#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ উনত্রিশ
#মম_সাহা
(৭৮)
সময় কখনো থেমে থাকে না। এই যে প্রেমের ঋতু বসন্ত, সে কি প্রেমিক হারানোর যন্ত্রণায় কভু নিশ্চুপ থাকে? থাকে না। কারণ, প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে। আর খুব সহজে সে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভুলে বাঁচতে শিখে যায়।
সময়টা রিক্ত শীতের মাস নভেম্বরের মাঝামাঝি। শহরের কঠিন শরীর চাদরে ঢাকা শীতকাল। বাহার ভাইয়ের জেল জীবনের অতিক্রান্ত সাতাশ দিন। বদলে গেছে সবকিছু। চিত্রারা ফিরে এসেছে নিজের বসতভিটাতে৷ সওদাগর বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। কোথাও যেন দূর বন হতে ভেসে আসে কানাকুয়োর অকল্যাণের সুর। বাতাসে বাতাসে কেমন স্বজন হারানোর শোক! সেই শোক ভুলানোর জন্য আফজাল সওদাগর অহির বিয়ের তারিখ ঠিক করেছেন আবার। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে তিনি সেড়ে ফেলতে চান বিয়েটা। অন্তত এই সুবাদে আনন্দরা হুমড়ি খেয়ে পড়ুক বাড়ির আঙ্গিনায়। হাসিরা নাহয় আরেকটা বার বাঁধন মুক্ত হোক। প্রতিটি মানুষের মাঝে নিজস্ব ভাঙন, অথচ প্রকাশ্যে তারা করছে ভালো থাকার চেষ্টা।
(৭৯)
মিরপুরের আধুনিক কলোনী শ্যাওড়া পাড়ার পাশ ঘেষে যাওয়া শুনশান জনমানবহীন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। পড়নে তার সাদা থ্রি-পিস। চোখে লাগানো রোদ চশমা এবং মুখে লাগানো মাক্স। খুব ধৈর্যের সাথে মিনিট কয়েক ব্যয় করে সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কারো অপেক্ষায়। শীতের মৌসুম অথচ তার শরীরে কোনো শীত বস্ত্র নেই। বরং হালকা ঘামের আভাস দেখা দিচ্ছে তার দেহ জুড়ে।
আরও মিনিট পাঁচ ব্যয় করতেই বড় আলিশান হোটেলটি থেকে বেড়িয়ে এলো সাদা পাঞ্জাবি পড়া উঁচু, লম্বা শক্তিশালী দেহের পুরুষ। মুখে লেগে থাকা মোহনীয় হাসি, শীতের শীতলতায় লাল লাল ওষ্ঠ। নির্দ্বিধায় সুপুরুষ বলা যায় তাকে।
হোটেলের বাহিরে এসে কাঙ্খিত রমণীকে চোখে পড়তেই মুচকি হাসলো সে। বেশ ভদ্রতার সাথে বললো,
“চিত্রা? এম আই রাইট?”
বেশ শান্ত ভাবে চিত্রা উত্তর দিলো, “হ্যাঁ।”
ভদ্র লোকটি পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে বললো,
“খুব ভুল না করলে আপনি বর্তমানের জেল খাটা আসামী বাহারের প্রেমিকা, তাই না?”
চিত্রার কোমল মুখমণ্ডল শক্ত হলো, কর্কশ কণ্ঠে বললো, “না। শুভাকাঙ্খী।”
চিত্রার উত্তরে বেশ দা°ন°বীয় এক হাসি দিলো লোকটা। কোমড়ে দু’হাত রেখে গা জ্বালানো হাসি দিয়েই বললো,
“হয়, হয়, এমনই হয়, প্রেমিকের কঠোর সময়ে প্রেমিকারা তাদের পরিচয় দিতে চায় না। প্রেমিক তখন শুভাকাঙ্খী হয়ে রয়।”
লোকটার গা জ্বালানো কথায় বিরক্ত হলো চিত্রা। চোখ মুখ বিরক্তে কুঁচকে এলো তার। অসহ্য রকমের এক মুখ ঝাম্টা দিয়ে বললো,
“প্রেমিক-প্রেমিকার সংজ্ঞা শুনতে আমি আপনার কাছে আসি নি। দরকারেই এসেছি। আমার দরকারী কথাটা শুনবেন দয়া করে।”
“হ্যাঁ বলুন। আমার আবার তত সময় নেই।”
বর্তমানে নিজের সামনের অবস্থানরত ছেলেটার সাথে কথা বলার নূন্যতম ইচ্ছাও চিত্রার মাঝে নেই। তবুও, বিপদের সময় ইচ্ছে অনিচ্ছার চেয়ে গুরুত্বটা বেশি ভূমিকা পালন করে। সেই জন্যই চিত্রা নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“আপনি নিজের এমন পাওয়ার ভুল কাজে লাগানো বন্ধ করবেন।”
“যেমন?”
“আপনার জন্য আজ আমার বাহার ভাই দোষী নাহয়েও চৌদ্দ শিকের ঐ অন্ধকার ঘরে আটকে আছে। তার উপর কোনো উকিল আমাদের পক্ষের কেইস লড়তে ইচ্ছুক না। একমাত্র আপনি তাদের ভয় দেখাচ্ছেন বলে তারা রাজি হয়েও পিছিয়ে আসছে। রাজনীতি যদি কুকাজেই লাগান তবে সে রাজনীতির মানে কী?”
“আর কিছু?”
