানিশি পরিশ্রম করে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে সে। এবং ওই মুহূর্তে নিজের পেশাকেই গুরুত্ব দেয়। মায়ের সাথে কথা বলার ফাঁকে অপ্রত্যক্ষভাবে প্রায়শই মাহির খোঁজটা নেবার ত্রুটি রাখেনি। আসমান আরা জাওয়াদ সাহেবের থেকে যতটুকু জানতেন ততটুকুই ছেলেকে জানাতেন। অন্য কাউকে বিয়ের করার প্রবণতা মাহির নেই– এমন কিছু শোনার প্রত্যাশাই আশফিকের হতো। কিন্তু মাহি তার পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে জানিয়েছিল, জীবনটা নিজের মতো ক’বছর উপভোগ করে তবেই নিজের পছন্দমতো কোনো ছেলেকে সে সঙ্গী করবে৷ বাবার কোনো পছন্দকে সে আর গ্রহণ করবে না। এ কথাগুলোই দীর্ঘ চার বছর বিদেশ বিভুইয়ে আশফিকের কাটিয়ে দেবার পেছনে দায়ী। তবে যে দিলিশা ওদের সম্পর্কের ফাটল তৈরি করেছিল সেই দিলিশাই মিলিত হবার অভিপ্রায় হয় একদিন। চার বছর পর সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ আশফিকের কাছে দিলিশার শাড়ি পরে এসে মাহির মতোই প্রণয়ের প্রস্তাব দেওয়া, ওদের দু’জনের পছন্দনীয় সেই একই গান, সব কিছু মিলিয়ে স্মৃতিবেদনাতুর হয়ে পড়ে ও৷ পাগলপ্রায় আশফিক মাহির সঙ্গে সংযুক্ত হবার জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা চালায় লন্ডন থেকে। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় যখন, তখন ছটফট করতে করতে অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় ও– নিজের লক্ষ্যের পিছে চারটা বছর তো ছোটা হলোই। এবার না হয় বউয়ের পেছনে ছোটা হোক!
নিকষ ভূতূড়ে আঁধারে জঙ্গলের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ জীবজন্তুর নানারকম আওয়াজে আজ মাহির উপলব্ধি হচ্ছে বন্য জীবনটায় দিনাতিপাত করার জন্য জঙ্গলপ্রেমী হওয়া আবশ্যক। যেমনটা আশফিক বরাবরই পাহাড় আর জঙ্গলপ্রেমী। আজ আশফিকের সাথে বসে মাথার ওপর লক্ষ লক্ষ তারার মেলা দেখতে দেখতে আর জঙ্গলের মাঝে ঠান্ডায় আগুনের তাপে উষ্ণতা অনুভব করতে করতে এক চমৎকার অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হলো মাহি৷ মন চাইছে সত্যিই এবার আশফিকের হাতটা ধরে ও-ও ছুটে চলুক জঙ্গলের গহীন থেকে গহীনে৷ কিন্তু শীতটা যতখানি বাড়ছে ততখানি আগুনের থেকে উষ্ণতা মিলছে না৷ এবার খেয়াল হলো কাঠ-খড়ি পুড়ে ছাই৷ আরও প্রয়োজন ওদের। আশফিকের দিকে লক্ষ করল, সে নির্জীব মানুষের মতো বসে আছে ছাইগুলোতে চেয়েই৷ এমন মলিনতা দেখে ওর ইচ্ছা করল আশফিকের মাথাটা নিজের কাঁধের ওপর টেনে নিতে। সে চায়নি নিজের ভেতরে পুষে রাখা কষ্টগুলোর বহিঃপ্রকাশ হোক আশফিকের কাছে। আশফিকের জন্য অতীতে এবং বর্তমানে ওর অনুভূতি কতটুকু ছিল আর আছে, সেটার প্রকাশও করতে চায়নি৷ কারণ, যে দায়িত্বের শিকলে বাঁধা পড়ে গেছে ও সেখান থেকে স্বাভাবিক এক সুখী সংসারের স্বপ্ন ওর জন্য অধরাই থেকে যাবে। আশফিকের কোনো প্রত্যাশা ও পূরণ করতে পারবে না কখনোই।
একটা সময় নীরবতা ভেঙে আশফিক বলল, ‘তাহলে তোমার সিদ্ধান্তটা জানাও, মাহি। আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের বোঝা তোমাকে বয়ে বেড়াতেই হচ্ছে। আজ না হোক কাল তুমি কাউকে না কাউকে পাশে চাইবেই সহযোদ্ধা রূপে৷ তার আগে এই সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটানো অতিব জরুরি, কী বলো?’
সব থেকে নিষ্ঠুর ছিল এই কথাগুলোই৷ আশফিক গভীর মনঃব্যথা আর অভিমান থেকে বললেও কথাগুলো ভুল বলেনি। মাহি চায় আশফিক ঝুট-ঝামেলা ছাড়া একটা সুন্দর জীবন গঠন করুক৷ এই দেড়-দুই মাসে আশফিকের প্রতি অভিমানটা কমে এসেছে তা বুঝতে পারে ও। কিন্তু জীবন থেকে যে মূল্যবান চারটা বছর হারাল তা যে ফিরে আসবে না৷ এই চার বছরে ওর জীবনের ধারাটাই তো বদলে গেল।
-‘কাউকে আমার জীবনের সাথে জড়াব কি জড়াব না সে বিষয় তো পরে। তবে আমার আর তোমার পথ সত্যিই আলাদা হয়ে গেছে৷ আমরা যদি সব কিছু ভুলে এগিয়েও যাই, বছরের আটটা মাসই আমাকে দেশের স্বার্থে নিয়োজিত থাকতে হবে৷ বাকি তিন চারটা মাসও যে নিশ্চিন্তে আমোদ প্রমোদে কাটাতে পারব তা নয়৷ একজন এনএসআই এর প্রতিনিধি হিসেবে সেটাও সম্ভব না।’
আশফিক ক্লেশিত হেসে শুধাল, ‘এনএসআই এর প্রধান কি অবিবাহিত, মাহি?’
