#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি
পর্ব – ৫
ঘুম থেকে উঠে নেহাল দেখলো দিশান ইতিমধ্যে উঠে গেছে,শেষ মূহুর্তের পাতা উল্টেপাল্টে ঝালাই চলছে। নেহালকে উঠতে দেখে হাসি দিয়ে গুডমর্নিং বলে আবার বইয়ে মন দিলো। নেহাল ফ্রেশ হতেই বাসার সাহায্যকারী শাবানা চা দিয়ে বললো,
– আপু,আপনার আম্মু এসেছে। খালার রুমে আছে। বলেছে আপনার পড়া শেষ হলে খালার রুমে যাবার জন্য আর কলেজ ড্রেস একা পড়তে না পড়লে ড্রেস নিয়ে ঐঘরে যাবার জন্য।
নেহাল বুঝলো মেয়েকে রেডি করে দিতে এসেছেন তার শ্বাশুরি, সাথে করে কলেজে নিয়ে যাবেন হয়তো কিন্তু মেয়ে-জামাইয়ের রুমে আসতে অস্বস্তি হচ্ছে। তাই সে উত্তর দিলো,
– তুই বল ওনাকে এখানে চলে আসতে। দিশান একা তৈরী হতে পারবেও না। আমি গেস্ট রুমে আছি।
বলে তার বাইরে যাবার পোশাক হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দিশান-নায়রা তৈরী হয়ে নাস্তা খেতে টেবিলে বসলো। দিশানের আম্মু বললো
– নেহাল বাবাকে দেখছি না?নাস্তা করবে না?
নেহালের আম্মু বললো,
– ও হালকা কিছু খেয়ে বেরিয়ে গেছে আপা। খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছে এখানকার কি সব মিটিং কনফারেন্সের জন্য। দৌড়ের উপর আছে সারাদিন।
নায়রা বললো,
– এটা কোন কথা! একটাবার বেস্ট উইশ দিয়ে গেলো না আমাকে। মানে বউকে দিয়ে বোনকে দিতে ভুলে গেলো।
পরোটার টুকরা মুখে প্রতিবাদ করলো দিশান,
– মোটেও আমাকে কিছু বলে যান নি। আম্মুই তো আমার সাথে কতক্ষণ থেকে।
এবার নেহালের আম্মু হাসতে হাসতে বললো,
– একদম চুপ করে খেয়ে উঠো দুজন। আমি নেহালকে বকে দিবো আসলে। নায়রাকে বলে যাবার জন্য না হলেও দিশানকে না বলে যাবার জন্য অবশ্যই বকা খাবে। বিয়ের পর বেচারির প্রথম পরীক্ষা, কোথায় সে গিয়ে দিয়ে আসবে, ব্যস্ততায় সেটা না পারলেও, বলে তো যাবে!
এসব কথাবার্তায় নীচে নেমে এলে ওরা। এসে অবাক হয়ে গেলো কারণ নেহাল গাড়ির চাবি হাতে বিরক্তি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখেই বললো,
– এতক্ষণ লাগে নামতে! কতক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছি!
নেহালের আম্মু বললো,
– তুই যাবি বলে আসছিস? এই দুইটা তো আরো গাল ফোলালো তুই না বলে বেরিয়েছিস বলে। আমি ক্যাব বুক করতে চাইলাম কিন্তু আপার অফিসের গাড়ি এসে দিয়ে যাবে বলে করিনি।
দিশানের মায়ের দিকে তাকিয়ে নেহাল বললো,
– মা,আপনি মানা করে দেন অফিসের গাড়ি আসতে। আমার কাছে গাড়ি থাকতে এত ঝামেলা করে যাবে কেন?
দিশানের আম্মু বললো,
– তোমার তো জরুরি কাজ থাকে বাবা। তোমার জন্য ঝামেলা হয়ে যাবে।
– অসুবিধা নেই। পরীক্ষার রুটিন দেখে আমি সেইভাবেই মিটিং ফিক্সড করেছি। আমি যে কয়দিন আছি, আমি দিয়ে আসবো। কয়তালায় সিট পড়ছে,দিশানের সেখানে উঠার ব্যাপার আছে। দিশান,তুমি সামনে চলে আসো,পা রাখার জন্য ছোট্ট টুল সেট করে দিয়েছি সেখানে।
দিশানের আম্মু মেয়ের প্রতি নেহালের কেয়ারিং এ আবেগে আপ্লূত হয়ে গেলো। তার মেয়েটাকে এই ছেলেটাই আগলে রাখতে পারবে। এত অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেয়াতে যে খচখচানি ছিলো মনে তা কেটে গেলো আজ৷
কলেজে পৌঁছে গাড়ি সাইড করে নেহাল সবাইকে বসতে বলে নেমে কলেজের ভেতর ঢুকলো। একটুপর বেরিয়ে এসে জানালো সিট পড়ছে তিনতালায়। তারপর দিশানকে আস্তে করে বের করে আনলো। হঠাৎ জানতে চাইলো,
– দিশান – নায়রা,তোমাদের ফ্রেন্ডরা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানে?
