নানান বরণ মানুষ রে ভাই ১০ম পর্ব

0
281

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
১০ম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ওমর খান,মানে আমার নানা, ইন্জিনিয়ার ছিলেন কিন্তু ঐ পথে পা বাড়ান নি। তিনি তাঁর বাবার অগাধ সম্পত্তি সামলাতেন,ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি সহায় সম্পত্তি দ্বিগুণ করে ফেলেন। ব্যবসা, দ্বিতীয় স্ত্রী, বন্ধুদের সাথে আড্ডা এই নিয়ে তাঁর জীবন। নিজের মা’কেও তিনি তেমন ধর্তব্যের মধ্যে ধরতেন না। দুই সন্তান নিয়ে রেখার কষ্টের সীমা ছিলো না। স্বামী ফিরেও তাকাতেন না, সতীন প্রচুর কষ্ট দিতেন আর শাশুড়ির তো কথাই নেই। সারাক্ষণ কাজ আর কাজ, বকা ঝকা, খোঁটা, নতুন বৌকে খুশি করার জন্য রেখাকে পদে পদে অপদস্হ করা,এই ছিলো শিমুলের দাদির কাজ। ভাইদের সাহায্য চেয়েছিলেন রেখা, চলে যেতে চেয়েছিলেন বাপের বাড়ি, ভাইরা আশ্রয় দেননি। বাপের বাড়িতে রেখার ভাগটুকু পর্যন্ত ভাইরা দেন নি। মায়ের কষ্ট দেখতে দেখতে ছোট্ট শিমুল অতি অল্প বয়সেই বেশি পরিণত হয়ে গেছিলেন। শিমুল তাঁর মা’কে ভাইদের পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছেন, মামাদের ঝটকা মেরে পা সরিয়ে নিতে দেখেছেন,মামীদের অকথা-কুকথা শুনেছেন, একজন আত্মীয়কেও দেখেন নি মায়ের পাশে দাঁড়াতে। রেখার সেই মনের জোর ছিলোনা স্বামী বা ভাইদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করার। রেখা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই দুয়োরানী। শিমুল শ্যামলা, কুশ্রী না হলেও রূপসী নয়,পলাশের দুই পা বাঁকা। আরও কিছু জটিলতা আছে। এসব নিয়েও রেখার গন্জনার সীমা ছিলো না। স্বামী-শাশুড়ির পা ধরেছেন বারবার ছেলেটাকে চিকিৎসা করানোর জন্য, উল্টে মুখ নাড়া খেয়েছেন। বাড়িতে তখন বড় আনন্দের দিন। রিয়া মা হতে চলেছেন। তাঁর যত্নের আর আদরের সীমা নেই। শাশুড়ি আর স্বামী মাথায় তুলে রেখেছেন রিয়াকে। বেশির ভাগ যত্ন করতে হয় রেখাকে। সতীনের পছন্দমতো খাবার রাঁধতে হয়, রিয়ার পেটের বাচ্চার পুষ্টির জন্য স্বামী-শাশুড়ির চিন্তার শেষ নেই, কতো খাবার, ফলমূল। রেখাকে সতীনের জন্য নানারকম স্যুপ বানাতে হতো, দুইবেলা দুধের গ্লাস দিয়ে আসতে হতো সতীনের ঘরে। নিজের চোখে দেখতে হতো স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কি আদর যত্ন করছেন। মায়ের সব কষ্ট, ব্যথা,অপমান,কান্না,বঞ্চনার নীরব সাক্ষী শিমুল। একটা ঘর বরাদ্দ ছিল শিমুল, পলাশ ও তাদের মায়ের জন্য। মা তেমন ফুরসত পেতেন না সন্তানদের দেখার। শিমুল পলাশের দিকে খুব খেয়াল করতো। পারিবারিক ডাক্তার দুই দিন পলাশের পায়ের ব্যায়াম শিখিয়ে দিয়েছিলেন রেখাকে। শিমুল ভালো করে শিখে নিয়েছিলো মায়ের থেকে।সে নিজেই ছোট্ট বাবু। কিন্তু নিপুণ ভাবে ভাইএর পায়ের পরিচর্যা করে শিমুল। মায়ের বুকের দুধ তেমন পায়না পলাশ। ক্ষুধায় তারস্বরে চিৎকার করে। রেখা স্বামী-শাশুড়ির কাছে পলাশের দুধের জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকেন বারবার,হাজার অপমান সত্ত্বেও। শেষ পর্যন্ত দুধের কৌটা জোটে, মাঝারি মানের। শর্ত দেওয়া হয় কমপক্ষে একমাস যেনো ঐ দুধ দিয়ে চলে।শিমুল আর তার মা যেনো ওখানে ভাগ না বসায়।