নিরুত্তর থাকতে বাধ্য হলো মাহি এ প্রশ্নে। তা বুঝে আশফিক মলিন হেসেই বলল, ‘আমাকে গ্রহণ না করতে চাইবার বাহানাটা দিয়ে না চাইতেও আঘাতটা বেশিই করলে তুমি। ওয়াশিংটন থাকতে ওখানকার একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা তার জীবনের সিনেমাটিক এক গল্প শুনিয়েছিল৷ ভিন্ন দেশের এক ছদ্মবেশী এজেন্টের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তিনি যেদিন জানতে পারলেন তার প্রেমিক পুরুষটা অন্য দেশের এজেন্ট। স্রেফ দেশের স্বার্থে তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছে, সেদিন তিনি তার ফেইক লাভারকে বলেছিলেন “বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা মৃত্যৃতুল্য। তুমি আমাকে খুন করতে চাও বরং খুন করেই পরিপূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা করো৷ ডিউটি ফুলফিল করা অবশ্যই তোমার নৈতিক দায়িত্ব৷ সেক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতাও পরিপূর্ণভাবে করা তোমার দায়িত্ব। শুট মি, মাই লাভ৷” তার বিশ সেকেন্ডের মাথায় সেই ছদ্মবেশী শুট করেছিল তাকে৷ এরপর দীর্ঘ সাত বছর পর যখন সেই ছদ্মবেশী ডিউটি থেকে অবসর পায়, সেই সময় আবার ছুটে আসে সেদিন আহত অবস্থায় ফেলে যাওয়া প্রেমিকার কাছেই। প্রেমিকাও বিনাবাক্যে তাকে গ্রহণ করে নেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন তার ছদ্মবেশী শেষ বয়সে হলেও ফিরবে৷ এর পরও তিনি কেন তাকে গ্রহণ করলেন জানো? দু’জনই দেশপ্রেমী। দু’জনই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট। সেই সাথে ভালোবাসাকেও স্বীকৃতি দিতে পিছুপা হয়নি ওরা। আমার বেলাতে আমি ছদ্মবেশীর মতো অত বড়ো অপরাধী কিনা জানি না। সে ক্ষমা পেলেও আমি হয়তো ক্ষমার অযোগ্য।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আশফিক তাই বলে দিলো, ‘মৌখিক তালাকই যথেষ্ট আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে। যেহেতু আইনি স্বীকৃতি নেই। আর বিচ্ছেদ যখন হবেই দেরি করে আমার আকাঙ্ক্ষা আর বাড়াতে চাই না। তুমি শুনতে প্রস্তুত, মাহি?’
অন্তর প্রদেশে কেয়ামত নেমে এলো যেন মাহির, কথাটা শুনেই। হ্যাঁ, এটাই চাওয়া ছিল ওর৷ কিন্তু আশফিকের মুখে তালাক শব্দটা শোনার ক্ষমতা কি আদতে হবে?
দু’জন দু’জনের অস্তিত্ব অনুভব, আর কথাটুকু শোনা ছাড়া কেউ কারও মুখটা দেখতে পাচ্ছে না৷ আশফিক তবুও মাহিকে দেখবার বৃথা চেষ্টা করে ওর দিকে দৃষ্টিপাত করে শুধাল, ‘তুমি কি আরও কিছু বলতে চাও? তুমি আজ যা চাইবে তা-ই হবে।’
বলেই আশফিক উঠে পড়ল৷ ফোনের আলোটা জ্বালিয়ে আশপাশ থেকে খড়কুটো কুড়িয়ে আনার বাহানায় নিজের অসহনীয় যন্ত্রণার কাতরানি আড়াল করতে পালাল৷ মাহি বসে এক নিষ্প্রাণ প্রস্তরে পরিণত হলো বোধ হয়। ঠিক চার বছর পূর্বের মতোই আকস্মিক দু’হাতে মুখ চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল। কতক্ষণ পার হয়ে গেল যেন কান্নার মাঝে৷ আশফিক লাকড়ি সংগ্রহ করে ফিরল। মাহি ওর উপস্থিতি বুঝে দ্রুত চোখ-মুখ মুছে নিলো। বসে পড়ে আগুন জ্বালানো শেষ করেই আশফিক মাথা তুলে পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করল মাহির চোখে৷ মাহিও আকুলতায় চেয়ে ছিল ওর পানেই৷ এগিয়ে এসে ওর খুব কাছে এসে আশফিক বসতেই ও জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বলতে পারবে তো?’