নিজের এত গুলো কথার বিপরীতে সামনের লোকটার এমন উত্তরে ভীষণ বিরক্ত হলো চিত্রা। মাথার মাঝে তরতর করে রাগেরা হামাগুড়ি দিলো। মুখ-চোখ তার নিমিষেই লাল হয়ে উঠলো, কণ্ঠধ্বনি সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে সে চেঁচিয়ে বললো,
“আপনাকে আমি খু°ন করবো।”
কথাটা বলার সাথে সাথেই চিত্রার গলাটা বেশ শক্ত করে চেপে ধরলো লোকটা। এতক্ষণের ফুরফুরে মেজাজটা আর দেখা গেলো না লোকটার মধ্যে। শরীর, চেহারা জুড়ে কেবল কাঠিন্যতা। সেই কাঠিন্যতা চলে গেলো কণ্ঠস্বর অব্দি। চিত্রার গলার মাঝে আরও চাপ দিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
“আওয়াজ নিচে।”
ভয়ে, অস্বস্তি এবং ব্যাথায় চিত্রার দম আটকে আসার উপক্রম। চোখ-মুখ উল্টে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। মুখ বেয়ে কিছুটা লালাও বেড়িয়ে এলো। চিত্রার এহেন দশা দেখে হয়তো মায়া হলো লোকটার, ছেড়ে দিলো সে চিত্রার গলা। আবার আগের মতন ফুরফুরে মেজাজ অথচ গাম্ভীর্যতা নিয়ে বললো,
“আপনাকে যদি এখানে মে°রে পুঁতেও ফেলি, তাহলেও কেউ আমার কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আপনাকে কেন মা°র°লা°ম না বলেন তো?”
কাশতে কাশতে চিত্রার অবস্থা নাজেহাল কিন্তু লোকটার কথা শোনার জন্য তাকালো লোকটার মুখমন্ডলে। চেহারার মাঝে উত্তরের আকাঙ্খা। লোকটা নিজের রোদ চশমাটা পড়তে পড়তে কিঞ্চিৎ ঠাট্টা করে বললো,
“আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আমার কাছে ধরা দিয়ে বেশ ভুল করেছেন। এবার পস্তানোর পালা।”
চিত্রা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না, তন্মধ্যেই বিশাল কালো গাড়িটা দিয়ে লোকটা চলে গেলো দৃষ্টি সীমানার বাহিরে। চিত্রা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলো। এখানে আসাটা যে তার চরম ভুল হয়েছে, তা সে মিনিটের মাঝেই উপলব্ধি করতে পারলো। কিন্তু হয়তো উপলব্ধি করতে বড্ড দেরী করে ফেলেছে।
(৮০)
সারাদিন উকিলদের দরজায় দরজায় ঘুরে হতাশ চিত্রা বিরস মুখে বাড়ি ফিরলো। ড্রয়িংরুমে তখন সওদাগর বাড়ির সকলেই প্রায় উপস্থিত। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া চিত্রাকে দেখতেই মুনিয়া বেগম নিজের হাতের চায়ের ট্রে টা টেবিলে রেখে ছুটে এলেন। মেয়ের বাহু জড়িয়ে ধরে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় ছিলিস আজ? শরীরটার কী অবস্থা করেছিস, দেখেছিস?”
চিত্রা নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো, হতাশ স্বরে বললো,
“ভালো উকিলের খোঁজ করতে গিয়ে ছিলাম, আম্মু। বাহার ভাইটার যে ওখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।”
মুনিয়া বেগম করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের পানে, স্বান্তনা দিয়ে বললেন,
“এভাবে ভেঙে পড়লে তো হবে না। তোমার বাহার ভাইকে আমরা ফিরিয়ে আনবোই। আমিও আমার কলিগদের সাথে কথা বলেছি ভালো উকিলের খোঁজ পাওয়ার জন্য। তুমি চিন্তা করো না। সব ভালো হবে।”
“সত্যিই যদি সবটা ভালো হতো!”
কথাটা বলার পর পর বেড়িয়ে এলো বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস। আফজাল সওদাগর তখন সোফায় বসে কোনো গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে ঝিমুচ্ছিলেন। চিত্রার কথা তার কর্ণগোচর হতেই চোখ মেলে তাকালেন, ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“আমিও করে ছিলাম উকিলের খোঁজ। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না।”
নুরুল সওদাগরের কথা থামতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রোজা সওদাগর। খ্যাঁক খ্যাঁক করে বললেন,
“কেন, কেন, আপনাকে কেন ঐ ছেলের জন্য উকিল খুঁজতে হবে? রাস্তার ছেলের জন্য এত কিসের দরদ আপনার? কেমন বে°জ°ন্মা ছেলে সে! এমন ভয়ানক পাপ টা করেছে!”
কথাটা থামতেই সশব্দে কাঁচের টেবিলটা ভেঙে যাওয়ার শব্দ হলো। সাথে সকলের দৃষ্টিগোচর হলো চিত্রার র°ক্তা°ক্ত হাত। মুখে ভয়ঙ্কর ক্রোধানল। ভাঙা কাঁচের একটা টুকরো তুলে ধরে নিজের বড় চাচীর দিকে তাক করে শাসানির স্বরে বললো,
“বাহার ভাইয়ের নামে আর একটা খারাপ কথা যদি আপনার মুখ দিয়ে বের হয়, তবে জিহ্বা টা আর থাকবে না কথা বলার জন্য।”
উপস্থিত সকলে আহম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো চিত্রার পানে। তাদের পরিচিত, চঞ্চল, আবেগী সেই ছোটো চিত্রাকে খুঁজে বেড়ালো এই মানবীর মাঝে কিন্তু সবাইকে হতাশ করে দিয়ে সেই বাচ্চা চিত্রা রণচণ্ডীর রূপ ধারণ করেছে। মুনিয়া বেগম তাজ্জব বনে কেবল উচ্চারণ করলো, “চিত্রা!”
চিত্রার চোখে-মুখে তখনও হিং°স্র°তা। হাতের কাঁচটা ছুঁড়ে মারলো দূরে। অহি, চাঁদনী, অবনী বেগম, তুহিন সহ সবাই এই ভয়ঙ্কর চিত্রার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। কাঁচ ভাঙার শব্দে নুরুল সওদাগরও নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। রোজা সওদাগর মুখে কাপড় চেপে কান্না আটকানোর অদম্য চেষ্টা করলেন। অভিযোগের স্বরে নিজের স্বামীর পানে তাকিয়ে বললেন,
“আপনি চুপ থাকবেন আজও? নিজের সন্তানের বয়সী মেয়ের থেকে এমন আচরণ পাবো বলেই কী আমার এত ত্যাগ তিতিক্ষার পরে সাজিয়ে ছিলাম এ সংসার! এটাই কী আমার প্রাপ্য?”