রিয়ার মেয়ে হলো। ওমর খান মেয়ের মুখ দেখলেন ভারি গলার হার আর রিয়াকে একসেট গয়না দিয়ে। যদিও ছেলে না হওয়ায় ওমর খান আর তাঁর মা মনে মনে একটু হতাশ, কিন্তু বাইরে সেই হতাশার কোনো প্রকাশ নেই।
শিমুলের দাদী তার নতুন নাতনীকে নিজের গয়নার ভান্ডার থেকে একটা জড়োয়া সেট দিলেন। রিয়ার বাপের বাড়ির অনেক মানুষ উপস্থিত। বাড়িতে উৎসব, খাওয়া দাওয়া। কাজ করার লোক আছে অনেক,কিন্তু তারা তো এমনি এমনি চলেনা,তাদেরকে চালাতে হয়।সেই চালানোর দায়িত্ব রেখার। সেই সাথে শাশুড়ির হুকুম,স্বামীর হুকুম, সতীনের হুকুম, সবচেয়ে বেশি হুকুমের ঝাঁপি সাজিয়ে বসেছিলেন রিয়ার মা। রেখার ফুরসত মিলতো না নিজের বাচ্চা দুটোকে দেখাশোনা করার। পৃথিবী বড় আশ্চর্যের জায়গা।একই দাদী,একই বাবা রিয়ার বাচ্চাকে নিয়ে মেতে আছেন, কিন্তু শিমুল -পলাশের ব্যাপারে তাঁদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। রিয়ার মেয়ে হয়েছে ফুটফুটে সুন্দর, শিমুল শ্যামবর্ণা, দাদীর ভাষায় আর তাঁরটা শুনে শুনে সবার ভাষায় “কালিন্দী “। আর পলাশ হলো ” লুলা”। লুলার আরও অনেক দোষ ক্রমশ ধরা পড়তে লাগলো। পলাশ কানে শোনেনা,তাই কথা বলতে পারে না। মুখ দিয়ে ক্রমাগত লালা পড়ে।ওমর খান সাহেব আদেশ জারি করলেন, রেখা যেন এইসব আপদ সাথে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। চোখের সামনে অপয়া দেখতে চান না রেখার স্বামী, শাশুড়ি, সতীন। তারমধ্যে শিমুল বড় উৎপাত করে। সুযোগ পেলেই নতুন বাবুকে দেখতে ঘরে ঢুকে পড়ে। এই পুতুলটা তার বোন ,মা বলেছেন। পলাশের উপরে যেমন মায়া,নতুন বোনটির জন্যও তার তেমন মায়া। বোনটির নামও সে প্রস্তাব করেছে। শিমুল-পলাশের বোন শিউলি। আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। উল্টে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও রিয়ার ঘরে ঢুকে নতুন বাবুকে ধরার অপরাধে কয়েকবার বেধড়ক পিটানি খেয়েছে শিমুল তার বাপ আর সৎ মা’র হাতে। কারণে অকারণে দাদী,বাবা,সৎ মায়ের হাতে চড় থাপ্পড় খাওয়া শিমুলের অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল। এরপরে সে এক ভয়ংকর অপরাধ করলো। নতুন বাবু যার নাম রাখা হয়েছে মৌরি, তার জন্য কেনা একটা দুধের কৌটা আর একটা ফিডার সে চুরি করে পলাশের জন্য নিয়ে গেলো। মৌরীর জন্য এতো দুধ,ফিডার,ক্রিম,লোশন,জামাকাপড় ; ওখান থেকে দু’দশটা সরালেও কেউ টের পাবে না। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি, অপমান,কষ্ট, সন্তানদের জন্য দুশ্চিন্তা এসব কারণে রেখাও ধরতে পারেন নি, পলাশ নিয়মিত নতুন ফিডারে দামী দুধ খাচ্ছে। শিমুলই দুধ বানাতো,শিমুলই ভাইকে খাওয়াতো।পেটটা ভরা থাকায় পলাশও অতো কান্নাকাটি করতো না। শিমুলের বিশ্বাস ছিলো,ভালো জিনিস খেলে পলাশ সুস্থ হয়ে যাবে। তারপর বাড়ির এক গৃহকর্মী চুরিটা ধরে ফেললো। কতোদিন ধরে এই চুরিদারি চলছে,মারের চোটে শিমুল সেটাও বলে ফেললো। বাপ আর দাদীর কাছে ভয়ংকর মার খেলো শিমুল। কুৎসিত গালাগালি করলেন রিয়া আর তার মা। স্বামীর হাতে সেদিন চড় থাপ্পড় ছাড়াও চাবুকের বেশ ক’টা বাড়ি খেলেন রেখা। “মেয়েকে
লাগিয়েছিস চুরি করতে? মেয়ে চুরি করতো আর তুই টের পাস নি?”
অপমানে -ব্যথায় -মেয়ের রক্তাক্ত এলিয়ে পড়া শরীর দেখে জ্ঞান হারালেন রেখা। জ্ঞান ফেরার পরে রায় শুনলেন,তাঁদের তিনজনকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। রিয়ার আদেশ। এই তিন অপয়া তার মেয়ের ক্ষতি করবে।

