#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৮
টানা দুইদিন বর্ষণের পরে আজ আকাশ একদম পরিষ্কার। রোদ উঠেছে। ১ ঘণ্টা হল ইলেক্ট্রিসিটি নেই। গরমটাও বেশ অসহনীয়। গরমে গা চিটচিট করছে। ঈশা অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত পাতলা একটা খাতা দিয়ে অনবরত বাতাস করেই চলেছে। জামাটা ঘেমে গায়ের সাথে লেপটে গেছে। বেশ অসস্তিতে পড়ে গেছে ঈশা। কি করবে সেটা ভাবতে গিয়েই মাথায় আসলো গোসল করে ফেললে অস্বস্তিটা হয়ত একটু কমবে। জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। ট্যাঙ্কি খালি হয়ে গেছে। যা পানি ছিল সবটা নানান কাজে ব্যবহার করে শেষ। এখন মহা যন্ত্রণা। ঈশা চেঁচাতে চেঁচাতে বাইরে গেলো। তার মা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। ঘাড় বাকিয়ে একবার ঈশার দিকে তাকাল। এলোমেলো চুল। বারবার ঘাম মুছে ফেলায় মুখ লাল হয়ে গেছে। ঈশার মা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–আমি গোসল করব। পানি নেই।
–তো আমি কি করব? অপেক্ষা করতে হবে। ইলেক্ট্রিসিটি না আসা পর্যন্ত।
ঈশা বেশ বিরক্ত হল। ধপধপ শব্দে রুমের ভিতরে চলে গেলো। কিন্তু ভিতরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সেই পাতলা খাতাটা নিয়ে বাতাস করতে করতে বারান্দায় গিয়ে বসলো। হালকা বাতাস আসছে। ঘরের থেকে এখানে একটু হলেও শান্তি আছে। মাথাটা সামনের দিকে বাড়াতেই দেখল তার একদম সামনের দোতলা ছাদ থেকে একটা ছেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই ছেলেটি অমায়িক হেসে উঠল। ঈশা বিরক্ত হয়ে সাথে সাথেই নিচে শুয়ে পড়ল। বারান্দার মেঝেতে শুয়ে থাকার ফলে তাকে আর বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে শুয়েই বিড়বিড় করে বলল
–আজকাল কার ছেলেরাও হয়। সামনে একটা মেয়ে দেখলেই হল। এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন মেয়ে জিবনেও দেখেনি। এদের জন্য নিজের বাড়িতেও ঘোরাফেরা করার আগে ১০ বার ভাবতে হয়। অসহ্য!
উপরের দিকে তাকিয়েই অনবরত হাত নাড়িয়ে বাতাস করছে। ঘামে ভেজা শরীরে মেঝের ঠাণ্ডা ভাবটা লাগতেই শরির ঝিমিয়ে আসলো। চোখের পাতা ভারি হয়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কখন যে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো ঈশা বুঝতেই পারল না। ইভান বারান্দার দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। সামনে গ্রিলে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আশে পাশে তাকাল। পাশের বারান্দায় একবার তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। ঈশা এরকম বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে কেন? তারপর মনে হল অনেক্ষন যাবত ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই হয়ত গরমে এখানে এসে বসে ছিল। একটা শ্বাস ছেড়ে ভিতরে চলে গেলো।
ঈশা ঠিক কতক্ষন ঘুমিয়েছে বুঝতে পারল না। বাইরে থেকে বেশ আওয়াজ কানে আসায় ঘুমটা হালকা হয়ে গেলো। উঠে বসে এদিক সেদিক তাকাল। এখন কেউ নেই। ছেলেটা তাকে দেখতে না পেয়ে চলে গেছে মনে হয়। ঘুমু ঘুমু চোখে এলোমেলো পা ফেলে বাইরে বের হয়ে দেখল তার মা আর বড় চাচি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছে। ঈশা হাই তুলে ঘুম জড়ান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কোথাও গিয়েছিলে তোমরা?
ইভানের মা বলল
–আমরা আচার শুকাতে দিতে গিয়েছিলাম ছাদে। তুই কি করছিলি?