আফজাল সওদাগর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তবে চিত্রা এমন আচরণ মানতে পারে নি সেও। গম্ভীর কণ্ঠে যখন সে চিত্রার উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার অন্যায় হয়েছে,চিত্রা।”
তৎক্ষনাৎ চিত্রার তাচ্ছিল্য কণ্ঠে উত্তর ভেসে এলো,
“আপনার চেয়ে আমার অন্যায় টা বোধহয় কমই, বড় চাচা।”
আবার অযাচিত নীরবতা গ্রাস করলো সওদাগর বাড়িতে। প্রতিটি প্রাণী হতবিহ্বল। মেয়েটা কী পা°গ°ল হলো!
সবার নীরবতা ছাপিয়ে শোনা গেলো চিত্রার কণ্ঠ, অসহায় স্বরে সে বললো,
“ভরণপোষণের দায়িত্বই যদি না নিতে পারেন, তবে কেন সন্তানের ভার মাথায় নিয়ে ছিলেন, চাচা?”
আফজাল সওদাগর, রোজা সওদাগর এবং নুরুল সওদাগর বাদে কেউ বুঝলো না চিত্রার কথার মর্মার্থ। অনেক দিনের লুকানো রূপকথার অতীত বেরিয়ে আসতে চলেছে ভেবেই ধপ করে সোফায় বসে পড়লো আফজাল সওদাগর। মাথা নিচু করে বিধ্বস্ত কাঁচের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে হলো যেন হিমালয় ভেঙে পড়েছে। বড় চাচা মানুষটি তো হিমালয়ের চেয়ে কম ছিল না সওদাগর বাড়ির সদস্যদের কাছে, তবে হিমালয়েরও জঘন্য অতীত থাকতে পারে তা যেন সবার ভাবনার বাহিরে ছিল। নুরুল সওদাগর আজ কিছু বললেন না। বাহারকে জেলে নেওয়ার পর থেকেই লোকটা চুপচাপ থাকেন, কোনো রকমের কটুক্তি করেন না। এ যেন অগাধ পরিবর্তন।
চাঁদনী আপা চিত্রার কাছে এলেন। স্থির নয়নে জোড়া, অথচ চঞ্চল মন। কোনো একটা অনাকাঙ্খিত ভয়ে দুরুদুরু কাঁপছে বুক। তবুও সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলো,
“চিতাবাঘ, কী বলছিস! পা°গ°ল হলি নাকি?”
চিত্রা হাসলো, তাচ্ছিল্য করে বললো,
“না গো আপা, পা°গ°ল হই নি। তোমাদের কাছ থেকে লুকানো এতদিনের অস্বচ্ছ অতীতটা পরিষ্কার করছি। আমার বাহার ভাইয়ের তো কোনো দোষ নেই, তবে তার জন্য কেন এমন কথা উঠবে! সেই কৈফিয়ত আমার চাই।”
রোজা সওদাগর ভীত হলেন। ছোটো ছোটো চক্ষুদ্বয়ে ভর করলেন ভয়। ভীতু গলায়ই বললেন,
“চিত্রা, তোর মাথা গরম এখন, ভুলভাল বলিস না।”
কথাটা শুনতে স্বাভাবিক মনে হলেও, কোথাও যেন চরম নিষেধাজ্ঞার আভাস। হয়তো সতর্কবার্তা। চিত্রা মানলো না সেই সতর্কতা, কেবল তাচ্ছিল্য করে বললো,
“চাঁদনী আপা, একটু আগে তোমার আম্মু বললো না বাহার ভাই বে°জ°ন্মা? সেই বে°জ°ন্মা মানুষটা কার সন্তান জানো? তোমার বাবার।”
ড্রয়িংরুমে ছোটোখাটো বো°মা ফাটলো মনে হয়। আফজাল সওদাগর মুখ ঢেকে ফেললেন দুই হাতে। চাঁদনী ধমকে বললো, “চিত্রা!”
কিন্তু চিত্রা থামলো না। একটু স্বা°র্থ°পর হলো সে। অনবরত বলে গেল বাহার ভাইয়ের জীবন বৃত্তান্ত। সবাই টান টান উত্তেজনা এবং অবাক ভাব নিয়ে শুনলো সেই বৃত্তান্ত। কারো পা কাঁপছে কারো বা চিত্ত। এতদিনের পুষে রাখা ঐতিহ্য ভেঙে গেলে তো ব্যাথা হবেই। চিত্রা এক মনে বললো সবটা, কোনো বিরতি নেই, কোনো ক্লান্তি নেই। বাহার ভাইয়ের শরীর থেকে সব ধরণের কলঙ্ক যেন সে মুছে দিবে, পৃথিবীর বুকে বাহার ভাই কেবল উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে। বাহার ভাইদের কোনো কলঙ্ক নেই।
অনবরত দীর্ঘ এক বক্তব্যের পর থামলো চিত্রা। তার পরিবারের লোক যেন সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে পাথর হয়ে গেছে। বড় চাচার মতন মানুষের অবহেলার জন্য আজ বাহার ভাই এবং তার পরিবারের এ দশা! চাঁদনী নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিলো, মাহতাবের ঘটনার পর থেকেই মেয়েটা নিজেকে এখন সামলে নিতে শিখে গেছে। সে নিজের বাবার দিকে স্থির দৃষ্টি ফেলে, অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আব্বু জানো, মাহতাব আর তোমার মাঝে আজ কোনো পার্থক্য আমি খুঁজে পেলাম! অথচ এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না।”
আফজাল সওদাগর কিছু বললেন না তবে ধমকে উঠলো রোজা সওদাগর। চাঁদনী সে ধমককে পাত্তা না দিয়েই বললো,
“মাহতাব হয়তো ইচ্ছেকৃত তার সন্তানকে মে°রে°ছে, নিজের হাতে। অথচ তুমি অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও নিজের সন্তানের খু°নি। তোমাকে যে মানুষটা ভালোবেসে, বুকে যত্নে আগলে রেখেও তোমার চরিত্রে তকমা না লাগিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, তুমি সে মানুষটারও খু°নি। তুমি কীভাবে এত পাষাণ হলে আব্বু? আমার আব্বুর না নরম মাটির দেহ ছিলো! মন তবে কেন এত পাথর হলো!”
