নানান বরণ মানুষ রে ভাই পঞ্চদশ (১৫ তম পর্ব) বড় গল্প

0
243

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
পঞ্চদশ (১৫ তম পর্ব)
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

শেষ পর্যন্ত খান বাড়িতেই থেকে যেতে হলো। ভালো কলেজে ভর্তি হলো শিমুল। বোর্ডে দ্বিতীয় হওয়া মেয়ে, কলেজে অ্যাডমিশন ফি লাগলো না।বেতনও দিতে হবে না। স্কলারশিপ পাওয়ায় লেখাপড়ায় আরও সুবিধা হলো। শিমুল ব্যবস্হা করে নিয়েছে বাড়িটার মালিক যেন সে হয়। মা’কে বিশ্বাস নেই। জীবন শিমুলের কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেছে,এখন জীবন যা দিতে চায়,তার এক বিন্দুও নষ্ট হতে দিবে না শিমুল।

পলাশকে এহেন কোনো হাসপাতাল নেই যেখানে হাসান মামাকে সাথে করে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় নি শিমুল। কিন্তু আশার বাণী পায়নি কোথাও।জন্মের পর হতে ভালো চিকিৎসা হলে হয়তো কিছুটা হলেও লাভ হতো। দাদীকে সরাসরি বলে,”আপনাদের নিষ্ঠুরতার জন্য আজ আমার ভাইটার এই অবস্থা। আজ বাড়ি দেন,জমি দেন,গয়না দেন,ক্ষমা চান,যাই করুন,আপনাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। আমি অন্তত আপনাদের ক্ষমা করবো না। পলাশকে পেটে নিয়ে কি কষ্টটাই না করতে হয়েছে আমার মা’কে, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক ছিলো না, সারাদিন ঘরের কাজ করাতেন, আপনার ছেলে ওই সময়ই বিয়ে করলেন, নতুন বৌকে নিয়ে কতো আদর-আহলাদ করতেন আপনার ছেলে ও আপনি, পানি ভেঙেছে মায়ের এমন সন্দেহ পাত্তা দেন নি আপনারা, ডেলিভারির সময় ভর্তি করালেন যাচ্ছেতাই ক্লিনিকে, আপনাদের জন্য ই আমার ভাইটা অস্বাভাবিক ভাবে জন্ম নিলো, আপনাদের অনুশোচনা তো হোলোই না বরং মায়ের উপরে শতগুণ অত্যাচার বাড়িয়ে দিলেন আপনারা, খুব ভালো জানতেন মায়ের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, আমার ভাইটাকে কতো ঘেন্না করতেন আপনারা, কতো ঠাট্টা, কতো উপহাস, মনে পড়ে আপনার? ভালো মানুষ হয়েছেন তো ঠেলা খেয়ে, এখন আমার মায়ের সেবা নিতে লজ্জা করে না আপনার? কি ভাবেন?এই যে বাড়ি,জমি,গয়না দিয়েছেন, এগুলো আপনার দান?অনেক মহৎ কাজ করে ফেলেছেন? মোটেও না,এটা আমাদের প্রাপ্য। কোনোদিন ক্ষমা করবো না আপনাদের তিনজনকে, আল্লাহও যেন মাফ না করেন। নরকে পচতে হবে আপনাদের।”

আফরোজা বেগমের চোখ দিয়ে পানি ঝরে। আসন্ন মৃত্যু ও তার পরবর্তী অবস্থার কথা ভেবে ভয়ে তাঁর বুক কাঁপে।

এরমধ্যে নতুন অতিথির আগমণ ঘটলো বাড়িতে। রিয়ার সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে নিয়ে আসা হলো এই বাড়িতে। এক বছরের একটু বেশি বয়স। পুলিশ হাসপাতালে মায়ের সাথে থাকতো, তারপরে তার জায়গা হলো মায়ের সাথে জেলখানায়, বিষয়টা অমানবিক বিধায় আবারো হাসপাতাল,আবারও জেলখানা। বাচ্চার মামা-মামী কোনোভাবেই তার দায়িত্ব নিতে রাজি না, অবশেষে খান বাড়ির ছেলে খান বাড়িতে এলো। রেখার আবেদনক্রমে,রেখার তত্ত্বাবধানে। নাম মিতুল।