রেখা শাশুড়ি -স্বামীর পা ধরে মাফ চাইলেন, এক পর্যায়ে রিয়ারও পা ধরলেন তাঁদের আশ্রয়চ্যুত না করার জন্য, কাজ হোলো না। রেখার সব গয়না,এমনকি যেগুলো তাঁর বাপ-মা দিয়েছিলেন, সেগুলো সব শিমুলের দাদী সিন্দুক বন্দী করে রেখেছিলেন। চরম দুঃসময়ে রেখা শাশুড়ির কাছে গয়না ফেরত চাইলেন, তিনি সোজা না করে দিলেন। ঠিক হলো,রেখা কালিন্দী আর লুলাটাকে নিয়ে ভাইদের কাছে থাকবেন, বাপ-মা মরার পরে ওটা আর বাপের বাড়ি নয়, ওমর খান মাসের খরচ পাঠিয়ে দিবেন। রেখার ভাইদের তীব্র প্রভাবশালী ভগ্নিপতির হুকুম মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

আশ্চর্য এটাই,খান সাহেব বৌকে তালাক দিতে পারতেন। তাতে কেউ তাঁকে সমস্যায় ফেলতে পারতো না। রিয়া বারবার রেখাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা বলেছেন,লাভ হয়নি।

মামার বাড়িতে রেখা আর তার ছেলেমেয়েদের গন্জনার সীমা ছিলো না। খান সাহেব মাসে যে টাকা পাঠাতেন, তাতে তিনটা পেট কোনোমতে চলে যায়। রেখা ভাইদের সংসারে ঝি এর মতো খাটতেন, তিনি আসা উপলক্ষে বাড়ির ঠিকা ঝি কে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।

