কহিনুর,০৬,০৭

0
668

#কহিনুর,০৬,০৭
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৬

ঘন নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঠকঠক করে কাঁপছে অধরা। একজোড়া সীতল দৃষ্টি ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে। ওই দৃষ্টিতে বুঝি ওর মৃ*ত্যু লেখা আছে। কালো থাইকাচ ভেদ করে সূর্যের রশ্মি ভেতরে প্রবেশ করেছনা ঠিক তবে আলো ছড়াতে জুড়ি মেলা ভার। অধরার সামনে জুবায়ের ফারুকী দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বের ন‍‍্যায় চোখমুখ শক্ত করে নেই তবে চোখে আছে হাজারো অভিযোগ অভিশাপ নাকি ঘৃণা বোঝা মুশকিল। অধরা গতকাল রাতের দৃশ্যটা দেখার পরে চুপচাপ রুমে চলে এসেছে। সারারাত ভেবেছে কিন্তু উত্তর পাইনি। জুবায়েরের যে জমজ ভাই আছে এটা ওকে কখনও বলা হয়নি। এই বাড়িতে সবাইকে দেখেছে কিন্তু ওই লোকটাকে অধরা কখনও দেখেনি। এক বাড়িতে থেকে একটা লোক কিভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতে পারে চমকে যাওয়ার মতোই কথা। সারারাত আজেবাজে চিন্তা করে ভোররাতে ঘুমিয়েছিল হঠাৎ জুবায়েরের এসে ওকে জোরজবরদস্তি করে উঠিয়ে দিয়েছে। অধরা ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে যে সামনে দাঁড়িয়ে এটা জুবায়ের নাকি ওর মতো দেখতে সেই ছেলেটা। অন‍্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মতোভাব বোঝার মতো সামর্থ্য ওর নেই। হঠাৎ আক্রমণে অধরার ধ‍্যান ভাঙলো। জুবায়ের ওর দু’বাহু শক্ত করে ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল,
> তুমি অভিশাপ দিয়েছিলে না? সব তোমার জন্য হয়েছে। কখনও ক্ষমা কবো না তোমাকে। তোমার জন্য আমার মা আর জুহিকে প্রাণ দিতে হলো।

জুবায়েরের কথা শুনে অধরা হতবাক। লোকটা ছ‍্যাকা খেয়ে রোগে শোকে দুঃখে পাগল হয়ে গেলো নাকি কে জানে। খু*ন করা বা মা*রার হলে ও প্রথমে জুবায়েরের কথা ভাবতো। লোকটার একটা কেনো একশোটা গার্লফ্রেন্ড থাকুক অধরা সেসব পরোয়া করে না। করবেই বা কেনো?অধরা মুখটা কঠিন করে নিজেকে এক ঝটকায় জুবায়েরের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ভ্রু কুচকে বলল,
> ঠকাতে পারেন আর ঠকতে পারবেন না এটাতো ঠিক না। থাপ্পড় দিবেন অথচ থাপ্পড়ের স্বাদ নিবেন না তাতো হতে দেওয়া যায় না। কেমন লাগছে সুলতান জুবায়ের ফারুকী?
অধরার কন্ঠ থেকে আক্রশ ঝরে পড়ছে। ইচ্ছে করছে লোকটার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে গলা টিপে দিতে কিন্তু ও পারবে না। শক্তিশালী পুরুষটার গলাতে হাত রাখলে ওর এইটুকু হাতে অনায়াসে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। জুবায়ের যথাযথ শান্ত থাকার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। অধরাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ওর গালটা দুহাতে দুমড়ে নিয়ে বলল,
> আমি সুখ না পেলে কাউকে সুখী হতে দিবো না। এতে কেউ আমাকে স্বার্থপর ভাবলেও কিছু যাবে আসবে না। আমাকে দেখে তুমি কটাক্ষ করবে!মজা নিবে আমি সহ‍্য করবো না।
অধরার মুখে প্রচণ্ড ব‍্যাথা লাগলো। মনে হলো মুখের হাড় ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়বে। চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। বহু কষ্টে আওয়াজ দিলো,
> মৃত গার্লফ্রেন্ডর রাগটা বুঝি বউয়ের উপরে তুলছেন জুবায়ের ফারুকী? কাপুরুষ কাকে বলে জানেন নিশ্চয়ই? নাকি ব‍্যাখা করে জানিয়ে দিব।