রোজা সওদাগর মানুষ হিসেবে যেমনই হোক, কিন্তু স্ত্রী হিসেবে পরিপূর্ণ। তাই তো স্বামীকে এমন প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেখেও সে চুপ থাকতে পারলো না। তেড়ে এলেন মেয়ের দিকে, মেয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে চিৎকার করে বললেন,
“তুই কাকে প্রশ্ন করছিস? এই মানুষটাকে? যে তোদের সুখের জন্য সারা দিন-রাত খেটে গিয়েছে! আমি দিচ্ছি তোর প্রশ্নের উত্তর, আমার কারণে তোদের বাবা ওদের কাছে যেতে পারে নি। কোন মেয়ে তার স্বামীর ভাগ দিতে পারে, বল? আমিও পারি নি তাই স্বামীর ভাগ দিতে। যখন জানলাম আমার স্বামী বাহিরে ঘর করছে মানতে পারি নি তখন। তবুও চুপ ছিলাম নিজের অক্ষমতার জন্য। বিবাহিত জীবনে একটা সন্তানের মুখ দেখাতে পারি নি, আমার কী জোর খাটানো সাজে! কিন্তু যখন তুই হলি তখনই পেয়ে গেলাম তোর বাবাকে আটকানোর অ°স্ত্র। আমি জানতাম বাহারের মা যে প্রসব ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল, কিন্তু আমি বলি নি। তুই স্বামীর ভাগ দিতে পারতি বল? সেই ছোটো বয়সে এ সংসারে হাল ধরেছি। সংসারের বেড়াকলে পড়ে ধীরে ধীরে ননীর পুতুল থেকে কাঠের পুতুল হয়েছি, কিন্তু এ সংসার আমাকে কী দিলো বল? স্বামীটাও শেষ অব্দি বাহিরে সংসার পাতলো, মানতে পারতি তোরা? তোর দাদীর অত্যাচার সহ্য করতাম সন্তান নেই বলে, পাড়া-পড়শীর কটু কথা। কিন্তু দিনশেষে যদি তোর বাবা অন্তত আমার সাথে থাকতেন, তাহলে আমার আফসোস ফুরাতো। এই যে যখন জানলাম চিত্রার জন্য তোর সন্তান টা বেঁচে নেই তখনও আমি আমার অতীতের সেই ভয় থেকে এমন করেছি। আমি তো জানতাম আমার হাসিখুশি সংসারে ভেতরের খবর। ভয় হচ্ছিল এই ভেবে যে আমার মতন না তোরও আবার এমন ভাবে পু°ড়°তে হয়। আমিও তো দিনশেষে মানুষ, কষ্ট আমারও তো হয়। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না, প্রকৃতি ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। সেদিন ওদের অসহায় অবস্থার কথা জেনে চুপ ছিলাম আজ আমরাও একই জায়গায় দাঁড়ানো। হায়রে জীবন!”
কেউ আর কোনো কথা বললো না। একই অবস্থানে কেটে গেলো অনেকটা সময়। বার বার ধাক্কায় সওদাগর বাড়ির ভিত্তিটা বেশ নড়বড়ে হলো। আনন্দের বেলা ফুরালো। প্রাণ গুলো আজ আধমরা!
(৮১)
গভীর রাত। কুয়াশাময় আকাশ। শরীরের শীত কাপড় টা ভেদ করেও যেন শীতলতা ছুঁয়ে দিচ্ছে, যেমন করে দুঃখ ছুঁয়ে দেয় আমাদের। অহির হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ। একটু খিদেও পেয়েছে তার। রাতের খাবার আজ কেউ খায় নি। এমন কথা শোনার পরও খাওয়ার ইচ্ছে ঠিক থাকে না। যে যার মতন মাথা দিয়েছে নরম বিছানায়। কেউবা এমন অহির মতন আকাশে লিখেছে নির্ঘুম এক রাতের গল্প।
ধোঁয়া উঠা গরম কফির মগে চুমুক দিতেই ফোনের ভাইব্রেশনে ধ্যান ভাঙে অহির। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠে ‘নওশাদ’ নামটা। কয়েক সেকেন্ড সেই নামটার দিকে তাকিয়ে থেকে কলটা রিসিভ করে অহি। সাথে সাথে ওপাশ থেকে নওশাদের কণ্ঠ ভেসে আসে,
“আমি জানতাম, আপনি ঘুমান নি।”
অহি আকাশের দিকে তাকিয়ে, কফির কাপে দ্বিতীয় চুমুকটা দিয়ে বললো,”কীভাবে?”
“আপনার মন খারাপ, তাই।”
“জানলেন কীভাবে?”
অহির প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক সাথে সাথে দিলো না নওশাদ। বরং বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বললো,
“বিয়ের তারিখটা কী পিছিয়ে দিবো?”
