ভাড়াটে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২.
শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়ে গেল। আমার কাছে এখনো ঘোলাটে লাগছে সব। ছোটবেলায় সিন্ড্রেলা, স্নো ওয়াইটের রুপকথাগুলো শুনে শুনে কল্পনার মানসপটে নিজের জন্যও একটা রাজকুমারের ছবি এঁকেছিলাম আমি। সে ঘোড়ায় করে আসবে, আমাকে নিয়ে যাবে আমার পছন্দসই জায়গায়। আমার খুব যতনে আঁকা রাজকুমারের প্রতিচ্ছবি অবশ্যই কনক নন। ওই হ্যাংলা হাতিকে আমি কখনোই পছন্দ করতাম না, করি না। উই আর এনিমি! পৃথিবীতে চিরুনি তল্লাশি করেও এমন জানেজিগার শত্রু খুঁজে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ আছে। একে অপরের চুল টানাটানির জন্যই আমাদের জন্ম। নাকি ভালোবাসে চুনুমুনু করার জন্য!
বিয়েটা আটকাতে আমি কম চেষ্টা করিনি। এমনকি সকালেও পালাতে চেয়েছিলাম। নিজের ব্যবহারযোগ্য ওড়নাগুলো বারান্দার রেলিংয়ের সঙ্গে বেঁধে সিনেমার নায়িকাদের মতো সুরসুর করে নামার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভুলে গেলে হবে না, আমি নায়িকা নই। নায়িকাদের মতো অলৌকিক শক্তি নেই যে এই সামান্য ওড়না আমার ওজন নিতে পারবে। তারওপর তিনতলা বিল্ডিং! এত তাড়াতাড়ি মরার শখ হয়নি আমার বাপু! তারচেয়ে ওই কনইক্কাই ভালো। অনতত ঝগড়া করে সময় তো কাটবে!
ওভাবে পালানোর প্লেনটা বাদ দিলাম। এবার ফ্ল্যাটের সদর দরজা দিয়ে পালাবো ভাবলাম। কিন্তু অসহ্য ব্যর্থতা পিছু ছাড়লো না। বিশ্রী গন্ধযুক্ত আঠার মতো পিছেই পড়ে রইলো। চাদর, টাদর দিয়ে নিজেকে ডাকাতের মতো ঢেকেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাবা হাতেনাতে ধরে ফেললেন। আমি চেঁচালাম, কাঁদলাম— আমি বিয়েটা করবো না। বাবা শুনলেন না। কাঁদার একফাঁকে দেখলাম, সদর দরজার কাছে কনক দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি স্থির আমার দিকেই। ঠোঁটে শয়তানি হাসি। আমাকে হেনেস্তা হতে দেখে মনে মনে ভীষণ পৈশাচিক আনন্দে হয়তো নাচানাচিও শুরু করে দিয়েছেন। আমিও কম কিসের? একে আমি নাকানিচুবানি খাইয়েই ছাড়াবো!
–
কনকের রুমটা খুব গোছালো। আমার রুমের মতো না। আমার রুমে জিনিস রাখার জায়গা এক জায়গায় আর জিনিস অন্য জায়গায়। কিন্তু এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা তো ভালো লাগছে না। ভারী শাড়ি সামলে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। প্রথমে নষ্ট করলাম গুছানো বিছানার চাদর, সাজসজ্জায় ব্যবহৃত ফুলগুলো, কনইক্কার বাঁধানো ছবিগুলো দেওয়াল থেকে নিয়ে এদিক-ওদিক ফেলে রাখলাম। এতটুকু করতেই যেন ক্লান্তিতে শরীরের ঘাম ছুটে গেল। কতগুলো কাজ করে ফেললাম এটুকু সময়ে। ভাবা যায়? এখন আমার দরকার প্রকৃতির নির্মল বাতাস। যা একমাত্র বারান্দায়ই পাওয়া যাবে।
লিউইসকে বাবা এখানে আনতে দেননি। এর অবশ্য কারণ আছে। কনইক্কা ইচ্ছে করে বাবাকে ফুসলিয়েছে, আমি জানি।
বারান্দায় গিয়ে আমার রুম একটুখানি উঁকি দিয়ে দেখলাম। আহা! আমার প্রিয় রুমটা! আমি ছাড়া কেমন এতিম এতিম হয়ে আছে। লিউইস শুয়ে আছে বিছানার মাঝখানটায়। খুব অসহায় ভাবে। আমি ডাকলাম ওকে। ও যেন খুব চমকালো। বারান্দার দিকটায় আমার আওয়াজ পেয়ে লাফিয়ে উঠলো ভীষণ ভাবে। একছুটে আমার কোলে চলে আসলো। আমি খুব করে আদর করলাম ওকে। পোষাপ্রাণিগুলো এত মালিকভক্ত হয়!
—“ধিন্দি! আমার রুমের এই অবস্থা কেন?”
চেঁচিয়ে কি কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবে নাকি এই লোক? উফ! এটা গলা নাকি অন্যকিছু মাবুদ! প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বারান্দা থেকে রুমে আসলাম। আমার কোলে লিউইসকে দেখে আপনা-আপনি এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন কনক। আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “এই লিউ-টিউ এখানে কেন?”
আমি অবাক হওয়ার ভান করলাম, “কেন মানে? কোথায় থাকবে? আমি যেখানে সেখানেই তো থাকার কথা ওর।”
—“না, থাকার কথা না। আমার রুমে ও থাকতে পারবে না।”
আমি এগিয়ে গিয়ে সোফায় আরাম করে বসলাম। লিউইসের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে ওদিকেই মনোযোগী হয়ে বললাম, “ভুলে যাচ্ছেন নাকি মিস্টার কনইক্কা? এটা কিন্তু এখন থেকে আমারও রুম। আমার প্রিয় জিনিসগুলোও এখন থেকে এখানেই থাকবে।”
আচমকা কনক দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলেন। আমার মাথার ঘোমটা সরিয়ে চুলের বেণি টেনে ধরলেন। তাচ্ছিল্য করে বললেন, “এত সহজ?”
