রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩২

0
446

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩২
__________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। এবং কপি নিষেধ।]

রোগা পাতলা শরীর, দেখতে ফর্সা, মোটামুটি ধাচের সুন্দরী বলা চলে সেবিকাকে। বয়সটা আনুমানিক মাহির মতোই বা ওর থেকে ছোটোও হতে পারে। পরনে ছিমছাম গোলাপি রঙা একটা সেলোয়ার-কামিজ। আশফিকের কাছে দাঁড়িয়ে সে আধা ঘণ্টা যাবৎ ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নরম করে রাঁধা সবজি খিচুড়ির প্লেটটা হাতে নিয়ে ওকে খাওয়ানোর জন্য।

-‘স্যার প্লিজ একটু মুখে দিন৷ নয়তো আমাকে জিহাদ স্যার খু্ব বকবেন৷ উনি ভীষণ কড়া প্রকৃতির। একটু মুখে দিন।’

মেয়েটার কথা বলার ধরনটা বেশ ফিটফাট। মানে খুব সুন্দর করে বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু শুনতে কেমন যেন মেকি ধরনের লাগছে বেশিই। বোঝা যাচ্ছে সে এমন করে কথা বলতে অভ্যস্ত নয়। সাথে এও বোঝা যাচ্ছে, আশফিকের সঙ্গে নিজেকে তাল মেলানোর প্রচেষ্টা আর কী!

যতবার আশফিকের মুখের সামনে তুলছে খাবারটা ততবার আশফিক মুখটা ঘুরিয়ে চেহারাটাই কুঁচকে বিকৃতি করে ফেলছে। এক পর্যায়ে মেয়েটাকে বিশাল এক ধমক দিয়ে উঠল ও, ‘অ্যাই! আপনি সরুন তো। চোখের সামনে থেকে দূর হন একদম। আমি নিজে হাতেই খাবো।’

খু্ব মন খারাপ হলো মেয়েটার, কেঁদে ফেলবে প্রায় এমন স্বরে বলল, ‘আপনি নিজে খেতে গেলে আপনার হাত কাঁপে স্যার৷ তার জন্যই আমি হেল্প করতে চেয়েছিলাম।’

-‘আমি কি এতিম? আমার কেউ নেই যে বাইরের কারও হাতে খাবো? বাড়িতে আমার আম্মু আছে। কিন্তু একটাই সমস্যা, আম্মু আমার অসুস্থতা নিতে পারে না৷ নিজেই বিছানাশয্যা হয়ে যায়৷ তার থেকেও আসল কথা আমার বউ আছে৷ আমার চাচাশ্বশুরকে বলুন আমার বউকে পাঠাতে৷ যার তার হাতে আমি খাবার খাবো কেন বউ থাকতে? আমার কত সমস্যা হচ্ছে আপনি বুঝতে পারছেন? সব কিছুর জন্য তো আপনার থেকে সাহায্য নিতে পারি না৷ হয় আমার আম্মুকে প্রয়োজন নয়তো বউকে। সেটা জানান আপনার জিহাদ স্যারকে।’