আচমকা জড়িয়ে ধরল আশফিক ওকে, ফিসফিস করে বলল, ‘যদি বলো এটাই আমাদের শেষ আলিঙ্গন তাহলে এভাবেই তোমার কানেকানে উচ্চারণ করব।’
কথাটা বলার শেষ মুহূর্তেই আশফিকের পুরো শরীরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল কেমন অদ্ভুতভাবে। মাহি কান্নার দমক এবার লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আশফিককে। পিঠের ওপর হাতদু’টো মেলে আঁকড়ে ধরতেই আশফিকের কাঁধের নিচে খুব গরম, তরল পদার্থ হাতের মাঝে চিটচিট করে উঠল। কী হতে পারে তা বুঝে উঠতে উঠতেই আশফিক নিস্তেজ শরীরটার সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিলো ওর গায়ে ওপর। বুকের ভেতরটায় আচমকা শিউরে উঠল মাহির। ভীত, কম্পিত স্বরে ডেকে উঠল, ‘অ্যাই! আশফি?’ ওর থেকে কোনো জবাব এলো না চকিতে।
আপনারা কি জানেন আমি একটা পর্বকে দুই অংশে দিই? প্রতিদিন পর্ব দেবার অনুরোধ ছিল আপনাদের। আমিও তাই ২৫০০-৩০০০ শব্দের একটা পর্বকে ভেঙে দুইটা ভাগে দিচ্ছি। আমার পক্ষে তো সম্ভব নয় এখন প্রতিদিন ২০০০-৩০০০ শব্দের একটা পর্ব লেখার। আমার ব্যস্ততা আমি প্রায়ই উল্লেখ করি পর্ব শেষে৷ এরপরও না বুঝলে যদি প্রতিদিনই উল্লেখ করতে হয় ব্যস্ততার কথা তাহলে আপনারাই একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে যাবেন। তাছাড়া আমার হাতে #বইমেলার পাণ্ডুলিপির কাজটাও রয়েছে। সময় পেলেই সেই সময়টুকু লেখার পিছে দিচ্ছি৷ গত এক সপ্তাহ ধরে এই ধারাবাহিকের সঙ্গে #ইবুক এর জন্য একটা ছোটো গল্প রেডি করলাম। সব এক সঙ্গে মেইনটেইন করতে গেলে বেশি বড়ো করে পর্ব লেখা সম্ভব নয় আমার জন্য। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো ৩৭ পর্বে গল্পের সমাপ্তি ঘটবে। আমার পরিকল্পনা মোতাবেকই হবে সমাপ্তি৷ আর অবশ্যই তা যুক্তিসম্মত। তাই আপনারা নিজেদের চাওয়া বললেও আমি আমার পরিকল্পনাতেই অটুট থাকব।
ইসরাত জাহান দ্যুতি
রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩০.২
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। এবং কপি অবশ্যই অবশ্যই নিষেধ]
কাছেপিঠে কোথাও বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে। তার বিকট শব্দ পুরো জঙ্গল কাঁপিয়ে তুলল। সারা বনে কত কত পশু পাখি, আশেপাশে কত মানুষের বাস! এদের জানগুলো যেন উপরওয়ালা রক্ষা করেন। মনেমনে প্রার্থনা করতে করতে আশফিকের হাতটা নিজের কাঁধের ওপর নিয়ে ওকে ধরে ধরে এনে মাহি বসাল সেই খাদটার কাছাকাছি। আশফিক খুব শিঘ্রই হয়তো চেতনা হারিয়ে ফেলবে, ও বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি পারো প্রশাসনের কাছে হেল্প চাও। ওখানে আমার বন্ধুগুলো আর অন্যান্যরাও বিপদে আছে আমার বিশ্বাস। ওদেরকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করো জলদি। তোমার ডিউটি শুরু৷ আমাকে ছাড়ো আর কর্তব্য পালনে প্রস্তুত হও। জঙ্গলেই তোমার শত্রুরা ঘাপটি মেরে আছে।’
-‘জানি না ওখানে কী ঘটছে। কিন্তু আমারও মনে হচ্ছে ওরা সেইফ নেই। তোমাকেও এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারব না। ছুরিটা বের করা গেলেও ওটার সাথে কোনো পয়জন ছিল৷ যার জন্যই তুমি এভাবে নেতিয়ে পড়ছ। ওটা কতটা বিষাক্ত সেটা নিয়েই আমার টেনশন।’
স্তিমিত কণ্ঠেই আশফিক বলল, ‘যা হয় ভালোর জন্যই হয়৷ টার্গেটটা তুমি ছিলে এটা শিওর। তোমাকে আজ পুরো জানে মেরে দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ওরা চেয়েছিল হয়তো তুমি ধুঁকে ধুঁকে মরো। কঠিন কোনো ক্ষোভ তোমার প্রতি ওদের। আরেকটা ভালো হলো, আজ হয়তো বিচ্ছেদটা ঘটেই যেত আমাদের৷ এই বিপদের অসিলায় ওই বিপদটা কেটে গেল, তাই না?’
-‘প্লিজ আশফি। ওই প্রসঙ্গই আর তুলবে না। আগে এটা বলো, তুমি কি বুঝতে পেরেছ খুব ক্ষতিকর পয়জন ছিল ছুরিতে?’
