#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৯
জানালার শুভ্র রঙের পর্দাটা ভেদ করে শেষ বিকেলের রোদ গলে ভিতরে সোজা বিছানার উপরে পড়ছে। কি তেজ সেই রোদের। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল ইভান। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তাই হালকা তন্দ্রা ভাব এসেছিলো। শুয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে একটু ঘুমিয়ে নিবে। কিন্তু সে আর হল না। রোদটা উত্তাপ ছড়িয়ে ঘুমটা নষ্ট করে দিলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। একটু চা হলে ভালো হত। বিরক্তিকর একটা শ্বাস ছেড়ে উঠে বসলো। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থেকে উঠে জানালা বন্ধ করে দিলো। দরজা খুলে সামনে এগোতেই চেঁচামেচিতে সোফার দিকে তাকাল। সবাই মিলে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। কি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। ইভানের মাও ছোটদের সাথে যোগ দিয়েছে। তিনিও বেশ মজা নিয়ে হাসছেন। ইভান সোজা বেসিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে লাগল। ঈশা কি একটা কথা নিয়ে বেশ হাসছিল। সামনে বেসিনের আয়নায় চোখ পড়তেই মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে গেলো। চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে ইভানের। সামনের চুলগুলো ভিজে কপালে লেপটে আছে। ঈশা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান মাথা তুলে আয়নায় তাকাতেই ঈশার দিকে চোখ পড়ল। আয়নায় চার চোখ এক হলেও ঈশা চোখ নামিয়ে নিলনা। তাকিয়েই থাকল। ইভান মুচকি হেসে এগিয়ে এসে মায়ের আচল দিয়ে মুখ ভালো করে মুছে নিলো। ইভান কে দেখে তার মা বলল
–কি রে তুই না ঘুমিয়েছিলি?
–ঘুম ভেঙ্গে গেছে। চা খাবো।
ইভান কথা শেষ করতেই তার মা উঠে দাড়িয়ে যায়। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ইভান নিজের এলোমেলো চুল হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ঈশার পাশে বসে পড়ে। ইভান কে ঈশার পাশে বসতে দেখে সবাই থেমে যায়। চারিদিকে হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা বিরাজ করায় সে ভ্রু কুচকে সামনে তাকায়। সবার দিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে
–এভাবে দেখার কারণটা জানতে পারি?
ইরিনা দাত কেলিয়ে বলে
–ইভান ভাইয়া এটা তো তোমার ছাদে যাওয়ার সময় তাই না?
ইভান ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে
–আমি কি আমার রুটিন মেইন্টেন করার দায়িত্বটা তোকে দিয়েছি? এতো হিসেব কিভাবে রাখিস?
ঈশান দাত কেলিয়ে বলল
–ওর তো হিসাব রেখে কাজ নাই। কিন্তু আশে পাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে হিসাব রাখতে হয়না। এমনি এমনি সব হিসাবের মধ্যে চলে আসে।
ইভান ভ্রু কুচকে তাকাতেই আবার বলল
–এলাকার মেয়েরা তোমার সাথে নিজের রুটিন সেট করে নেয়। তুমি কখন ছাদে উঠ। কখন ঘুমাও। কখন খাও। সব তাদের মুখস্ত।
ইভান সোফায় গা এলিয়ে দিলো। হাতটা ঈশার পিছনে প্রশস্ত করে আরেক হাতে ফোনটা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলল
–সো হোয়াট? সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর কারো ব্যাক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তো আর আমার নেই।
ঈশান আবারো বলল
–তোমার কারনে এলাকার ছেলেরাও কষ্টের মধ্যে আছে। তারা মাঝে মাঝেই আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।
ইভান ঠোটের কোনে ক্ষিন হাসি রেখে বলল
–ছেলে হয়ে যদি তারা কোন মেয়ে পটাতে না পারে তাহলে সেটার দায় কি আমার? ছেলে নামের কলঙ্ক সব কয়টা।
সবাই হেসে ফেলল। কিন্তু ঈশা চুপচাপ। কোন কথা বলছে না। ইলু হাসি থামিয়ে বলল
–আমার এক বন্ধুর গার্ল ফ্রেন্ড নাকি আমাদের এলাকার মেয়ে। তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। আবার সেটা নাকি বয় ফ্রেন্ডের সাথে আলোচনা করে।
কথা শেষ করে সবাই আবার হাসতে শুরু করলো। কিন্তু কলিং বেলের আওয়াজে হাসি থেমে গেলো। ইফতি বলল
–আমি দেখছি।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে একটু সরে দাঁড়ালো। হাসি মুখে বলল
–আরে নম্রতা আপু। কেমন আছেন?
