#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৭)
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা,
নানিকে সাথে নিয়েই পড়তে বসেছে রিপ্তি। তবে তিনি ঝিমুচ্ছেন। তসবিহ পাঠ করছেন একমনে। সেদিকে মহসীনের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তার চমকানো দৃষ্টি দুইপৃষ্ঠার কাগজে। তার ধারণা ছিলো পেজভর্তি প্রশ্নেভরা থাকবে। যার উত্তর লিখতে লিখতে তার কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শুধু একটা লাইন লিখেছে রিপ্তি। প্রথম পৃষ্ঠা ফাঁকা। তারপরেরও ফাঁকা তারপরেও ফাঁকা রেখে একদম নিচে অনেকটা পড়ে যাওয়ার মতো করে লিখেছে,
*আপনি এমন কেন?!!!
মহসীন বেশ বিস্ময় আর অবাকচোখে চেয়ে আছে লেখাটাতে। এমন অর্থহীন,মানেহীন,হেতুহীন প্রশ্নের কি উত্তর দিবে? এই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটার একটা প্রশ্নে সে কুপোকাত। তবে আরেকটা ভাবনাও বাজছে। এই ছোট্ট লাইনটা লিখতে দুটো পৃষ্ঠা ব্যয় করলো কেন? সর্বশেষেই বা লিখলো কেন? রহস্যমাখা প্রশ্নের মধ্যে স্থিরদৃষ্টি রেখেই আরো গভীর রহস্যজালে আটকে যাচ্ছে সে। কিছু তো একটা উত্তর দেওয়া দরকার। কিন্তু কি উত্তর দিবে? এভাবে শূন্য খাতা ফেরত দিতে বড্ড মানে লাগছে মহসীনের। প্রেমপুরুষ হতে পারে কিন্তু সাথে শিক্ষকও তো? এভাবে ছোট্ট ছাত্রীর কাছে ফেল করে বসবে? প্রেমে ফেল করলেও মানা যায় কিন্তু শিক্ষায়? মহসীন আরো কিছুক্ষণ সাতপাঁচ ভেবে নিয়েই রিপ্তির প্রশ্নের নিচে লিখলো,,
*তুমি এমন নও তাই!*
রিপ্তির কপাল কুঁচকে গেলো। লেখাটার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে প্রশ্ন করে বসলো,,
“” আমি কেমন না?””
মহসীনেরও ভাবলেশ উত্তর,
“” আমি যেমন না।””
“” আপনি কেমন না?””
“” সেটা তো তুমি জান।””
“” আমি কিভাবে জানি?””
“” যেভাবে প্রশ্নটা লিখেছো!””
রিপ্তির কুঁচকানো কপাল স্বাভাবিক হয়ে এলো। এই মানুষটাকে তার কাছে যে কেমন লাগে সেটা সে আদৌ বোধে আসতে পারছেনা। শুধু বুঝতে পারে কেমন কেমন জানি লাগে। সামনে থাকলে লজ্জা লাগে,দুরে গেলে ব্যথা লাগে। কন্ঠ শুনলে বুকটা ধুরুধুরু করে,নিরব থাকলে বিষন্ন লাগে। তার দিকে তাকালে,মরে যেতে ইচ্ছে করে,না থাকলে বেঁচে থেকে লাভ কি এমন প্রশ্ন জাগে। এই মিশ্র অনুভূতির একটা নাম দেওয়া দরকার। কিন্তু কি সে নাম? এতো এতো ভেবেও খুজে পায়না রিপ্তি!
“” পরীক্ষার আর তিনদিন বাকি,রিপ্তি। পড়ায় মন দাও।””
রিপ্তি নামহীন মিশ্র অনুভূতি নিয়েই বই খুলে বসে। লিখতে লিখতে আড়চোখে তাকায় মহসীনের বুকের দিকে। ঐখানে কিছু তো আছে,যাকে সে পেতে চাচ্ছে। কিন্তু কি? তাকে জানতে হবে। তবেইনা বলতে পারবে,আমার ওটা চাই,এক্ষুণি। নাহলে যে আমি মরে যাবে। এই যে এখনি অভাববোধ করছি,অক্সিজেনের!
“” তোমার কি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? নাকে ঠান্ডা বসেছে নাকি?””
মহসীনের আকস্মাৎ প্রশ্নে খানিকটা ছিটকে উঠলো রিপ্তি। তার তো শরীরের কোনো অংশেই ঠান্ডা বসেনি শ্বাস কষ্ট তো কল্পনায় হচ্ছিলো উনি জানলেন কিভাবে? তবে কি আমি কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে ঘেটে দিয়েছি?