নওশাদে প্রশ্নে কেমন অসহায়ত্বের সুর। খারাপ লাগলো অহিরও। লোকটা নিরেট ভদ্রলোক। আগাগোড়া ভালো মানুষ। এই ক্ষেত্রে অহি তার ভাগ্যের উপর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। এতটা ভালোমানুষ তার জীবনে আসবে সে ভাবেই নি।
অহিকে চুপ থাকতে দেখে নওশাদ নিজেই বললো,
“বাহার ভাই ফিরে আসুক, আমরা নাহয় তখন ধুমধাম করে বিয়ের সেলিব্রেশন করবো।”
অহি উত্তর দিলো না। পরিবেশ, পরিস্থিতির এ অবস্থায় বিয়ের অনুষ্ঠান টা বেমানান। অথচ বার বার এমন বিয়ে পিছিয়ে নিলে দেখতেও দৃষ্টিকটু লাগবে। নওশাদের পরিবারও বা কীভাবে নিবে বিষয়টা, ভেবেই অহির বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
অহির ভাবনা হয়তো বুঝলো নওশাদ, দীর্ঘশ্বাসের আড়ালের কথা গুলো হয়তো পৌঁছে গেলো নওশাদ অব্দি। তাই তো সে তৎক্ষণাৎ বললো,
“আশেপাশের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই আপনার। আপনি কেবল আপনার মনের কথা শুনুন বাকিটা আমি সামলে নিবো। একদিন বৃষ্টিস্নাত রাতে একজন মানুষ বলেছিল ভালোবাসা নাকি মানসিক শান্তি। আমি তা আজ বুঝি। এই যে আপনার সাথে দু তিনটে কথা হয়, সেটাই আমার মানসিক শান্তি। আমি এভাবেও কাটিয়ে দিতে পারবো। আমার মানসিক শান্তিরও কিছু শান্তির প্রয়োজন তাই না? আপনি বরং সময় নিন।”
নওশাদের এমন স্নিগ্ধ কথায় মুগ্ধ হলো অহি। একটা মানুষের পরিপূর্ণতা কী? যখন একজন মানুষ আরেকজন মানুষের তৃপ্তিতে খুশি হয়, তখনই একজন মানুষের পরিপূর্ণতা সেটা। আর নওশাদ নামের ছেলেটা পরিপূর্ণ। এই ছেলেটাকে ভালো লাগা থেকে এখনও ভালোবাসাতে আনতে পারে নি দেখে খারাপ লাগে অহির। তবে ভালবাসা কী আর হাতের মোয়া? যখন তখন যাকে তাকে দেওয়া যাবে! অহি ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো,
“আমি ভেবে জানাবো। রাখছি।”
নওশাদ আর কোনো বাক্যব্যয় না করে ফোনটা রেখে দিলো। এই মানুষটার মতন বোধহয় অহিকে আর কেউ বুঝতে পারবে না এই জীবনে। এমন মানুষও পাওয়া ও ভাগ্যের ব্যাপার।
কফির কাপটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। অহি রুম ছেড়ে বের হলো। কফির কাপটা রান্নাঘরে রাখতে গিয়ে দেখে বাড়ির কাজের মেয়ে দোয়েলের শোবার দরজা খোলা। কৌতুহল বশত অহি উঁকি মেরে দেখে মেয়েটা ঘরে নেই। কপাল কুঁচকে আসে তার। অতঃপর নজর যায় তাদের ড্রয়িংরুমের পাশে লাগোয়া ছাঁদের সিঁড়ির দিকে। ছাঁদের দরজাও খোলা! ছাঁদের দরজার দিকে তাকাতেই অহির বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে। বাহার ভাই বাড়ি ছাড়ার পর এত গুলো দিন ছাঁদে উঁকি দেওয়া হয় নি তার। মনের শূন্যতা মানা যায় কিন্তু স্মৃতির শূন্যতা মানা যায় না। ছাঁদে যখন গিয়ে দেখবে আগের মতন চিলেকোঠার ঘরে হলুদ বাতিটা জ্বালানো নেই, কিংবা গিটারের টুংটাং শব্দ আসছে না তখন স্মৃতির দেয়ালে যে শূন্যতা তৈরী হবে, তা অহিকে জ্বালিয়ে দিবে। কিন্তু আজ এতদিন পর গুটি গুটি পায়ে ছাঁদের দিকে এগিয়ে গেল অহি। কিছুটা শূন্যতা কুড়ানো যাক নাহয়।
ছাঁদের বা’পাশের দিকে লাইট জ্বলছে যা রীতিমতো পুরো ছাঁদটাকে আলোকিত করার কাজ সম্পাদন করছে। ছাঁদের খষখষে, উঁচুনিচু মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে আছে চিত্রা। তার সামনেই দোয়েল বসা। চিত্রার দিকে এক গ্লাস দুধ এগিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বললো,
“ছোটো আপা, খাইয়া লন না দুধটা।”
চিত্রা নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকালো দোয়েলের পানে, বিষন্ন স্বরে বললো,
“তোকে আমার জন্য দুধ আনতে কে বলেছে?”
“ক্যান, বাহার ভাইজান।”
দোয়েলে উত্তরে চমকানোর সাথে সাথে অবাকও হলো চিত্রা। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“বাহার ভাই? বাহার ভাই তোকে কীভাবে বললো? মজা করছিস আমার সাথে? বিরক্ত করিস না তো।”
“মজা করুম ক্যান? আমি সত্যিই কইছি আপা। বাহার ভাইজানই বলছে আপনারে প্রতি রাতে এক গেলাস কইরা বাদামদুধ দিতে।”
চিত্রার কুঁচকানো কপাল আরও কুঁচকে গেলো। অবাক ভাবটা তখনো তার চোখ-মুখে স্পষ্ট। সে আবার প্রশ্ন করলো,
“বাহার ভাই তোকে কখন বলেছে এটা?”
“আইজ ই বলছে। আপনি তো দুইদিন ধইরা জ্বরের লাইগ্যা দেহা করতে যাইতে পারেন না। তাই আইজ বাজার করার নাম দিয়া আমিই গেলাম। আপনার আব্বার থানাতেই তো তারে রাখছে। আমি যহন গেছি তহন চাচা থানায় ছিলো না। জানেন আফা, বাহার ভাইজানের লগে দেহা করার লাইগ্যা ঐ পুলিশ হাবিলদাররে আমার পাঁচশো টাকা দেওয়া লাগছে। বাহার ভাইজান তো আমারে দেইখাই আপনার কথা জিজ্ঞাস করছে। আমি যখন কইলাম আফনি অসুস্থ তখনই আমারে হেই কইছিলো আপনারে যেন প্রতি রাইতে বাদাম দুধ খাইতে দেই।”
ষোলো বছরের কিশোরী দোয়ালের কথা শুনে অবাক হলো চিত্রা। এতটুকু একটা মেয়েও কিনা বাহার ভাইকে দেখতে পাঁচশো টাকা খরচ করেছে! চিত্রা ক্ষীণ হাসলো, কোমল কণ্ঠে বললো,
“তুই এতখানি টাকা খরচ করতে কেন গেলি? কই পেলি এত টাকা?”