-‘হুঁ, বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। হয়তো আর দশটা মিনিট। এরপর আর সেন্সে থাকতে পারব না আমি। এর মাঝেই হয় তোমাকে আমাকে ফেলে ওদের কাছে যেতে হবে আর শত্রুদের মোকাবিলা করতে হবে৷ নয় এমার্জেন্সিভাবে তোমাকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এখানে বসেই।’
-‘আমি দেখছি।’
আশফিককে মাহি বুকের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে ফোনের এমার্জেন্সি নাম্বারটাতে কল করল। বুকটা ঢিপঢিপ করছে ওর আশফিকের খারাপ কোনো ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। এই বিপদটা জেনে-বুঝেই ডেকে এনেছে ও। অনিলের হঠাৎ উদয় হওয়াটা একদমই যে স্বাভাবিক ছিল না তা তো বুঝেছিলই৷ যার জন্য ক্যাম্পিংটা যাতে সুরক্ষিতভাবে সবাই উপভোগ করতে পারে সেই ব্যবস্থাও ঘণ্টা তিনের মধ্যে করে ফেলে ও। তারপরও নিজের আঘাতটা আশফিকের শরীরে লেগে যাওয়াতে আর বোমা হামলাতে কষ্ট, দুশ্চিন্তার পাশাপাশি বিভৎস রাগে শরীর চিড়বিড় করছে ওর। নৃশংস এক প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠছে। পাকাপোক্তভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে এলেও ছোটোখাটো একটা ব্যাকআপ তো আছেই। কিন্তু জঙ্গলে কারা ঢুকেছে, কতজন আছে, সেটা মারাত্মক দুশ্চিন্তার বিষয়। ওপাশ থেকে কলটা ধরতেই সেই ব্যক্তিটা অধীর গলায় শুধাল, ‘ম্যাম, আপনি ফোন তুলছিলেন না কেন?’
-‘আশফিক ইজ ইনজুরড, আসিফ। ওকে দ্রুত হসপিটালাইজ করতে হবে। বিচে ওরা কি ঠিক আছে?’
-‘এটা জানাতেই কল করছিলাম বারবার। হেলিকপ্টারটা দেখার পর আপনি আমাদের জানাতেই আমরা নজরে রাখি ওটা। কিন্তু এটা সম্পূর্ণই আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য। যাতে ক্যাম্পিংয়ের পাশটা থেকে আমাদের অ্যাটেনশন ব্রেক হয়। এই সুযোগেই আশেপাশে থেকেই কেউ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তবে সেটা ভয়াবহ পর্যায়ের না হলেও ক্যাম্পের মাঝে যারা ছিল তারা সিরিয়াস ইনজুরড। চারপাশ থেকে সবাই দৌঁড়ে এসে ওদের উদ্ধার করেছে। তখনই আবার বিচের কাছের জঙ্গলটাই আরেকটা ব্লাস্ট হয়। সেটা দেখেই বাকিরা সবাই খুব ভয়ে আছে। আপনাকে উপর থেকে এ জন্য ভালো প্রেশার দেবে ম্যাম।’
মাহি সত্যিই খুব দুশ্চিন্তায় ঘামতে শুরু করেছে৷ তবে সেটা নিজের জন্য নয়। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য আর সব থেকে বেশি আশফিকের জন্য। নিজের আত্মাকে একটু প্রশান্তি দিতে এসে সবাইকে কেন বিপদের সম্মুখীন করল ও?
-‘আমাকে নিয়ে ভাবছি না। ওদেরকে হসপিটালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে? কতজন ক্ষতিগ্রস্ত?’
-‘হ্যাঁ, আমরা এখানের পুলিশের সহায়তায় এদিকটা সামলে নিয়েছি। পাঁচজন ৷ তিনজন মেয়ে, দু’জন ছেলে। আপনাদের রেসকিউ করতে আমি আগেই সেফটি টিম পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনার ফোনের জিপিএস এর সহায়তায় খুঁজে নিয়েছে ওরা আপনাকে। খুব বেশিক্ষণ না। আর মাত্র পাঁচটা মিনিটের মধ্যেই আপনারা বেরিয়ে আসতে পারবেন। আপনাদের আশেপাশে যারা ছিল তারা অলরেডি স্থান ত্যাগ করেছে আমাদের এগজিস্টেন্স বুঝে।’
-‘ওরা কেন পালাল? আমি তৈরি ছিলাম ওদের মোকাবেল করতে।’
-‘আপনার সাথে যুদ্ধ করতে ওরা নামেনি ম্যাম। খুব কৌশলে ওরা প্ল্যানটা করেছে আপনাকে জাস্ট আমাদের অথোরিটির তোপের মুখে ফেলতে। আর এটা একান্তই আপনার ওপর ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে বলে মনে হচ্ছে।’
-‘হুঁ, বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে রাখছি। সবটা কেয়ারফুলি সামলাও।’
আশফিকের দিকে নজর দিলো মাহি৷ দশটা মিনিটও নয়, মাত্র চার মিনিটের মাঝেই আশফিক জ্ঞান হারিয়েছে। সজাগ থাকলে বন্ধুদের অবস্থা জানতে মরিয়া হয়ে উঠত। মাহিও মন থেকে সাহস পেলো না পরাগদের মাঝে কেউ আহত হয়েছে কি না তা জানতে চাইতে।
ওর আদেশে জরুরিভাবে জেট প্লেন করে আশফিককে নিয়ে যাওয়া হলো হসপিটাল। খিচুনি উঠে গিয়েছিল ছেলেটার। বিষটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে প্রায়৷ কতটা ক্ষতিকারক বিষ তা জানার সুযোগ হয়নি মাহির। বুকটা ফেটে আসছিল শুধু আশফিককে নিষ্প্রাণের মতো পড়ে থাকতে দেখে। এছাড়া যে পাঁচজন আহত হয়েছে তারা কে কে সেটাও জানার সুযোগ হয়নি ওর। শুধু জানা গেছে তাদের অবস্থাও খুব শোচনীয়।