“” কি হলো?””
রিপ্তি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,,
“” না না কিছু বসেনি। তারপর কোনটা করবো?””
মহসীন বই নিজের দিকে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। মনে কালো মেঘমালা মালা গাথছে। মেয়েটা তাকে এখনো তুমি করে বলেনি। তবে কি কাল সে আঙুলপত্রটি পড়েনি? বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গিয়েছিলো?
“” পোকা!””
মহসীন বই থেকে চোখ তুললো। রিপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো,,,
“” মানে?””
রিপ্তি মহসীনের বুকের দিকে আঙুল তুলে বললো,
“” ঐতো তোমার শার্টে। দেখ,কেমন এঁকেবেঁকে হেঁটে যাচ্ছে।””
মহসীনের বিশেষভাব ঠেকেছে রিপ্তির মুখে তুমি সম্বোধনটিতে। এক ভালো লাগা শিহরণ অনুভব করতেই রিপ্তি চেয়ার ছেড়ে দাড়ালো। মুখে চিন্তার ভাজ এনে বললো,,
“” তোমাকে কামড়ে দিবে। বিষাক্ত পোকা!””
পোকা নিয়ে যে তার বিশেষ মাথাব্যথা নেই তা রিপ্তির চোখ এড়াচ্ছেনা। এখন পর্যন্ত শরীরের কোনো অঙ্গপ্রতঙ্গই নড়ে উঠেনি। ভয়ে কেঁপে উঠেনি। তবে চোখদুটো কেমন চিকচিক করছে। মন্ত্রমুগ্ধ চাহনি তার দিকে। রিপ্তি কি ধরা পড়ে যাচ্ছে? অভিনয়টা কি খুব বেশিই কাঁচা হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু পিছু হটলে যে চলবেনা। সামনের মানুষটার শরীর থেকে ভেসে আসা মৃদুমিষ্টি সুবাসটা গাঢ় করে নিতে চায় সে। যেমনটা কাল নিয়েছিলো। নিতান্তই পরিস্থিতির শিকার হয়ে!
রিপ্তি নিজের অভিনয়টাকে আরো পক্ক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে মহসীনের পেছন চলে গেলো। পিঠের মধ্যে ময়লা মুছে দেওয়ার মতো ডান হাতটা নেড়ে দিতে দিতে নাকটা নিয়ে আসলো মহসীনের কাঁধে। গভীর নিশ্বাস টেনে চোখদুটো বন্ধ কর নিতেই মহসীনের ভারীকন্ঠ,,
“” পছন্দ হয়েছে?””
রিপ্তি চট করে সোজা হয়ে গেলো। নিজেকে সামলিয়ে বললো,,
“” কি?””
“” রজনীগন্ধার সুবাস!””
“” মানে?””
মহসীন ঘাড়ের সাথে সাথে বক্ষঃস্থল বাকিয়ে রিপ্তির দিকে তাকালো। ঠোঁটে মিষ্টি হাঁসি ঝুলিয়ে বললো,,
“” রজনীগন্ধা আমার খুব প্রিয়। আমার রুমে সবসময় রজনীগন্ধা থাকে। বাসা থেকে বের হলে রজনীগন্ধা সুবাসহীন বাতাসে নিশ্বাস নিতে একদমই ইচ্ছে করেনা। এখন হয় আমাকে নিশ্বাসের অভাবে মরতে হবে নাহয় সাথে করে রজনীগন্ধা নিয়ে ঘুরতে হবে। দুটোই আমার জন্য দুর্বিষহ। তাই সমাধান হিসেবে নিজের শরীরটাকে কৃত্রিম রজনীগন্ধার সুগন্ধি মাখি।””
রিপ্তির চমকানো চেহারাটাকে ভিষণ উপভোগ করছে মহসীন। আজকে আর পড়ানো হবে বলে মনে হচ্ছেনা। সময়টাও গড়িয়ে যাচ্ছে। পাশে চোখ বুলিয়ে কাঠের খাটটার দিকে তাকালো। নানি কি ঘুমুচ্ছেন?
মহসীন যতটা সম্ভব নানির অগোচরেই রিপ্তির ডানহাতটা টেনে নিলো। কনিষ্ঠ আঙুলে ছোট্ট করে লিখলো,,
“” তুমি আমার রজনীগন্ধা হবে?””