-‘আপনি ম্যারিড স্যার?’ প্রচণ্ড বিস্ময় কণ্ঠে শুধাল মেয়েটা।

আশফিকের কেন যেন এই মেয়েটাকে সহ্যই হচ্ছে না। ও জীবনে কখনও কোনো মেয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেনি। কারণেও না, অকারণেও না। প্রথম দুর্ব্যবহারটা করেছিল নিজের প্রিয় মানুষটার সাথেই। আর যদি বলা হয় ঘৃণা করা যায় এমন মানুষ কি ওর জীবনে আছে কি না? তবে সেই তালিকাতে ঐশী সর্বপ্রথমেই। দিলিশাকে ঘৃণা করতে পারে না৷ কেননা, ও মনে করে অতীতে দিলিশার থেকেও বড়ো অপরাধী ও-ই ছিল৷ প্রশ্রয়টা ও দিয়েছিল বলেই দিলিশা সুযোগ নিতে পেরেছিল৷ কিন্তু এই মেয়েটাকে কী জন্য ওর অসহ্য লাগছে তা ও বুঝতে পারছে না। বলতে একটু ভুল হলো– শুধু এই মেয়েটাই নয়। মাহির ছোটোচাচা মানুষটাকে আরও বেশিই অসহ্য লাগছে ওর। যতবার ওই মানুষটা ফোনে কথা বলেছেন ততবারই শরীর চিড়বিড় করছে রাগে ওর। মাহির কথা জিজ্ঞেস করলেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান নয়তো বিনা নোটিশে ফোনটাই কেটে দেন৷ ওকে ঢাকা থেকে গত পরশু রাতেই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। যখন হুঁশ ফেরে ওর তখন ও একজন পুলিশ অফিসারের কাছে এখানে নিয়ে আসবার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই সে জানায়, ওর চিকিৎসাটা খুব গোপনে করা হবে। কোনোভাবেই জানতে দেওয়া যাবে না কাউকে যে ও গুরুতরভাবে আহত হয়েছে নিঝুম দ্বীপে গিয়ে৷ এই বাংলো বাড়িতেই তাই সমস্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে ওর। শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া বিষের প্রভাবটা ধ্বংস করতে একটা অ্যান্টিডোট পুশ করা হয়েছিল। বিষটার কার্যক্রম ধীরেধীরে শুরু হতো। এবং একটা সময় শরীর আপনাআপনি পচন ধরতে শুরু করত। তখন চিকিৎসা নিয়েও কোনো লাভ হতো না। সঠিক সময়ে চিকিৎসাটা না নিলে মৃত্যুটা যে কত যন্ত্রণার হতো আশফিক শুধু সেটাই ভাবে সুস্থ হবার পর থেকে। আরও ভাবে, মাহির শত্রুগুলো এতটাই সাংঘাতিক আর হিংস্র মনোভাবের যা ধারণার বাইরে! তাহলে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জীবন ওর প্রিয়দর্শিনী মানুষটার! এমন সংকটময় জীবনে মাহিকে ও কোনোভাবেই দেখতে চায় না৷ ওদের এতটা দুর্ভাগ্য না হলেও তো হতো। চারটা বছর আগে চলে না গেলে মাহিকে আজ এই পেশায় দেখতে হতো না।

মেয়েটার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আশফিক খিটখিটে মেজাজ নিয়ে এক কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল কম্বলের নিচে ডুব দিয়ে।

-‘স্যার শুয়ে পড়লেন যে? আপনি দুপুরেও ঠিকমতো খাননি। এখন একটু না খেলে আপনি দ্রুত সুস্থ হবেন না তো!’

কম্বলটা মুখের ওপর থেকে সরিয়ে আশফিক রাশভারী গলায় বলল, ‘আপনার জিহাদ স্যারকে ফোন করেন তো।’

-‘কেন স্যার?’

-‘আপনাকে এত জবাবদিহি করব কেন?’ বেশ চেঁচিয়েই বলল আশফিক।

মেয়েটা সত্যিই এবার কেঁদে ফেলল। নিজের ব্যাগ থেকে ফোনটা হাতে নিতেই মাহি দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘ফোন করে জানিয়ে দিন আমি পৌঁছে গিয়েছি আর আজ এখানেই থাকছি।’

চমকে উঠে ভেজা চোখদু’টোই পিছু ফিরে দেখল মেয়েটা মাহিকে, ‘আপনি কে?’

আশফিক তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসল। তাতে কাঁধের ক্ষত জায়গাটাই ব্যথা পেলো খুব। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠতেই মাহি দ্রুত কাছে চলে এলো, ‘এত তাড়া কেন? আমি কি চলে যাচ্ছি?’

