কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৯

0
660

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৯
কলমে: ইয়াসমিন

কুয়াশাচ্ছন্ন এক শীতের সকালে জড়সড় হয়ে মাঝারি ধরনের একটা ব্যাগ বুকের সঙ্গে জড়িয়ে যখন জার্মানির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছিলাম তখন জানতাম না বাংলাদেশের কোথায় গিয়ে আমার ঠাই হবে। শুধুমাত্র ভিডিও আর বাবা মায়ের থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া আমি ।একদিকে পেটের চিনচিন করা যন্ত্রণা অন্যদিকে স্বামীর জীবনের ঝুঁকি। কি করবো কোথায় যাবো মাথায় কাজ করছিল না। একটুর জন্য ভেবেছিলাম এখুনি বুঝি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। কিন্তু চমৎকার ভাবে আমার সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলাম।আল্লাহ সহায় তাই একজন ভালো মানুষের দেখা পেয়েছিলাম সেদিন। আমার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনে চৌধুরী সাহেব দেবদূত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার দিকে। আমি সেদিন উনার সঙ্গে এসেছিলাম। আর সেই থেকে এই চৌধুরী বাড়িতে আছি। সুখে দুঃখে এরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। কখনও প্রিয়জনের অভাব বুঝতে দেয়নি। শাশুড়ি মা আর আপনার দেওয়া অর্থ দিয়ে এখানে রিসোর্ট খুঁলেছি।ওটা দিয়ে মা মেয়ের খুব ভালো করে চলে যায়।

অধরা একদমে কথাগুলো ভলে থামলো। জুবায়ের এতোক্ষন মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সারারাত আজ ঘুম হয়নি দুজনের। তাই গল্প করে কাটিয়েছে। জুবায়ের অধরার ললাটে ওষ্ঠদ্বয় রেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> খুব সরি আমি ওরকম না করলে তুমি আজ ভালো থাকতে না। ওখানে থাকলে সর্বদা আমার চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে যেতে। তাছাড়া রহস্যের সন্ধানে তুমি চুপচাপ থাকতে পারতে না। এইযে এতদিন পরে দেখা হয়েছে এটাই কম কিসের। খুব ভালোবাসি তোমাকে। নিজের থেকেও বেশি।

অধরা জুবায়ের কলার সোজা করতে করতে উত্তর দিলো,
> আপনার গার্লফ্রেন্ডের চাইতেও বেশি ভালোবাসেন? আহারে ওর জন্য আমাকে আপনি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

বেশ আবেগপূর্ণ মূহুর্তে অধরার বলা বাক্যটা রীতিমতো টনেডোর মতো কাজ করলো। জুবায়ের ওর দুবাহু শক্ত করে দরে বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
> দিলে তো মুড খারাপ করে? খোচা দিতে কথা বলবে না।তুমি জানো তোমাকে ছাড়া এতদিন কিভাবে কেটেছে আমার? সুলতান জুবায়ের ফারুকীর মতো উড়ন চন্ডী ছেলে বাচ্চা মানুষ করেছে। নিজের সঙ্গে বাচ্চার দেখাশোনা অফিস সব একা সামলেছি শুধুমাত্র তোমাকে ভুলে থাকার জন্য। শুনো তোমাকে দেখাশোনা করতো সেই গৃহকর্মীর কথা তোমার মনে আছে?
অধরা মুখে আঙ্গুল লাগিয়ে ভেবে বলল,
> খুব আছে। আমাকে টাইম টু টাইম খাবার সার্ভ করতো। কেমন আছেন তিনি?
> মারা গেছেন। ঐশ্বর্য উনার একমাত্র মেয়ে। তোমাকে বাঁচাতে সেরাতে ওই পিশাচদের হাতে ও খুন হয়েছিল। জানি ওর ঋণ শোধ করতে পারবো না তবুও একটু চেষ্টা করেছি। ঐশ্বর্যকে নিজের মেয়ের মতো লালনপালন করেছি। কখনও বুঝতে দেয়নি আমি ওর কেউ হয়না।
অধরা ভ্রু কুচকে বলল,
> আমাকে বাঁচাতে মানে কি? কি হয়েছিল সেদিন আমার অগোচরে?
জুবায়ের উঠে বসলো। অধরা ওর সামনে এলোমেলো চুলে জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। জুবায়ের ওর চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে ওর প্রশ্ন ইগনোর করে বলল,
> কপালে চুমু দিবে একটা? তাহলে বলবো।
অধরার এবার মেজাজ খারাপ হলো। গুরুত্বপূর্ণ কথার মধ্যে লোকটা কিসব বলছে। অধরার কাপালের বিরক্তির রেখা দেখে জুবায়ের হাসলো। ওর কোলের উপরে শুয়ে পড়ে বলল,
> এমন হাজারো রজনী আমি তোমার সঙ্গে কাটানোর প্রয়াস নিয়ে এসেছি আর তুমি একদিনে সব জানতে চাইছো মেয়ে? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো। আপাতত বরের সেবাযত্ন করো, যাও কফি আনো। মাথায় যন্ত্রণা করছে ঘুম ঘুম পাচ্ছে।

