এসো শব্দহীন পায়ে পর্ব ১৬ মিশু মনি

0
287

এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ১৬
মিশু মনি

মধ্যরাত।
তিতাস ও ফ্রেরীহা একসাথে বসে ছবি এডিটিং এর কাজ করছে। আজ ওয়ার্কশপের তৃতীয় দিন। খুব উত্তেজনা কাজ করছে তিতাসের মাঝে। এই কয়েক দিনে অসংখ্য ছবি ধারণ করেছে ও। যার প্রত্যেকটাই ওর জীবনের মাস্টারপিস ছবি বলে মনে হচ্ছে। হরিণের ছবিই তুলেছে প্রায় বিশটা। আর অসংখ্য পাখি, জন্তু জানোয়ার তো আছে ই। বনে ট্রেকিং করার সময় ফ্রেরীহা ওর সাথেই থাকতো। দুজনাতে বেশ ঘনিষ্ঠ ভাব জমে গেছে। ফ্রেরীহাও নিঃসন্দেহে চমৎকার ছবি তোলে কিন্তু এডিটটা ও পারে না। তিতাস ওকে দুদিন ধরে এডিটিং শেখাচ্ছে। হঠাৎ পাশের তাঁবু থেকে একটা মেয়ের আবেদনভরা কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। খুব হালকা স্বর ভেসে আসছে। তবুও নির্জন রাত হওয়ায় এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে তারা বিশেষ অন্তরঙ্গ মুহুর্ত পার করছে। আর এটা তারই আওয়াজ।
তিতাস ছোটবেলা থেকেই খুব লাজুক প্রকৃতির। এসব ব্যাপারে সাধারণত বন্ধু বান্ধবরা কত রকমের হাসি ঠাট্টা করে থাকে। ও কখনোই কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে না। সেখানে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে ওর ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। ফ্রেরীহার মুখে মুচকি হাসি। মুখ টিপে হাসছে ও। তিতাস লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

ফ্রেরীহা বললো, কারা বলো তো?

তিতাস ফ্রেরীহার দিকে একবার তাকিয়েই মাথা নামিয়ে ফেললো। লজ্জায় ওর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বললো, ‘বাদ দাও না এসব। আমি আনইজি ফিল করি এসব ব্যাপারে কথা বলতে।’
– ‘ওকে ফাইন। এই ছবিটা কেমন হয়েছে দেখো?’
– ‘চমৎকার হয়েছে। তবে গাছের শরীরের রংটা চেঞ্জ করতে হবে। একদম কুচকুচে দেখাচ্ছে। চামড়া আছে বোঝাই যাচ্ছে না।’
– ‘এটা আমি পারি না।’
– ‘আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’

মাথার উপর খোলা আকাশ। দুজনে দুটো চেয়ার নিয়ে বসেছে। আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র। রাতের নির্জনতায় একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে। সবকিছু একটু বেশিই সুনসান। ফ্রেরীহা তিতাসের এডিটিং খেয়াল করছে মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ দেখলো এলিসার তাঁবু থেকে আফ্রিকান ছেলেটা বেরিয়ে নিজের তাঁবুতে গেলো। ফ্রেরীহা মুখ কালো করে বললো, ‘এতক্ষণ ওরাই তাহলে এইসব..’

তিতাস ফ্রেরীহার দৃষ্টি বরাবর তাকালো। তারপর কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। ফ্রেরীহা বললো, ‘তোমার কোনো ফিলিংস হচ্ছে না?’
– ‘কিরকম?’
– ‘নাথিং।’
– ‘দেখো এখন গাছগুলো কত সুন্দর লাগছে।’
– ‘ওয়াও! রিয়েলি নাইস। কিন্তু তুমি একটা আনরোমান্টিক।’
– ‘আমি আবার কি করলাম?’
– ‘কিচ্ছু করো নি। আজকের কাজ শেষ। আমি ঘুমাতে গেলাম।’
– ‘ওকে গুড নাইট।’

