#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৩
৭.
মুখের সামনে কারো গরম নিঃশ্বাস টের পেয়েও ঘুম ভাঙলো না মৌনর। চারঘন্টা জার্নির ক্লান্তি, তীব্র শরীর ও মন ব্যথা নিয়ে সে গভীর ঘুমে। চোখ খুলে সামনে তাকানোর শক্তি হয়তো তার নেই। তবে থেমে থেমে নিজের হাত পায়ের জখমগুলোতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো সে। মনে হচ্ছে কাঁচগুলো কেউ টেনে টেনে খুলছে।
বেলা এগারোটা। নীল আকাশে রাজত্ব করছে তেজস্বী সূর্য। সূর্যের তেজে হতাশ চোখে তাকিয়ে পৃথিবীর মানবজাতি। সূর্যের সে খেয়াল আছে নাকি! সে তো নিজের তেজ দেখিয়ে মহাখুশি।
‘মৌন, মা। উঠো মা।’
শাশুড়ীর ডাকে ঘুম ভাঙে মৌনর। আস্তে আস্তে চোখ খুলে নিজেকে ধাতস্থ করে সে কোথায়। এটা কোন জায়গা? আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজে তার চৌকি, পড়ার টেবিল, তার বোন রথি। কোথায় সব!
খানিক সময়বাদে মনে পড়ে এটা ফরিদপুর নয় এটা তার শশুড় বাড়ি ঢাকা ধানমন্ডি।
‘মৌন, বাবুই তোমার গাঁয়ে হাত তুলেছে?’
নিজেকে সামলিয়ে মৌন বলে,
‘না, মা।’
মৌনের হাত দুটো সামনে টেনে ধরেন মিরা রহমান। এলোমেলো ব্যান্ডেজ পেঁচানো।
‘এগুলো কি করে হলো মা।’
‘আসলে, ঘরে অনেক কাঁচের টুকরো ছিলো যে। লেগে কেঁটে গেছে।’
মিরা রহমান বিষয়টি আর ঘাটলেন না। উনি জানেন এগুলো তার ছেলেরই করা। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
‘খাটে তোমার জন্য শাড়ি রেখেছি। ফ্রেশ হয়ে ডাক দিয়ো আমি পরিয়ে দিবো।’
‘সমস্যা নেই মা। আমি পারবো।’
‘আচ্ছা, আসো। হাঁটতে পারবে?’
‘জ্বি।’
শাশুড়ী বেরিয়ে যেতেই দেয়াল ধরে ঘরে আসে মৌন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তার হাত,পায়ে কোনো কাঁচ বিঁধে নেই। এবং ব্যথাটাও কম।
________________
হাত, পায়ের এলোমেলো ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে মৌন।ফ্রেশ হয়ে নীল রঙা শাড়িটা পরে নিচে আসে সে। সোফায় বসে পেপার পড়ছেন নাজমুল। সাথে চা খাচ্ছেন। মিতু পাশে বসেই টিভি দেখছে। বিশাল ড্রয়িং রুম। মৌনকে দেখে মিতু ইশারা করলো পাশে এসে বসতে। মৌন ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো।
‘তুমি কিন্তু আমার অনেক ছোট। আমি তোমায় ভাবি ডাকবো আর তুমি আমাকে আপু ডেকো। কেমন?’
‘ঠিক আছে আপু।’
‘আসো, খাবারটা খেয়ে নাও। আম্মু সকালেই ডাকতে চেয়েছিলেন। আমিই না করেছি। এতো জার্নি করেছো একটু রেস্ট প্রয়োজন।’
নাজমুল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটা বড়ই মিষ্টি, নম্র, ভদ্র। নাজমুল বলেন,
‘মা, তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো? কিংবা তোমার শাশুড়ীর উপর?’
‘না, বাবা।’
‘আচ্ছা, তুমি ব্রেকফাস্ট করে আমার ঘরে এসো। কিছু কথা বলা প্রয়োজন।’
‘জ্বি।’
ডাইনিং টেবিলে অসহায় ভাবে বসে আছে মৌন। হাতের যে অবস্থা! নিজ হাতে খাওয়া সম্ভব না। তখনই মিরা একটা প্লেট নিয়ে এসে চেয়ার টেনে মৌনর পাশে বসেন। গরম ভাত আর মুরগির মাংস লেবু দিয়ে মাখিয়ে একটা লোকমা মৌনের সামনে ধরেন। মৌন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। মিরা ইশারা করেন লোকমাটা খেতে। মৌন হা করে মুখে পুরে নেয়। অবাক চোখে তাকিয়ে মমতাময়ী শাশুড়ীকে দেখছে। ফরিদপুরে মিরার অনেক সুনাম আছে। প্রত্যেক ইদে, শীতে মানুষকে হাত ভরে দান করতেন। মৌন প্রায়ই উনি ঢাকা থেকে গেলে উনাদের বাসায় যেতো। নিম্নবিত্ত বলে কখনোই অবহেলা করতেন না। উজ্জ্বল ফর্সা, খোঁপা করা, ক্রিম কালার শাড়ি পরিহিতা মহিলাটিকে মৌনের খুবই আপন মনে হচ্ছে। খুব!