আরো একটি নির্ঘুম রাত কাটলো রিপ্তির। মানুষ হয়ে সে কিভাবে ফুল হবে? ফুল হলে কি হবে? মহসীন স্যারের রুমের মধ্যে ফুলদানিতে পড়ে থাকবে? উনার রুমে সুবাস ছড়াবে কিন্তু কি করে? তার তো কোনো সুবাস নেই! তাহলে? এই সুবাসহীন মেয়েটাকে রজনীগন্ধা হতে বললো কেন? উফ! মানুষটা শুধু প্রশ্নই রেখে যায় কখনো উত্তর রাখেনা। এই ছোট্ট রিপ্তি এতো এতো প্রশ্নের উত্তর কি করে খুজবে?
~~~
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নবম থেকে দশম শ্রেণীতে উঠেছে রিপ্তি। সাথে মনের অনুভূতিগুলোও কয়েকধাপ এগিয়ে এসেছে। এখন অনেককিছুই বুঝতে শিখেছে। নিজের নাম না জানা মিশ্র অনুভূতিগুলোর অনেকগুলো নামও ঠিক করে ফেলেছে। এখন শুধু শুভক্ষণের অপেক্ষা। সাথে বিপরীত মানুষটার পরিষ্কার পদক্ষেপেরও প্রয়োজন!
টিফিন পিরিয়ডে সহপাঠীদের সাথে গল্পে মেতেছিলো রিপ্তি। যদিও খুব কম সখ্যতা তাদের সাথে। তবে আড্ডা দেওয়ার মতো। কথায় কথায় প্রসঙ্গ পাল্টে মহসীন স্যার উঠে এলেন। একেকজনের কাছে একেক রকম বক্তব্য শুনছে রিপ্তি। সাথে গাল ফুলাচ্ছে,নাক ফুলাচ্ছে,কপাল কুঁচকাচ্ছে। রাগে শরীর রি রি করছে। ইচ্ছে করছে সবকটার চুল ছিড়ে দিতে,নাক থেতলে দিতে,পেট ছিড়ে দিতে, চোখ গেলে দিতে। রিপ্তি রাগ নিয়ে উঠে পড়বে তখনি তারিন লাজুক কন্ঠে বললো,,
“” আমার মনে হয়,স্যার আমাকে পছন্দ করেন। মাঝে মাঝেই আড়চোখে আমার দিকে তাকান। আজ তো নিজেই আমার খাতায় ভুল শুধরিয়ে লিখে দিলেন।””
পাশ থেকে অনি উৎসাহ নিয়ে বললো,,
“” কাল তো আমার খাতায়ও লিখে দিলেন। লেখা শেষে আমার দিকে তাকিয়ে কি সুন্দর বুঝালেন। তাহলে তো স্যার আমাকেও পছন্দ করেন!””
রিপ্তি আর চুপ করে থাকতে পারলোনা। গলায় খানিকটা ঝাঝ নিয়েই বললো,,
“” মহসীন স্যার শুধু আমাকে পছন্দ করেন।আর কাউকে না!””
তারিন আর অনি কিছু বলতে যাবে তন্মধ্যেই স্বয়ং মহসীন স্যার হাজির। ওরা দুজনেই ভীতদৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। মহসীন স্যার ভরাটগলায় বললেন,,
“” ঘন্টা পড়েছে শুনতে পাওনি? ক্লাসে যাও।””
তারিন অনি দ্রুতপায়ে আড্ডা স্থান ত্যাগ করছে। রিপ্তি এক পলক তাকালো মহসীনের দিকে। অভিমানি চোখের ভাষা কি মহসীন বুঝতে পেরেছে? রিপ্তিও মাথানত করে ক্লাসের উদ্দেশ্যে পা ফেলবে,অমনি ওর ডান হাতটা চেপে ধরে মহসীন। বুক পকেটে থাকা কলমটা দিয়ে ছুলো রিপ্তির অনামিকা আঙুলটি।
*মহসীন স্যার নয়,শুধু মহসীন ডাকবে*
রিপ্তিকে রেখেই মহসীন চলে গেলো। আঙুলপত্রে তাকাতেই রিপ্তির সব অভিমান গায়েব। ঠোঁট ছুয়িয়ে বিড়বিড় করলো,, আপনি এমন কেন?
