#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩২
শোভনের রুম থেকে বের হয়ে রোদেলা বাইরে বের হয়। সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক বাকী। রিসোর্ট থেকে বের হয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে বাইরে। হাঁটতে হাঁটতে মার্কেটে এসে পরে। যদিও এটুকু একটা দ্বীপে মার্কেট বলতে কয়েকটা দোকান মাত্র। অনেকটা গ্রামের বাজারের মতো। মায়ের জন্য টুকটাক জিনিস কেনে রোদেলা। স্টুডেন্টদের জন্য আচার আর চকলেট। এখানে জিনিসপত্রের মোটামুটি ভালোই দাম। কক্সবাজারের তুলনায়। যদিও বেশীরভাগ জিনিসই ঢাকায় পাওয়া যায়। সামান্য কিছু জিনিস আছে যা এখানকার স্পেসিফিক। তেমনি কিছু কিনলো ও। কাল দুপুরে খাওয়ার পরই রওনা হবে ওরা। পরে আর সময় পাওয়া যাবে না। তাই কেনাকাটা সেরে নিলো।
দোকান থেকে বের হয়ে গেলো খাবারের দোকানে। সেখানে বসে হালকা খাবার খেলো। পেঁয়াজু, আর মাছের ফ্রাই…
এ দোকানের মাছের ফ্রাইটা খুব স্বাদের হয়। বিকেলের ঐসব যন্ত্রণায় কিছুই খাওয়া হয় নি ওর, সেটা একদমই খেয়ালই ছিলো না। শোভনকে সান্টিং দেবার পর একটু স্বাভাবিক আর শান্তি লাগছে…
তাই খিদেটাও জানান দিয়েছে। এতক্ষণ ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। সেই ঘোর নিজের হাতে কেটে এসেছে রোদেলা। শেষ করেছে এই চোর পুলিশ খেলা। এখন কেমন শান্তি লাগছে…..
এমন সময় কল করে প্রিসিলা, বড় মামীর ফোন দিয়ে..
আপা কই তুই.. রুমে এসে দেখি তুই নাই…?
জলদি আয়, একা আমার ভয় করে…
আমি একটু বের হইছি…
আসছি দাঁড়া..
পাঁচমিনিটের মধ্যে আসছি….
রুম অবধি আসতে রোদেলার সাত মিনিট লাগে, এসে দেখে ওর বোন দড়জা একটু ফাঁকা রেখে বসে আছে। এমন একটা ভাব যেন ভুত আসলেই দৌড় দিবে। ভয় হলে কি হবে, ম্যাডাম আবার ভুত এফ.এম শুনে…!
রুমে ঢুকে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয় ও, এ ফাঁকে প্রিসিলা যায় ফ্রেশ হতে। বোন আর মামীর জন্য কিছু খাবার সাথে করে এনেছে রোদেলা, মামী পেঁয়াজু রেখেছেন শুধু, ফিশ ফ্রাই নেননি। প্রিসিলা বের হয়ে খাবার দেখে বলে, আপা সুফিয়ান ভাই আমাদের সবাইকে নাশতা করিয়েছে। আমার পেট ভরা। আমি কিছু খেতে পারবো নারে…
সরি আপা….
ঠিকাছে, তুই রেস্ট নে, বলে ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকে। এমন সময় নাতাশা আসে ওদের ঘরে। ছেঁড়া দ্বীপের গল্প বলতে এসেছে ও। তিনবোন মিলো কলকল করে রাত নয়টা পর্যন্ত। কে বিশ্বাস করবে যে কিছু সময় আগেই রোদেলা হাপুস নয়নে কেঁদেছিলো। কে বুঝবে কিছুক্ষণ আগে কি ঘটে গেছে ওর জীবণে…!
