ময়ূখ #পর্ব-২৯ #লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

0
668

#ময়ূখ
#পর্ব-২৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৫.
আজ প্রায় দুইমাস হয়ে গেলো। মৌনর কোনো খোঁজ নেই। নিভৃত এমন কোনো জায়গা নেই যে মৌনকে খুঁজেনি। কোথায় গেলো মৌন? কোথায় তার সন্তান?

মৌনর বইগুলো রাখা ডিভানের সামনে রাখা কাঠের টি-টেবিলের নিচে কাঠ দিয়ে বানানো পাটাতনে। নিভৃত কিছুক্ষণ আগে যোহরের নামাজ আদায় করে খাটের সাথে ঘেঁষে দ-আকৃতির পা করে মেঝেতে বসে আছে। এখনকার নিভৃত অনেক নিশ্চুপ, চুপচাপ। পাগলামি করেনা। খালি চেয়ে থাকে। নিশ্চল তার দৃষ্টি। আল্লাহর কাছে দুইহাত তুলে দোয়া চায় যেখানে থাকুক তার মৌন, তার বাচ্চাটা ভালো থাকুক। নিভৃত কি মনে করে মৌনর বইগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। একটা একটা করে বইগুলোতে হাতবুলায় সে। মিটি উড়ে এসে তার কাঁধে বসেছে। নিভৃতের সাথে তার অনেক ভাব। হঠাৎ একটা বই উল্টানোর সময় কভার পেজের ভিতরের অংশে কিছু নাম্বার লেখা। উপরে লেখা
‘বান্ধবীরা’।

এক, দুই দিয়ে প্রায় সাতজনের মতো মেয়েদের নাম্বার লেখা। এদের মধ্যে পাঁচজনের সাথে নিভৃতের কথা হয়েছে। নাম দেখে চিনে ফেললো নিভৃত। তবে দুইজনকে চিনেনা সে। একজনের নাম লেখা সুমি, অপরজনের দোলা। নিভৃত খাটের উপর থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে দোলার নাম্বারে কল লাগায়।
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম কে?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি নিভৃত রহমান বলছি।’
‘জ্বি,বলুন।’
‘মৌন কি আপনার কাছে?’
‘কে মৌন?’
‘মৌনতা সুবহা মৌন। চিনেন না?’
‘ওহ্, আপনি মৌনতার কথা বলছেন। কিন্তু ওর সাথে তো আমার দেখা হয়না প্রায় চারবছর।’
‘সত্যি করে বলুন। মৌন আপনার কাছে নেই?’
‘আরে কি আশ্চর্য! আমি মিথ্যা বলবো কেন?’

হতাশ হয় নিভৃত। হতাশ কন্ঠে বলে,
‘আপনার কাছে যদি যায়। দয়াকরে আমাকে জানাবেন।
‘আপনি কে?’
‘মৌনর হাসবেন্ড।’
‘আচ্ছা, আমার কাছে আসলে কিংবা কোনো যোগাযোগ হলে আমি জানাবো।’

নিভৃত এবার সুমির নাম্বারে কল দেয়। অদ্ভুত কারণে তার বুকটা কাঁপছে। হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে গেছে নাকি?

কল রিসিভ হলে,নিভৃত জিজ্ঞেস করে,
‘হ্যালো…..

ঐপাশটা নিশ্চুপ। নিভৃত একটানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তবে ফেরত পাচ্ছে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ অপরিচিত একজন নারী কন্ঠ শোনা যায়।
‘কে আপনি?’

৮৬.
‘আমি নিভৃত। নিভৃত রহমান।’
‘কি কারণে ফোন দিয়েছেন?’
‘আপনি মৌনকে চিনেন?’