জুবায়ের খপ করে ওকে ছেড়ে দিলো। মেয়েটা কি ইঙ্গিত করছে বুঝতে সময় লাগলোনা।অযথাই রাগ হচ্ছে শুধু। মনের মধ্যে ভয়ানক জিদ চেপেছে। ইচ্ছে করছে জুহির লা*শ তুলে ইচ্ছে মরো পিটাতে। বদজাত মেয়ে জীবনে ক্ষমা করবে না জুবায়ের ওকে। ওর জন্য এখন কথা শুনতে হচ্ছে। জুবায়ের লাথি দিয়ে সামনে থাকা ট্রি টেবিলটা সরিয়ে দিলো। হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> গলা টিপে দিবো আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে। আমাকে রাগাবে না। জুহির জন্য তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম কিন্তু এখন তো সে নেই। আমার তোমার উপরে আর কোনো দায়বদ্ধতা রইল না। সো চুপচাপ থাকবে।
> জানি দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু আপনার রক্ত তার উপরেও কি আপনার দায়বদ্ধতা নেই? বাচ্চাটা কিন্তু আপনার সেটা তো স্বীকার করেন? আপনার সম্মুখীন যদি কেউ আপনার বাচ্চার ক্ষতি করে সেটা মানতে পারবেন তো? ধরুন কহিনুরকে কেউ হত্যা করলো ওর র*ক্ত
অধরা বাকী কথাটা শেষ করতে পারলো না জুবায়ের ওর গলা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> আমার মেয়েকে নিয়ে একদম বাজে কথা বলবে না। বারবার বাক‍্য দ্বারা আঘাত করে আমার স্পর্শ নিতে চাইছো তুমি? রাগলে আমার স্পর্শ কিন্তু তোমার জন্য একদম ভালো হবে না। ভেবোনা কহিনুরের জন্য তোমাকে ছেড়ে দিব। জানিনা ড‍্যাড ওকে কেনো চেয়েছে কিন্তু এই মূহুর্ত থেকে ওকে আমার নিজের জন্য চাই। আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।

জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তারপর কি একটা ভেবে আবারও ফিরে এসে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল
>আমার কাউকে দরকার নেই। কহিনুরকে দরকার নেই আমার। ড‍্যাড যা বলেছে তাই হবে।

জুবায়ের পূর্বের ন‍্যায় গটগট করে বেরিয়ে গেলো। অধরা বালিশে মুখ ডুবিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। ভেবেছিল জুবায়েরকে নিয়ে আর ভাববে না নিজের মতো সবটা উদ্ধার করবে কিন্তু লোকটা যে ওকে একটুও শান্তি দিচ্ছে না। ওর মধ্যে যে অশান্তি চলছে সেটা অধরার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অধরা কান্নাকাটির পর্ব শেষ করে রাগে ফুলে উঠলো। ভয়ানক ভাষায় দু’টো গালি দিলো একদম আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাব দেখালো মিররে মলিন বদন খানি দেখার প্রচেষ্টা করছিল। জুবায়েরকে ও জীবনে ছাড়বে না। শাশুড়ি আম্মা ঠিক বলেছিল কাউকে বিশ্বাস না করতে।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆
জুবায়ের অধরার উপরে রেগে গিয়ে কাঠকাঠ গলাই বাবার সামনে জানিয়ে দিলো ওই মেয়েটাকে ওর এখন আর দরকার নেই। আরমান ফারুকী ছেলের মুখটা দেখে ভয়ানক চটে আছেন দেখে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছেন না। এই ছেলেকে দিয়ে উনার কিছুই হবে না বুঝতে বাকি নেই। থাপ্পর দিতে পারলে শান্তি লাগতো কিন্তু পারবেন না। যেভাবেই হোক হাতে পায়ে ধরতে হবে। বড় কোনো স্বার্থের জন্য এরকম ছোট ছোট ত‍্যাগ স্বীকার করাই যায়। উনি মুখটা মলিন করার যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন এবং শেষমেশ সফল হলেন। ছলছল চোখে বললেন,
> বাবা জুবায়ের তোমার ড‍্যাড আজ পযর্ন্ত তোমার থেকে কিছু চেয়েছে বলো? যখন যা চেয়েছো আমি সবটা দিয়ে তোমার আবদার পূরণের চেষ্টা করেছি তাহলে আজ কেনো ড‍্যাডের কথা ভেবে দশটা মাস অপেক্ষা করছো না। আমি কি ভেবে নিবো আমি পৃথিবীর সব চাইতে হতভাগ্য পিতা?
জোবায়েরর রাগ পড়ে গেলো। সত্যিই তো বাবার জন্য ও এইটুকু পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। সন্তান পিতার ইচ্ছে পূরণ করবে এখানে দোষের কি। তাছাড়া সবটা যে সুখের হবে এমনটা না। পরিবারের কথা ভেবে এসব করাই যায়। তবে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> কহিনুরকে নিয়ে তুমি কি করতে চাইছো বলবে? বেবি ছেলে না মেয়ে হবে আগেই তুমি জানলে কিভাবে? পৃথিবীতে এতো এতো নাম থাকতে ওর নাম কহিনুর কেনো রাখলে?