-‘এসেছ সেটাই তো বিশ্বাস করতে পারছি না! চলে যাওয়ার কথা তো পরে।’

মাহি জবাব না দিয়ে ওকে বিছানার হার্ডবোডের সঙ্গে বালিশ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। সেবিকার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম?’

-‘রুমা।’

রুমার হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে বলল, ‘জে.কে. স্যারের কাছে কল করে জানিয়ে দিন মাহিয়ান এসেছে। আপনি এখন আসতে পারেন৷ সারাদিন অনেক পরিশ্রম গেছে বোধ হয় রোগীর পিছে।’

-‘ওনাকে না খাইয়ে যাওয়ার তো অনুমতি নেই৷ আপনি কে হন ওনার?’

মাহি বলার পূর্বেই আশফিক হঠাৎ খুব দম্ভের সাথে বলে দিলো, ‘বউ। আমার বউ। এবার আপনি আসুন তো!’

-‘তুমি এমন অদ্ভুত আচরণ করছ কেন আশফি? রগচটা মানুষদের মতো। এরকম করে তো কখনও কারও সাথে কথা বলো না!’ মাহি অবাক কণ্ঠেই বলল।

আশফিক ক্লান্তি স্বরে জবাব দিলো, ‘আমি জানি না। আমার ভালো লাগছে না কিছু। কাউকে ভালো লাগছে না।’

-‘আমাকেও না?’

প্রশ্নটা একদমই অযৌক্তিক হলো কি না! আশফিক ভ্রু, কপাল কুঁচকে ফেলল তাই৷ তবে কেন যেন সত্যিই মাহির সাথেও কথা বলতে খুব একটা ইচ্ছে করছে না৷ শুধু মনটা চাইছে এই ঘরের বাইরে যেতে, কোনো ছায়াবীথিতে নীরবে মাহির পাশাপাশি হাঁটতে। নয়তো খুব কাছাকাছি দু’জন থাকবে শুধু, কোনো বাক্য ব্যয় হবে না, অভিমান আর দ্বিধা থাকবে না, যতটা সম্ভব শুধু ভালোবাসাবাসি হবে দু’জনে দু’জনে।

আশফিক রুমা মেয়েটার দিকে তেরছা চোখে তাকাতেই মেয়েটা মাহিকে বলল, ‘উনি সারাদিনে খুব একটা খাননি। প্রেসক্রিপশন রাখা আছে টেবিলেই। খাবারটা খায়িয়ে দিয়ে যদি সম্ভব হয় ওনাকে কমলালেবু কিংবা মালটাগুলো খেতে দেবেন।’

মাহির নিজের শরীরটাও খুব একটা সায় দিচ্ছে না। জ্বর, ঠান্ডা লেগে গেছে হঠাৎ। রুমাকে বিদায় জানিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো৷ বাংলো বাড়িটার চারপাশে বাগান থাকলেও বাসার ভেতরটা একদমই সাদামাটা৷ এখানে এর আগেও আসা হয়েছে মাহির। এই বাংলোটা ব্যবহারই হয় নিজেদের পেশার কারণে।

খাবারটা একটু একটু করে আশফিককে খাইয়ে দিতে দিতে বলল ও, ‘বিষক্রিয়াটা খুব বাজেভাবে প্রভাব ফেলেছে তোমার মধ্যে৷ বিরক্ত লাগছে সব কিছু?’

-‘হুঁ।’ গম্ভীর গলাতেই সায় দিলো আশফিক।

-‘কী করতে ইচ্ছা করছে?’

-‘আপাতত বাইরে যেতে চাই।’

-‘আচ্ছা৷ জলদি খাও৷ নিয়ে যাচ্ছি আমি।’

-‘তোমার গায়ে শীতের জামা নেই কেন? শীত করছে না?’