এই হচ্ছে রোদেলা।
ও যে গান শিখতো একাডেমিতে। সেখানে বাৎসরিক একটা উৎসব হয়, প্রতিযোগিতা হয় অন্যান্য একাডেমির সাথে। এর আগের বছর নাম দিয়েও অংশ নিতে পারে নি ও। তাই সে বছর জোরদার প্রস্তুতি নিয়েছে ও। যেদিন ওর অনুষ্ঠান ছিলো সেদিন সকালে ওর বাবা একটা চিরকুট লিখে চলে গিয়েছিলেন। তিনি অনেক ঝমেলার মধ্যে আছেন, তার একটু সময় দরকার এসব গুছাতে, তাই তিনি দূরে সরে যাচ্ছেন এই ছিলো সেই চিরকুটোর সারমর্ম। ওর মা সকাল থেকেই কান্নাকাটি করছিলো।
ঘরে কোন বাজার নেই। মায়ের অতি কষ্টে জমানো কিছু টাকা ছিলো একটা মাটির ব্যাংকে। সেটাও জায়গা মতো নেই, রান্নাঘরে সেই ব্যাংকটা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে কানাকড়ি ও ছিলো না।
এমন একটা পরিস্থিতিতে অন্য কেও হলে হয়তো ভেঙে পরতো, কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিত। অনুষ্ঠানে যাবার কথা চিন্তাও করতো না। কিন্তু রোদেলা ওর মাকে না জনিয়েই সে অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, লুকিয়ে ব্যাগে ড্রেস নিয়ে নিয়েছিলো, তৈরী হয়েছিল একাডেমির গার্লস কমন রুমে। শুধু তাই নয় সেইদিন রোদেলা
গানও গেয়ছিলো-
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে,
বুকের ‘পরে ॥
পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে
দুই নয়ানে—
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে
পড়ুক প্রাণে ।
নিশিদিন এই জীবনের সুখের ‘পরে
দুখের ‘পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে ।
যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না
একেবারে,
তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক
জাগায়ে সেই শাখারে ।
যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার,
জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে
সুরের ধারা ।
নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ‘পরে,
ভুখের ‘পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে ॥
গানটা গাওয়া অবস্থায়ই ওর চোখ বেয়ে পানি পারছিলো। পেছনে ফেলে এসেছে যা হয়তো তাই ভেবে। এজন্যই হয়তো কন্ঠে ছিলো সীমাহীন দরদ।
গান শেষ তবুও ওর কান্না শেষ হয় না। সেদিন “গ” ক্যাটাগরিতে প্রথম পুরস্কারটি রোদেলা পায় যা ওদের একাডেমির একমাত্র পুরষ্কার ছিলো।
রাতের খাবারের জন্য ডাক আসে। রোদেলা যাবে না বলে ঠিক করে। ওর পেট ভরাই…, বলে তোরা যা আমার ক্ষুধা নাই। রোদেলাকে রুমে রেখেই ওরা চলে যায় ডাইনিং হলে। যে যার মতো পছন্দের খাবার নেয়। কেও ভাত তো কেও নান রুটি আর তরকারি।
হঠাৎ কি ভেবে যেন রোদেলা ডাইনিং হলে যায়। ইশারায় নাতাশা জিজ্ঞেস করে – আসবি না বললি যে….!
রোদেলা ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে বসে পরে একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে। ভাত-সবজি-ডাল অল্প করে খায় রোদেলা। এখানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসেছে কারন না আসলে শোভন ভাবাতে পারে রোদেলা ওর থেকে চোখ বাঁচাতে আসেনি রোদেলা, তাই এসেছে। কিন্তু এসে দেখে শোভন ডাইনিং হলে নেই, বেচারা যেই ধাক্কা খেয়েছে। এখনো মনে হয় স্বাভাবিক হতে পারে নি।
রাতে সবাই বীচে যাবে। লেট নাইট বারবিকিউ করতে। রোদেলা সেখানে যায় না। যদিও ও জানে শোভনও নেই সেখানে। রোদেলার সব আনন্দ মাটি করে দিয়েছে এই হতচ্ছাড়া শোভন। এখন মনে হচ্ছে না আসলেই ভালো হতো।
এ ট্যাুরে সবচেয়ে হাসিখুশি মুখ প্রিসিলার। দুনিয়ার বাস্তবতা এখনো ওকে ছুঁতে পারে নি। তাই তো কত্ত আনন্দিত আর হাসিখুশি ও। যাক নিজের না হোক বোনের খুশিতে খুশি ও। রোদেলা ওর রুমে
শুয়ে টিভি দেখছিলো এমন সময় দড়জায় নক করে কেও। বিছানায় শোয়া রোদেলা দ্রুত উঠে বসে…
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে দশটা বাজে। কে আসবে এত রাতে…. শোভন নয়তো….