~~~
কেটে গেলো আরো কয়েকটি মাস। মহসীন আর রিপ্তির শিক্ষক আর ছাত্রীর মধ্যকার দুরত্বটা অনেকটাই কমে এসেছে। এখন নিরব সময়টাতেও দুজন দুজনের নিশ্বাসের কথপকথন চালিয়ে যায়। ক্লাস চলাকালিনেও চলে দুজনের চোখের ইশারায় প্রেমবাক্য। সময়-অসময় রিপ্তির বাড়ির আশেপাশে মহসীনকে দেখতে পাওয়া যায়। ভাবভঙ্গিটা এমন থাকে যেন হঠাৎ চলে এসেছে এদিকে। দুজন মুখোমুখি হলে দু একটা ভালোমন্দের বাক্য বিনিময় হয়। কিন্তু তাদের মনে মনে যে চলে অগণিত প্রেমবুলি তা বুঝি তাদের অজানা? সবটাই জানা তবুও কেন হচ্ছেনা প্রকাশ্য প্রেম? কেন একজন আরেকজনকে বলছেনা,আমি তোমাকে ভালোবাসি!
কয়েকদিন পরেই টেস্ট এক্সাম রিপ্তির। পড়াশোনার ভিষণ চাপ। তারমধ্যে মহসীনের অনিয়মিত পড়ানোটা রিপ্তি সয়তে পারছেনা। কি এমন ব্যস্ততা চলছে তার? একদিন আসছে তো দুদিন আসছেনা। হুট করে চলে আসলেও ঠিক মতো পড়াচ্ছেনা। কয়েক মিনিটে বই পত্তর ঘাটাঘাটি করে বলছে,,
“” আজ উঠি,রজনীগন্ধা।””
রিপ্তি শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে থাকে। একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করতে পারেনা। কেন উঠবে? আমি তো এক পৃষ্ঠাও লিখিনি। তুমি না থাকলে যে আমার পড়ায় মন বসেছে। আরেকটু থাকো! কতদিন পড়ে এলে। একটু দেখি তোমায়। চুপচুপ করে তোমার মনের সাথে কথা বলি। অনেকদিন হলো ঠিকমতো কথা হয়না!
পরীক্ষার ঠিক তিনদিন আগে সন্ধ্যেবেলায় মহসীন উপস্থিত হলো রিপ্তিদের বাসায়। প্রায় এক সপ্তাহবাদে মানুষটাকে দেখেই রিপ্তির চোখ ভিজে এলো। কন্ঠ কাঁপছে তার। কিছু কি বলবে? নাকি এভাবেই ঝাপসাদৃষ্টিতে মানুষটকে আখিবরণ করবে?
“” তোমার সাথে কিছু কথা আছে। শুনবে?””
রিপ্তি চুপ,মহসীনও চুপ। রিপ্তির চোখে আগ্রহ,মহসীনের চোখে আকুলতা! রিপ্তির মনে চঞ্চলতা,মহসীনের মনে নিরবতা! রিপ্তির কণদ্বয়ে অস্থিরতা,মহসীনের ঠোঁটদ্বয়ে আবেষ্টতা!
রিপ্তি আর ধৈর্য্য ধরতে পারলোনা। অধৈর্য্য হয়ে বললো,,
“” বলছো না কেন?””
সাথে সাথে মহসীনের ঠোঁট নড়ে উঠলো,,
“” ট্রান্সলেট করো!””
“” কি?””
“” যা বললাম।””
“” কি বললে? কখন বললে?””
“” এই তো এখন, মনে মনে।””
রিপ্তি এবার কেঁদেই দিবে। এতোদিন বাদে এসেছে মনে মনে কথা বলার জন্য? রিপ্তি কাঁদার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিতেই মহসীন ছোট্ট করে বললো,,
“” আসি।””
রিপ্তি রেগে গেলো। কঠিনস্বরে বললো,,
“” আসি মানে? কিছু তো বললেই না।””
মহসীন চলার মাঝে থেমে গেলো। বুক পকেটে হাত দিতেই হৃদয়টা গুড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আজ সে কলম আনতে ভুলে গিয়েছে। এমন ভূল তো আগে কখনো হয়নি। এই মেয়েটার সামনেই কি তার জীবনের ভুলের সূচনা ঘটলো?
মহসীনের ব্যাপারটা ধরতে পারলো রিপ্তি। দৌড়ে নিজের কলম নিয়ে এগিয়ে দিলো মহসীনের দিকে। মহসীন কাঁপা কাঁপা হাতে কলমটা নিচ্ছে। চোখের দুর্বলদৃষ্টি রিপ্তির উৎকন্ঠা চাহনিতে!