চুলে টান অনুভব হতেই চোখ-মুখ, পুরো মুখশ্রী বিকৃত করে ফেললাম, “উফ! ছাড়ুন! ব্যথা পাচ্ছি না?”
—“রুম গুছাও।” সাবলীল আদেশ। অথচ আমার জটিল প্রতিবাদ, “পারবো না। আমি এখন ঘুমাবো।”
—“রুম গুছানোর আগে ঘুমাতে পারবা না।”
চুল থেকে কনকের হাত ছারানোর চেষ্টা করে বললাম, “ফালতু লোক! সরুন সামনে থেকে। আপনাকে দেখলেই গাটা জ্বলে যায় শুধু।”
কনকের ব্যাঙ্গাত্মক উত্তর, “তো? আমার কি আদর সোহাগ জাগে নাকি?”
ঝগড়া চলতেই রইলো। আমাদের ঝগড়া শুরু হয়েছিল ঘড়ির বরাবর বারোটা পঞ্চান্ন মিনিটের কাটায়। শেষ হলো একটা পঞ্চান্নতে। পুরো এক ঘন্টার ঝগড়ার সমাপ্তি বিন্দু হলো লিউইশ। হ্যাংলা হাতি কনইক্কা আমার লিউইশকে বারান্দা থেকে ফেলে দেওয়ার ভয়াবহ ধমকি থামতে বাধ্য করলো আমাকে। নিমিষেই নিজের ঝগড়াটে রুপ পালটে নমনীয়, কোমল নারী হয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “ওকে ফেলবেন না কনক সোয়ামী। এখান থেকে পরলে মরেই যাবে ও।”
কনক দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আগাগোড়া দেখলেন আমায়। বিড়বিড় করে বললেন, “নাটকবাজ ধিন্দি!”
তবে অকপটে বললেন, “আমার সাথে বেয়াদবি করার শাস্তি হিসাবে পঞ্চাশবার কান ধরে উঠবস করবে এখন। তারপর রুম গুছাবে। যাও।”
শুনে আমার যেন মাথা ঘুরবার যোগাড়। পাগল প্রায় হয়ে বললাম, “পঞ্চাশবার? তাও একা? দুইজনে একসাথে ভাগাভাগি করলে হয়না? আমি পঁচিশ, আপনি পঁচিশ?”
প্রতিউত্তরে কনক কিছুই বললেন না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এমনভাবে হাত আলগা করলেন, যেন তিনি এক্ষুণি লিউইসকে ছেড়ে দিবেন তিনতলা থেকে। উপায়হীন আমাকেও কনকের সামনে পঞ্চাশবার কান ধরে উঠবস করতে হয়েছে। তারপর আবার রুমও গুছাতে হয়েছে। কনক পুরোটা সময় আমার ওপর নজরদারি করছিলেন। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই গমগমে গলায় বলে উঠছিলেন, “ধিন্দি আন্ধি হয়ে গেছ? ওইখানে কাগজ পরে আছে, দেখছো না?”
আমি তখন কটমট দৃষ্টে তাকাচ্ছিলাম তার দিকে। দৃঢ় প্রতিশোধের জন্য গাঢ় হচ্ছিল মনোভাব।
এত এত কাজ করে শেষে ক্লান্তিতে আমার শরীর অচল হয়ে পরলো। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম। বেচারা লিউইস ঘুমানোর জন্য স্থান পেল সোফার এককোণায়। কনইক্কা যে এত পাষাণ! এত নিষ্ঠুর! কস্মিনকালেও কখনো ভাবিনি। আমি এখন নিশ্চিত! কনক আঙ্কেল, আন্টির ছেলে নন। রাজাকারের ছেড়ে যাওয়া কালিমাখা বংশধর।
–
আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। আমি অচেনা জায়গায় ঘুমাতে পারিনা। অন্ধকারে ভয় পাই। তখন ক্লান্তিতে ঘুম পেলেও মাঝরাতে ঠিকই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবিষ্কার করলাম, এ জায়গা আমার চেনা না। খুব অচেনা। ডিমলাইট নেই, কিচ্ছু নেই! চারপাশে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। নিজের উদরে শক্তপোক্ত কি যেন একটা আছে। উষ্ণ নিশ্বাসের শব্দ কানে লাগছে। ভয়ে মুখ পানসুটে হয়ে গেল। লিউইসও কাছে নেই। ও থাকলে ভয়টা আমার একটু কম লাগে।
উদরে থাকা জিনিসটা একটুখানি নড়লো। এতক্ষণে সচল হলো মস্তিষ্ক। এটা কনকের হাত। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। খুব ভালো ভাবেই, শক্ত করে। রাগে, দুঃখে তৎক্ষণাৎ দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচালাম, “হাত সরান কনইক্কা! হাত ভেঙ্গে দিবো কিন্তু।”
সে নড়লেন মাত্র। নীরবই রইলেন। আমার ধৈর্য শক্তি ফুরিয়ে গেল। প্রচন্ড রাগে খিটখিটে হয়ে গেল মেজাজ। সজোড়ে পেটে থাকা হাতটা টান মেরে কামড় বসিয়ে দিলাম ফর্সা চামড়ায়। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড! পরপরই চোখ, মুখ খিঁচে কনকের ভরাট কণ্ঠের চিৎকার শোনা গেল, “ধিন্দি! তোমাকে আমি কাঁচা চিবিয়ে ফেলবো!”
_______________
চলবে~