শিমুল রেখাকে ধরলো,” সব অচল,আতুর এদের সবার দায়িত্ব পালন করা কি একা তোমার দায়িত্ব ? একজন বিছানায় পড়ে থাকা বুড়ির দায়িত্ব তুমি নিয়েছো, আরও চারটা বাচ্চার দায়িত্ব নিয়েছো,এখন দুইটা জালিমের এতো ছোট বাচ্চার দায়িত্ব ও তুমি নিলে?কেন,বলো তো?আমাদের নামে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতায়? সবাই তোমাকে দেবী মনে করে মাথায় তুলে রাখবে,এই আশায়?”

“ভদ্র ভাবে কথা বলো শিমুল।ইদানীং তোমার কথাবার্তা বেশ উদ্ধত হয়ে যাচ্ছে। তোমার দাদী একজন মরণাপন্ন অসহায় বৃদ্ধা। তিনি যেমনই হোন,আমার শাশুড়ি। তাঁকে দেখাশোনা করার দ্বিতীয় কেউ নেই। কাজের লোকদের দিয়ে সবকিছু হয় না শিমুল।”

” নার্স রেখে দাও কিংবা ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দাও।”

“আমার যখন এমন অবস্থা হবে,তখন আমার জন্যও তুমি একই ব্যবস্থা করবে?”

“তুমি আমার মা, আর উনি তোমার শাশুড়ি। ভালো শাশুড়ি হলে হতো,অসম্ভব অত্যাচারী এক শাশুড়ি। ”

“অতীতের কথা থাক। এখন উনার সেবাযত্ন করা আমার কর্তব্য। আর নিজের কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার শিক্ষা আমার বাবা-মা আমাকে দেন নি।”

“এখন তোমার শাশুড়িকে দেখাশোনা করবে,এই বাচ্চাকেও দেখাশোনা করবে।তোমার নিজের দেখাশোনা কখন করবে?”

“তোদের দেখাশোনা করলেই আমার নিজের দেখাশোনা হয়ে যায়।”

“কিন্তু তুমিতো আমাদের দেখাশোনা করোনা?”

“কি বলছিস শিমুল? ”

” ছোটবেলায় আমি তোমাকে কাছে পেতাম গভীর রাতে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমার গোসল,খাওয়া আমি নিজেই করেছি।মাছ বাছতে পারতাম না। একদিনও এসে মাছ বেছে দাওনি। সুতরাং আমার মাছ খাওয়া হোতো না।আমি একটা ঘ্যাঁট আর ডাল দিয়ে কোনোমতে খাওয়া সারতাম।”

“তখন আমার যে তোর খেয়াল করার অধিকার, সুযোগ কিছুই ছিলো না,এটা বুঝার বুদ্ধি তো তোর আগে ছিলো, এখন নাই?”

“পলাশ পেটে থাকা অবস্থায় তুমি বাড়ি ছেড়ে আমাকে নিয়ে চলে যেতে পারো নি?

” কোথায় যেতাম? তোর মামা-মামীরা আমাদের গ্রহণ করতেন? ”

“অনেক মা আছে যারা অত্যাচারিত হলে,বিশেষ করে সন্তানকে অত্যাচারিত হতে দেখলে বাচ্চা নিয়ে স্বামীর বাড়ি হতে বের হয়ে যায়, বস্তিতে বাসা নেয়, পরের বাড়িতে ঝি গিরি করে হলেও সন্তানদের নিয়ে সুখে থাকে।”

” যতোটা সহজে বলছো,ততোটা সহজ কিন্তু ব্যাপারটা না শিমুল।”