রিপ্তি তাড়া দিয়ে বললো,,
“” কি হলো লিখো।””
রিপ্তি ডানহাতের মধ্যমা আঙুলটা খুলে দিয়েছে। মহসীন আঙুলটা ছেড়ে তালুতে একটা ঠিকানা টুকে দিলো। আরেকবার রিপ্তির দিকে তাকাতে গিয়েও তাকালো না। অপরাধির মতো মুখ করে নিভুসুরে বললো,,
“” সরি,রজনীগন্ধা!””
সেই সন্ধ্যার পর মহসীন হারিয়ে গেলো। আর আসেনি রিপ্তিদের বাড়ি। রিপ্তির নাওয়া খাওয়া বন্ধ। রোজ স্কুলে যাচ্ছে মহসীনের খোজে। যেখানে প্রাইভেট পড়াতো সে বাড়িটা তালা দেওয়া। তবুও সেখানেই বারবার রিপ্তির পদচিহ্ন পড়ে। নাক দিয়ে গভীর শ্বাস টানে!
~~~
অবিরত কলিংবেলের শব্দে বেশ বিরক্ত নিয়েই দরজার দিকে এগোয় মহসীন। এমন ভরসন্ধ্যেবেলা কে এসেছে? আবার এমন বেয়াদবী আচরন করছে! বড় হোক অথবা ছোট দরজা খুলেই কয়েকটা কটু কথা শোনাবে এমন ভাবসাবেই দরজা খুলে মহসীন। সাথে সাথে সে এক পা পিছিয়ে যায়। বিস্ময়ের সীমানা এতোটাই ছিলো যে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে বিড়বিড় করে,এটা রিপ্তি হতে পারেনা। এমন বধুসাজে রিপ্তি সাজতেই পারেনা। ও তো ছোট,বাচ্চা মেয়ে,একমাসের ব্যবধানে এতো বড় হতে পারেনা। কখনোইনা। আমি ভুল দেখছি,স্বপ্ন দেখছি,কল্পনায় বিরাজ করছি!
মহসীনের বিড়বিড়ানির মধ্যেই রিপ্তির আহ্লাদিসুর,,
“” আমরা কখন বিয়ে করবো?””
মহসীনের চোখ খুলে গেলো। বিস্ফোরিত চোখে বললো,,
“” বিয়ে!””
“” হুম। সেদিন মনে মনে এটাই তো বলেছিলে তাইনা? আমি একদম রেডি। এই দেখ বেনারশী পড়েছি,গয়না পড়েছি,চুড়ি পড়েছি,পায়ে আলতাও পড়েছি! কবুল বলবো?””
রিপ্তির দেওয়া চমকটা মহসীন এখনো সামলাতে পারছেনা। তার ধারণা,এখনো সে স্বপ্ন দেখছে,ঘুমিয়ে। ঘুম ভাংলেই সব ফুরুৎ,রিপ্তি ফুরুৎ,বেনারশী ফুরুৎ,গয়না ফুরুৎ,চুড়ি ফুরুৎ এমন কি ময়লা পায়ের ঝাপসা আলতাও ফুরুৎ!
মহসীনকে পাশ কাটিয়ে রিপ্তি ভেতরে ঢুকলো। বসার রুমটা দেখতে দেখতে বললো,,
“” রজনীগন্ধা? কি তাজা ঘ্রাণ,মহসীন!””
“” তুমি আমার বাসা চিনলে কি করে?””
রিপ্তির ভাবনাহীন উত্তর,,
“” তুমিই তো ঠিকানা দিয়ে এলে।””
মহসীন আরেকদফা অবাক হলো। এটা সত্যি সে ঠিকানা দিয়েছিলো। তাই বলে নরসিংদী থেকে সোজা ঢাকা? কি করে সম্ভব হলো?
“” তুমি বর সাজবে না? তোমার পান্জাবী নেই? ইশ! আব্বুর পান্জাবীটা আনলেই তো হতো। একটুও মনে নেই।””
রিপ্তি মুখটাকে এমন করে কুঁচকালো যেন কোনো মহাভুল করে ফেলেছে। মহসীন স্নিগ্ধমাখা মুখটাতে এক পলক তাকালো। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল শুরু হওয়ার আগেই কিছু করতে হবে।
“”বলো না কখন কবুল বলবো?””
“”কেন এসেছো?””
“” কেন আবার? বিয়ে করতে!””
“” আমি বলেছি তোমাকে বিয়ে করবো?””
“” হুম। ঐদিন বলেছো,মনে মনে।””
“” তুমি বুঝি মনোবিজ্ঞানী? মনের কথা বুঝতে পারো?””