______________________________
ঢাকা সেগুনাবাগিচায় ফিরে এনএসআই এর প্রধান কার্যালয়ে এসে ডিরেক্টর জেনারেলের অফিস কক্ষে বসে আছে মাহি। মেজর জেনারেল সাইফুল হকসহ আরও কিছু ইনটেলিজেন্স অফিসারও আছেন। সবাই অপেক্ষা করছেন সচিব সমমান জিহাদ কবিরের (জে.কে.) জন্য। যার সাথে সম্পর্কটা মাহির বাকি সবার থেকে অনেক বেশিই অন্যরকম। বলা জরুরি, আজকের মাহি গড়ে উঠেছেই তার হাতে।
অপেক্ষার প্রহর শেষ করে ছ’ফুট উচ্চতার মধ্যবয়স্ক একজন বলিষ্ঠ পুরুষ এলেন। তিনিই এনএসআই এর কাউন্টার টেররিজম উইংস এর প্রধান কর্মকর্তা জিহাদ কবির। সবাই দাঁড়িয়ে উঠে তাকে সম্মান প্রদর্শন করতেই তিনি রুদ্র চাউনি ছুঁড়লেন মাহির দিকে। মাহি নত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে তখন।
নিঝুম দ্বীপ বর্তমানে বহুল পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র বাংলাদেশের। সেখানের জঙ্গলের পশু পাখিগুলো সেই পর্যটন কেন্দ্রের সম্পদ৷ আর সেই জঙ্গলের ক্ষতি এবং মাহির ইচ্ছাকৃত অসতর্কতার জন্য পাঁচজন মানুষ মৃত্যুমুখে এবং জিহাদ কবিরের আদেশ অবজ্ঞা করার জন্য এর শাস্তি কতটা বিশাল হতে পারে সবাই সেটাই ধারণা করছে। তবে তার আগে আলোচনা করা হলো দেশে দুইদল মাফিয়া সংগঠনে যুক্ত ছদ্মবেশীদের যেখানে সেখানে আবির্ভাব ঘটা নিয়ে। যার সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দলের বড়ো বড়ো কিছু নেতা। তাদের মাঝে অনিল প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। শুধু প্রমাণের অভাব। মাস ছয় আগে মাহি নেত্রকোণায় একটা অপারেশনে গিয়েছিল। সেখানে শিশু পাচার চক্রকে ধরতে গিয়ে বিনা পরিকল্পনায় এবং ঠান্ডা মাথায় বড়ো বড়ো তিনজন অপরাধীকে এনকাউন্টার করে দিয়েছিল। সেই থেকেই ওই চক্রের মূল লিডার অর্থাৎ অনিলের রোষের শিকার মাহি। অবৈধ কাজের সূত্রে অনিল পরবর্তীতে নেপাল মাফিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই মাফিয়া দলটি একদমই নতুন৷ কিন্তু তাদের লক্ষ্য এবং লক্ষ্য পূরণে কার্যক্রম খুবই ভয়াবহ। আরেকদল মাফিয়া এ দেশেরই। যারা ওই নেপাল মাফিয়াকে এ দেশে কাজ চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে। তাদের কাজই মাদক পাচার, মানব পাচার, চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র পাচার।
মাহি শেষ দু’বছরে যতগুলো অপারেশনে গিয়েছে সব অপারেশনই সফলতা এসেছে। আর সেই অপারেশন করতে গিয়ে ওকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে। কিন্তু নেত্রকোণায় এনকাউন্টার করবার সময় ওর সঙ্গে পুলিশের কর্মকর্তারাও ছিল ক’জন৷ তাদের মাঝেই কেউ বা কারা পরোক্ষভাবে জড়িত অনিলের সঙ্গে। নয়তো ওর জানবারই কথা নয় মাহির হাতেই ওর তিনজন সেরা কর্মী নিহত হয়েছে। আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা শেষে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন জিহাদ কবির। সরকার থেকে খুব চাপ এসেছে এনএসআই সংস্থার ওপর। নিঝুম দ্বীপের বোমা বিস্ফোরণের দুর্ঘটনা শুধুই কি এনএসআই এর এজেন্টের ওপর ব্যক্তিগত ক্ষোভের জন্য না কি জঙ্গিরাও জড়িত এর সাথে তা অতি দ্রুত খতিয়ে দেখার আদেশ করা হয়েছে৷ যদি তাই হয় তবে দেশের সব পর্যটন এলাকা সুরক্ষা রাখবার ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং জঙ্গি গোষ্ঠীকে ক্রসফায়ার- এনকাউন্টার করে দেবারও অনুমতি দিয়েছেন সরকার।
সবাই বিদায় নিলেও তিনজন নারী ইনটেলিজেন্স অফিসার থেকে গেল অফিস কক্ষে৷ তাদের মাঝে মাহিকে উদ্দেশ্য করে জিহাদ কবির বাকি দু’জনকে আদেশ করলেন, ‘টর্চার চেম্বারে নিয়ে ওকে খেদমত করার দায়িত্ব তোমাদের। এখন বাজে বেলা তিনটা। ঠিক সন্ধ্যা ছ’টা অবধি চলবে বিরতিহীন, পানিও পাবে না ও।’
মাহিকে নিজের পক্ষে এক বাক্য বলার সুযোগ না দিয়ে জিহাদ কবির গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলেন৷ তবে যাবার সময় মাহির নতজানু মুখটাই বিষণ্নতা দেখে তিনি আরও রেগে গেলেন। তখন বলে গেলেন, ‘এটা কেবল প্রাথমিক পর্যায়। পরবর্তী পানিশমেন্টের জন্য যাতে মানসিক এবং শারীরিক কষ্ট খুব বেশি না হয় তার জন্য প্রস্তুত করে নেবে নিজেকে।’