অধরা রাগ করে জুবায়েরের চুরে টান দিয়ে বলল,
> বয়স হয়েছে সেদিকে একটু খেয়াল করুণ? দুই দুইটা মেয়ে বিবাহ উপযুক্ত হতে চলেছে। আর আপনার কোনো চেঞ্জ নেই।সেই আগের মতো? আমার রিসোর্টের ছেলেটার খু*ন নিয়ে এখটু ভাবুন প্লিজ? ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দুজন মানুষের মৃত্যুর কারণ একা।এটা কিভাবে এক হতে পারে বলুন? শরীরে আঘাতের চিহ্ন পযর্ন্ত নেই অথচ হৃদপিন্ড ছরিয়ে ছিটিয়ে কয়লা টাইপ হয়ে আছে। ধাঁধাটা আপনাদের সুলতান পরিবারের সঙ্গে মিলে যায়। জামসেদ ফারুকীকে আমার সন্দেহ হচ্ছে।

জুবায়ের কিছু বলতে গেলো কিন্তু পারলো না।বাইরে থেকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসছে। অধরা জুবায়েরকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুঁলে দিলো। ডালিয়া হক কিছু একটা নিয়ে চমকে আছেন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল,
> জামাইয়ের মতো দেখতে একজন এসেছে। তোদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। ডাইনিং রুমে অপেক্ষা করছে।
শোনা মাত্র জুবায়ের দ্রুতগতিতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলো। অধরা ভয়ে ভয়ে ওর পিছু নিলো। দুজনেই বুঝেছে কে এসেছে। লোকটার মাথা গরম না জানি কি করে বসে ভেবে অধরা জুবায়েরকে আটকানোর চেষ্টা করছে।
****************************
ছোটবড় একটা জটলা বসেছে ডাইনিং রুমে। জামসেদ ফারুকী বারবার অধরার পা ধরে ক্ষমা চাইতে আসছে নিজের কৃতকর্মের জন্য। উনি অনুতপ্ত হচ্ছেন। জুবায়ের অধরার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে কিছুতেই জামসেদের সামনে যেতে দিচ্ছে না। এমন সময় খটখট মৃদু আওয়াজ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমেও আসলো কহিনুর। মেয়েটার পরণে পিঙ্ক রঙের গাউন। চুলগুলোর ওর হাটার গতির সঙ্গে ঢেউ খেলছে। ওষ্ঠে হাসির ঝিলিক। উপস্থিত সকলে যেনো কিছু সময় থমকে গেলো। আহির বুকে হাত দিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলল। ঐশ্বর্য হতবাক। এতদিন ভাবতো সুলতান পরিবারে ওর চাইতে সুন্দরী কেউ নেই অথচ সেটা সম্পূর্ণ ভূল। এই মেয়ের রূপের কাছে ও তুচ্ছ। সকলের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে কহিনুর এসে জামসেদের পায়ে হাত রেখে কদমবুচি করে ফেলল। জামসেদ মেয়েটাকে চিনতে পারলো না। অনুমান করে অধরার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই জুবায়ের দ্রুত গিয়ে মেয়েটাকে উঠিয়ে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> মাম্মা ওই লোকটার থেকে দূরে থাকো। কেনো এসেছো তুমি এখানে? অধরা ওকে নিয়ে উপরে যাও এখুনি।
জামসেদের ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে উঠলো।যা বোঝার বুঝে গেছে। ও আর অপেক্ষা করলো না কহিনুরকে জুবায়েরের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
> পাপা হয় তোমার। তুমি সুলতান পরিবারের একমাত্র মেয়ে। আমাদের সকলের আদরের। এই তুচ্ছ বাড়িটা কি করে তোমার মূল্য বুঝবে? কহিনুর কোনো সাধারণ পরিবারের সাধারণ মেয়ে না যে এই মুঘল আমলের পুরাতন বাড়িতে তুমি থাকবে। তোমার জন্য রাজপ্রাসাদ অপেক্ষা করছে। আমি থাকতে তুমি এখানে থাকতে পারোনা।

জামসেদ একদমে কথাগুলো বলে থামলো। কহিনুর ওর ঠোঁটের দিকে তাঁকিয়ে আছে। অধরা বুঝতে পারলো কহিনুর সবটা শুনতে না পারলেও বুঝতে পারছে তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