ঈশা অসহায় সরে বলল
–পানি নেই বড় মা। গোসল করতে পারছি না।
ইভানের মা ভ্রু কুচকে বলল
–আমাদের বাসায় চল। ওখানে গোসল করবি।
ঈশা কিছু বলতে চেয়েও পারল না। তাকে কোন কথা বলতে না দিয়েই ইভানের মা বলল
–কাপড় নিয়ে আমার সাথে চল।
ঈশা সম্মতি দিয়ে ঘরে চলে গেলো কাপড় নিতে। কাপড় হাতে নিয়েই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। সামনের এলোমেলো চুলগুলো একটু ঠিক করে ওড়নাটা মাথায় টেনে দিলো। তখনই চোখ পড়ল ডান হাতে। বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকাল। হাতের চুরিটা কিছুদিন আগে মার্কেটে দেখে এসেছিল সে। বেশ ভাল লেগেছিল তার। কিন্তু ইভানের তাড়াহুড়োতে কেনা হয়নি সেদিন। তাই একটু মন খারাপ হয়েছিল। পরে আবার ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু সেই চুরি আবার তার হাতে আসলো কিভাবে। চুরিটা খুলে হাতে নিলো। অদ্ভুত ব্যাপার তো। সকালেও এটা ছিল না। তার মানে সে যখন বারান্দায় ঘুমাচ্ছিল কেউ এটা পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কে? আর কেনই বা তার হাতে না দিয়ে এভাবে চুপি চুপি পরিয়ে দিলো? কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল ঈশা। সব ঠিক করে কাপড় নিয়ে বের হয়ে গেলো।
————–
অনেকটা সময় নিয়ে ঈশা গোসল করে বের হয়ে দেখে ঘরে ফ্যান চলছে। বারান্দায় ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে চুল গুলো মুছে বিছানায় বসলো। তখনের ঘুমটা পুরন না হওয়ায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ বন্ধ করে মাথাটা একটু ঠেকিয়ে আরাম করে বসলো সে।
–তুই আমার ঘরে?
গম্ভির আওয়াজে চোখ খুলে ফেলল। ইভান কে সামনে দেখে মোটেই অবাক হল না। কারন সে ইভানের ঘরে বসে আছে। সে জখন এসেছে তখন ইভান বাসায় ছিল না। তাই তার ওয়াশ রুমে ঢুকেছিল। ইভান বেশ কিছুক্ষন ভ্রু কুচকে দাড়িয়ে থেকে আবার বলল
–কি করছিস এখানে?
ঈশা ক্লান্ত গলায় বলল
–বাসায় পানি ছিলনা তাই এসেছিলাম গোসল করতে।
ইভান আর কিছু বলল না। বিছানার উপরে পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল। ফোনে মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। ঈশা আবারো মাথা ঠেকিয়ে দিলো। কিন্তু চোখ বন্ধ করলো না। এবার দৃষ্টি স্থির করলো ইভানের উপরে। দুজনেই চুপচাপ। অনেকটা সময় পর ইভান ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল
–আমি কতটা সুন্দর সেটা জানি তো। তাই বলে এভাবে দেখার কিছু নেই।
কথা শেষ করে ফোনটা বুকের উপরে রেখে ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। একটু ঘুরে বসলো। ইভান এবার মনোযোগ দিয়েই ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা বুঝতে পেরেই ঈশার আরও বেশী অসস্তি হচ্ছে। ওভাবে শুয়েই বলল
–চুল ঠিক মতো মুছিস নি কেন? ঠাণ্ডা লাগবে না?
ঈশা উলটা দিকে ঘুরেই মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–লাগুক।
ইভান কঠিন সরে বলল
–কিছু বললি?
ইভান যে তার কথা শুনতে পেয়েছে সেটা গলার সর শুনেই ঈশা বুঝতে পারছে। তাই একটু ভয় পেয়ে বলল
–কিছু না।
বলেই উঠে গেলো। ঈশা দরজা পর্যন্ত যেয়েও আবার থেমে গেলো। ইভান ততক্ষনে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ঈশা দরজার সাথে হেলানি দিয়ে হাত গুজে গম্ভির সরে বলল
–ইভান ভাইয়া।
ইভান চোখ খুলে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল
–কিছু বলবি?
ঈশা মুচকি হেসে বলল
–তুমি আমার ঘরে গিয়েছিলে?
ইভান চোখ খুলে ফেলল। কঠিন দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল
–তুই কি সেটাই এক্সপেক্ট করিস?
ইভানের এমন প্রশ্নে ঈশার মেজাজ বিগড়ে গেলো। উত্তর তো দিলই না উলটা এমন একটা প্রশ্ন করে বসলো ঈশা এখন কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। ঈশাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে ইভান ধমক দিয়ে বলল
–কিছু বলতে চাইলে বল। নাহলে এখান থেকে চলে যা। মেজাজটা এমনিতেই খারাপ আছে। আরও খারাপ হয়ে গেলে কিন্তু তোর কপালে দুঃখ আছে।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–মেজাজ কেন খারাপ?
