গল্প: ঠিকানা লেখা : মিশু মনি পর্ব:০৬

0
560

গল্প: ঠিকানা
লেখা : মিশু মনি

পর্ব:০৬
.
চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বেডে।
শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছে,মাথা টা ভারী হয়ে আছে।ডান হাত টা যেন অবশ হয়ে আছে।খুব দূর্বল বোধ করছি।
মাথা ঘুরে তাকিয়ে দেখি ইফতি চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে আছে।আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। একটু কষ্ট হলেও উঠে বসলাম।
তারপর ডাকলাম, ইফতি..
ইফতি মুখ তুলে তাকালো।ওর চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। একি হাল হয়েছে চেহারার! মুখ টা শুকিয়ে গেছে,চুল গুলো এলোমেলো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব টেনশনে ছিলো।
উঠে এসে অনেক্ষন অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিলো।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।এই প্রথম ইফতিকে কাঁদতে দেখছি!
বললাম,এই পাগল কাঁদছিস কেন? আমার তো কিছুই হয়নি।
ইফতি চোখ মুছে বলল,খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে।তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাচতাম?
– আমার কিছু হয়নি তো।এইতো আমি ভালো আছি।
– হয়নি কিন্তু হতে পারতো। আমি এতটা ভয় পেয়েছিলাম যে কাল থেকে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।পাগলের মত ঘুরছি শুধু।আমার মেজ চাচা ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে মারা গেছে।
– হুম,এখন ভয়ের কিছু নেই।শুধু মাথায় একটু ব্যাথা পেয়েছি আর হাতে। আর কিছু হয়নি আমার ইফু।
– আমি মরে যেতাম তোর কিছু হলে।
– ইস রে,মরতে হবেনা।দ্যাখ অন্য ছেলের সাথে বিয়ে হতে গিয়েও তোর সাথে হলো।তোর কাছ থেকে আমাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
ইফতি আবারো চোখ মুছলো।
আমি একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই ইফতি নিজেই এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো।
বললাম, খুব ভয় পেয়েছিলি সেটা বুঝতেই পারছি।
– কাল তুই মেঝেতে ছিটকে পড়ার পর আমি হতবাক হয়ে দেখছিলাম তোকে।তোর মুখটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছিলো,কষ্টে ছটফট করছিলি তুই।বিশ্বাস কর,আমার ও ঠিক ততটাই কষ্ট হয়েছে।আমি ও তোর মতই ছটফট করছিলাম।কিন্তু যখন তুই একেবারে অচেতন হয়ে পড়লি আমি ভেবেছিলাম তুই হয়ত আমাকে ছেড়ে…
ইফতি আর কিছু বলতে পারলো না।কেঁদে ফেললো আবারো। আমি ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম,কাদবি না তো মেয়েদের মত।
– হুম,তুই আর কখনো ইলেক্ট্রিক লাইনে হাত দিবিনা বলে দিলাম।
– কেন? শোন,মৃত্যু যেভাবে লেখা আছে সেভাবে ই হবে।যদি কোনো এক্সিডেন্ট এ মরণ লেখা থাকে তো..
ইফতি আমার মুখে হাত দিয়ে বলল,এমন কথা বললে আমি নিজেই তোকে মেরে ফেলবো একদম।
– তোর চেহারা এমন উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছে কেন? বউ মরলে বুঝি এমন হবি?
– নাহ,আমার কিছু হব্বেনা।তুই মরার চল্লিশ দিনের মধ্যেই আরেকটা বিয়ে করে ফেলবো।
– তাহলে এখুনি মেয়ে ঠিক করে রাখ।
– কেন?
– এ যাত্রায় বেচে গিয়েছি কিন্তু এর পরের বার সত্যিই মরে যাবো।
ইফতি রেগে অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে গেলাম।
ইফতি আমার মাথাটা ওর বুকে চেপে ধরলো।আমার খুব ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে ওর বুকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের জায়গা।আমার পুচকে শরীরটা ওর শরীরের সাথে মিশে এক হয়ে গেলো।
.
অনেক্ষন নিরবে কেটে যাওয়ার পর ইফতি আমায় ছেড়ে দিয়ে বলল,তুই এত মিষ্টি কেন রে?
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,কেন?
– তোকে জড়িয়ে ধরে এত ভালো লাগে কেন?
– হা হা হা।
ইফতির কথায় খুব মজা পেয়েছি। হাসি থামাতে পারছি না।
ইফতি বাসায় ফোন দিয়ে আমার জ্ঞান ফেরার কথা জানালো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই শ্বশুর বাড়ির সবাই এসে হাজির।
শ্বাশুরি মা খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ইফতি কাউকে খাইয়ে দিতে দিলো না।নিজেই আমার পাশে বসে আমাকে তুলে খাওয়াতে লাগলো।
আমি বললাম,কিরে তুই আবার তেলাপোকার স্যুপ খাওয়াবি না তো?
– হ্যা খাওয়াবো।
– তাহলে কিন্তু হসপিটালের বেডে হেগে ল্যাডাফ্যাডা করে ফেলবো।