> আলগা পিরিত দেখাচ্ছেন আপনি? আপনাদের ভয়ে আমি ওকে বাঁচাতে এই বাড়িতে এসে উঠেছিলাম। এই বাড়িটা পুরাতন কিন্তু এই বাড়ির মানুষ গুলো আপনাদের মতো অধম না এরা উত্তম। পরকে আপন করতে জানে। আমার মেয়েকে একদম আজেবাজে কিছু বোঝাতে আসবেন না।
জামসেদ বিরক্ত হলো অধরার কথা শুনে। জুবায়ের কহিনুররের ডান হাত ধরার জন্য এগিয়ে আসতেই জামসেদ ওকে সরিয়ে দিলো। আশপাশ থেকে অনেকেই অনেক কথা বলছে। ঐশ্বর্য মহা বিরক্ত জামসেদের উপরে। লোকটা দরকার ছাড়া কখনও ওর সঙ্গে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কত ইচ্ছে ছিল সুলতান ভিলাতে একবার গিয়ে থাকার কিন্তু কখনও হয়নি। ওকে কেউ পছন্দ করে না। অথচ কহিনুরের জন্য রীতিমতো ঝগড়া করছে। এর মধ্যেই বাড়ির সামনে দুটো গাড়ি এসে থামলো। জুবায়েরের বাবা মা দাদু আর বোনেরা এসে হাজির। ওদের কাছে কে খবর দিয়েছে জুবায়ের বুঝতে পারছে না। কি করবে মাথায় আসছে না। ও বউ মেয়েকে দুহাতে আগলে নিয়ে বলল,
> আমি সুলতান ভিলাতে ফিরবো না। মেয়েদেরকে নিয়ে যেভাবে আছি সেভাবেই থাকবো। দয়াকরে আমাকে কেউ রিকুয়েস্ট করবে না।

জুবায়েরের দাদু ঠকঠক আওয়াজ করে লাঠিতে ভর দিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসলেন। অধরা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই লোকটা ঠিক একদম আগের মতো আছে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চেহারার পরিবর্তন ঘটে এর কেনো ঘটেনি ভেবেই ওর বুকের মধ্যে ধুপ করে উঠলো। অজানা ভয়ে শরীর কাঁপছে। লোকটা একদম অধরার সামনে এসে বলল,
> কেমন আছো দাদুভাই? এভাবে পালিয়ে এসে তুমি ঠিক করোনি। কহিনুর হচ্ছে সুলতান পরিবারের সন্তান। সেই পরিবারের মেয়েদের এভাবে এই পরিবেশে মানাই না তুমি নিজেও জানতে তবুও কেনো এমন করলে? যাইহোক ভূল করেছো ক্ষমা করছি আমাদের কহিনুরের দিকে তাঁকিয়ে। ফিরে চলো আমাদের সঙ্গে।

অধরা কিছু বলার আগেই জুবায়ের বলল,
> ওরা ফিরবে না দাদু। আমি ওদেরকে ভালো রাখবো। ওদের চিন্তা কাউকে করতে হবে না।

জুবায়েরের কথা শুনে আরমান ফারুকী গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
> অবাধ্য হওয়া তোমার মুদ্রা দোষে পরিণত হয়েছে। তোমার স্ত্রী সারাজীবন আমাকে ভূল বুঝে এসেছে সঙ্গে তুমিও। কিসব আবোলতাবোল কথাবার্তা বলে সে পালিয়ে আসলো। যাইহোক তোমরা না যেতে চাও সমস্যা নেই তবুও কহিনুর আমাদের সঙ্গে যাবে।
কহিনুর ইতিমধ্যে সকলকে পায়ে ধরে সালাম করে ফেলেছে। বোবা তাই ইশারা ইঙ্গিতে আর মৃদু হেসে সবাইকে স্বাগতম জানিয়েছে যেটা দেখে অধরা চমকে গেছে। মেয়েটা কখনও কারো সামনে এভাবে আসেনি তাহলে কি রক্তের সম্পর্ক তাই এমন করছে নাকি অন্য কিছু? প্রচুর ঝগড়া ঝামেলার পরে শেষমেশ জুবায়ের ওদেরকে নিয়ে সুলতান ভিলাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। না নিয়ে উপাই ছিল না। কহিনুর যেতে চাই। অধরা ধমকে বকেও মেয়ের মন গলাতে পারলো না। সকাল সকাল না খেয়েই সকলের থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বেরিয়ে আসলো। আসার আগে অধরা সবাইকে ধরে খুব কেঁদেছে। বিশেষ করে ডালিয়া হক আর চৌধুরী সাহেব ওর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষ ছিল। জুবায়ের ওকে শান্ত করেছে। গাড়ি গিয়ে থামলো সুলতান ভিলার সামনে। সাদা রঙের বিশাল বিল্ডিংটা দেখে মনে হচ্ছে কোনো স্বর্গপুরি। অধরা জানে উপর থেকে যেটা দেখা যায় ভেতরে তার কিছুই নেই। বাড়ির সামনে কালো পোশাক পরিহিত বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওদের গাড়ি থামতেই বাড়ির ভেতর থেকে কিছু মেয়েরা ছুটে আসলো। অধরার চোখ একজনকে খুঁজে চলছে কিন্তু তাঁকে পাওয়া গেলো না। মেয়েটার জন্য ওর মনে শঙ্কা কাজ করছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here