শিমুল বড্ড বুদ্ধিমতী ছিলো। শুধু এটা তার মাথাতে কুলালো না চুরির মতো মহাপাপ করার পরে সবাই তাকে এতো মারলো, বকলো,বাড়ি থেকে বের পর্যন্ত করে দিলো,তাও মা তাকে এতোটুকু বকলেন না কেন?মা অবশ্য কাউকে কখনো বকেন না,মারাতো দূরের কথা। কিন্তু এটা কি ঠিক? শিমুল মনে মনে অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছিল অনাদর,অবহেলা,তাচ্ছিল্য পেতে পেতে। কেন মা এতো কষ্ট করেন? কেন মা’কে কটু কথা বললে মা চুপ করে থাকেন? প্রতিবাদ করেন না কেন? কেন উল্টো বকা দেন না? ছোট মা বাবার বৌ,কি আরাম করে থাকেন! মাও তো বাবার বৌ,উনি কেন বলেন না উনাকেও ছোট মায়ের মতো সম্মান দিয়ে, যত্ন করে রাখতে হবে? বাবা শিমুল,পলাশ,মৌরি তিনজনেরই বাবা, তাহলে মৌরিকে সবাই মাথায় করে রাখবে আর শিমুল-পলাশকে দূর ছেই করবে কেন? এই বাড়ি নাকি মামাদের আর মায়ের বাবা-মা বানিয়েছিলেন, তাহলে এটা শুধু মামাদের বাড়ি কেন,মায়ের বাড়ি কেন নয়?

শিমুল মায়ের কাছে জানতে চায়। রেখা বলেন, “আমি যে বড় দুর্বল মা। আমার বাপ নাই,মা নাই। আমি লেখাপড়া করিনি। তোমার বাবা অনেক লেখাপড়া করা মানুষ, তোমার ছোট মা ও। আমি অশিক্ষিত। তাই আমাকে কেউ সম্মান করে না মা।”

” তা কেনো? বড় মামীতো পড়াশোনাই জানেন না, লিখতে পারেন না, তাও বাসার সবাই তাঁকে ভয় পায়। বড় মামাও। আর বাবা যদি তোমাকে পছন্দ না করেন,তাহলে বিয়ে করলেন কেন?”

“ওসব কথা থাক আম্মু। তুমি ভালো করে পড়ালেখা করো। তাহলে মায়ের আর কষ্ট থাকবেনা। সবাই তোমাকে অনেক সম্মান করবে।”

“আমাকে যে বিয়ে করবে,সে আর তার মাও অনেক সম্মান করবে?”
“হ্যাঁ, মা। করবে। ”
“পলাশ পড়াশোনা করবে না?আমিতো ওকে পড়ানোর অনেক চেষ্টা করি।ও তখন হাসে।”

“না মা। ও পড়বে না। ওর অসুখ।”
শিমুল বলতে পারে না যে অসুখ হলে ডাক্তার ডাকো। নিজের চোখে বহুবার সে মাকে বাবা আর দাদীর পা ধরতে দেখেছে ছেলের চিকিৎসার জন্য। একবার বাবা মায়ের বুকে জোরে এক লাথি দেন। তারপর থেকে মা আর পলাশের চিকিৎসার জন্য কাউকে বলেন নি।

শিমুলকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন আর কেউ নয়, পাশের বাড়ির হাসান চাচা। এই চাচা রেখার বড়ই অনুরাগী ছিলেন। উনার বাবা-মা রেখার বাবা-মায়ের কাছে ছেলের হয়ে প্রস্তাব ও পাঠিয়েছিলেন। একই সময়ে খান পরিবারের থেকে প্রস্তাব আসে। কোথায় ইন্জিনিয়ার,সেই সাথে ব্যবসায়ী, বিশাল বাড়ি-গাড়ি, নিজের মামাতো বোনের ছেলে,রাজপুত্রের মতো চেহারা আর কোথায় বিএ পাশ ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত বাড়ির সাধারণ চেহারার হাসান আকন্দ।

সেই হাসান আকন্দ এখনো বিয়ে করেন নি। ব্যবসা করেন, এর ওর উপকার করে বেড়ান। শিমুলকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, পলাশকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার আশার বাণী শুনাতে পারলেন না। রেখা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলেন। হাসান আশ্বস্ত করলেন,পলাশকে ঢাকায় নিয়ে যেয়ে সবচেয়ে বড় ডাক্তার দেখাবেন।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here