টর্চার চেম্বারে মাহিকে আনার পর থেকে তিন ঘণ্টার এক মিনিটও ছাড় দোয়া হয়নি ওকে। হাতে মোটা দণ্ড নিয়ে দু’জন সহকর্মী লাগাতার আঘাত করে গেছে সর্ব শরীরে ওর। শরীরের জায়গায় জায়গায় কেটেছেটে গেছে, ছেঁচেও গেছে। অস্থিমজ্জাতেও তীব্র ব্যথায় চিৎকার করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ। তবু এক বিন্দু পানিও দেওয়া হয়নি। মাহিও মুখ ফুটে চায়নি, সহকর্মী দু’জনকেও থামতে বলেনি। এই শাস্তির একটাই কারণ, জিহাদ কবিরের আদেশ-নিষেধ অমান্য করা। শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়ার শাস্তি শেষে তারাই দু’জন ওকে সেবাশুশ্রূষার দায়িত্ব নেয়।
এর মাঝে কেটে যায় টানা একদিন৷ মাহিকে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ খেয়ে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে৷ আশফিক বা বাকি আহত পাঁচজন কারও অবস্থায় সরাসরি গিয়ে দেখে আসার সুযোগ হয়নি ওর। তবে জানতে পেরেছে ওই পাঁচজনের মাঝে তিথি নামের মেয়েটি আর সাদিয়া আছে। সাদিয়ার শরীরের চল্লিশ শতাংশ পুড়ে গেছে, তিথি মেয়েটা দৃঢ় মনোবলের হওয়াই কেউ উদ্ধার করতে আসার পূর্বেই ও ছুটে সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল বলে বিশ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে শরীরের। বাকি তিনজনের মাঝে এক জনের বিস্ফোরণে ডান পা’টাই উড়ে গেছে। লাইফ সাপোর্টে সে। অন্য দু’জনের অবস্থা সাদিয়ার মতোই। আর আশফিক! তার খবরটা ইচ্ছাপূর্বক জানতে দেননি জিহাদ। এই শাস্তিটাও কেবল মানসিক শাস্তির প্রাথমিক পর্যায়। মাহি মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছে। সবটাই মহান সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আশফিক সুস্থ হলে যদি সাদিয়ার খবরটা জানতে পারে ওর কেমন লাগবে কে জানে! তবে মাহি শোনার পর ওর ভাবনচোখে কেন যেন ভেসে ওঠে সেই অবিরাম বৃষ্টিদিনের সন্ধ্যাক্ষণের মুহূর্তটা। আজ সন্ধ্যায় জিহাদ কবিরের ব্যক্তিগত নিবাসে ওকে যেতে হবে। তার আগে ওকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষবারের জন্য দেখা করে আসতে। তবে আশফিকের কাছে যাবার অনুমতি নেই। আপাতত বাড়িতেই যাচ্ছে সে এই মুহূর্তে।
__________________________________
অতীতের স্মৃতি পাতায় সেই দিনটাই ভীষণ জ্বরে আশফিক ছিল চৈতন্য হারা প্রায়। আসমান আরা তখন ভাইদের কাছে লন্ডন বেড়াতে গেছেন। সাথে জাওয়াদ সাহেবও। ছেলের দুর্দান্ত জ্বরের কথা শুনে বোনদের কাউকে আশফিককে দেখতে যাবার কথা বলার থেকে মাহিকে জানানোটা বেশি উপযোগী বলে মনে করলেন তিনি। ঢাকার আকাশ তখন শরতের চনমনে রোদের স্থানে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারায় মুখরিত৷ পরাগদের দলটা ফোনে আশফিকের অসুস্থতার খবর শুনে ওরা পরিকল্পনা করেছে সারা সন্ধ্যা ওরা আশফিকের বাসাতেই আড্ডা জমাবে আজ। সাথে আশফিককেও দেখেশুনে রাখা যাবে৷ ওদিকে আসমান আরার ফোন পেয়ে আশফিককে কল করে মাহি অবিলম্বে। ক’বার বেজে বেজে কেটে যায়। শেষবারের সময় আশফিক ধরতেই কী সব এলোমেলো কথা বলে যায় যেন। তা শুনে বৃষ্টির আন্দোলনকে তুচ্ছজ্ঞান করেই মাহি চকিতে রওনা হয় গুলশানের ২ এর পানে।
আশফিকের পাশের এলাকাতেই প্রথমে হৃদয় তারপর সাদিয়ার বাসা। কথা ছিল হৃদয় আর সাদিয়া একত্রে আসবে। কিন্তু হঠাৎ কোনো কাজে আটকা পড়ে যাওয়াই হৃদয় পরে আসবে জানিয়ে সাদিয়াকে একাই চলে যেতে বলে। এরপর সবার মাঝে সাদিয়াই সবার আগে আশফিকের বাসায় এসে পৌঁছয়। বাড়ির কাজের লোকগুলো কাজ সেড়ে চলে গেছে বিকালেই। সাদিয়া যখন আসে তখন গোধূলি বেলা।
আশফিকের ঘরটায় জানালা খোলা, বৃষ্টির ছাট এসে ঘরে না পৌঁছলেও পাগল হাওয়ার তোড়ে ধূসর সাদা রঙের পর্দাটা এলোমেলো গতিতে উড়ছে৷ বিছানা থেকে জানালাটা খুব বেশি দূরে নয়। আশফিক খোলা শরীরটাই অর্ধেক অবধি কম্বলটা টেনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে প্রবল ঠান্ডায়, ক্ষীণস্বরের আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে ভাঙা কণ্ঠ থেকে। আরও উষ্ণতা প্রয়োজান তার। ধরাধামের বুকে তার শরীরটা থাকলেও সেই শরীরের আত্মাটা না আছে হুঁশে আর আছে না বেহুঁশে। সাদিয়া প্রায় আঁধারে নিমজ্জিত ঘরটাতে ঢুকেই হালকা উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে, ‘আশফিক? কীরে ঘুমোচ্ছিস না কি?’