ইভান এবার এমন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশা খুব ভালভাবেই বুঝে গেলো যে মেজাজ খারাপের কারন সে। কিন্তু সে কি এমন করলো যে ইভান এরকম রেগে গেলো। এরকম রেগে জাওয়ার তো কোন কারন নেই। তার ওয়াশ রুমে গোসল করার জন্য রাগ নাকি চুল না মুছার জন্য রাগ। আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই ইভান উঠে বসে বলল
–আমার মেজাজ খারাপের কারনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় তুই জানতে চাস। তাই কারণটা নিয়ে এতো গবেষণা না করে যা জানতে চাস সেটা জিজ্ঞেস করেই চলে যা।
ঈশা একটা শুকন ঢোক গিলে বলল
–তুমি কি আমার ঘরে এসেছিলে?
জিজ্ঞেস করতেই ইভান আবারো কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। তার দৃষ্টির মানে এমন যেন একি কথা আর একবার জিজ্ঞেস করলেই কথা বলাই বন্ধ করে দিবে। ঈশা নরম সরে আবার বলল
–না মানে আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি। আমার মনে হল আমার ঘরে কেউ গিয়েছিল তাই জিজ্ঞেস করলাম। অন্য কোন কারন নেই।
ইভান শান্ত সরে বলল
–আমিও সেরকম কিছু বলতে চাইনি। তোর কেন এরকম মনে হল যে আমিই গিয়েছিলাম? বাড়িতে এতো মানুষ থাকতেও আমার এই বাড়ি থেকে তোর ঘরে যাওয়ার কারণটা তোর কাছে স্পষ্ট হলেও আমার কাছে নয়। বিষয়টা কি একটু অদ্ভুত মনে হয়না?
ঈশা কোন কথা বলল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো। কারন সে ভাল করেই জানে ইভান তার ঘরে গিয়েছিলো। আর সেই তাকে এই চুরিটা পরে দিয়েছে। সে তখন ঘুমাচ্ছিল বলেই বুঝতে পারেনি। আর এখন তার কাছে কোন প্রমান নেই। এই চুরির কথা জিজ্ঞেস করলেও ইভান এখন কোন ভাবেই সিকার করবে না। কিন্তু কেন? এরকম করার তো কোন দরকার নেই। বলে দিলেই হয়। বললে তো আর ঈশা তাকে খেয়ে ফেলবে না। মানুষটা কেমন আজব। কিন্তু কিভাবে তার মুখ থেকে বের করবে। কেন যে এরকম একটা জটিল মনের মানুষের প্রেমে পড়েছিল। দুনিয়াতে কি সরল মনের মানুষের অভাব ছিল। জতসব! ভেবেই দরজার মধ্যে একটা লাথি দিলো। নিজের পায়ে নিজেই ব্যাথা পেল। কিন্তু প্রকাশ করলো না। ব্যাথার থেকে রাগটাই তার বেশী এখন। ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশা। ইভান তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–এভাবে লাথি দিলে রাগ তো কম্বেই না বরং পা ভাংবে। তখন বরের কোলে চরে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে। আমার অবশ্য কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তুই পারবি তো?
ঈশা আরও রেগে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার বর আর আমার ব্যাপার সেটা। আমরাই বুঝে নিব।
–বুঝলেই ভালো।
একটা জ্বালাময়ী হাসি দিয়ে ইভান ওয়াশ রুমের দরজা পর্যন্ত চলে গেলো। ঈশা রেগে বিড়বিড় করে বলল
–রুমে একটা সিসি ক্যামেরা লাগাব যাতে কে আসে কে যায় সবটা রেকর্ড হয়ে থাকে। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কাউকে আর প্রশ্ন করতে হবে না।
–খুব ভালো চিন্তা। আমিও ভাবছি জানিস এরকম কিছু করলে খারাপ হয়না। সারাদিন রুমে বসে সামনে মনিটরে দেখব।
ঈশা ভ্রু কুচকে ইভানের দিকে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–সারাদিন ঘরে থাকলে আবার সিসি ক্যামেরা লাগানোর কি দরকার?
ইভান হাসল। দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল
–আমি কখন বললাম আমার ঘরে লাগাবো। আমি তো তোর ঘরের কথা বলছিলাম।
ইভানের কথা শুনে ঈশার মুখ পুরাই হা হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকাল। ইভান চোখ টিপ দিয়ে মুচকি হেসে ওয়াশ রুমের সামনে গেলো। দরজা ঠেলতেই ঈশা এপাশ থেকে গলা তুলে বলল
–এই বিশেষ উপহারের জন্য অজানা মানুষটাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে। এভাবে চুপিচুপি না দিলেও পারত। তবুও অনেক ধন্যবাদ।
ইভান সামনে তাকিয়েই মুচকি হেসে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশাও হেসে বাইরে চলে গেলো।
চলবে………