‘শোনো মৌন মা। আমার ছেলেটাকে একটু সময় দাও। মাত্র একটা ট্রমা থেকে উঠেছে। রুহানিকে ও সত্যিই অনেক ভালোবাসতো। আমার নরম ছেলেটা কেমন পাগলাটে হয়ে গেছে। ওঁর মন অনেক ভালো মা। একটু মানিয়ে নাও। আমাদের ভুল বুঝোনা। ছেলেকে সুখী দেখতে কে না চায়? আমরা কি বেশি স্বার্থপর হয়ে গেছি? আমি জানিনা। তবে তোমার চোখে কি যেন দেখেছি। আমার মনে হয়েছে। হ্যাঁ, এই মেয়েটাই পারবে আমার বাবুইটাকে সুখি করতে। পারবেনা মা?’
মৌন চুপ করে আছে।মিরা রহমান নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেন। তার চশমা ঝাপসা হয়ে উঠে। উনি বাঁ হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে তা মুছে নেন।
৮.
‘বাবা, আসবো?’
‘আসো।’
নাজমুল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। ছেলের চিন্তায় তার চোখের তলা কালো হয়ে গেছে। বাড়িটার সবচেয়ে বড় ঘরের এটি বোধহয় একটি। বিশাল খাট, পাশে ইজি চেয়ার, দেয়ালে সেট করা আধুনিক টেলিভিশন, নিভৃতের ঘরের মতো একটা ডিভান। আর পাশেই বিশাল বুকসেলফে বইয়ের সমাহার।
মৌন দাঁড়িয়ে রইলো। হাতে পায়ে মাঝেমাঝে চিনচিন ব্যথা হয়। ছোট কাঁচ বোধহয় রয়ে গেছে ভিতরে। একটু আধটু চুলকায়। নরম পায়ে কাঁচগুলো তীব্রভাবেই ডেবেছিলো।
‘খাটে বসো।’
কিছুক্ষণ নিরবতা। বারান্দা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে নাজমুলের মুখে। পুত্রের চিন্তায় লোকটা যে অনেক হতাশ তা যেন রোদের আলোয় আরো গাঢ় করে প্রস্ফুটিত হচ্ছে।
‘মৌন মা।’
‘জ্বি,বাবা।’
‘আমার ছেলেটা কিন্তু খারাপ না, মা। অধিক শোকে সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। আমি বাবা হয়ে কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিলাম না। নিভৃতের মা বললেন ছেলেকে আবার বিয়ে দিলে কেমন হয়?’
নাজমুল থেমে আবার বলেন,
‘আমি প্রথমে না মানলেও ছেলের দুর্দশা দেখে মানতেই হলো। মিরা তোমার কথা বললো। আমিও আমার বাল্যবন্ধু আলমের কাছে অন্যায় আবদার করে বসলাম। ব্যাংকের টাকা শোধ করতে ও যখন টাকা চাইতে আমার কাছে এলো আমি বিনিময় তোমাকে পুত্রবধূ হিসেবে চেয়ে নিলাম। আমি জানি কাজটা ভালো হয়নি। তবে আমি অপারগ ছিলাম মা। এই অসহায় বাবাকে ক্ষমা করে দিও মা।’
মৌন মাথা নিচমুখী করে এতক্ষণ সব শুনছিলো। এবার মুখ তুলে চেয়ে বললো,
‘এভাবে বলবেন না বাবা। আমার নিজেকে ছোট মনে হয়।’
‘বাবা বলে ডেকেছো যেকোনো দরকার হলে আমাকে জানাবে। এই টাকাটা রাখো। আর পড়াশোনার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো? পাবলিকে পরীক্ষা দিবে? কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিবো?’
নাজমুল একহাজার টাকার পাঁচটা নোট গুঁজে দিলেন মৌনর হাতে। মৌনের না তিনি শুনেননি।
‘আপনি যা ভালো মনে করেন বাবা।’
‘দোয়া করি সুখি হও মা।’
৯.