নায়রা বললো,
– জানে তো,কাছের যারা ওরা তো বিয়েতে এসেছিলো।
– ওকে, নয়তো আমার দিশানকে উপরে তুলে দিয়ে আসার ব্যাপারটা চোখে লাগতো।অনেক গার্ডিয়ান আছে দেখে এলাম,তাই বলছি ।
এবার দিশান ক্র্যাচে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে আগালো,নেহাল সামলে রাখলো পাশ থেকে। অনুমতি নিয়ে হলে বসিয়ে দিয়ে এলো। বারবার বুঝিয়ে বলল যে নেহাল নিতে না আসা অবধি যেন না নামে,একটু সিড়িতে পা হড়কালে অনেক বিপদ হতে পারে। নেহালের এই কেয়ারিং দেখে তাদের অনেক সহপাঠী মুখ টিপে হাসছে। দিশান একটু লজ্জাই পেলো। নেহাল বুঝতে পেরে সরে এলো।
পরীক্ষা শেষে অপেক্ষা করতে হয়নি তেমন,একটুপরই পৌঁছে গিয়েছিলো নেহাল। ধীরেসুস্থে নেমে গাড়ি টান দিতেই নায়রার আবদার,
– ভাইয়া কিছু খাওয়াবি না?
– কি খাবি?সময় নাই আমার হাতে,আধা ঘন্টার মধ্যে পৌছুতে হবে মিটিংয়ে।
– আইসক্রিম নে তাহলে গাড়ি সাইড করে।
– আরে তাতেও সময় লাগবে তো।
– তুই কতদিন পর নিয়ে বের হলি বল। কতক্ষণ আর লাগবে? আম্মু খেতে দেয় না ঠান্ডা লাগবে বলে।
– তোরা এত অবুঝ। কে কোনটা খাবি ঝটপট বল।
– আমার চকবার অথবা কোণ একটা হলেই হলো। দিশান তুই? নিশ্চয় অরেঞ্জ ললি? ঐ ক্যাটক্যাটে কমলা আইসক্রিমটাতে তুই কি মজা পাস?
বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে দিশান।
– আমার ঐটাই মজা লাগে। ভাইয়া, আমার জন্য অরেঞ্জ ললি।
বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো ৷ আবারও ভাইয়া বলছে,তাও আবার নায়রার সামনে,ভাগ্যিস নায়রা পিছনে বসাতে এতটা খেয়াল করেনি। নেহাল চোখ পাকালো। দিশান সাথে সাথে কান ধরে স্যরি বোঝালো।মজা পেয়ে হেসে দিলো নেহাল। নেমে গিয়ে ওদের জন্য আইসক্রিম আর তিনজনের জন্য তিনটা কিটক্যাট নিয়ে ফিরলো।
২য় পরীক্ষাটাও ভালোই হলো ওদের৷ নেহাল মনে মনে প্ল্যান করে রাখলো এরপরের পরীক্ষাটাতে তাদের একটু সারপ্রাইজ দিবে। পরীক্ষা শেষে বাসায় না ফিরে গাড়ি একটা রেষ্টুরেন্টের সামনে দাঁড় করালো। নায়রা বললো,
– তুই কি এখানে মিটিংয়ে নেমে যাবি? তাহলে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবে কে?
– কিচ্ছু করার নেই, এখানে জরুরি একটা মিটিং আছে। তোরা চলে যেতে পারবি না?
দিশান হেসে বললো,
– আপনি এটা কখনোই হতে দিবেন না আমি জানি। আপনি এতদূর থেকে আমাদের একা ছেড়ে দিবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। আপনার মিটিং থাকলেও দরকার হয় আমাদের গাড়িতে বসিয়ে রাখবেন শেষ না হওয়া অবধি তবুও যেতে দিবেন না। অসুবিধা নাই,আপনি মিটিংয়ে যান,আমরা অপেক্ষা করবো।
নায়রা চিৎকার দিলো,
– মোটেও না। কাল রাতে এত কম ঘুমিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসে আমি মোটেও এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবো না। তুমি তোমার জামাই নিয়ে বসে থাকো,গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করো,আমি গেলাম।
নেহাল পিছনে ঘুরে নায়রার মাথায় চাটি মেরে বললো,
– দুইদিনের বউ আমাকে এত সুন্দর বুঝলো আর তুই কি রে এত বছরের বোন হয়েও এই বুঝলি! ও! নিজের বোন হলে তো বুঝতি,তোকে তো আবার কুড়িয়ে পাইছে!