আমার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।
ইফতি বলল,এই অবস্থায় তোর মুখে রসিকতা আসছে মিশু?
– হু,আমি তোর বউ না?
ইফতি কিছু বলল না।বাবা বললেন, ওরা থাক।আমরা বাইরে যাই।
তারপর সবাই বেড়িয়ে গেলো।
.
ইফতি একটু কাছে এসে বলল,একটু আগে যে নার্স টা এসেছিল ওকে ভাল্লাগছে।লাইন করিয়ে দে না।
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। আমি ওর বউ এটা কি ভুলে গেছে ইফতি?
ও বলল,কি দেখছিস শকুনের মত?
– আমি শকুন?
– শকুনের নানী তুই।লেডি কুত্তা কোথাকার।
আমি হাসলাম।এইতো ইফতি স্বাভাবিক হয়েই গেছে।কিন্তু তবুও কেমন যেন উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে।
আমি জানি ইফতি না খেয়ে আছে।তাই ওকে ও খেতে বললাম।
খাওয়া শেষ হলে ইফতি হাত ধুয়ে এসে পাশে বসলো।
বললাম,আমি আজই বাড়ি যাবো।
– মাথা খারাপ?
– না,পেট খারাপ।
– মানে?
– এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।বাড়ি যাবো আমি।
– স্যালাইন লাগাবে তোর শরীরে।ডক্টর যেতে দিবেনা।
– বাসায় গিয়ে স্যালাইন দিবো। প্লিজ ইফু,বাড়ি যাবো।
– মিশু,পাগলামি করিস না।
– না না,তুই এখানে থাকলে ওই মহিলা নার্সকে লাইন মারবি এটা আমি হতে দিতে পারিনা।
– হা হা হা,এ জন্য ভয় পাচ্ছিস?
– তোকে বিশ্বাস নেই ভাই।
– আমি তোর ভাই?
আমি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললাম,ভুলেই গেছি তুই আমার বর।
– বরকে কেউ তুই বলে? যাই হোক মিশু,তুই অসুস্থ।চুপচাপ শুয়ে থাক।এত কথা বলবি না।
– বলবো, একশবার বলবো।
– বলবি না,চুপ থাক।
– না না না,আমি কথা বলবো। একশবার বলবো, হাজার বার বলবো। কথা বলতে বলতে তোকে পাগল করে দিবো।
– আমি তোর মুখ বন্ধ করে দিবো মিশু।
– কিভাবে?
– দেখতে চাস?
– হু হু দেখা।
ইফতি উঠে এসে আমার মাথাটা ধরে ফেললো।তারপর ওর মুখটা আমার মুখের কাছে নিয়ে আসলো।আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম।ধুকপুকুনি টা বাড়তে শুরু করেছে।কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে।ইফতি একদম কাছে চলে এসেছে!
ঠিক এই মুহুর্তে দরজা খুলে ডাক্তার প্রবেশ করলো।ইফতি আমাকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাড়ালো।আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলাম।
মনে মনে রাগ ও হচ্ছে আবার হাসিও পাচ্ছে।এটা কিছু হলো? ইফতি যখন ই আমার কাছে আসতে চায়,তখন ই একটা না একটা বাধা।অসহ্য!
.
ডাক্তার অনেক্ষন আমাকে দেখলেন, অনেক মন্তব্য করে চলে গেলেন।
আমি ইফতির দিকে তাকালাম।তারপর শয়তান মার্কা হাসি দিয়ে চোখ মারলাম।
ইফতি এগিয়ে এসে বলল,তুই একটা শনি।
– কেন?
– কারন তোর নাম মিশু মনি।আর মনি নামের মেয়েরা শনি হয় বুঝলি?
আমি হাসলাম।ওর রাগ করার কারণ টা বুঝতে পেরেছি!
ইফতি বেড়িয়ে গেলো ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য।
.
ডাক্তার বলেছে ভয়ের কোনো কারণ নেই।তাই জেদ করেই বিকেলবেলা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলাম। আমার বাবার বাড়ি!
ইফতি ও সাথে এসেছে।শ্বশুর বাড়িতে এটা ওর প্রথম নাইওর!
ভাবতেই হাসি পাচ্ছে।আগে দুদিন পরপর ই ইফতি আমাদের বাসায় আসতো।কিন্তু তখন আমি ছিলাম ওর বন্ধু,আর আজ আমি ওর স্ত্রী।দারুণ মজার ব্যাপার!
.
ঘুমানোর আগে আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেনি করতে লাগলাম।
ইফতি এসে নিজেই বেনি করে দিতে দিতে বলল,তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ।হানিমুনে যাবো।
– এত তাড়া কেন মশাই?
– শুধু তুই আমার আমি,হারিয়ে যাবো।
– আমি না তোর ফ্রেন্ড? ছিঃ ফ্রেন্ড কে এসব বলা যায়?
– তুই আমার ফ্রেন্ড?
– হু,বউকে কেউ তুই বলে? আর আমি তো তোর ফ্রেন্ড ই তাইনা?
ইফতি ক্ষেপে গিয়ে তাকালো আমার দিকে।আমি হেসে চোখ মারলাম।
কিছু বুঝে উঠার আগেই ইফতি আমাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর বিছানায় নিয়ে এসে শুইয়ে দিলো। আমি লজ্জায় নীল হয়ে উঠলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here