চিত্রার কথায় চোখ বড়ো বড়ো করলো দোয়েল। তার যে পছন্দ হলো না কথাটা তা চোখে-মুখে ফুটে উঠলো। সে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“আল্লাহ্, যামু না কেন? ভাইজান কত ভালো মানুষ। তারে দেখার লাইগ্যা আমি পাঁচশো কেন, এর বেশিও দিতে রাজি। আম্মার ওষুধ কেনার লাইগ্যা যে টাকাটা রাখছিলাম, সেইখান থেইকাই দিছি। আম্মা এই মাসে একটা ওষুধ নাহয় কম খাইলো। জানেন আফা, ভাইজান প্রায়ই আমারে দুই তিন হাজার কইরা টাকা দিতো আম্মার ওষুধের লাইগ্যা। আর খালি কইতো ‘দোয়েল, দেখে রাখিস আম্মারে। মনে রাখিস তোর বড় সম্পদ ঐ মানুষটা’। তহন তো বুঝতাম না ভাইজান ক্যান এমন কইতো, কিন্তু আইজ তো বুঝলাম মানুষটার মনে কী কষ্ট আছিলো। ভাইজান আমারে কত গুলান বইও আইন্যা দিছিলো আপা, কইছিলো আমারে পড়তে। পড়ালেহা করলে নাকি আম্মার দুঃখ মুছা যাইবো। হেই মানুষটা আইজ হেই অন্ধকার ঘরে কেমন কইরা থাহে আপা? তার তো অনেক কষ্ট হয় তাই না কন? ভাইজানরে আপনে ফিরায় আনবেন তো? কন?”
শেষের কথা গুলো বলতে বলতে ষোড়শী কন্যা দোয়েল ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়। সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা অহির চোখেও অশ্রু আসে কেবল কাঁদে না চিত্রা। চোখ ভরে দেখে দোয়লকে। একটা ছন্নছাড়া মানুষ পুরো পৃথিবীর বুকে কেমন মায়া ঢেলে দিয়ে গেছে? মানুষটা নাকি ভালোবাসতে জানে না! মানুষটার মতন অমন করে ক’জনই বা ভালোবাসতে পারে!
চিত্রা দোয়েলের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনার স্বরে বললো,
“কাঁদিস না দোয়েল, তোর ভাইজান ফিরে আসবে। আমি তো আছি তাই না বল? তুই আমার উপর বিশ্বাস রাখিস না?”
দোয়াল টলমলে অশ্রু চোখে এবং মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলে,
“আপনার উপরই এখন আমার ভরসা, আপা।”
চিত্রা কেবল মলিন হাসে। দূর হতে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা অহিও ক্ষীণ স্বরে বলে,
“আমিও তোর উপর ভরসা করে আছি চিত্রা। ফিরিয়ে আনিস তাকে।”
অতঃপর সে ফোনের স্ক্রিন অন করেই ক্ষুদে বার্তা পাঠালো নওশাদের ফোনে ‘বিয়েটা তারিখ অনুযায়ীই হবে।’
একটা রাতের আকাশে কত গুলো মানুষের হৃদয় উজাড় করা বিশ্বাস। পাওয়ায় আকাঙ্খা ভেসে বেড়াচ্ছে, পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষায়।
(৮২)
আজ বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো চিত্রার। শীতের কুয়াশা-মাখানো আকাশেও রৌদ্রের উত্তাপ। বুঝাই যাচ্ছে দুপুর ঘনিয়েছে। চিত্রা দ্রুত উঠলো। সারা রাত মাটিতে শুয়ে থাকার ফলে পিঠ ব্যাথা হয়ে গেছে। কয়েকদিন যাবত অতিরিক্ত ঠান্ডা লেগেছে। রাত হলেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। বুক ব্যাথা করে। এমন দিনের পর দিন মেঝেতে ঘুমালে ঠান্ডা তো লাগবেই, তাও আবার শীতকাল। মুনিয়া বেগম এর জন্য একদিন অনেক রাগারাগিও করেছেন। চিত্রা কেবল এতটুকু বলেছে, ‘আমার বাহার ভাইয়েরও আজ এমন শীতল মেঝেতে ঠাঁই হয়েছে, সে পারলে আমি কেন পারবো না?’ মুনিয়া বেগম মেয়েকে আর কিছু বলতে পারলো না। কথা গুলোর গভীরতা যে অনেক।
শরীরে এমন গা কাঁপানো জ্বর নিয়েও ঠান্ডা পানিতে গোসল করলো চিত্রা। শরীর বেশ শৌখিন একটা বস্তু। এটাকে আরাম দিলে ননীর পুতুল হবে, আরাম না দিলে কাঠের পুতুল। এর সাথে এত কোমলতা দেখানোর কিছুই নেই।
গোসল সেড়েই ঝটপট তৈরী হয়ে নিলো সে। আজ কোর্টে হেয়ারিং আছে। বাহার ভাইয়ের কেইস টা দ্রুতই কোর্টে উঠছে। কিন্তু উকিল না পাওয়ার কারণে ঘুরে-ফিরে বারবার সময় দেওয়া হচ্ছে বাহার ভাইকে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো লাভ হচ্ছে না। প্রমাণ সব বাহার ভাইয়ের বিপক্ষে। কেইসটাকে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে দোষী মনে হচ্ছে তাকেই। মেয়েটিকে যে অ°স্ত্র দিয়ে মা°রা হয়েছে সেটাতেও বাহার ভাইয়ের আঙ্গুলের ছাঁপ। অথচ বাহার ভাই ছু°ড়িটা বের করার জন্য ধরেছিলেন। মেডিকেল রিপোর্টও বাহার ভাইয়ের বিপক্ষে তুমুল টাকার কাজ যে এটা তা আর বুঝতে বাকি নেই কারো। আর এত দ্রুত কেইসটা চলার পেছনেও যে বিরাট হাত আছে তাও সবাই জানে। এসব ভেবেই হতাশার শ্বাস ফেলে নিচে নেমে এলো চিত্রা। রান্নাঘরে তখন দোয়েল আর বড় চাচী রান্না করছে। চাচীর চোখ-মুখ স্বাভাবিক। গতকাল যে এতকিছু হলো তার কোনো প্রভাবই তার চোখে-মুখে নেই। গম্ভীর চোখ-মুখ।
চিত্রা বাহিরে যেতে উদ্যোত হতেই দোয়েল রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
“আপা, খাড়ান না।”
চিত্রা দাঁড়ালো। ব্যস্ততা মেশানো কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। দেরী হচ্ছে।”
দোয়েল নিজের হাতের টিফিন বক্স টা চিত্রার হাতে দিতে দিতে বললো,
“ডিমসহ বড় বড় ইলিশ মাছের টুকরা বেগুন আলু দিয়া ঝোল করছি আর সাদা গরম ভাত। ভাইজানের তো অনেক পছন্দ। কতদিন মানুষটা ভালোমন্দ খায় না। নেন, উনারে দিয়েন।”
চিত্রা টিফিন বক্স টা নিতে নিতে সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“মাছ কে এনেছে? রেঁধেছে কে?”