-‘এখানে আসার পর করছে মোটামুটি।’

-‘আমার জ্যাকেটটা গায়ে ঢোকাও।’

-‘পরব, আগে খাওয়া শেষ করো।’

কড়া স্বরে বলল আশফিক, ‘আগে জ্যাকেটটা পরতে বলেছি আমি।’

মাহি চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল ওর দিকে, একটু সময় কী ভেবে তারপর বলল, ‘চরম খিটখিটে হয়ে গেছ। এই টোন তোমার নিজেরই না! এটা অন্য আশফি। গম্ভীর, বদমেজাজি, রুক্ষভাষী।’

-‘মেনে নিলাম। এবার যাও জ্যাকেটটা পরে আসো।’

শীতের শেষভাগ বলে ঢাকার মধ্যে শীতটা অনুভূতই হয় না। গাজীপুরের এদিকটা গাছগাছালির পরিবেশ বলেই এখানে মোটামুটি ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটা আছে। আশফিকের কাঁধের ক্ষত জায়গাটা কিছুটা সেড়ে না ওঠা অবধি ও ঢাকা ফিরতে পারছে না। বাবা-মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে তাদের মিথ্যে জানিয়েছে যে, ও নিঝুম দ্বীপে বিস্ফোরণ ঘটার সময় সেখানে ছিলই না মাহিকে নিয়ে। যে ক’জন আগুনে পুড়েছে তাদের পরিবারের পাশে থাকছে এখন। কিছুদিন পর বাসায় ফিরবে। তবুও আসমান আরা শান্ত হতে পারছেন না। মায়ের মন বলেই সন্তানের বিপদের আশঙ্কা ঠিক টের পেয়েছেন৷ সাদিয়ার পরিণতি জানার পর থেকে খুব মন খারাপ হয়ে আছে আশফিকের৷ একটাবার বন্ধুটিকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা কতবার বলেছে জিহাদ সাহেবকে! তিনি রাজিই হননি। এসব কারণেই তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে আশফিক। বাইরে এসে মাহির সাহায্যে হাঁটছিল ও। রাত প্রায় ন’টা। একটু বাতাস বেশি বাইরে। মাহি একটু পরপর হাঁচি দিয়ে উঠছে। তাই বলল, ‘ঘরে চলো, তোমার ঠান্ডা লেগে গেছে।’

-‘সমস্যা নেই৷ তুমি আরেকটু ঘুরোফিরো।’

কথাটা বললেও মাহির মন চাইছে সত্যিই ঘরে ফিরে গরম কম্বলটা গায়ে নিয়ে শুয়ে পড়তে। ওর কথার ফিরতি জবাব না দিয়ে আশফিক ঘরের পথে হাঁটতে আরম্ভ করল৷

মাহি আশফিকের অদ্ভুত আচরণের সাথে এই একটা ঘণ্টাতে তাল মিলাতে পারছে না, দু’জন এত আপন হয়েও। রুমা মেয়েটা একটা দিন বেশ নাজেহাল হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। নেহাৎ মেয়েটা ধৈর্যশীল বলেই চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিল। এত দ্রুত মেজাজ পরিবর্তন হচ্ছে আশফিকের যে তাল মিলিয়ে ওকে সন্তুষ্ট করাটাই কঠিন প্রায়।

-‘বাইরে আসার জন্য একটু আগেও ছটফট করছিলে। এখন কী হয়ে গেল?’

-‘এখন তোমার ঠান্ডা লেগে গেল।’ ভার কণ্ঠে জবাব দিলো আশফিক।

-‘আমার সামান্য ঠান্ডাকে কেন্দ্র করে পেরেশান হচ্ছ এটা প্রচণ্ড হাস্যকর।’

-‘তো হাসো। নিষেধ করছি না কি হাসতে? আমি শুয়ে পড়ব। ঘুমঘুম লাগছে। তুমি ওই মেয়েটা কী যেন নাম? যা হোক, ওকে বলো তোমার জন্য খাবার রেডি করে পাঠাতে।’