ফ্রেরীহা ওর ল্যাপটপ আর বাকি জিনিসপত্র নিয়ে উঠে চলে গেলো। তিতাস তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। ফ্রেরীহা ওকে আনরোমান্টিক বলেছে। কথাটা বোধহয় সত্য। এত বছরে একটা প্রেমও হলো না। কারো সাথে ভাব হলেই সে কোনো না কোনো কারণে ব্রেক আপ করে দিয়ে চলে যায়। তিতাসকে বোঝারই সময় দেয় না নিজের ভুলটা কোথায়। হয়তো ফ্রেরীহার উক্তিটির কারণেই। আর এ কারণেই সেদিন ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে রূপসার দেখা পেয়েও কিছু বলা হয় নি। মনের অব্যক্ত অনুভূতি গুলো প্রকাশের আগেই আবার ঢাকায় ফিরে এসেছে। সত্যিই আমি একটা..

রাত অনেক বেড়ে গেছে। ফ্রেরীহা আবার এসে চেয়ারে বসলো। তিতাস জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুমাও নি?’
– ‘না। ঘুম আসছে না।’
– ‘কেন?’
– ‘তিতাস তুমি বোধহয় জানো না আমি মনেমনে ড্যানকে পছন্দ করতাম।’

তিতাস এতক্ষণে বুঝতে পারলো আসল কাহিনি। ড্যান অর্থাৎ আফ্রিকান ছেলেটার প্রতি ফ্রেরীহার একটা নরম ফিলিংস জন্মাচ্ছিলো। ফ্রেরীহা মাঝেমাঝেই ড্যানের ব্যাপারে বলতো। কিন্তু সত্যিই ওর প্রতি আলাদা ফিলিংস আছে এটা তিতাসের জানা ছিলো না। আজকে রাতে ফ্রেরীহা ড্যানকে আরেকটা মেয়ের তাঁবু থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। শুধু তাই নয় তাদের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ব্যাপারে তিতাস ও ফ্রেরীহা দুজনেই নিশ্চিত। কাজেই ফ্রেরীহার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। খুব হাসি এলেও কষ্ট করে হাসি চেপে রাখলো তিতাস।

ফ্রেরীহা বললো, ‘আমার না কাউকেই জাস্ট বিশ্বাস হয় না। কাউকে না।’
– ‘তুমি বাঙালি ছেলেদের প্রেমে পড়ছো না কেন?’
– ‘তাই করতে হবে। অবশ্য ছেলে তো ছেলে ই। সেটা বাঙালি হোক কাঙালি হোক। আমার কাউকেই ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না।
– তাহলে ড্যানকে মনেমনে পছন্দ করে বসে আছো কেন?
– জানিনা কেন যেন আমার কালো ছেলেদের ভালো লাগে তাই।
– বিষয়টা অন্যরকম হয়ে গেলো না? ফর্সা হলেই তাকে ভালোবাসতে হবে, কিংবা কালো হলেই.. এসব ভুলে একজন মানুষকে ভালোবাসো। সে হোক কালো কিংবা সাদা। কি যায় আসে তাতে।

ফ্রেরীহা অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। ওকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। পরিচয়ের প্রথমদিন থেকেই ওকে কখনো এতটা আনমনা দেখায়নি যতটা আজকে এখন লাগছে। তিতাস খানিকটা কৌতুহল থেকেই জানতে চাইলো, ‘তুমি ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছো?’
– ‘আরে ধুর। ওকে নিয়ে আমার তেমন কোনো ফিলিংস নেই। আমি ওর কথা ভাবছি না।’
– ‘তাহলে?’
– ‘তোমাকে একটা কথা বলবো তিতাস?’
– ‘প্লিজ।’

ফ্রেরীহা অন্যদিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমি আমার বাবাকে কখনো দেখি নি। আমার বাবা ছেড়ে চলে গেছে এমনটা নয়, সত্যিটা হচ্ছে আমি জানি ই না আমার বাবা কে?’
তিতাস ফ্রেরীহার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকালো।