এসব ভাবনার মধ্যেই আবার টোকা পরে দড়জায়। কাছে গিয়ে দুরুদুরু বুকে দড়জা খোলে ও। দড়জা খুলে দেখে সুফিয়া আন্টি দাঁড়ানো….
বুক থেকে পাষাণ নামে ওর। তিনি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করেন বিরক্ত করলাম না তো…?
আজেবাজে চিন্তায় সালামটাও দিতে মনে ছিলো না ওর, সালামের উত্তর দিয়ে দড়জা ছেড়ে দাঁড়ায় ও। না আন্টি টিভি দেখছিলাম, আসুন না….
ওরা সবাই পার্টি করছে বীচে, শুনলাম তুমি নাকি যাও নি, তাই তোমার কাছে এলাম….
ওহ্ আসুন না…
ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো ব্যাস্ত। রাতের সমুদ্রটা দেখা হয় নি, তুমি কি আমাকে একটু নিয়ে যাবে…? যদি তোমার কাজ থাকে তাহলে থাক, আমি সুফিয়ানকে ডেকে নিচ্ছি। উনি এমন ভবে বললেন না বলবার কোন উপায় নেই… রোদেলা বললো আন্টি আপনি রুমে যান আমি তৈরি হয়ে আসছি….
রোদেলা ওড়না জড়িয়ে নেয় গায়ে। কেডসে পা গলায়। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সুফিয়া বেগমের ঘরের কাছে আসে। একবার নক করতেই তৈরী হয়ে বের হন তিনি। রুম লক করে রিসোর্টের পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে পরেন বীচের উদ্দেশ্যে। টুকুর টুকুর করে কথা বলে দুজনে। বীচের কাছটা নিকষকালো। আকাশে তারারা জ্বলজ্বল করছে। কি অপরূপ দৃশ্য….
সুফিয়া বেগম বালির মধ্যে বসে পরলেন, তার বাবা মা ভাইবোন আর ছোটবেলার গল্প বললেন, রোদেলা অখন্ড মনযোগে শুনলেন তার গল্পগুলো। সুফিয়া বেগমকে দেখে সাধাসিধা একজন গৃহিণী মনে হলেও তার গাঢ় ব্যাক্তিত্বের ছাপ তার চোখে মুখে এবং কথায়…
রোদেলা আসার আগেই তা টের পেয়েছে। তিনি রোদেলাকে এমন ভাবে সাথে আসতে বললেন যেন না করতে না পারে রোদেলা। ছোট্ট একটি বাক্যই যথেষ্ট তার বিশদ বিশ্লেষণে। তিনি কিন্তু একবারের জন্য ও জানতে চাননি রোদেলা সম্পর্কে। শুধু নিজেই বলে যাচ্ছেন, গল্প বলায়ও তিনি ভিষণ রকমের পটু। সাধারণ কিছু কথা তিনি এমন ভাবে বলছেন যে রোদেলার একটু বোর লাগছে না ওর মায়ের চেয়েও অনেক বড়ো ষাটোর্ধ মহিলার সাথে কথা বলতে। মাঝে মাঝে দূর থেকে তাদের হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কি সুন্দর দৃশ্য…!
আবু সুফিয়ান তার বারবিকিউ পার্টি থেকে বার দুই এসে দেখে গিয়েছে এ দৃশ্য। তার মনের গতিবিধি বোঝা না গেলেও তিনি যে এই নাটকের নির্দেশক তা বুঝতে বাকী থাকে না রোদেলার। রুম থেকে বের হওয়ার আগেই মনে মনে বলে রোদেলা একটা জাল কেটে বেরিয়েছি মাত্র। আরেকটা কাটতে হবে খুব শীঘ্রই…….
চলবে…
(পড়ে অবশ্যই কমেন্ট করবা সবাই, তোমরা কমেন্ট করলে কষ্ট স্বার্থক মনে হয়)
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1520207001773819/
next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1521576244970228/