কিছুক্ষণ নিরবতা। তারপর জবাব আসে,
‘হ্যাঁ, মৌন নামে আমার একটা ফ্রেন্ড ছিলো।’
‘মৌন কি আপনার কাছে গেছে?’
‘না, আমার সাথে মৌনর যোগাযোগ নেই অনেকদিন ধরে।’
‘সত্যি করে বলুন।’
‘আমি মিথ্যে বলতে যাবো কেন?’
‘মৌন আপনার কাছে গেলে কিংবা কোনো যোগাযোগ করলে আমাকে জানাবেন দয়াকরে।’
‘জ্বি।’

ফোনটা কেটে দেয় সুমি। সামনের সোফায় বসে থাকা মৌনর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? অন্তত পেটেরটার কথা ভাব।’
‘আমি কোনো স্বার্থপরের সাথে ঘর করতে চাইনা। উনি থাকুক উনার রুহানিকে নিয়ে। তাছাড়া উনি পেটেরটাকে চায়না।’
‘একবার বলে তো দেখা উচিত ছিলো।’
‘সুমি তুই সবটাই জানিস। দয়াকরে এসব ব্যাপারে আমাকে আর কিছু বলিসনা।’

মৌন উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। সুমি সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাতের গভীরে ঠিকই তো কান্নার আওয়াজ সে পায়।

______________________

মৌন ফজরের নামাজ পড়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা কামিজ পরনে। মাথায় লম্বা করে ঘুমটা টানা। সারা শরীর ঢেকে রেখেছে উড়নাটা। পাঁচমাসের পেটটা উঁচু হয়েছে খানিকটা। মৌন বাইরে বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে একটা তসবি। হঠাৎ পরিচিত, চিরচেনা কেউ একজন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নিজের কাঁধে গরম গরম অশ্রুর ফোঁটা অনুভব করলো মৌন। লোকটা তাকে ছাড়ছেনা। এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলে মৌন কোথাও হারিয়ে যাবে। মৌন নিশ্চল হাতে খানিকটা চেষ্টা করে লোকটাকে সরিয়ে দেওয়ার। তবে সে পারেনা। সামনে তাকিয়েই বলে,
‘কেন এসেছেন?’

৮৭.
লোকটা জবাব দেয়না। মৌনকে সামনে ফিরিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে। তার হলদে পরীটা মোটা হয়েছে অনেকটা। গালদুটো ফুলেছে। কি স্নিগ্ধ, সুন্দর লাগছে। তবে কিসের যেনো বিষণ্ণতা। উড়নাটা সরিয়ে মৌনর উঁচু হয়ে যাওয়া পেটে চুমো খায় নিভৃত। একটা, দুইটা, তিনটা অসংখ্য। মৌন একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে কেবল। শরীরটা শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালোদাগ, গাল ভর্তি দাঁড়ি। এ কোন নিভৃত! মস্তিষ্ক বলছে সরিয়ে দে আর মন বলছে থাক না।

নিভৃত আলতো করে কোমরটা জড়িয়ে ধরে কান পাতে পেটে। কি শুনেছে কে জানে। বিরবির করে বলে,
‘বাবা পঁচা তাইনা পুঁচকো। বাবুটাকে কত কষ্ট দেয়?’

নিভৃত আবার ঠোঁট ছুঁয়ায় মৌনর পেটে। মৌন অনেকক্ষণ সহ্য করেছে এসব আহ্লাদ। এবার নিভৃতকে ছাড়িয়ে পাশে দাঁড়ায় মৌন। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘একদম আহ্লাদ করতে আসবেন না নিভৃত। আমার বিরক্ত লাগছে। আর কিসের বাবা? এতোদিন বাবার প্রয়োজন পড়েনি আর সামনেও পড়তে দিবোনা। সুমি কাজটা ঠিক করলোনা।’
‘প্লিজ মৌন তোমার দুইটা পায়ে ধরি বাসায় চলো। আমার বাবুটা বাবাকে চায় মৌন।’
‘বাবার অধিকার দেখাবেন না একদম। সন্তান তো বাবা-মায়ের ভালোবাসার ফসল হয়। আমার সন্তান তো আপনার ভুলের ফসল।’
‘মৌন!’
‘আমার নাম আপনার মুখে নিবেন না। আপনার তো বাচ্চা চাইনা? সেদিন তো এজন্য মারলেনও আমাকে। আজ এতো দরদ উতলে উঠছে কেন?’
‘আমি ক্ষমা চাচ্ছি মৌন। আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করা যায়না?’
‘না, যায়না।’