নম্রতা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
–ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
–ভালো আছি।
সামনে উকি ঝুকি দিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–আনটি বাসায় নেই?
–মা রান্না ঘরে।
ইফতির কথার উত্তরে ছোট করে ‘ওহ’ বলতেই পাশে চোখ পড়ল। ইভান কে দেখে এক গাল হেসে বলল
–ইভান ভাইয়া কেমন আছেন?
ইভান এতক্ষন ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিজের নামটা কানে আসতেই চোখ তুলে তাকাল। একটু হেসে বলল
–ভালো আছি আপু। তুমি কেমন আছ?
ঈশা আড় চোখে একবার তাকাল। হঠাৎ করে মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো তার। নম্রতা বেশ কিছুক্ষন ইভানের দিকে তাকিয়ে থেকে রান্না ঘরে চলে গেলো। ইভানের মায়ের সাথে কথা বলে আবার বেরিয়ে এলো। ইভানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল
–আমি এখন আসি। আবার পরে আসব।
বলেই বের হয়ে চলে গেলো। ঈশা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান কারণটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসল। এর মাঝেই ইলু বলল
–যে ভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল এখনি গিলে ফেলবে।
সবাই তার কথা শুনে হেসে ফেলল। ঈশান বলল
–বেশী সুন্দর হওয়ার অপকারিতা কি জানো ইভান ভাইয়া? বউ তোমাকে অনাহারে রেখে চোখ দিয়ে নিজে গিলবে।
সারা ঘরময় হাসির শব্দ ঝমঝম করে উঠল। ইভান শান্ত ভাবে বলল
–অসুন্দর হওয়ারও অপকারিতা আছে। বউ তোকে না দেখে সুন্দর ছেলে দেখতে দেখতে বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
কথাটা কানে আসা মাত্রই ঈশার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল। স্থির দৃষ্টি অগোছালো হয়ে গেল। পাশ ফিরে ইভানের দিকে তাকাতেই ঠোটে সেই জ্বালাময়ী হাসি দেখে রাগটাও চাড়া দিয়ে উঠল। সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। হাসি থামিয়ে ইলু বলল
–বারান্দায় আবার কোন বলদ ঘুমায়।
কথাটা কানে আসতেই ঈশা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। ইলু কথাটা বলেই আবার হাসতে শুরু করে দিলো। ইভান ঠোট টিপে হেসে চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাতেই সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ঠাট্টার সুরে বলল
–কি রে ঈশা তুই এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? কোন ভাবে তুইও আবার বারান্দায় ঘুমাস না তো?
ঈশা এবার প্রচণ্ড রেগে গেলো। উঠে রান্না ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষন পরেই চা নিয়ে বের হয়ে আসলো। সবার হাতে হাতে কাপ দিলেও ইভানের হাতে দিলো না। সামনের টেবিলে কাপটা রেখে দিলো। ইভান কাপটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইভানের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলল
–তুই কোথায় যাচ্ছিস? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো।
ইভান তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
–চা খাব না মা।
ঈশা পিছন ফিরে তাকাল। অভিমানী কণ্ঠের কথা শুনে অভিমানটা বুঝতে তার কষ্ট হল না। ইভানের মা অসহায়ের মতো বলল
–কি হল হঠাৎ করে? নিজেই তো খেতে চাইল।
ঈশা একটু ভেবে নামানো কণ্ঠে বলল
–আমি দিয়ে আসি বড় মা?
ইভানের মা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। ঈশা দরজায় নক না করেই ঘরে ঢুকে গেলো। পুরো ঘর অন্ধকার। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় হালকা আলো আসছে ঘরে। সেটা দিয়েই আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। ইভান ঘরে কোথাও নেই। ঈশা আন্দাজ করে বারান্দায় গেলো। দরজা থেকে দেখল ইভান এক কোণায় বসে আছে। ঈশা চায়ের কাপটা পাশে রেখে নিশব্দে বসে পড়ল তার পাশে। ইভান ঘুরে তাকাল না। সামনে তাকিয়েই বলল
–আমার এখন চা খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি বাইরে গিয়ে খাবো।
ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–না খেলে বড় মা কষ্ট পাবে।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
–বড় মা কষ্ট পাবে?
ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান সামনে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–আমার আম্মুকে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারি। সেটা তোর না ভাবলেও চলবে।
ঈশা আর কোন কথা বলল না। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ইভান রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–তোর কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই কেমন জানি একটা ভাললাগা ছুয়ে গেলো। তার মন খারাপের কারণটা অজানা থাকলেও ইভান যে মন খারাপটা বুঝতে পেরেছে সেটাতেই সে বেশ অবাক হচ্ছে। মুচকি হেসে নিজের অজান্তেই ইভানের ঘাড়ে মাথা রাখল। ইভান কিছু বলল না। ঈশা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো
–ইভান ভাইয়া তুমি সেদিন আমার ঘরে গিয়েছিলে তাই না?
কিছুক্ষন আগের মান অভিমানের দেয়ালটা হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো। এখন বেশ ভালো লাগছে। ইভান খুব সাভাবিক ভাবেই বলল
–কেন বারবার একি কথা জানতে চাইছিস?
ঈশা অভিমানী কণ্ঠে বলল
–কেন? বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
ইভান মুচকি হেসে সামনে তাকিয়েই বলল
–লাভ ক্ষতির হিসাবটা বড়ই কঠিন ঈশা। এই হিসাবটা সবাই সঠিক ভাবে করতে পারেনা। আমার জীবনের এই প্রাপ্তিটা সবটাই আমার লাভ। কিন্তু আমি কোন ভুল করে সেটা ক্ষতিতে পরিণত করতে চাইনা।
একটু থেমে আবার বলল
–সব বিষয়ে এতো কৌতূহল থাকা ভালো না ম্যাডাম। এরকম থাকলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবেন।
ঈশা মাথা তুলে বলল
–বিপদ কেন ডেকে আনবো? আমি তো ভুল কিছু বলিনি।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে পুরো মুখটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–আপনার কৌতূহল মেটাতে গিয়ে যদি আমি নিজেই কৌতূহলী হয়ে যাই। তখন কি হবে? আমার কৌতূহল কে মেটাবে?
ঈশা নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার দিকে দৃষ্টি স্থির রাখল কিছুক্ষন। ঈশার মনের অনুভূতিটা যে তার মতই গভির সেটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু এখনও হয়ত সেভাবে অনুভুতি প্রকাশের সময়টা আসেনি। কিন্তু তার প্রেয়সী তো অভিমানী কিশোরী। সময় সুযোগ না বুঝেই হুট করে অভিমান করে বসে। বন্ধ থাকা আবেগের দরজায় কড়া নেড়ে সেটা খুলতে চায় বারবার।কিন্তু সেটা যে এখন কোনমতেই সম্ভব না। ঈশা উঠে দাঁড়ালো। নত দৃষ্টিতে বলল
–আমি বাইরে যাচ্ছি। সবাই বসে আছে।
ইভান নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাল। মোহনীয় কণ্ঠে বলল
–সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অনুভুতি ততটাই প্রকাশ করা শ্রেয় যতটা পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখা সম্ভব। নিজেকে সংযত রাখতে চাওয়া যদি অভিমানের কারন হয় তাহলে সেটাই মেনে নিলাম।
ঠোটের কোনে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘুরে তাকাল ঈশা। ইভান সামনেই তাকিয়ে আছে। ঈশার মনের সব কথা এভাবে না বলতেই বুঝে যাওয়াটা কি খুব সহজ কোন বিষয়? মোটেই না। এর পরেও ঈশার আর কিছুই জানার নাই। যেখানে নিরব অনুভুতির আদান প্রদান হয় সেখানে কি মুখের কথা আদৌ কোন মুখ্য ভুমিকা পালন করে?
চলবে………
(গত পর্বে একটু ভুল ছিল। রিচেক না করার কারনে ভুলটা ধরতেও পারিনি। পড়ে চোখে পড়লেও এডিট করা সম্ভব হয়নি কারন পেজে পোস্ট করা হয়েছিলো। এর জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)