এখানে হঠাৎ চলে আসায় মাহির ওষুধগুলো নেওয়া হলো না। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। আশফিককে কিছু বুঝতে দেওয়াও যাবে না। নয়তো এই ছেলে ওকে নিয়ে পড়বে।

আশফিককে ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাংলোর কেয়ারটেকার ছেলেটাকে নিজের ওষুধগুলো আনতে পাঠিয়ে দিলো। রুমার সঙ্গে বসে টুকটাক কথা বলতে বলতে দু’জনে মিলে খেয়ে নিলো৷ তবে ও খুব একটা খেতে পারল না। গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে কেমন যেন, মাথা ঘুরছে। কেয়ারটেকার ওষুধ নিয়ে ফিরলে মাহি ওষুধ খেয়েদেয়ে আশফিকের ঘরে চলে এলো৷ এসে দেখল সে ঘরের মাঝে গুরুগম্ভীর চেহারা করে দাঁড়িয়ে চাকর ছেলেটাকে আদেশ করছে, ‘ওই সোফাটা বসার ঘরে যে কোনো জায়গায় রাখবে৷ আর তুমি আজকে আর বাসায় ফিরবে না৷ ওই বসার ঘরের ডিভানটাতেই ঘুমাবে। কেয়ারটেকার ছেলেটাকেও রেখে দেবে সাথে। বুঝতে পেরেছ?’

আঠারো বছর বয়স বাচ্চা ছেলেটার। আশফিকের অমন ভারী গলার কড়াকড়ি আদেশ শুনে না চাইতেও পালন করতে সায় দিলো মাথা নেড়ে। তারপরই ও আর কেয়ারটেকার ছেলেটা মিলে ঘর থেকে তিন সিটের সোফাটা নিয়ে চলে গেল। মাহিকে ইশারায় ঘরের দরজা বন্ধ করে তারপর এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আশফিক৷

-‘সোফাটাকেও কি সহ্য হচ্ছিল না?’ মাহি ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।

-‘আসলেই তাই।’ আশফিক বিছানার এক পাশে সরে এসে শুয়েছে৷ মাথার নিচের আরেকটা বালিশ নিজের বালিশের পাশাপাশি রেখে কথাটা বলল৷ মাহি শুধু ওর কার্যকলাপ চেয়ে চেয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে।

-‘যাও! দরজটা বন্ধ করে দাও।’

দরজাটা লাগিয়ে এসে মাহি ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনোভাবে কি তুমি এটা ভেবেছিলে আমি সোফায় ঘুমাব কিংবা বসার ঘরে?”

আশফিক এমনটাই ভেবেছিল। কিন্তু তা স্বীকার করল না। শুধু বলল, ‘লাইটটা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি এসে শোও।’

হিমেল হাওয়া বাতাবরণের ফাঁক গলে ছুটে এলেও মাহি জানালাটা বন্ধ করল না৷ আশফিক এ নিয়ে মিনিট দশেক আগে ওর সঙ্গে খ্যাঁকখ্যাঁক করে উলটো পাশ ফিরে শুয়ে আছে কাঁধের ব্যথাকে অগ্রাহ্য করেই৷ মাহি বিকারশূন্য তবুও৷ নিকষ কালো আকাশটা দেখা যায় জানালা থেকে। শুয়ে শুয়ে তারাগুলোর মিটিমিটি জ্বলা নেভা দেখতে ভালোই লাগছে ওর। বাবা আর ভাইয়ের কথা যত ভুলতে চাইছে ততই মনে পড়ছে বেশি বেশি। আর ততই ওর বুকের মধ্যে হাঁসফাঁস হাঁসফাঁস করছে শুধু। আশফিকও কথা বলছে না। ও এই মুহূর্তে ভীষণ চাইছে, কোনো এক তরিকাতে বাবা আর ভাইয়ের আঘাতটা যদি ভুলে থাকা যায়! পাশ ফিরে আশফিকের দিকে চাইল। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। পেছন থেকে তো কোনোভাবেই জড়িয়ে ধরা যাবে না তাকে। কিন্তু আশফিকের গা ঘেঁষে শুতে মন চাচ্ছে ওর খুব। উঠে বসে দেখল, এক কোণায় বেশ জায়গা রেখেই আশফিক প্রায় ওর কাছাকাছি এসে শুয়ে আছে। জানালাটা এবার বন্ধ করে দিলো। তখন ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগতেই ও বারবার হেঁচে কেশে উঠছিল৷ তাই আশফিকের আদেশ ছিল জানালাটা বন্ধ করে দেওয়ার।