” পলাশকে তোমার অনেক সময় দেওয়া উচিৎ, মা।”

“পলাশ তো ভালো আছে। তুই বা মৌরি খাইয়ে দিস, একা একাও খেতে পারে কিছুটা, তুই বা আমি গোসল করিয়ে দিই, ভাইবোনদের সাথে খেলাধূলা করে কতো আনন্দের সঙ্গে, ও তো আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছে। ”

“ওকে সবসময় নজরে রাখা উচিৎ। আমি কলেজে যাই, মৌরিরা স্কুলে থাকে,তখন একা একা ও কি করে? বাথরুমে আছাড়ও তো খেতে পারে,তাই না? আর আরেকটা পুষ্যি আসলে তুমি তো ওর গোসল করানো দূর, ওকে চোখে দেখারও সময় পাবে না।”

“তুমি মৌরিদের চারজনকে এতো ভালোবাসো,এ তো তাদেরই একজন।তাহলে এর দোষটা কি?এখন নিজেকে নিয়ে ভাবো শিমুল, ভালো করে লেখা পড়া করো। বড় কিছু হও। পলাশকে নিয়ে চিন্তা করোনা, ও তোমার ভাই বটে, আমারওতো ছেলে।”

নতুন মেহমানকে নিয়ে ভাইবোনদের মহা বিষ্ময়। পলাশ হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে ধরতে চাচ্ছে। মুখ ভরা হাসি।বাকি ভাইবোনদেরও একি অবস্থা। বাচ্চাটা খুব কাঁদছে। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ দেখে তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছে। রেখা সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। মন্জু, মতির মা,শাহানা, পারু,নতুন আসা পাখি কেউ তাকে সামলাতে পারছে না।

বাচ্চাটা ফিডারে দুধ খাচ্ছে। পেট ভরার পরে এবং অতিরিক্ত কান্নাকাটি করায় ক্লান্ত হয়ে সে এখন ঘুমাচ্ছে। শিমুলের বিছানায় অয়েলক্লথ আর কাঁথার উপরে হাত পা ছড়িয়ে। ঘুমের মধ্যেও ফুঁপাচ্ছে থেকে থেকে। সব বাচ্চারা চুপ করে গোল হয়ে বসে আছে। আনন্দে একেকজন ঝলমল করছে।নতুন এক খেলার পুতুল পেয়েছে তারা।

রাতে রেখা শাশুড়ি ও মুমুকে নিয়ে ঘুমাতেন। সেদিন ঘুমানোর আগে মহা গন্ডগোল শুরু হলো। নতুন বাবু মিতুল গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। আফরোজার খুব শারীরিক কষ্ট হচ্ছে শব্দে। তিনি এই শিশুর সাথে ঘুমাতে পারবেন না।রেখার প্ল্যান ভেস্তে গেছে। তাঁর ইচ্ছা ছিলো তিনি মিতুল ও শাশুড়িকে নিয়ে ঘুমাবেন। দুজনের ই তাঁকে দরকার। মুমু ঘুমাবে শিমুলের কাছে।এদিকে মায়ের কোল ছাড়া হওয়ার ভয় সন্ধ্যা থেকেই মুমুর মধ্যে কাজ করছে। রাতে খাওয়ার পর থেকে সে রেখাকে আঁকড়ে ধরে আছে। রেখা বললেন,”পাকনা বুড়ির মা ছাড়া চলে না? বড় আপার কাছে ঘুমাতে অসুবিধা কোথায়? এমনিতে তো আপা,আপা করে অজ্ঞান। ” এটা ঠিক। ছোট সব কয়টা ভাইবোন শিমুলের অন্ধ ভক্ত। আপার উষ্ণ, আন্তরিক ভালোবাসা তারা অনুভব করে। আবার আপাকে তাদের ভয়ও লাগে। এদিক -ওদিক হলে আপা এমন ঠান্ডা ভাবে একটানা চেয়ে থাকে যে বুকে কাঁপন শুরু হয়ে যায়। মুমু যখন ভাবছে আপার কাছেও শোয়া যায়,তখন আফরোজা বললেন,”রেখা, ঐ বাচ্চা এখানে থাকলে আমি ঘুমাতে পারবো না মা।এমনিও এতো শব্দে বুক ধড়ফড় করছে।”

