উপন্যাস: রোদেলা
লেখক: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১
রাত দুইট পয়তাল্লিশ, রোদেলা বারান্দার গ্রীলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য দিনের চেয়ে পুরো বাড়িটা এখন স্তব্ধ। কিছুক্ষণ আগেও বাড়ি গমগম ছিলো। আনন্দ উপচে পরছিলো সবার চোখেমুখে । সারাদিন ব্যাস্ততায় কেটেছে সবার, বাড়ির সব মেয়েদের অনেক ধকল গেছে আজ, প্রায় সারাটা দিন কেটেছে রান্নাঘরে। ক্লান্ত সবাই গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেছে তাই বাড়িটা এমন অসম্ভব স্তব্ধ। অন্যান্য দিনে বাড়ির কেও না কেও সজাগ থাকেই… মামা, মামী, নানু কিংবা মা….
হালকা একটা বাতাস বইছে চারপাশে, আকাশ কালচে নীল রঙের হয়ে গেল চোখের পলকেই। কিছুক্ষণ আগেও গুমট একটা ভাব ছিলো চারদিকে। ক্লান্ত পৃথিবী যেন ঘুরতে ভুলে গেছে, দুদন্ড জিরিয়ে নিতে চাইছে, তাই সময় থমকে দাঁড়িয়ে। ইশ্বর যেন পৃথিবীটাকে স্ট্যাচু বলেছে….! গাছের পাতা, পাশের ছাদে শুকাতে দেওয়া কাপড়, দূরে মাজারের মিনারে টানানো সবুজ পতাকা, সব সবকিছু যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। অসহ্য গরমও লাগছে।
হঠাৎই কেমন যেন বদলে গেলো চারপাশ। নারকেল গাছের পাতাগুলো দুলছে। পাশের বাড়ির ছাদের বিছানার চাদর সেটা এখন ঝড়ে পরা নৌকার পালের মত দুলছে। বাতাসের দমকে সাদা রঙের কি যেন একটা পরে গেলো দড়ি থেকে। সেটাকে কুন্ডুলি পাকানো বিড়ালের মতো দেখাচ্ছে এখন।
ওদের বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলোও দুলছে এলোমেলো ভাবে। মনে হচ্ছে পরে যাবে এখনি। অন্য সময় হলে রোদেলা এই কাপড় গুছাতে ব্যাস্ত হয়ে পরতো। কিন্তু ওর ওদিকে একটুও মন নেই। একবার বাতাসে নাচতে থাকা কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো ও।
বাতাসের দমক বাড়লো হঠাৎ করে। গাছের পাতা একটা আরেকটার উপর আছড়ে পরছে। শো শো শব্দে বাতাস যেন ছুটবার দিক খুঁজে বেসামাল। ওর পথের সামনে যা পাচ্ছে তাই গুড়িয়ে দিতে চাইছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো সাথে সাথে। ওর হাত মুখ ভিজে গেলো বাতাসে করে বয়ে আনা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির কণায়। মুহুর্তের মধ্যে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
ভিজে গেল রোদেলা। একটুও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরে দাঁড়ালো না ও। ওর চোখের সামনেই বারান্দায় সব কাপড় ভিজে গেলো। এলোমেলো বাতাসে কোন কোন কাপড় পরে গেলো বারান্দার মেঝেতে। ঘর মোছার কাপড়, ধুয়ে শুকাতে দেওয়া পাপশ, বড় চালুনিতে শুকাতে দেওয়া মরিচ সব সব ভিজে গেলো ওর চোখের সামনেই। ওর টনক নড়লো না একটুও। যদিও ও জানে এজন্য কাল সকালে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শোনাবে ওর মা….