বিছানা থেকে নেমে চুপচাপ আশফিকের বুকের কাছটায় এসে শুলো মাহি৷ আশফিক নিশ্চিন্তে ঘুমের অতলে তখন। ওর হাতটা নিজের গায়ের ওপর টেনে নিয়ে ওর পিঠ আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজল। একটু পর আবার দমবন্ধ লাগলে মুখটা কম্বলের ফাঁক থেকে বের করে রাখে৷ একেকরকম বাহানা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়েই পড়ল।

কিন্তু আশফিকের ঘুমটা বেশিক্ষণ টিকল না কাঁধের ব্যথা আর শীত শীত লাগার কারণে। খেয়াল করল কম্বলের বাইরে চলে এসেছে ও। মাহি কখন এপাশে এসেছে তা বুঝতে পারেনি৷ পুরো কম্বলটা টেনেটুনে একাই কব্জা করে ঘুমিয়ে আছে সে বিছানার একদম এক কোণ ঘেঁষে। ঘুমের ঘোরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তার বউটার। ওকেও অন্যপাশ ফিরে এবার শুতেই হবে৷ ব্যথায় টনটন করছে কাঁধটা। মাহিকে ওভাবেই টেনে এনে বিছানার মাঝ বরাবর নিলো। তাতে অনেক বেশিই ঝক্কি গেল ওর শরীরের ওপর দিয়ে। ব্যথায় জর্জরিত কাঁধটার জন্য মুখ থেকে আপনা আপনিই আর্তনাদের শব্দ বেরিয়ে এলো। মাহির ঘুমটা পাতলা হয়ে এসেছিল আশফিক টেনে আনার মাঝেই। এবার পুরো নিদ্রাই ভঙ্গ হলো। লাফ দিয়ে উঠে বসল, ‘অ্যাই কী হলো?’ বলতে বলতেই আশফিকের কাছে চলে এলো। আশফিক নিরুত্তর। শুধু মুখের ইশারায় বোঝাল ও ঠিক আছে৷

-‘ব্যথা পাচ্ছ, আবার বলছ কিছু হয়নি? হঠাৎ ব্যথা বাড়ল না কি? ওষুধ তো নিয়েছিলেই।’

-‘নড়তে সরতে গিয়ে লেগেছে হঠাৎ।’

-‘কিছু লাগবে? লাগলে বলো।’

-‘খিচুড়ি খেয়ে গলা শুকিয়ে শুকিয়ে আসছে। পানি দাও একটু।’

পানি ভর্তি গ্লাসটা বিছানার পাশের ল্যাম্পটেবিল থেকে নিয়ে আশফিকের মাথাটা একটু উঁচু করে খায়িয়ে দিলো। কিন্তু অসাবধানতার জন্য পানি পড়ে বুকের কাছটা ভিজে গেল ওর৷ মুখটা অপরাধীর মতো করে মাহি অন্য একটা গেঞ্জি এনে পরিয়ে দেওয়ার জন্য ওকে ধরে বসিয়ে দিলো আবার। আশফিক এবার নিজেই চেষ্টা করে গা থেকে ভেজা গেঞ্জিটা খুলে নিলো।

-‘ব্যথার ওপর ব্যথা দিচ্ছ বারবার। টান লাগেনি ওখানে?’