– ভাইয়া,ভালো হবে না বলছি। আমি কিন্তু নামলাম গাড়ি থেকে।
– দয়া করে নাম। আমি দিশানকে নামাচ্ছি।
– দিশানকে কেন? তুই ওকে নিয়ে পরে আয়,ঐ বেচারি কিভাবে এত উঠানামা করবে? আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো।
নেহাল ততক্ষণে নেমে গেছে গাড়ি থেকে। দিশানকে আস্তে করে নামালো। তারপর রেষ্টুরেন্টের ভিতরে নিয়ে চললো। নায়রাও কিছু বুঝতে না পেরে বকবক করতে করতে তাদের পিছু নিলো। ভিতরে ঢুকতেই দিশান বললো,
– ওয়াও!!!!কি সুন্দর তো। আগে কখনো আসিনি এখানে। নতুন ওপেন হলো?
– হুম, এক মাস হলো। আমি গত পরশু এখানে লাঞ্চ করে গিয়েছি কোম্পানির সাথে।
ওরা একটা টেবিলে বসলো। রিসিপশনের ম্যানেজার নেহালকে দেখে এগিয়ে এলো। গত পরশু নেহালদের একটা বড় আয়োজন ছিলো এখানে।
– স্যার, আজও কোন মিটিং আছে নাকি আপনাদের? আমরা তো কোন বুকিং ইনফরমেশন পাইনি।
নেহাল বললো,
– না না,আজ আমি পারসোনালি এসেছি আপনাদের এখানে।
– ও আচ্ছা স্যার। ফ্যামিলি প্রোগ্রাম বুঝি?
– কোন প্রোগ্রাম না,এমনি ওদের নিয়ে খেতে এলাম।
– স্যার, আরো কেউ আসবে নাকি ওয়েটারকে বলবো অর্ডার নিয়ে নিতে?
– অর্ডার নিয়ে নিন প্লিজ। আমাকে আবার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে অফিসে।
– সিউর স্যার।
নেহাল দিশান- নায়রার দিকে তাকালো।
– কি খাবি তোরা?যা মন চায় অর্ডার দিতে পারিস। তোরা দুজন মিলে সিলেক্ট কর। কিন্তু তাড়াতাড়ি করবি।
ওরা দুজন মিলে মেনু কার্ড দেখতে লাগলো। দুয়েকটা আইটেম নিয়ে তাদের মতবিরোধ হলো। ম্যানেজার, ওয়েটার দাঁড়িয়ে আছে তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। নেহাল এবার মেনু কার্ড নিজের দিকে টেনে নিলো।
– তোদের সময় শেষ। ওনাদের তো আর কাজ নেই যে তোদের জন্য এত সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
ম্যানেজার হেসে বললো,
– অসুবিধা নেই। স্যারের দুই বোন বুঝি?
নেহাল অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। প্রশ্নটা এড়িয়ে খাবার অর্ডার করে দিলো। একটা স্যুপ,ফ্রায়েড রাইস, ক্রিসপি হানি চিকেন ,চিকেনের একটা গ্রেভি আর মাটন সিজলিং বলে দিলো। ডেজার্টে চীজকেক দিতে বললো।বারবার ওয়েটারকে বলে দিলো স্যুপ আর রাইসে যেন কোনভাবে প্রণ না দেয়। কারণ দিশানের জন্য এলার্জিক খাবার না খাওয়াটাই ভালো। প্লাস্টার এর ভিতর একটু চুলকানি হয় ও দেখেছে,এলার্জিক খাবারে সেটা বাড়তে পারে।
খাবার আসতে আসতে গল্প জুড়ালো দিশান। কিন্তু নেহালের মাথায় এসব কিছু ঢুকছে না। তার মনের ভিতরটা খচখচ করছে। কেন সে দিশানের পরিচয়টা স্বচ্ছন্দে বলতে পারলো না? এটা তো দিশানকে একরকম অপমান করা হলো। দিশান না বুঝুক, সে তো বুঝতে পারছে সে নিজেই তার ওয়াইফকে ছোট করলো পরিচয় না দিয়ে। নিজের উপর রাগে মাথার চুলগুলো খামচে ধরলো নেহাল।
চলবে……