জুবায়ের একসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আরমান ফারুকীর দিকে। উনি অবস্থা বেগতিক দেখে খুকখুক করে কেশে বললেন,
> সবটা তোমার না জানলেও চলবে। সুলতান বংশের মূল্যবান রত্ন সে। তাকে কহিনুর ডাকতে অসুবিধা কিসের? আমার মন বলেছে তোমার মেয়ে হবে ।তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?
জুবায়ের উত্তর দিলো না। চুপচাপ চলে আসলো নিজের রুমে। বড় মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। জুবায়ের চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পরক্ষণেই ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চোখ খুলল। পাশে মারিয়া বসে আছে। জুবায়ের ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> ও ঘরে খোঁজ নিয়েছিস? আমাকে ও ইচ্ছা করে রাগিয়েছে।
মারিয়া হাতের ফোনের নোটবুকে লিখে ওর দিকে ধরলো। লেখা আছে,
> ভাবিকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? ছেড়ে দাও ড‍্যাডকে না বলে। আমার কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া।
জুবায়ের চোখ বন্ধ করে বলল,
> ওকে যেতে দিলে অন‍্যকেউ বন্দী করবে। এখানে আছে ভালো আছে। আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। যা হচ্ছে হতে দে। ড‍্যাড আমাদের ভালো চান।
মারিয়া কথা বাড়ালো না। চুপচাপ স্থান ত‍্যাগ করলো। একে বোঝানোর ক্ষমতা ওর নেই। এই বাড়ান যে ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। বহু বছরের পুরাতন ইতিহাস পূনরায় ফিরে আসতে চলেছে। থমথমে পরিবেশ তার জানান দিচ্ছে।
☆☆☆☆☆
জুবায়েরর এসব পাগলাটে আচরণে অধরা বেশ কষ্ট পেয়েছে। বারবার শুধু বাবা মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল তাই মায়ের দেওয়া কালো রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে অধরা। বাবা মায়ের অন্তিম যাত্রার সময় নিজের বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ওর। মায়ের সুটকেসটা নিয়ে এসেছে। বাবা মায়ের স্মৃতি হিসেবে। কয়েকটা কাপড় আছে। যখনই মাকে মনে পড়ে তখনই একটা শাড়ি ঝটপট পরে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। শাড়ি বের করার সময় হঠাৎ একটা পুরাতন ডাইরি পেয়েছে সেটাই নিয়ে পড়তে বসেছে অধরা। এটা মূলত ওর মায়ের না বাবার ডাইরি। গোটা গোটা অক্ষরে প্রথম পেজে লেখা আছে” কহিনুর ”
নিজের বাবার ডাইরিতে এই নামটা দেখে ও চমকে উঠেছে। আগ্রহ নিয়ে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টাতেই পেলো,
” আমি প্রফেসর নওশাদ বারি, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুণ প্রচন্ড ভালোবাসা পেয়ে ছোট থেকে বড় হয়েছি। সেই আমি কখনও কল্পণাও করিনি বাবা মায়ের থেকে দূরে চলে আসবো। কিন্তু ভাগ্য আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। বাবার অর্থসম্পদের অভাব ছিল না। যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আমাদের কতগুলো জমি আর কি পরিমাণ অর্থ আছে সেটা আমি কখনও হিসাব করিনি। বাবা সেসব দেখাশোনা করতেন। আমি লেখাপড়া আর বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটাতাম। আমার এই অর্থসম্পদের পাহাড় আমার বাবার নিজের হাতে তৈরী করেছিলেন। কিভাবে করেছেন তা আমার অজানা ছিল জেনেছি পরে। দাঁদা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁর আয়ে টুকটাক সংসার চালানোর এবিলিটি ছিল। এটা নিয়ে তাঁর আফসোস ছিল না। আমি উনাকে খুব ভালোবাসতাম। তাঁর মৃত্যুতে আমি ভেঙে পরি।আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তাঁর কয়েক মাস পরের ঘটনা, এক কঠিন সত্যি আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়। যেটা জানার পরে আমার মাথায় কাজ করছিল না। একজন মানুষ কিভাবে এতটা জঘন্য হতে পারে আমার জানা ছিল না। বৃদ্ধ মানুষটা ধুকে ধুকে মা*রা গিয়েছিল শুধু আমার বাবার জন্য। সে স্বার্থের লোভে এই মানুষটার সুখ চিরতরে কেড়ে নিতে দুবার ভাবেনি। আমার দাদিজান জোছনা বিবি কে দাদাজান খুব ভালোবাসেন। বাবা ছিলেন দাদাজানের প্রথম সন্তান। বাবার বয়স যখন আঠারোর উপরে তখন দাঁদিজান জানতে পারেন উনার কোল জুড়ে আবারও কোনো চাঁদের দেখা মিলতে চলছে। দাঁদাজান খুশী হলেন। আল্লাহ্ কাছে শুকরিয়া জানালেন কিন্তু আমার বাবা সবটা উল্টে দিলো। উনি গ্রামের মোড়লের মেয়েকে পছন্দ করতেন। মোড়ল কিছুতেই বাবার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে মানতে চাইলেন না। কারণ বাবার অবস্থা তখন ভালো ছিল না। বাবা হতাশ হলেন তবে হাল ছাড়লেন না। বাড়িতে আসা কমিয়ে দিলেন। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি নেশা করতেন। কোন এক রাত্রিকালে নেশায় বুদ হয়ে ফিরছিলেন তিনি। ঘন অন্ধকার রাত। খোলা মাঠ পেরিয়ে যখন বিলের রাস্তায় হাটা ধরেছেন ঠিক সেই সময় একটা খোলা জমিতে বসা একজন মানুষের দেখা পেলেন। উনি বাবার নাম ধরে ডেকে সামনে বসতে বললেন। বাবা কৌতুহলবশত বসে পড়লেন। লোকটা বাবাকে শর্টকাট অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার বুদ্ধি দিলেন। যার জন্য উনাকে করতে হবে কালো জাদুর বা পিশাচ সাধনা। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। সাধনার জন্য গর্ভবতী মহিলার জীবন বলি দিতে হবে। সেটা পর কেউ হলে চলবে না। নিজের আপনজনকেই দিতে হবে। বাবার চোখ তখন চকচক করে উঠলো। উনি এক কথায় রাজি। সারারাত দিন লাগিয়ে সাধনা করলেন। হঠাৎ একদিন বাড়িতে দাদিজানের প্রাণ গেলো তবুও ফিরলেন না। গভীর রাতে কেউ একজন দাঁদিজানের কবর খুড়ে খুলি চুরি করলো সেটাও জানলেন না। উনি ফিরলেন সফল হয়ে। তারপর হঠাৎ করে কিভাবে জানি এই বিশাল সম্পদ পেলেন। সঙ্গে পেলেন আমার মাকে। কিন্তু দাদাজন পেলেন সঙ্গী হারানোর হাহাকার। বাকী জীবন মরার মতো বেঁচে ছিলেন। করো সঙ্গে কথা বলতেন না। চুপচাপ ঘরে পড়ে থাকতেন। দাঁদাজানের মৃত্যুর আগের দিন উনি আমাকে সবটা বলে গেলেন।। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। চিরতরে চলে আসার সব ব‍্যবস্থা করে ফেললাম।কথায় বলে পাপ ছাড়ে না বাপকে ঠিক তেমনই হলো। আমি আসার দুদিন আগে হঠাৎ বাবা আমাকে কাছে ডাকলেন। সীমাহীন ভয় নিয়ে আমার সামনে এক পাথর বের করে ধরলেন। বর্ণনা করলেন সেই পাথরের কাহিনি। ওটা ছিল এই ধনসম্পদের আসল হাতিয়ার। সাধনা শেষে সেই লোকটা বাবাকে এটা দিয়েছিলেন। যতদিন ওটা বাবার কাছে থাকবে ততদিন উনার সম্পদ বাড়তেই থাকবে। আমি ভয়ানক একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী বাবার পাথর চুরি করে দেশ ছাড়লাম। যেই পাথরের জন্য উনি দাদাজনকে কষ্ট দিয়েছেন আমি সেই পাথর উনার থেকে কেড়ে নিলাম। এখানে আসার পর বাড়িতে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। পড়াশোনার সঙ্গে ছোটখাট চাকরি করে আমার ভালোই দিন যাচ্ছিলো। হঠাৎ সহপাঠীর প্রেমে পড়ে ওকে বিয়ে করে জমিয়ে সংসার করতে লাগলাম। ততদিনে আমার লেখাপড়া পাট চুকে গেছে। প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছি । দিনকাল ভালো যাচ্ছিলো কিন্তু হতাশা পিছু ছাড়লো না। বহুকাল অপেক্ষা করলাম সন্তানের মুখ দর্শন করা ভাগ্যে ছিল না বোধহয়। হতাশার মূহুর্তে মানুষ একটা ক্ষীণ আসার দেখা পেলেও বুকবাঁধে। আমিও তাই করলাম। পাথরটা বের করলাম। জানিনা কিছুই শুধু মনে মনে বিড়বিড় করলাম কিন্তু মন মানলো না। সেটা লুকিয়ে ফেললাম। ভাবলাম ওটা আর বের করবো না। কিন্তু হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখলাম। দাঁদিজানকে যাকে আমি কখনও দেখিনি। ওটা স্বপ্ন নাকি ছিল কল্পণা তাও জানিনা। দাঁদিজান বললেন,নওশাদ ওসব পাথর টাথর ফেলো।