এই শুকিয়ে যাওয়া কাপড়, কিংবা রোদে টনটনে হয়ে যাওয়া শুকনো মরিচ কেন দুনিয়াটাও যদি এই মুহুর্তে গুড়িয়ে যায় এই বাতাসে তাও বোধয় ওর টনক নড়বে না। ভিতরকার ঝড়ের সাথে বাইরের ঝড়ের মিল দেখেই মনে হয় ও এমন বিহ্বল হয়ে গেছে।
রোদেলার বাবা অনেক শখ করে ওর নামটা রেখেছিলেন। প্রথমে মেয়ে হওয়ায় ওর দাদী একটু অখুশি হলেও বাবা কিন্তু খুব খুশি ছিলেন। কি মনে করে এই নামটা রেখেছিলেন কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি । কিন্ত ওর জীবণটা নামের সাথে একেবারেই সামঞ্জস্য ছিলো না। ওর জীবণটা দিনের আলোতেও অন্ধকারে পরিপূর্ণ ছিলো। ওর নাম হওয়া উচিত ছিলো মেঘলা কিংবা অন্ধকারের সমার্থক কোন শব্দ। ফেসবুকে প্রায়ই একটা পোস্ট আসে, ছোটবেলায় ফিরে যেতে চান কিনা, রোদেলা এ ছবিটা দেখলে আতকে উঠে। ও কখনোই ওর ছোটবেলায় ফিরে যেতে চায় না।
ওর বাবা ওর কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। মা একটু কড়া। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে বাবা মায়ের দা-কুমড়ো সম্পর্ক। যতদিনে ও বুঝতে শিখেছে তাদের দুজনের বিয়ে হওয়া উচিত হয় নি ততোদিনে একটা বোন এলো ওদের ঘর আলো করে। সবাই বলে সুখী সংসার। স্বামী-স্ত্রী কত মিল। একজন আরেকজনকে চোখে হারায়। অথচ ঘরের পরিস্থিতি রোদেলাকে সব সময় ভাবাতো যদি ও নিজে হারিয়ে যেতে পারতো। এমন অসুস্থ একটা পরিস্থিতিতে ওর ছোটবেলা কাটলো। দুজনের অমিল কোথায় কিংবা কেন এমন হচ্ছে তা ও বুঝতে পারছে না। নিজের মতো করে থাকার চেষ্টা করছে। স্কুল, টিউশন, গানের ক্লাস এসবে ব্যাস্ত থাকার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ওর মা সংসারের অশান্তির কারনে ক্ষয়ে যাওয়া মেজাজের পুনরুদ্ধার করতো ওকে মেরে, ওর সাথে বাজে ভাষায় কথা বলে কিংবা কোন শাস্তি দিয়ে। এমন একটা পরিস্থিতি ছিলো যে ও সবসময় আতংকে থাকতো এ বুঝি মা বকলো, কিংবা মারলো। সব মন্দেরই একটা ভালো দিক থাকে। রোদেলার কাজে-কর্মে পারফেকশন এ ঘটনারই ফল।
অন্যের মা-দের দেখলে রোদেলা ভাবতো ইশ্ আমার মা-টা যদি এমন হতো… ও মন খুলে কোন কথা মা কে বলতে পারতো না। কখনোই না… কোনদিন ওকে স্কুলে দিয়ে আসতো না। এ জিনিসটা ওকে খুব কষ্ট দিতো। সত্যি বলতে রেদেলা একটা সময় ওর মাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। তার হুকুমের আগে সব কাজ করে রাখে যাতে বকা দেওয়ার সুযোগ না পায়। তবুও এ ছুতায় ও ছুতায় প্রতিদিন ও বকা খেতো মায়ের কাছে। একটা সময় এসব স্বাভাবিক হয়ে যায় ওর কাছে। ও নিজেকে একটা ডাস্টবিন ভাবতে শুরু করে। যেখানে ওর মা প্রতিদিন তার রাগ, ক্ষোভ, না পাওয়া, কষ্ট সব ঝেরে ফেলে ।
রোদেলা সবচেয়ে বেশী বিপাকে পরে যায় মা দিবস আসলে, সবাই কি সুন্দর পোস্ট লিখে মায়ের সাথে তোলা ছবি দেয়। ওর এখন ২২ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও ওর মায়ের সাথে কোন ছবি নেই। ওর এক ক্লাসমেট একটা পোস্ট লিখে সুন্দর একটা ছবি দিয়ে, যে বাসায় রান্না করতে গেলে এমন বাটি নিয়ে ঘুরঘুর করে মাকে জ্বালাস কে কে…?
পোস্টটা দেখে রোদেলার কান্না পায়। এমন কিছু তো ও কল্পনায় ও ভাবতে পারে না। ওর মনে পরে না যে ও ওর মাকে বলেছে যে মা আমার এটা খেতে মন চেয়েছে, কিংবা আজ এটা রাঁধো। বিকালের নাশতায় মা যা মন চায় তৈরী করতো। খেলে খাও না খেলে যাও….
আর এসব আবদারের কথা তো বহুত দূর কি বাত…..