দাদিশাশুড়ি দিলারার সাথেও বেশ জমলো মৌনের। তিনি হাঁটতে পারেন না। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। দিলারার একটা কথা খুবই মনে ধরেছে মৌনর।
‘নারীই পারে পুরুষের ক্ষত ভুলাতে। পুড়তে পুড়তে অঙ্গার, ছাই হয়ে যাওয়া বুকটাকে আবার বাগানে রুপান্তরিত করতে। কেবল প্রয়োজন মায়ায় জড়ানো। ভালোবাসা নামক পবিত্র বাঁধনে আটকে দেওয়া।’
এ বাড়িতে দুইজন বুয়া আছেন। একজন ছুটা বুয়া আরেকজন স্থায়ী। তাদের সাথেও কথা হলো। এবাড়ির প্রতিটা সদস্যই ভালো। অমায়িক তাদের ব্যবহার। তবে আসল লোকটাই যে মৌনকে মানেনা। আদোও মানবে কিনা মৌনের জানা নেই।
______________
মৌন নিভৃতের ঘরে ডিভানে বসে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করছে। এই বাড়িটা একটা দুইতালা ডুপ্লেক্স বাসা। দুতালায় দক্ষিণ পাশে ঘরটাই নিভৃতের। বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। এঘরটায়ও তেমনি। বিশাল রাজকীয় খাঁট, রাজকীয় ডিভান, শখের জিনিসে ঠাসা প্রতিটা কোণায়। খাটের সামনের দেয়ালটায় রুহানির ছোট থেকে শুরু করে তাদের বিয়ের সকল ছবি। সবচেয়ে বেশি মন কাড়ে রুহানির হাসোজ্জল ছবিটা। কি সুন্দর হাসি! পাশেই বিশাল দেয়াল ঘড়ি। মৌন মিতুর মুখে শুনেছে এই ঘরের প্রতিটা জিনিস নিজের হাতে সাজিয়েছে রুহানি। ওঁর রাজকীয় ঘর, পুরানো সু-পিস বেশ পছন্দ ছিলো। তাই এমন রাজকীয়ভাবে ঘর সাজিয়েছিলো সে। মৌনর হঠাৎ খারাপ লাগছে। সে কি স্বার্থপর হয়ে গেলো? কারো সাজানো গুছানো সংসারে সে কি পরগাছা? নাকি কোনো পরিযায়ী পাখি? হায়! কত স্বপ্ন নিয়ে দুজনে মিলে নিজের ছোট সংসার সাজিয়েছিলো। আজ কোথায় গেলো সেই সংসার। একজন মাটির নিচে আরেকজন মাটির উপরে তার দহনে পুড়ছে। এ কোন খেলা নিয়তির! রুহানিকে মৌন একবার দেখেছিলো। তাদের গ্রামে গিয়েছিলো সে। অনেক হাসি-খুশি একটা মেয়ে ছিলো।
ঘরে প্রবেশ করে বিধ্বস্ত নিভৃত। পরনে কালো টাউজার, সাদা টি-শার্ট। মৌনকে দেখেই তেড়ে গেলো তার কাছে। মৌন ভয় পেলেও তা প্রকাশ করলোনা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো একসময়ের তার দেখা সুদর্শন পুরুষটার বিষণ্ণতা, হতাশা, প্রেয়সীর মৃত্যুর শোকে শরীর, চেহারার বেহাল দশা।
‘এই বেয়াদব মেয়ে। তুমি আবার আমার ঘরে এসেছো। তুমি কি ভেবেছো আমার রুহানির জায়গা নিবে? জীবনেও না। স্বার্থপর, ছোটলোক মেয়ে।’
মৌন কিছুই বলছেনা দেখে আরো মাথা খারাপ হয়ে যায় নিভৃতের। তাকে পাশের দেয়ালে নিয়ে চেপে ধরে। হাতের ব্যথা প্রাপ্ত স্থানে আঘাত লাগায় ‘আহ্’ করে উঠে মৌন।
মৌনকে দেয়াল থেকে শরীরে দরজার দিকে টেনে নিচ্ছে নিভৃত।
‘আপনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারেন না। আমারও এই ঘরে অধিকার আছে। আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী।’
ছোট মেয়েটার মুখে এরূপ কথা শোনায় থেমে যায় নিভৃত। মাথা গরম হয়ে যায় তার। আবারো চড় বসিয়ে দেয় মৌনের গালে। মৌন চোখে জল, মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে কেবল।
‘একদম অধিকার দেখাবিনা।এটা আমার আর রুহানির ঘর। তুই একটা ছোটলোক। তোর বাবাও….
‘ব্যস, অনেক বলেছেন। আমাকে যত যাই বলুন আমার বাবাকে একটা বাজে কথা শুনালে আমি ভুলে যাবো আপনার সাথে আমার সম্পর্ক। বিয়ে করে এই বাড়িতে এসেছি। উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এই ঘরেই থাকবো।’
তেজস্বিনীর গলায় থমকে যায় নিভৃত। বাথরুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। রাগে মাথা দপদপ করছে মৌনের।
(চলবে)……