ফ্রেরীহা বললো, ‘আমি যেখানে বড় হয়েছি সেখানে অধিকাংশ লোক মনে করে কারো বাবার পরিচয় জানতে চাওয়াটা হচ্ছে জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রশ্ন। কারণ ম্যাক্সিমাম ছেলে মেয়েরা জানেনা তাদের বাবা কে। মেয়েরা যার তার সাথে ঘুরছে, থাকছে, প্রেম করছে। কোনো বিধিনিষেধ নেই। কোনো দায়বদ্ধতাও নেই।’
– ‘খুব খারাপ লাগছে শুনে।’
– ‘খারাপ আমারও লাগে। হয়তো লাগতো না। কিন্তু আমার মা আমাকে খুব ছোটবেলায় খালার কাছে রেখে চলে গেছে। খালা বাঙালি তাই তার কাছে মানুষ হয়ে কিছুটা অনুভূতি আমারও জন্মেছে। যদি ওদের মত হতাম তাহলে এই অনুভূতি টুকুও থাকতো না।’
– ‘তোমার মা কখনো বলে নি?’

ফ্রেরীহা একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললো, ‘আমি কখনো জানতে চাই নি। জানতে ইচ্ছে হয় নি এমনটা নয়। আসলে একটা মানুষকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ বলো? যদি লোকটা মাকে ভালোই বাসতো তাহলে নিশ্চয় ওরা বিয়ে করতো। একসাথে থাকতো। যেহেতু বিয়ে করেনি, তারমানে তার কথা জিজ্ঞেস করলে মাকে হার্ট করা হবে।’

তিতাস আর কোনো প্রশ্ন করলো না। অতি আধুনিক দেশের ওসব নিয়ম নীতি ওর একেবারেই পছন্দ নয়। এসব নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।
ফ্রেরীহা বললো, ‘তোমার মা বাবা একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসেন তাই না? কিন্তু আমি নিজের চোখে কখনো কারো সংসার বা ভালোবাসা দেখি নি।’
– ‘তোমার নিজের একদিন হবে। তখন দেখবে জীবনটা অন্যরকম।’

ফ্রেরীহা কিছু বললো না। তিতাস নির্বাক ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বলে ওর এই নিরবতা ভেঙে দিতে ইচ্ছে করলো না।

১৬
ধানের কাজ চলছে খুব তোরজোর সহকারে। যত দ্রুত সব ধান ঘরে উঠবে, তত দ্রুত বিয়ে। বিয়ের তারিখ পাকা হওয়ার পরেরদিন সাহিলের পরিবার ঢাকায় চলে গেছে। এরপর থেকে একবারও রূপসার সাহিলের কথা মনে হয় নি, এমনকি তিতাসের কথাও না। ও শুধু মায়ের কাজে সহায়তা করে, আর বাকি সময়টা কিভাবে যেন উদাসীনতায় কেটে যায় বুঝতেই পারে না। বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলে মেয়েদের মাঝে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। রূপসারও হয়েছে তাই। কি ভাবছে, কি ঘটছে কোনকিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতের কাছে দু একটা বই পেলে পড়ে ফেলে। নয়তো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।

আজকে হঠাৎ সাহিল এলো বাড়িতে। রূপসা জানতো না। ও ঘরে শুয়ে ছিলো। হঠাৎ সাহিলের গলা শোনা গেলো। কাকে যেন সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করছে। রূপসা হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। সাহিলের আগমনের প্রত্যাশা ওর একদমই ছিলো না। আবার সাহিলকে অপছন্দ হয়েছে তাও না। মনের ভেতর ঠিক কি চলছে রূপসা নিজেও ধরতে পারছে না।

সাহিল বারান্দায় বসেছে। মা বাবা ওর সাথে কথা বলছেন। বাড়ির উঠোনে কয়েকটা কুকুর অনেক্ষণ থেকে ঘেউঘেউ করছে। কুকুরে কুকুরে ঝগড়া। কি বিশ্রী ব্যাপার!