সাড়া মেলে না আশফিকের থেকে৷ ও এগিয়ে এসে আশফিকের মাথার কাছটাতে বসে, ‘ওই ছেলে! জ্বর কি বেশি না কি তোর?’
মেয়েলী কণ্ঠের ডাকটা আশফিকের কান অবধি পৌঁছলেও ওর ইন্দ্রিয় ক্ষমতা বুঝতে অক্ষম সেই মেয়েটি কে। অবচেতনই ও প্রত্যাশা করে আছে মাহি ওর কাছে এসেছে৷ যার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক আগেই প্রলাপ বকেছে, যখন ফোন করে মাহি। বিড়বিড় করে বারবার বলতে থাকল, ‘কম্বলটা জড়িয়ে দাও মাহি, শীত যাচ্ছে না। আম্মুকে ডাকো তো একটু। মাথা যন্ত্রণা করছে।’
সারা শরীরে শীতে কাঁটা দাঁড়িয়ে গেছে আশফিকের। ওর অল্প লোমবহুল চওড়া বুকটার ওপর থেকে কম্বলটা গলা অবধি টেনে দিতে গিয়ে সাদিয়ার মনের ধর্ম পালটে গেল সহসা৷ কলেজ জীবনের শুরুতেই আশফিকের প্রতি ওর প্রথম দুর্বলতার জন্ম নিলেও বিপরীতে আশফিকের কাজেকর্মে আর মনে ছিল ওর জন্য শুধুই বন্ধুত্ব। যার জন্য সেই দুর্বলতা প্রকাশের সাহস আর হয়ে ওঠেনি ওর৷ এরপর এলো সৌরভ। বন্ধুত্ব থেকেই ধীরে ধীরে ওদের মাঝে প্রণয় প্রবণতা ধরা দেয় একটা সময়। কিন্তু আশফিকের প্রতি মুগ্ধতার রেশ কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাদিয়া। মাহি আশফিকের জীবনে আগমন নেবার পর থেকে না চাইতেও ওর বক্ষঃস্থলে ঈর্ষানল বারবার জ্বলে ওঠে।
বেদম জ্বরেও আশফিকের শুকিয়ে যাওয়া সারা মুখ, ডেবে যাওয়া চোখের নিচ, ঠান্ডায় লালচে নাকের ডগা আর চিকন সুন্দর ঠোঁটে নির্দ্বিধায় আঙুলে ছুঁয়ে দিতে থাকে সাদিয়া। মাহি আর আশফিক যখন একাকী সময় কাটায় তখন মাহিকে কেমন করে ভালোবাসে তা স্বচক্ষে দেখা না হলেও ও কল্পনা করতে থাকে। তবে বেশ ক’বার ওর চোখে পড়েছে মাহির ঠোঁটে, গলায় আশফিকের দেওয়া আদরের ক্ষতগুলো। অন্তর ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত ওর৷ সে সময়গুলো সৌরভের থেকে চূড়ান্ত মুহূর্তের ভালোবাসা নিয়েও ওর মনের তৃষ্ণা মিটত না৷ কাউকে বলতেও পারত না সে কথা।
নীচবৃত্তি যে মনের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে ছিল আজও তা আশফিককে একা এভাবে নিরালায় কাছে না পেলে বুঝতই না আশফিকের থেকে ভালোবাসা পাবার অদমনীয় আকাঙ্ক্ষা ওর কতখানি! দরজাটাও আধখোলা সেদিকে খেয়াল নেই সাদিয়ার৷ এ মুহূর্তে বাসায় কেউ নেই শুধু এতটুকুই মস্তিষ্ক স্মরণে রেখেছে ওর। গা থেকে ওড়নাটা খুলে একই কম্বলের নিচে আশফিককে জড়িয়ে ধরল ওর বুকের মাঝে। আশফিকের শরীরের উত্তপ্ততা ওর শরীরের বেহায়া অনুভূতিকে লাগামছাড়া করে তুলতেই আশফিককে বুক থেকে তুলে ওর সারা গলাতে যখন এলোমেলো চুমুতে ভরিয়ে তুলছিল, তখনই দরজার বাইরের ডানপাশে থাকা পুষ্পাধার পড়ে ভেঙে যাবার ঢাউস আওয়াজে চমকে ওঠে ও৷ এক ঝটকায় আশফিককে ছেড়ে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। ঘরের লাইটটা জ্বেলে আশফিককে ডাকতে থাকে। যেন সে মাত্রই এসে ডাকাডাকি করছে ওকে।
মাহি পায়ে ব্যথায় আহঃ উহঃ করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে আসে। সাদিয়া ওকে হঠাৎ দেখেই শুধায়, ‘তুমি কখন এলে মাহি? ব্যথা পেলে কী করে?’