চিত্রার প্রশ্নে আমতা-আমতা করলো দোয়েল। পরক্ষণেই তাড়াহুড়ো করে বললো,
“আপনার না দেরী হচ্ছে আপা? যান যান। সব ভালো হবে দেইখেন।”
চিত্রাও আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। দোয়েল রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসি দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললো।
(৮৩)
মানুষের পরিপূর্ণ হৈচৈ কোলাহলে ভরা কোর্টের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালো চিত্রা। আশেপাশে তাকাতেই দেখলো, বড় দালানের কিনারায় বেঞ্চিতে বসে আছে বাহার ভাই। চিত্রা দ্রুত পায়ে সেখানে গেলো। পুলিশের পোশাকে থাকা নিজের বাবাকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো চিত্রা। কোনোরকম অনুমতি না দিয়ে সে বসে পড়লো বাহার ভাইয়ের পাশে। নুরুল সওদাগর কিছু বললেন না। বরং কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন।
চিত্রাকে দেখেই মলিন হাসলো বাহার। কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“শরীর কেমন?”
চিত্রা এই ভেঙে যাওয়া বাহার ভাইকে দু-চোখ ভরে দেখলো। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেশ নরম স্বরে বললো,
“আপনি চিন্তা করবেন না, আমাদের ঠিক একটা গতি হয়ে যাবে।”
চিত্রার কথায় হাসলো বাহার। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ভেঙে পড়ছো কেনো? তোমাকে ভালো থাকতে হবে। তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো।”
চিত্রার কান্না এলো দু-চোখ ভরে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালালো। তবে চোখের জল যে বরাবরই অবাধ্য। সে তার নিজ গতিতে ঝরে পড়লো। বাহার মিছি মিছি রাগ দেখালো, মিছে ধমক দিয়ে বললো,
“কাঁদছো কেন? একদম এখান থেকে ফেলে দিবো।”
বাহারের ধমকে ফিঁক করে হেসে দিলো চিত্রা। তার ঐ হাসি হাসি মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে মোহনীয় কণ্ঠে বাহার ভাই বললো,
“তোমার আর আমার সংসার হলে খারাপ হবে না বলো? দু চারদিন তোমার হাসি দেখে অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাই না?”
চিত্রার হাসি হাসি মুখটা কেমন চুপসে এলো। বিবশ কণ্ঠে বললো,
“আমাদের একটা সংসার হলে, আমি পৃথিবীর সকল স্বা°র্থপরতা ভুলে যেতাম বাহার ভাই।”
“পৃথিবী কোথায় স্বা°র্থ°পর? সে তো তার জায়গায় ঠিকই আছে। আমরাই বরং কিছু নিয়ম মানতে পারি না। তবে মানিয়ে নেওয়াটাই উচিত।”
চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“খাবার এনেছি। খাইয়ে দেই?”
“আমার কাছে অনুমতি না দিয়ে নিজের বাবার কাছে নেও। কারণ আমি তার দায়িত্বে।”
না চাইতেও চিত্রা নিজের বাবাকে ডাক দিলো,
“স্যার?”
নুরুল সওদাগর কিঞ্চিৎ চমকালেন। প্রায় আঠাশ দিন পর মেয়েটা তাকে ডাকলো তাও অন্য কোনো নামে! সেদিন রাতের সেই আহাজারির পর থেকে মেয়েটা আর তাকে ডাকে না। কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুরুল সওদাগর উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ?”
“আপনাদের আসামীর জন্য বাড়ি থেকে খাবার এনেছি। খাওয়াতে পারবো? নাকি মুখের খাবারও কেঁড়ে নিবেন?”
শেষের কথাটাই তুমুল তাচ্ছিল্য। নুরুল সওদাগর তা গায়ে মাখলেন না। বরং ধীর কণ্ঠে বললেন,
“পারো।”
অনুমতি পেতেই চিত্রা হাত ধুয়ে ভাত মাখালো। বেশ আয়েশ করে এক লোকমা তুলে দিলো বাহারের মুখে। বাহার ভাইয়ের চোখ গুলোতে তখনও টলমলে অশ্রুর চিলিক। তা দেখে চিত্রারও কান্না এলো কিন্তু সে শব্দ করে কাঁদলো না। নিরবে বিসর্জন দিলো অশ্রুকণা। দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখে অবাক নয়নে পথচারীরা চাইলো। কোর্টের বামপাশে চায়ের দোকানের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অহি এবং অবনী বেগমও দেখে কাঁদলেন কিছুটা। নুরুল সওদাগর আরেকটুখানি দূরে সরে গেলেন। ছেলেমেয়ে গুলোর এমন দৃশ্য কত মানুষ চোখ মেলে দেখলো।
অবশেষে শেষ মুহূর্তে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না চিত্রা। বাহার ভাইয়ের গলা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন,
“আমাদের একটা সংসার হলে খারাপ হতো না, বাহার ভাই। তবুও কেন বিধাতার এমন বিধান?”
“খুব ভালো কিছু যে হতে নেই রঙ্গনা।”
মানুষ দেখলো দু’জনের হাহাকার। কেউ কেউ চোখের জল মুছলো। বিচ্ছেদে এত ব্যাথা কেন!