নিভৃত অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা তার।
‘আপনি চলে যান নিভৃত। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছিনা। প্লিজ চলে যান।’

নিভৃত তবুও দাঁড়িয়ে থাকে। মৌন নিভৃতের বাম হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যায় টিনসেড বিল্ডিংয়ের দরজার কাছটায়। তারপর মেইন দরজাটা মুখের উপর বন্ধ করে দিয়ে দরজার পাশটায় বসে পড়ে। বুকটা এতো জ্বলছে কেন? সুমি বাইরে থেকে সবই দেখছে। তবে সে কিছু বলবেনা বলে ঠিক করে। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যে অন্যদের নাক না গলানোই উত্তম। সময় পেরিয়ে যায়। নিভৃত দুপুরের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। তার অসহায় চোখজোড়া স্থির স্টিলের দরজার দিকে।

মৌন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙে অনেকটা সময় পর। দুপুর বোধহয় ১টা। মৌন হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজা খুলে বের হবে তখন শুনে নিভৃত ফোনে কথা বলছে। বিচলিত তার কন্ঠস্বর।
‘হ্যালো, আম্মু। বাবার কি হয়েছে?’
‘………..’
‘কি!’
‘কোন হসপিটালে নিয়েছো? আমি এখনি আসছি।’

নিভৃত সব ছেড়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাবা নামক মানুষটাকে বড্ড ভালোবাসে নিভৃত।

‘সুমি, আমার ঢাকা যেতে হবে!’
‘কেন?’
‘বাবার বোধহয় কিছু একটা হয়েছে সুমি।’
‘এই অবস্থায় কিভাবে যাবি। ডাক্তার না বললো বেডরেস্টে থাকতে। জার্নিটা কি ঠিক হবে?’
‘ঠিক ভুল জানিনা সুমি। আমাকে নিয়ে চল।’

অনেকটা পথ পেরিয়ে রাত প্রায় বারোটার দিকে ঢাকা পৌঁছায় মৌন, সুমি। ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িটাতে প্রায় তিনমাস পর আবার পা বাড়ায় মৌন। বাড়িতে কেবল দিলারা,জুলখা আছে। সোফায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে দুজনে। দিলারা বারেবারে চোখ মুছছেন। মৌনকে দেখে অবাক হোন দিলারা।
‘বাবা, কোন হসপিটালে?’

মৌনর ক্লান্ত বিচলিত কন্ঠস্বর। জুলেখা বলে,
‘আপালো হাসপাতালো নিসে বললো।’

সুমিকে নিয়ে মৌন ছুটে যায় এপেলো হাসপাতাল। রিসিভশনে নাম বললে তারা কেবিন দেখিয়ে দেয়। মৌন অনেকটা দৌড়ে সেদিক পানে যাচ্ছে। পিছনে সুমি।

‘বাবা’

হঠাৎ মৌনর কন্ঠ শুনে মিরা দরজার দিকে তাকান। সাদা বেডে নাজমুল শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। মৌন মিরার দিকে এগিয়ে আসে। মিরা হঠাৎ চিৎকার করেন। মৌন নিচে তাকিয়ে দেখে তার নিচটা রক্তে ভরে যাচ্ছে। লাল রক্তের বন্যা বইছে যেনো। সাদা রঙা সেলোয়ার-কামিজ লাল বর্ণে রঙিন হয়ে যাচ্ছে। নিভৃত বাইরে ঔষধ আনতে গিয়েছিলো। ফিরে এসে মৌনকে দেখে ‘মৌন’ বলে চিৎকার করে কোলে তুলে নেয় সে। জ্ঞান হারায় মৌন।

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here