রিপ্তি কিছু বলতে যাবে তারমধ্যেই মহসীন বললো,,
“” তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে? মাত্র পনেরোতে পা দিয়েছো। আমার বয়স জানো?””
রিপ্তি মাথা দুদিকে নাড়তেই মহসীন কন্ঠ তুললো,,
“” পুরো ছাব্বিশ!””
“” তো কি হয়েছে?””
“” কি হয়েছে মানে? আমাদের বয়সের ব্যবধানটা বুঝতে পারছোনা?””
“” এতোকিছু বুঝে কি হবে? ভালোবাসলেই তো হলো।””
“” আমি বলেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি?””
রিপ্তি মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না বুঝালো।
“” তাহলে? কেন বিয়ে করবো তোমায়?””
রিপ্তির চোখের কোল পানিতে টয়টুম্বর। কম্পিত কন্ঠে বললো,,
“” ভালোবাসো না?””
“” বাসায় ফিরে যাও,রজনীগন্ধা!””
“” আগে বলো ভালোবাসো না?””
মহসীন খানিকটা সময় নিলো। দম আটকে বললো,,
“” না।””
“” তাতে কি আমি তো ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি!””
মহসীন রিপ্তির দিকে কাঠিন্যদৃষ্টি ছুড়ে বললো,,
“” না,তুমিও ভালোবাসো না।””
“” বাসি।””
“” না বাসো না। তোমার আমার প্রতি আকর্ষণ তৈরী হয়েছে। শুধুই আকর্ষণ। আমার সাথে ঘনঘন মিশেছো তাই। কয়েকদিন পর সব ভুলে যাবে। তোমার তো ‘ভালোবাসি’ শব্দটার তাৎপর্য বুঝার বোধটুকুও তৈরী হয়নি। তুমি এখনো অবুঝ,বাচ্চা একটা মেয়ে। আমি জেনেবুঝে একটা বাচ্চাকে বিয়ে করতে পারিনা।””
“” মিথ্যে কথা। আমি সব বুঝি।””
“” না বুঝো না।””
“” তুমি বললেই হবে?””
“” হ্যা।””
“” মোটেও না। আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই তো বিয়ে করতে এসেছি। কতদুর থেকে এসেছি। একা একা। আমার তো খুব ভয় করছিলো,যদি হারিয়ে যেতাম!””
“” এইটাকে ভালোবাসা না পাগলামী বলে,রিপ্তি!””
রিপ্তির চোখের ভরা পুকুর আর পানি ধরে রাখতে পারছেনা। অবাধে বন্যা তৈরী করে ফেললো। গাল দুটো ডুবিয়ে গলায় পৌছে যাচ্ছে।
“” আমি সত্যি ভালোবাসি,মহসীন!””
“” ফিরে যাও।””
রিপ্তি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। অনুরোধী কন্ঠে বললো,,
“” ফিরিয়ে দিওনা। আমি সয়তে পারবো না।””
মহসীন আলতো করে রিপ্তির হাত নিজের হাতে বন্দী করে বললো,,
“” তোমাকে যেতে হবে।””
“” পারবো না।””
মহসীন রিপ্তির চোখের পানি মুছে দিলো। সোজা করে দাড় করিয়ে বললো,,
“”যাও!””
“” পারবো না। হারিয়ে যাবো।””
“” হারিয়ে গেলে বুঝবে আমি তোমার আকর্ষণ ছিলাম! অবুঝ বয়সের পাগলামী!!””
রিপ্তিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওকে বাইরে দাড় করিয়ে দিলো মহসীন। বুক পকেটে থাকা কলমটা নিয়ে ওর মধ্যমা আঙুলে লিখলো,
*ভালো থেকো*
~~~
“” ব্রেকফাস্টে কি খাবে? নিশ্চয় অভুক্ত পেটে বেরিয়েছো?””
মহসীনের বর্তমানভরাট কন্ঠে রিপ্তির পুরোনো স্মৃতিগুলো মিলিয়ে গেলো। মহসীন দরজাতে দাড়িয়ে আর সে বিছানায় বসে। রিপ্তি সোজা হেঁটে মহসীনের কাছে এসে দাড়ালো। ওকে অবাক করে বুক পকেটে হাত দিলো রিপ্তি। চোখে চোখ রেখে কলমটা নিজের আয়ত্ব নিয়ে মহসীনের বৃদ্ধা আঙুলটাতে লিখলো,,
“”কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলে সেদিন?””
চলবে