(৮৪)
বাহিরে উতলা মন নিয়ে অপেক্ষারত চিত্রা। টানটান উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করছে মন। কোর্টের ভেতরে যায় নি সে। কী হবে, কী হবে না ভেবেই আর যাওয়া হয় নি। আজ নাকি কেইসের শেষ শুনানি। এরপর হয়তো বদলে যাবে সব। ভয়, আশংকায় তরতর করে চিত্রার গায়ের তাপমাত্রা বাড়লো। অস্থির পায়ে পায়চারী করলো সে।
তন্মধ্যেই কোর্ট থেকে অহি আপা, ছোটো চাচী বেরিয়ে এলেন। চিত্রার হৃৎপিণ্ডের গতি যেন আকাশ ছুঁয়েছে। হাত-পা কাঁপছে তার। তবুও সে কোনোমতে ছুটে গেলো তাদের দিকে। অস্থির চিত্তে অনবরত প্রশ্ন করলো,
“কী হয়েছে অহি আপা? চাচী, কী বললো ওখানে? আরেকটু কী সময় দিয়েছে আমাদের? ভালো কিছু কী হয়েছে?”
অহি আপা এবং চাচীর মুখ থমথমে। অবনী বেগম চিত্রাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে উৎকণ্ঠিত গলায় বললো,
“আল্লাহ্! তোমার তো শরীরে অনেক জ্বর! বাড়ি চলো তাড়াতাড়ি।”
চিত্রা বিরক্ত হলো। বেশ উচ্চস্বরে বললো,
“ভেতরে কী হয়েছে চাচী? বলুন না।”
“ডিসেম্বরের বিশ তারিখ, বাহার ভাইয়ের ফাঁ° সি।”
চিত্রা যেন কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেলো। কণ্ঠধ্বনিতে আটকে গেলো,শব্দরা। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললো,
“তুমি মজা করছো, আপা?”
চিত্রার প্রশ্নে ডানে-বামে মাথা নাড়াতে নাড়াতে কেঁদে দিলো অহি। চিত্রা অনবরত পাগ°লের মতন ডানে-বামে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“না, না। আমার বাহার ভাইয়ের সাথে আমার অনেক গুলো বছর বাঁচা বাকি। না আপা, তুমি কী বলছো! এটা কী বললে তুমি।”
অশান্ত চিত্রাকে সামলানোর আগেই কোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো বাহার ভাই। দু’হাত মেলে ধরে ডাক দিলো,
“রঙ্গনা।”
চিত্রা চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকালো বাহার ভাইয়ের পানে। বাহার ভাইয়ের হাতের দিকে তাকিয়ে ছুটে গেলো সেদিকে, কিন্তু যেই মুহূর্তে সে বাহার ভাইয়ের বুক পাজরে মুখ লুকাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে হাত গুটিয়ে নিলো বাহার। মুচকি হেসে বললো,
“এই বুকে যে তোমাকে ঠাঁই পেতে দিলো পৃথিবী। পরজন্মে নাহয় লুটিয়ো হেতায়।”
চিত্রা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বাঁধ ভাঙলো কান্নার। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না, বাহার ভাই। এটা তো কথা ছিলো না। আপনি কথা ভাঙছেন কেন? এটা তো কথা ছিলো না।”
বাহার ভাই অশান্ত চিত্রাকে দেখলো। ততক্ষণে সেই মানুষটার চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। মুখে লেপ্টে আছে মায়াবী হাসি। মোহনীয় কণ্ঠে সে বললো,
“ভেঙে পড়লে হবে, বলো? তোমার তো এখন অনেক দায়িত্ব। বাহার ভাইয়ের অসম্পূর্ণ কাজ গুলো পূরণ করবে না? তোমার বাবার কাছে নূপুর জোড়া গচ্ছিত আছে। যেদিন আমাকে পৃথিবী ছাড়ার হুকুম দিয়েছে, সেদিন নাহয় সেই নুপুর জোড়া আমার বোনের কবরে রেখে দিয়ে এসো। রাখবে না বলো?”
চিত্রা জোর করে নিজের মাথাটা চেপে ধরলো বাহার ভাইয়ের বুকে, অভিযোগে স্বরে বললো,
“ও বাহার ভাই, বাহার ভাই, এমন করছেন কেন? আপনি জানেন না অষ্টাদশী আপনাকে ছাড়া থাকতে পারে না? আপনি তো এত নি°ষ্ঠুর না, বাহার ভাই। তবে কেন কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে? আপনারে ছাড়া আমি কেমন করে থাকবো বলেন? পারবো না আমি। আমার বুকের ভেতর কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে জানেন? আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আপনি ছেঁড়ে গেলে আমি বাঁচতে পারবো না, বাহার ভাই। অষ্টাদশীর বুকের মাঝে এমন ভাবে এক্কা-দোক্কা খেলে পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটতে পারলেন বলুন। আপনারে ছাড়া বাঁচবো না যে।”
“বাঁচবে রঙ্গনা। পৃথিবীতে একটা তিক্ত সত্যি কী জানো? আমরা মানুষ হারিয়েও বাঁচতে পারি। প্রকৃত পক্ষে আমাদের যা মনে হয় তা বাস্তবে ঘটে না। আমরা মানুষ, নীল তিমি নই যে সঙ্গী হারানোর শোকে ম°রে যাবো। কিংবা কাকের মতন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করবো। আমরা হলাম গিয়ে মানুষ, আর আমাদের মানুষ ভুলে বেঁচে থাকার অদম্য শক্তি আছে। তুমি সামলে নেও নিজেকে রঙ্গনা। মনে রেখো,
তুমি ভেঙে পড়ো না এভাবে,
কেউ থাকে না চিরদিন সাথে।
রঙ্গনা, তোমার সংসার করার স্বপ্ন পূরণ হোক। আমার সাথে নাহয় না হলো, অন্য কারো সাথে পূরণ হোক। আমাদের অযাচিত বিচ্ছেদ ভুলে খুশি হও তুমি।
❝তোমার একটা সংসার হোক, অল্প বিস্তর ভালোবাসার নামে,
আমায় তুমি খুঁজে নিও, পরিচিত কোনো ডাকনামে।❞
বাহার ভাইয়ের মুখে মায়াবী হাসি, রঙ্গনার গগন ফাঁটানো চিৎকার, ” বাহার ভাই কথা রাখে নি, আল্লাহ্। বাহার ভাই কথা রাখে নি।”
#চলবে
Please sad ending deben na….please
বাহার ভাই যেন বিনা দোষে শাস্তি না পায় please