আমি নিজেই তোমার মেয়ে হয়ে তোমার কোলে আসবো। আমাকে কিন্তু পূর্বের মতো বলি হতে দিওনা। ওই পাথর তুমি নষ্ট করে দাও। ওর জন্য আমরা সবাই কষ্ট পেলাম। দাঁদিজানের কথার মানে না বুঝেই আমি পাথরটা মসজিদের পাশে থাকা দানবক্সে ফেলে আসলাম। মনে হলো আমার উপর থেকে বোঝা নেমে গেলো। দাঁদিজানের স্বপ্নটা আমি ততটা আমলে নেয়নি কিন্তু সত্যি সত্যি মাস খানেক পরে জানতে পারলাম আমি বাবা হবো। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। কি এক অনুভূতি । আমার আধার কালো সাদামাটা জীবনে ছোট্ট একটা বাবু আসছে। আমি নামও ঠিক করলাম। অধরা যার মধ্যে নাকি আমার দাদিজানের আদলের মিশ্রণ থাকবে। জানিনা দাদিজান কেমন ছিলেন। পাথরের চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম। পৃথিবী আলোকিত করে আমার ছোট্ট পরি আসলো। পরীকে ঘিরে আমাদের ছোট্ট সংসার । কিন্তু আমার অধরা যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিলো সেই সঙ্গে বাড়ছিল ভয়।। একরাতে আবারও স্বপ্ন দেখলাম দাদিজান বলছেন, নওশাদ পাপ তো পিছু ছাড়লো না রে। তোর মেয়ের মধ্যে কহিনুরের শক্তি প্রবেশ করেছে। ওকে বিয়ে দিয়ে দে। সন্তান আসুক কহিনুরের শক্তি নিয়ে তাঁর জন্মহোক।
(চলবে)

#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৭

অজানা উত্তেজনাতে কাঁপছে অধরা। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন আর আতঙ্ক। কহিনুর অভিশাপ কি আশির্বাদ আল্লাহ্ ভালো জানে।অধরা একদমে ডাইরির কয়েক পৃষ্ঠা পড়া শেষ করে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টে সেখান থেকে শুরু করলো,
” অধরার মধ্যে আমি কখনও অদ্ভুত কিছু দেখিনি। স্বপ্ন তো স্বপ্নই হয়। শয়তানের ধোকা ছাড়া কিছু না। আমি সামান্য কারণে আমার বাচ্চা মেয়েটার জীবন নষ্ট করতে পারিনা। আমার একমাত্র মেয়ে যার মুখ দেখে আমার শুভ সকাল শুরু হয়। পারবোনা তাঁর জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে। আমি চাই আমার মেয়েটা পড়াশোনা শিখুক। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের ইচ্ছেতে কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করুক। এতেই আমার শান্তি। কিন্তু এরকম কিছু হলো না। বারবার দাদিজানকে দেখলাম। সেই এক কথা। আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। এতো বছর পরে বাবার খোঁজ নিলাম। ভেবেছিলাম বাংলাদেশ ফিরে গিয়ে উনার কাছ শুনবো এই পাথরের অভিশাপ কিভাবে কাটানো যাবে। কিন্তু পারলাম না। বাবা মারা গেলেন। আমাদের বিশাল সম্পত্তি ততদিনে সব মামা আর মামাতো ভাইয়ের দখলে। মা ওদের সঙ্গেই থাকেন। বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে চিঠি লিখে গেলেন। হাতে পেলাম দুদিন পরে। বাবা চিঠিতে বারবার ক্ষমা চেয়েছেন। যেই সম্পত্তির জন্য উনি নিজের মায়ের প্রান বলি দিলেন সেই সম্পদ এখন পরের মানুষ লুটপাট করছে। মায়ের ভালোবাসা পেয়েও উনি হারিয়েছেন। একমাত্র ছেলে বাড়ি ছাড়া হওয়ার অপরাধে আমার মা,বাবার সঙ্গে কথা বলতেন না। শেষ বয়সে এসে উনি নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। পাথরটা যে আমার কাছে এটা উনি জানেন। পাথরটার সামনে যেনো আমি কোনো আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ না করি হুশিয়ার করেছেন। কিন্তু আমি যে ভূল করেই ফেলেছি। পাথরটা উনি কোনো নদীতে ফেলে দিতে বলেছিলেন। লোকের হাতে পড়লে ঝামেলা হবে। ওই পাথরটার জন্য অনেকেই মুখিয়ে আছে। বাবার চিঠি পড়ে মেয়ের বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু করলাম। একদিন ভালো পরিবার পেয়ে বিয়েও দিলাম। কিন্তু স্বপ্নের থেকে রক্ষা পেলাম না। দাদিজানের জায়গাই আমি অধরাকে দেখা শুরু করেছি। মেয়েটা বারবার বলছে বাবা আমাকে বলি হতে দিও না। তুমি না দাদিজানকে কথা দিয়েছিলে আমাকে রক্ষা করবে তবে কেনো করছো না? ওরা আমাকে মেরে ফেলবে বাবা। আমার কহিনুরের র*ক্তে কহিনুরের শক্তি ফিরিয়ে নিবে।