ঘেউঘেউ শব্দে কানের পোকা চমকে যাবার পালা। চাচা লাঠি দিয়ে কুকুর তাড়াতে গেছেন। রূপসা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘চাচা ওরা ঘেউঘেউ করুক। আপনি তো বুঝতেছেন না। আমি বুঝতেছি। ওরা আনন্দ করছে, উল্লাস করছে। বাসায় নতুন জামাই আসছে তো তারা জামাই দেখতে আসছে।’

বলেই হেসে ফেললো। চাচা ওর কথায় ভ্রুক্ষেপ করলেন না। কিন্তু কথাটা বারান্দা পর্যন্ত শোনা গেছে ঠিকই। রূপসা জানালা থেকে সরে এসে আয়না নিয়ে বসলো। কুকুর দেখে হোক কিংবা সাহিলের আগমণেই হোক, ওর মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেছে। আয়নায় তাকিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে গুণগুণ সুরে গান শুরু করলো, ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে…’

যার আসার কথা সে আসে নি, এসেছেন মা। বিছানার কাছে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘তোর আক্কেল জ্ঞান নাই? কি কস এইগুলা? জামাই এইগুলা শুনতে পাইছে। কি ভাবতেছে ছেলেটা?’
– ‘কি ভাবতেছে সেটা তো আমার জানার কথা না।’
– ‘কুত্তাগুলা জামাইরে দেখতে আসছে এইকথা কস নাই তুই?’

রূপসা উত্তর দিলো না। মা বললেন, ‘ভালো হয়া যাইস কইলাম। নইলে অন্যের বাড়িতে ঝাঁটার বাড়ি খাইতে খাইতে জীবন যাবে।’
রূপসা কিছুই বললো না। তবে ওর বলতে ইচ্ছে করেছিলো, আচ্ছা মা। ওইরকম পড়াশোনা জানা শিক্ষিত মানুষটা কি ঝাঁটা দিয়ে মারবে মনে হয়? কিসের ঝাঁটা দিয়ে মারবে? ফুলের ঝাড়ু নাকি কাঠির ঝাঁটা?

মা বেরিয়ে গেলে রূপসা শোকেচ থেকে জামাকাপড় বের করলো। কিন্তু সাজগোজ করার আগে তো হাতমুখ ধুতে হবে। ও ঘর থেকে বেরিয়ে টিউবওয়েলে যাওয়ার সময় বারান্দার দিকে তাকালো। দেখলো চেয়ারে সাহিল বসে আছে। আশেপাশে কেউ নেই। গুটি গুটি পায়ে সাহিলের সামনে এসে সালাম দিলো রূপসা।

সাহিল সালামের জবাব দিয়ে বললো, ‘কেমন আছো রূপসা?’
– ‘আপনি আসার পর খুব ভালো আছি।’
– ‘তাই?’
– ‘মনে হয়। আপনি আমাকে ভালো করে দেখেন। মুখ ধুইতে যাচ্ছি। তারপর সাজুগুজু করবো। মুখ ধোয়ার আগে কেমন লাগে আর পরে কেমন লাগে ভালো করে দেখে নেন। বিয়ের পর কিন্তু অধোয়া মুখেই দেখতে হবে।’
– ‘হা হা তাই নাকি? অধোয়া মুখেই তোমাকে বেশি সুন্দর লাগছে।’

রূপসা দেখলো মা আসছে। তাই দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে টিউবওয়েলের দিকে চলে গেলো। কিন্তু মা সেখানেও এসে হাজির। কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘কি কথা বলতেছিলি ওর সাথে? হাত মুখ না ধুইয়া ,জামা না পাল্টাইয়া ওর সামনে গেছিলি ক্যান? তোর কাজকর্ম দেখে আমার শরীল খালি জ্বলতেছে রে রূপসা।’

কথাটা বলে মা সম্ভবত শরীরের জ্বলুনি প্রকাশের জন্য কিছুক্ষণ কটমট করে চেয়ে রইলেন। তারপর গোসলখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। রূপসা মুখে সাবান ডলতে ডলতে মনেমনে বললো, ‘বিয়াটা খালি হইতে দাও। আর জীবনেও আসবো না তোমার এইখানে।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here