-‘তা তো লেগেছেই।’

-‘আমি পরিয়ে দিচ্ছি গেঞ্জি।’

-‘সেই তো হাতটা উঁচু করতেই হবে। আমার খালি গায়ে ঘুমানোর অভ্যাস বেশি। শীত অত বেশিও নেই। তুমি রাখো গেঞ্জি। শুইয়ে দাও আমাকে।’

হঠাৎ কেন যেন মাহির বুকটা ধুকপুক করছে। আশফিক যে স্বেচ্ছাচারী চরিত্রের পুরুষ! যতবার কাছাকাছি হয়েছে ওরা ততবারই কিছু না ঘটিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে পাঁজিটা৷ যদিও আজ ওর শরীরের পরিস্থিতি অনেকটাই প্রতিকূলে।

খোলা গায়েই আশফিক শুয়ে পড়ল৷ মাহি ওর গায়ে কম্বলটা টেনে দিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়তেই বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল আকস্মিক৷ আশফিকের খোলা শরীরের উষ্ণ স্পর্শ আজ ওকেই নাজেহাল করে ছাড়ছে৷ অথচ আশফিক তো দিব্যি শান্ত। এমন তো হওয়ার কথা ছিল আশফিকের ক্ষেত্রে!

-‘অ্যাই আশফি, তুমি একটু সরে শোও।’

-‘কেন কী সমস্যা? আমি গোসল করিনি বলে কি গা থেকে গন্ধ আসছে? আমি তো করতে চেয়েছিলামই। ওই মেয়েটা করতে দিলো না।’

-‘আরে নাহ। ঠিক আছে সরতে হবে না। রুমা ওর নাম। ও তো ঠিকই করেছে।’

-‘আমি গা টা একটু মুছতেও পারিনি। তোমার সরে শোও শুনে এখন আরও কেমন কেমন লাগছে। তোয়ালেটা ভিজিয়ে এনে একটু শরীরটা মুছে দেবে?’

-‘এই রাতের বেলা? কোনো দরকার নেই৷ কাল সকালে।’

-‘না না এখনই৷ তুমি যে জন্যই বলো। আমার এখন না মুছতে পারলে ঘুম হবে না।’

কী এক বিপত্তি! মাহিকে উঠিয়েই ছাড়ল আশফিক। ছুরির কোপ খেয়ে মানুষের পুরো স্বভাবই বদলে যায় না কি?

ভেজা তোয়ালেতে আশফিকের সারা শরীর মুছে দিতে দিতে হঠাৎ মাহির মন অদৃশ্য এক বেগতিক হাওয়ায় এলোমেলো করে দিলো। শেষ কবে খোলা দেহে থাকা আশফিককে জড়িয়ে ধরেছিল সেই দিনটাই শুধু ভাবন ঘরে ঘুরছে ফিরছে ওর৷ পিঠটা মুছে দিয়েই কপালটা ঠেকাল আশফিকের পিঠের মাঝে। পেছন থেকে আশফিকের পেট আঁকড়ে ধরে গালটা ঠেকাল এবার সেই জায়গাতে। আশফিকের চোখ হাসছে, চিকন ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে হাসছে মিটিমিটি। মাহির হাতটা উঠে এলো ওর বুকের মাঝে। তারপরই পিঠের মাঝে ভেজা চুমুর তুমুল ঝড়। আশফিক অর্ধভাগ ঘুরে মাহিকে আগলে ধরে সামনে ফিরিয়ে আনল। অচিন্তনীয় প্রেমের আদরে কে কতটুকু উন্মাদ হলো, বেপরোয়া হলো তা খেয়ালহীন। চাতক পাখির মতো অপেক্ষারত কেবল বেসামাল ওই দম্পতি আজ একই পুরু আস্তরণে মাঝে সমস্ত লাজ আর দ্বিধাকে মুক্তি দিলো, অনাবৃত দেহে নিবিড়ভাবে মিশে একে অপরের হলো।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

(কাল শেষ পর্ব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here