তার মানে এই না যে এটা কোন খারাপ মায়ের উপাখ্যান কিংবা সৎ মায়ের অত্যাচারের দুঃখগাঁথা ৷ তারপরও তিনিই শ্রেষ্ঠ মা ওর কাছে। দুনিয়ার সবাই সবদিক থেকে সুখি হয় না। খোদা নিশ্চয়ই অন্য কোন দিক দিয়ে এটা পুষিয়ে দিবেন।
আজ ওর মায়ের জন্য ওর মন খারাপ না। বাইশ বছরের জীবনে এটা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার ওর কাছে। বরং এমন না হলেই ও চিন্তায় পরে মার কিছু হলো কি…..? গতকাল বড় খালামনি এসেছিলো ওদের বাসায়, বড় মামার মেয়ে নাতাশাকে আংটি পরাতে আসবে তাই । রোদেলা তাকে সবসময় এড়িয়ে চলে। সুযোগ পেলেই কথা শুনায়। এ কথা সে কথা এই দোষ সেই দোষ। মেহমান আংটি পরিয়ে যেতে যেতে রাত এগারোটা, যাবার পর রেদেলাদের ঘরে এলে ওর মা তার কাছে কি যেন বলেছেন। তিনি রোদেলাকে দেখা মাত্র শুরু করে দিলেন তার ভাষণ। তোদের জন্য আমার বোনের জীবণের আজ এ অবস্থা…. এরপর শুরু হলো কলের রেকর্ড……..
আজ ভিন্ন কিছু বলেছেন তিনি। নাতাশাকে দেখতে আসার সময় ও নাকি সেখানে গিয়ে ছিলো। ও নাতাশার বিয়ে ভাঙতে নাকি এমন করেছে। আরো অনেক বাজে কথা। এত বাজে যে সুস্থ মস্তিষ্কে এসব ভাবা অসম্ভব। অথচ ছেলের চাচা মানে বড় মামার কলিগ প্রথমে রোদেলাকেই পছন্দ করেছিলো। রোদেলার মা সাফ মানা করে দিয়েছে। এত বড়লোকদের সাথে সম্বন্ধ করবে না। পরে বড় মামা নাতাশাকে দেখায়। যদিও নাতাশার বয়স সতেরো। আসছে নভেম্বরে আঠারো হবে। নাতাশার মা একদম রাজি না এ বিয়েতে। বড় মামার ভয়ে তা বলতে পারছে না। তাই বড় মামী রোদেলার মাকে অনেক বুঝায়। তবুও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল।
নাতাশা ওর বয়সে ছোট, সেই ছোট্ট বেলা থেকে ওকে কোলে নিয়েছে, আদর করেছে, চুল বেঁধে দিয়েছে ও। ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু রোদেলা। ওই একমাত্র ছোট বাবু ছিলো দুই পরিবারের আত্নীয়দের মধ্যে। ও ওর ক্ষতি হোক এমন কিছু ভাবতেই পারে না। মামী এসব কিছুই বলে নি। অথচ তিনি মা হয়ে এমন বাজে কথা বলেছেন যে দুঃখে ওর মরে যেতে ইচ্ছে করেছিলো।
তাতেও তার হয় নি। এখম আবার বোনকে দিয়ে শুনাতে হবে। খালামনি এই খোটা সেই খোটা, খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে, আজ সেই পাতেই ছিদ্র করতে চাস…
রোদেলার বাবা মারা যাবার পর থেকে ওরা ওদের নানু বাসায়, এ বাড়িতে সবার মতো ওর মায়েরও ভাগ আছে। তাছাড়া ক্লাস এইট থেকে ও টিউশনি করিয়ে টাকা ইনকাম করে। সব টাকা ময়ের হাতে তুলে দেয়। ভালো ছাত্রী হওয়ায় এই বৃত্তি সেই বৃত্তি পেতেই থাকে। স্কুল কলেজে একরকম ফ্রীই পড়াশোনা করে ও। ছোট বোনটার পড়াশোনার খরচও ও দেয়। বড় মামা ওদের খরচ দিতে চান। কিন্তু রোদেলার মা নেন না। তিনি চান মেয়েদের বিয়েটা যেন তার বড় ভাই দিয়ে দেয়। তাই এই এড়িয়ে চলা। তার নিজেরও ব্যাক্তিগত সেভিংস আছে। সংসারের খরচে কন্ট্রিবিউট করে না তা ঠিক, কিন্তু তার ভাগের ভাড়া ঘর আর দোকানের সবটাই বড় মামা তুলে নেন। তারপরও খাওয়ার খোটা, পরার খোটা। এ নিয়ে মা কোন প্রতিবাদ তো করেই না উল্টো তাদের সাথে তাল দেয়। তার এই দুঃখ শুধু বুঝে মেঝ খালামনি। তিনি ওকে বুঝায় কষ্টে কষ্টে তোর মায়ের আজ এই অবস্থা, তোর বাবা তোর মাকে কোনদিন শান্তি দেন নি। তাই মেজাজটা এমন হয়ে গেছে। কি করবি বল মা তো….
মা পাগল হলেও বেঁধে রাখতে হয়……
চলবে……
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1469263916868128/