এই পযর্ন্তই লেখা ছিল ডাইরিতে। অধরার চোখে পানির ধাঁরা নেমে আসলো। বাবা ওর জন্য কতটা চিন্তিত ছিল বোঝা যাচ্ছে। এই কাহিনী শুরু হয়েছিল বহুকাল আগে থেকে কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গে ওই পাথরের কি সম্পর্ক আছে বুঝতে পারলো না। আরমান ফারুকী জেনে বুঝে ওকে এই বাড়িতে এনেছে এটা পরিস্কার। মস্তিষ্ক কাজ করছে ওর। নিজের সঙ্গে বাচ্চাটার জীবনের ঝুঁকি আছে বুঝতে অসুবিধা হলো না। এই বাচ্চাটাকে ওরা মেরে ফেলবে। অধরার শরীর কাঁপছে। কিভাবে রক্ষা করবে নিজের সন্তানকে? সবাই যে স্বার্থপর। শাশুড়ি মাকে ও হাজারটা ধন্যবাদ দিলো। এই বাড়িতে থাকা ওর চলবে না। এই বাড়ির রহস্য ওর পিছনে ছাড়বে না মনে হচ্ছে। অধরা দ্রুত ডাইরি লুকিয়ে ফেলল। হাতে এখনো সময় আছে। ভাবতে হবে।
☆☆☆☆☆☆
বোবা হিসেবে অটিস্টিক স্কুল কলেজে পড়ার কথা ছিল মারিয়া ফারুকীর কিন্তু জুবায়ের কখনও চায়নি ছোট বোনটাকে এভাবে আলাদাভাবে মানুষ করতে। ও নিজ দ্বায়ীত্বে বোনটাকে নরমাল ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই মানুষ করেছে। বোনটাকে ও খুব স্নেহ করে। সব সময় পাশে থাকার চেষ্টা করে। মেয়েটার বুদ্ধিমত্তাটা সাধারণ মেয়েদের মতো না। সহসা সে রাগে না। রাগলেও কাঁদে না। মন খারাপ বিষয়টা একদম এড়িয়ে চলে। জুবায়ের প্রতিদিন বোনকে ইউনিভার্সিটির গেটে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যায়। ক্লাস শেষে বোনকে নিতে আসে। কখনও এর এদিক ওদিক হয়না। আজও ওর ভুল হয়নি। বোনকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মারিয়া মাথায় মাফলার চাপিয়ে চুপচাপ ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো। ক্লাসের সামনে ওর সহপাঠীরা জড় হয়েছে। ওকে নিয়ে আলোচনা করছে। কেউ জানেনা আধরা কথা বলতে জানেনা। ওরা ভেবেছে মেয়েটা ইচ্ছে করে সবাইকে অপমান করছে। ক্লাসে যাওয়ার আগে সবাই মিলে ওকে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিলো। মারিয়া ঠোঁটে হাসি রেখে সবাইকে দেখেছে। চুপচাপ ক্লাস করে যখন বেরিয়ে আসবে ঠিক তখনই পাশ থেকে একটা ছেলে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ছেলেটার চোখেমুখে বিস্ময়। মারিয়া ইশারা করলো কি চাই। ছেলেটা ভ্রু কুচকে বলল,
> কথা বলতে পারো না কিন্তু শুনতে নিশ্চয়ই পারো?
মারিয়া চমকে উঠলো। এই সত্যিটা জুবায়ের ছাড়া কেউ জানেনা। কিন্তু এই ছেলেটা জানলো কিভাবে?

মারিয়া থমকে গিয়ে আবারও হাটতে শুরু করলো। ছেলেটা দমে গেলো না। দ্রুত ওর পিছু নিয়ে বলল,
> ভয় পাচ্ছ তুমি? আমি তোমার ক্ষতি করবো না। আমি জানি তুমি শুনতে পাও। আমি দেখেছি কেউ ডাকলে তুমি সেদিকে তাঁকাও। উচ্চ শব্দ হলে কানে হাত রেখে প্রতিরক্ষা করো। ঠিক বলছি না! বলো তুমি?
ছেলেটা হড়বড় করে কথা বলে চলেছে। মারিয়া দৌড়ে গেলো গেটের দিকে। ছেলেটাও কম যায়না ওর পেছনে ছুটছে। জুবায়ের বোনকে নিতে এসেছিল হঠাৎ ওকে দৌড়াতে দেখে হুট করে গাড়ি থেকে নেমে নিজেও এগিয়ে গেলো। বোনের হাত ধরে পেছনে তাঁকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> কি চাই!ওকে বিরক্ত করছেন কেনো?
ছেলেটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কোনো রকমে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> সরি আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। ও অযথাই আমাকে ভয় পাচ্ছে। বন্ধুত্ব করতে চাইলাম। আসলে ওতো একা থাকে।
জুবায়ের মুখটা কঠিন করে বলল,
> ওর থেকে দূরে থাকবেন। নিজের জন্য ভালো হবে। আমার বোন কথা বলতে পারে না। বন্ধুত্ব করতে চাইলে অন‍্যদের সঙ্গে করুন।
জুবায়ের আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত ওকে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে আসলো। দিন যাচ্ছে সময়টা কঠিন হচ্ছে। সুলতান বাড়ির মেয়েদের জন্য যে ভালোবাসা বিয়ে বা সংসার করা ভাগ্যে নেই। ওরা যেতেই ছেলেটা চোখ বন্ধ করলো। এই মারিয়া ফারুকীকে ওর চাই। যেভাবেই হোক চাই।
☆☆☆☆☆☆☆
ডাইরি পড়ার পরে অধরার দুবার বমি হয়েছে। অতিরিক্ত টেনশনে পেশার কমে গেছে। অশান্তি লাগছে। শরীর বেশ দুর্বল। খেতে ইচ্ছে না হলেও ও খাওয়া বন্ধ করছে না। এই মূহুর্তে শরীর ঠিক রাখা জরুরি। সারাদিন জুবায়ের এই রুমে আসেনি। যখনই আসে তান্ডব করে যায়। অধরা জানে লোকটা না আসলেও ওর উপরে নজর ঠিকই রাখছে। ওর মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে আয়নাটা লাথি দিয়ে ভেঙে দিতে। এই বাড়ি থেকে যাওয়ার দিন ও এই মহান কাজটা ঠিকই করে যাবে। কথাগুলো ভেবে ও বিছানা থেকে উঠে পড়লো। ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে নিয়ে বের হলো। এই বাড়িতে রাত হলে আধার নেমে আসে। আলোর ব‍্যবহার যদিও এই বাড়িতে খুব কম। এরা কিভাবে এই অবছা আলোতে থাকতে পারে আল্লাহ্ ভালো জানে। অধরা সেদিনের সেই যুবকের খোঁজ করতে নেমেছে। পাশের রুমে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। অধরা উঁকি দিয়ে দেখে নিলো। ছেলেটা নিচের রুমে ছিল ও সেদিকেই এগিয়ে গেলো। চুপচাপ রুমে ঢুকে পড়লো। কিন্তু আজ এখানে কেউ নেই। নিস্তব্ধ লাগছে। অধরা আশেপাশে তাঁকিয়ে দেখলো। মাঝারি রুম মাঝখানে বড়সড় একটা খাট। দেয়ালের সঙ্গে আলমারিটা লটকানো আছে। রুমটাতে কোনো বেলকনি নেই। অধরা হতাশ হয়ে পড়লো। ফিরে আসতে চাইলো কিন্তু হঠাৎ আলমারির মধ্যে খুট করে শব্দ হতেই ফিরে আসলো। দ্রুত আলমারির দরজা খুলে হতবাক। এখানে আরেকটা দরজা আছে। ও দ্রুত দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। নিচের দিকে সিঁড়ি। অধরা চুপিচুপি নেমে পড়লো। বেশ কিছু সিঁড়ি পার করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলো। এখানে উপরের মতো পাশাপাপাশি তিনটা রুম। রুমে কোন জানালা নেই। অধরা একটা রুমে ঢুকে পড়লো। বিশাল বড় রুম। চার‍দিকে দামিদামি আসবাবপত্রের ছড়াছড়ি। এখানে কেউ থাকে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। অধরার গা ছমছম করছে। ও আশপাশ যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিল হঠাৎ ওর কাধে কারো নিশ্বাস পড়লো। অধরা চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে অবাক হলো। সেদিনের সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। অধরা ভয়ে কাঁপছে। ছেলেটার মধ্যে কোনো বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
> এখানে কি তোমার? রুমে যাও।
অধরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
> কে আপনি?
ওর প্রশ্ন শুনে ছেলেটা হয়তো মজা পেলো। ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
>কেনো চিনতে অসুবিধা হচ্ছে? আমি সুলতান জুবায়ের ফারুকী,তোমার স্বামী।
অধরা বিরক্ত হলো। জুবায়েরের চালচলন ওর খুব ভালো করে রপ্ত আছে। জুবায়ের কখনও এমন শান্ত থাকে না। অধরার কপালে ভাজ পড়লো। মুখটা কঠিন হয়ে আসলো। রাগে দাঁত চেপে বলল,
> মিথ্যা বলার একটা লিমিট থাকে। আমি জানি আপনি জুবায়ের ফারুকী না তাই ভনিতা রেখে নিজের ফর্মে আসুন। বলুন কে আপনি? এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকার মানে কি? চারদিকে এতো রহস্য ছড়িয়ে কি প্রমাণ করছেন আপনারা?