রেখা শিমুলকে দাদীর কাছে ঘুমাতে বললেন। শিমুল এক কথায় নাকচ করে দিলো দাদীর সামনেই। মা’কে বললো,”মিতুলকে আমার কাছে দাও।”

“মিতুল কাঁদবে একটু পরপর। পেশাব করবে। দুধ বানিয়ে খাওয়াতে হবে।তুই ঘুমাবি কখন?”

“ইনার কাছে থাকলে আমার আরও ঘুম হবে না। ইনি একবার পানি খাবেন,একবার পেশাব করবেন,এই চলবে সারা রাত। তাছাড়া উনার মতো মহিলার সাথে ঘুমানোর চাইতে ফুটপাতে ঘুমানো অনেক ভালো।”

রেখা আন্তরিক দুঃখিত হলেন। মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আজন্ম রেখা আব্বা-আম্মার কাছে শিক্ষা পেয়েছেন, “মুরুব্বিদের কোনো অবস্থায় অসম্মান করবে না। কেউ তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে তুমি তার সাথে আরও ভালো ব্যবহার করবে।অসুস্থ জনকে জানপ্রাণ দিয়ে সেবা করবে।” আব্বা-আম্মা শুধু যে উপদেশ দিতেন,তা নয়। নিজেরাও নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। দাদা-দাদী, নানা-নানি, আরও অনেক বৃদ্ধ আত্মীয়
স্বজন আব্বা-আম্মার হাতের আন্তরিক সেবা যত্ন,আদর পেয়েছেন। রেখাদের বাড়িতে তাঁদের শেষ জীবন খুব সুন্দর কেটেছে। এক পাগল বাড়ি থেকে বেশ দূরে একটা গাছ তলায় বাস করতো। রেখার আম্মা তিনবেলা যত্ন করে ভাত তরকারি পাঠাতেন। রেখা এই আদর্শ থেকে বিচ্যূত হতে পারবেন না। শিমুল সেদিন ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলো এই বলে যে রেখা তাদের দুই ভাই বোনকে বিভৎস অত্যাচার থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন নি। আসলে কি তাই? কি করতে পারতেন রেখা? বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন দুই শিশুকে নিয়ে? তিনটা মুখকে আশ্রয় দিতো কে?নিজের ভাই তিনটা হয়েছে আব্বা-আম্মার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাছাড়া রেখার সাহস আর আত্মবিশ্বাসের ও ঘাটতি আছে কিছুটা।

রাতে মিতুলের ঠাঁই হলো শিমুলের কাছে। পাখির জন্যও একটা চৌকি পাতা হলো শিমুলের ঘরে। বেশি জ্বালালো না শিশুটি।সারা রাতে একবার দুধ খেলো, একবার পেশাব করলো। শিমুলের সে রাতে ঘুম এলো না। পুরানো স্মৃতিগুলো বড্ড জ্বালাতে লাগলো। এই বাচ্চাটার মা আর বাবা কি অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতো মায়ের উপরে,তাদের দুই ভাই বোনের উপরে। একবার মনে হলো বাচ্চাটাকে বালিশ চাপা দিয়ে নিঃশব্দে মেরে ফেলে। আরেকবার ভাবলো বাচ্চার পা দুটোকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেয়। ঠেলা বুঝুক ওর বাপ-মা। পরমুহূর্তেই আবার নিজের উপরে রাগ হলো শিমুলের। এমন খারাপ চিন্তা তার মাথায় আসলো কি করে? ছিঃ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here