মাহি উত্তর দেবার পূর্বে আশফিকের পাশে এসে বসল, ওর গায়ে কম্বলটা টেনে দিয়ে তারপর ব্যথা পাওয়া জায়গাটাই ডলতে ডলতে বলল, ‘সারা বাসায় অন্ধকার আপু৷ আমি নিচ থেকে আলো জ্বালাতে জ্বালাতে উপরে এসেছি৷ করিডরে এসে সুইচ খুঁজতে গিয়ে ফ্লাওয়ারপটে গুঁতা খাই৷ ওটা বোধ হয় ভেঙেই গেছে।’
সাদিয়া রাগে দিশাহারা। কষ্টেসৃষ্টে নিজেকে সামলে দারুণ অপ্রকাশ্য ক্রোধ কণ্ঠে শুধাল, ‘তোমার কি আসার কথা ছিল? আশফিক তো বলল না তখন তোমার আসবার কথা।’
-‘কখন কথা হয়েছে ওর সঙ্গে?’
-‘দুপুরে।’
-‘ওহ, আমার সাথে কথা হয়েছে এখানে আসার ঘণ্টা তিন আগে। এখন তো মাগরিবের আজান দিচ্ছে।’
-‘অপিরাও আসবে বলল। কিন্তু কাউকেই তো দেখছি না এখনও।’
মাহি আর কথা বাড়াল না৷ আশফিকের গায়ে হাত রেখে জ্বরের তাপমাত্রা দেখে বাথরুমে ছুটল। সাংঘাতিক জ্বর। আর ও এতক্ষণ আজগুবি মানুষের সাথে বসে বকবক করছিল! বালতি ভর্তি পানি টেনে এনে ঘরের মাঝে রাখতেই সাদিয়া এগিয়ে এলো সাহায্য করতে৷ মাহি ওকে বলল, ‘আপু, তুমি যদি কিছু মনে না করো ওর জন্য ভর্তা ভাত আর স্যুপটা রেডি করবে? যেটা খেতে চায় আর কী! ততক্ষণে আমি ওর মাথায় পানি ঢালি।’
-‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই।’
সেই মুহূর্তটাই সাদিয়া কয়েক পলের জন্য মাহির চোখে চোখ রেখে উত্তর দেবার সময় ওর শীতল চোখজোড়া দেখে নিজের কিছুক্ষণ পূর্বের অপরাধটার জন্য হঠাৎ ভয় হতে লাগল৷ ওর মনে হলো মাহি সবটাই দেখেছে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবার মতো আর সাহসটাই হলো না।
সেদিন আশফিক একটু সুস্থবোধ করতেই নিজের পাশে সকলকে দেখে খুশি হবার বদলে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিল৷ শুধু মাহিকেই নিজের কাছে প্রত্যাশা করছিল ও। হৃদয়দের সেটা মুখের ওপর বলে দিতেই ওরা কতক্ষণ দু’জনকে টিপ্পনী কেটে তারপর বিদায় নেয়। মাহি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আশফিক কাছে আসবার আহ্বান করবার পূর্বেই ও এসে অপ্রত্যাশিতভাবে আশফিকের বুকের কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। সত্যিই তখন ভীষণ অকল্পনীয় ছিল নিজে থেকে মাহির ধরা দেওয়াটা৷ অথচ যে সব সময়ই আশফিকের লাগামছাড়া আদর ভালোবাসার অত্যাচার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত, তার অনাকাঙ্ক্ষিত কাছে আসাটা জ্বর মস্তিষ্কে আশফিকের লেগেছিল মাহি ওদের বিবাহিত সম্পর্কের পূর্ণ পরিণতি দিতে ইচ্ছুক৷ পাগলামি ভালোবাসাতে মাতোয়ারা হতে গিয়ে মাহি সেদিন আটকানোর চেষ্টা করেছিল ওকে এ কথাতে, ‘জ্বর ছেড়ে ওঠার পর আজকের অনুভূতি কিন্তু উপলব্ধিই করতে পারবে না তুমি।’
আশফিক সে কথা কানে তুললে তো! সে তো বাত্যাবিক্ষুব্ধ উত্তেজনা আর অনুভূতির উন্মাদনায় মাহিকেও নিজেরই মতো অনাবৃত করতে যখন বেসামাল, মাহি তখন শিকারীর কাছে নিজে থেকেই ধরা দেবার মতো ওকে খুব শক্ত করে নিজের খোলা শরীরের সঙ্গেই জাপটে ধরে, কেবল সমস্ত লজ্জা থেকে রেহাই পেতে। আশফিকের স্কন্ধে মুখ গুঁজে বলে, ‘আমি চাইছি না আশফি, একদমই চাইছি না এই মুহুর্তকে এত সাদামাটাভাবে স্বীকৃতি দিতে। আমাদের এই মুহূর্ত তো হবে সব থেকে সুন্দর! সব থেকে স্মরণীয়!’
_________________________________
মনোযোগ দিতে পারছি না লেখাটাতে তেমন। আগ্রহ পাচ্ছি না আর চেষ্টা করেও। কেন তা জানি না। তাই খুব বিস্তারিত লেখাটাও সম্ভব হচ্ছে না। অত্যন্ত দুঃখিত আমি তার জন্য। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন৷ এডিট করার সময় হয়নি।
ইসরাত জাহান দ্যুতি