ছেলেটা ঘাবড়ালো না। প্রাণখুলে হাসলো। ওর মধ্যে না আছে উত্তেজনা আর না আছে সত্যি প্রকাশের ভয়। কোনরকম হাসি থামিয়ে অধরার চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,
> মনে আছে সেই তুষারপাতের রাতের কথা? তুমি বন্দী হয়ে আটকে ছিলে নির্জন রাস্তায়। তোমার গায়ে ছিল সাদা শুভ্র পোশাক। আধার কালো রাত্রীর বুক চিরে মনে হয়েছিল তুষারের উপরে কোনো পরি নেমে এসেছিল। আমার হার্ট ধুকপুক করছিল। ভেবেছিলাম একটু ছুয়ে দেখি। কিন্তু পারলাম না। মায়ায় জড়ানো যে আমার জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তোমাকে সাহায্য করেছিলাম। মনে আছে?
অধরা এবার ঢোক গিলল। এসেছিল এক রহস্য ঘাটতে এখানে এসে আরেক ঝামেলায় জড়িয়ে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> কবে কোথায় কি হয়েছে সেসব আমার মনে নেই। দয়াকরে সেসব এখন টানবেন না। আমি শুনতে ইচ্ছুক না। তাছাড়া আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী। আশাকরি সম্মান করবেন।
অধরার করা শুনলে ছেলেটা আবারও হাসলো। বিড়বিড় করলো” বাঘিনী”। অধরার ভয় করছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। নির্জন এই কক্ষে শুধু একটাই ভরসা। আর যাইহোক এই বাড়ির কেউ ওর ক্ষতি করবে না। এখনো সেই সময় আসেনি। ছেলেটা সোফায় গিয়ে বসতে বসতে বলল,
> অনুমতি থাকলে তোমাকে আমার করতে এক সেকেন্ডও লাগতো না। আফসোস তুমি আমারই ভাইয়ের স্ত্রী। বিষয়টা খুব জঘন্য তাই না? একই জঠরে জন্ম নিয়েও ও কতসুন্দর জীবনযাপন করছে অথচ আমি এই অন্ধকারে সঙ্গী বিহীন। সময় আমারও আসবে। আচ্ছা ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ের অনুমতি আছে তো তাই না?
অধরা জ্বলে উঠলো লোকটার এরকম জঘন্য কথাবার্তা শুনে। ছিঃ এটা কি মানুষ। জুবায়ের খারাপ হোক কিন্তু এতটা জঘন্য না। অধরা চোখমুখ কঠিন করে বলল,
> তাঁর আগে জেনো আমার মৃত্যু হয়। দরকার নেই আপনার পরিচয় জানার। আপনি যে কতটা জঘন্য যেটা বুঝতে আমার বাকি নেই। জুবায়েরের দৃষ্টি চনচল,বদ মেজাজী তবে আপনার মতো ঘৃণ্য না।
> তাই নাকি? কিন্তু ও যে তোমার সঙ্গে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করলো তাঁর বেলা?
> চোখ বন্ধ করে মানুষ বিষ খেয়ে নিতেও দ্বিধা করে না। আমার তো মনে হচ্ছে ওকে দিয়ে আপনারা করিয়ে নিচ্ছেন। প্রয়োজন শেষে ওকে ছুড়ে ফেলতে সময় নিবেন না। যেমন আপনার বাবা করেছিলেন। উনি জমজ ভাইকে সরিয়ে তাঁর জায়গাই নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। দারুন বুদ্ধি কিন্তু।
ছেলেটা এবার চোখ শক্ত করে নিলো। এই মেয়েটা অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। এতোটা জানার দরকার ছিল না। ও এতক্ষণ মেয়েটাকে মূল বিষয় থেকে সরিয়ে নিতে আজেবাজে বকেছে কিন্তু না মেয়েটার লক্ষ্য ঠিক আছে। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। ঝঙ্কার দিয়ে বলল,
> জুবায়ের রুমে অপেক্ষা করছে। সময় মতো না পৌঁছনোর ফল আশাকরি ভালো হবে না। শুনো বড় মায়ের কক্ষে আর কখনও যাবে না। এতো কৌতূহল ভালো না। আমি তোমাকে রক্ষা করবো প্রমিজ করছি। এখন যাও।
অধরা চুপচাপ চলে আসলো। এই লোকটার সামনে ও দ্বিতীয়বার আর পড়তে চাই না। খারাপ অভদ্র লোক। রুমে গিয়ে আবার জুবায়েরের ঝামেলা। অধরা দৌড়ে উপরে আসলো। ভাবলো জুবায়ের যদি জানতে পারে তবে তান্ডব লাগিয়ে দিবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here