#হলুদ_খামে
#পর্ব_১৮
𝘼𝙙𝙝𝙖𝙧𝙚𝙧 𝙈𝙪𝙨𝙖𝙛𝙞𝙧 (ইফ্ফাত)
এবারও আমার কোনো কথা তামিমের কানে গেলো না। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে যা বললো তাতে আমার পিত্তি জ্বলে গেলো।
রাগ আমার চরমে উঠে গেছে, ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিতেই আমি তামিমের কাছ থেকে আলাদা হয়ে পানিতে ছিটকে পড়লাম।
দ্রুত কাছে এসে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে তামিম বললো–
— কেনো এমন করছো তানহা?
দেখো, যা হয়েছে সেটা আমি সেদিন করতে চাইনি।
আনফরচুনেটলি হয়ে গেছে।
এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি জান।
এটাই সত্যি, আর তোমাকে এটা মানতেই হবে।
তুমি জানোনা আমি… আমি…
তুমি আমাকে সত্যিই চিনতে পারছো না?
হ্যাঁ চিনেছি, আপনি একটা লম্পট বখাটে মেয়েবাজ লোক।
কে জানে আমার মতো আর কত মেয়েকে এভাবে দিনের পর দিন জ্বালিয়ে মেরেছেন।
আমি তো বুঝতেই পারছি না আমি আপনার সাথে কেনো এখনও এই জঙ্গলে পরে আছি।
আপনি আমাকে উপরে উঠিয়ে দিন, না হয় ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
আমার কথা শুনে তামিমের চোখ রক্ত বর্ণ ধারন করলো।
লম্বা লম্বা ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে, চোয়ালটাও শক্ত হয়ে গেছে।
মনে হচ্ছে আমাকে এখনই গিলে খাবে।
আমি তামিমের চোখ থেকে আমার চোখ সরিয়ে নিলাম।
আমার কোমর শক্ত করে ধরে বললো–
— কি করবি তুই? হ্যাঁ কি করবি?
যা, কোথায় যাবি যা তুই।
একটা কথা বলবি তো ধাক্কা দিয়ে তোকে পানিতে ফেলে এখান থেকে চলে যাবো।
বেশি বড় হয়ে গেছিস তাইনা?
আমার মুখে মুখে কথা বলিস!
থাপড়ে তোর দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদপ মেয়ে।
তাকা আমার দিকে, আমার চোখে চোখ রাখ তুই।
কি দেখতে পাচ্ছিস বল।
আমাকে দেখে তোর লম্পট বখাটে মেয়েবাজ মনে হয়?
কিছুই মনে পড়েনা তোর?
তুই কল্পনাও করতে পারবি না আমি তোকে কত খুঁজেছি জান।
কেনো চলে গিয়েছিস তুই।
যদি জানতাম তুই-ই আমার তানহা তোকে প্রথম যেদিন এখানে দেখেছিলাম সেদিনই কিডন্যাপ করে নিজের কাছে নিয়ে আসতাম।
আমাকে দেখ তানহা, চিনতে পারছিস না আমাকে?
তামিমের কথার আগা মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তবুও তামিমের মুখের দিকে তাকালাম আমি।
সত্যিই কোথাও একটা মিল তো আছেই;
কিন্তু কার সাথে মিলছে তা কিছুতেই আমার মনে পরছে না।
পৃথিবীতে অনেক মানুষের সাথেই অনেকের চেহারার মিল পাওয়া যায়।
তামিমেরও হবে হয়তো।
তামিমের এই চোখ, এই চোখ আমার খুব চেনা চেনা লাগছে।
যেনো কতদিনের পুরোনো এই চোখ।
থুতনির মাঝখানে চাপ দাড়ির মাঝে লুকোনো ঐ কালো তিলটা মনে হচ্ছে আমি কতবার দেখেছি।
কিন্তু সে আমাকে তুই করে কেনো বলছে!
বলবেই বা না কেনো, বখাটে লম্পট মেয়েবাজ বলাতে গাঁয়ে লেগেছে হয়তো।
আমি তামিমের প্রশ্নের জবাবে আর কিছু বলিনি।
চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি তার চোখ থেকে।
সেও আমায় আর প্রশ্ন করেনি।
আমার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে খুব যন্তে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে।
আমি চেয়েও উপেক্ষা করতে পারছি না।
ঘৃণায় আমার গা ঘিন ঘিন করছে।
এ’দুদিন যেখানে আমি ছিলাম তামিম ঠিক তার উল্টো রাস্তায় আমাকে নিয়ে এলো।
মনে হচ্ছে যেনো আগে থেকেই তামিমের সব রাস্তা চেনা।
তামিমের হাতে আর কাঁধে পা রেখে আমি পানি থেকে উপরে উঠে এলাম।
দু’জনে উপরে উঠে এসে মাটিতে চুপচাপ বসে আছি।
কিছুক্ষন পর তামিম বিনাবাক্যে হাত থেকে আমার উড়নাটা খুলে আমাকে দিয়ে দিলো, আমিও পরে নিলাম।
🍁
🍁
তারপর চলে গেলো প্রায় পনেরো থেকে বিশ দিন।
কোনো দিন গাছের ফলমুল খেয়ে তো কোনো দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের।
দু’জনেই খুব দূর্বল হয়ে পরেছি।
দিনের পর দিন সারা জঙ্গল হেঁটে হেঁটে দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে পোকা মাকড় আর মশার কামড় খেয়েও এক ঘুমে রাত পার করতাম।
তামিমের ঘুম ভাঙ্গতো কিনা জানিনা তবে ক্লান্ত শরীরে আমি এক ঘুমেই রাত পার করতে পারতাম।
আমার আর তামিমের কারো পায়েই জুতো ছিলো না।
আমি হাঁটতে না পারলেও তামিম আমাকে নিজের কোলে করে নিয়ে হাঁটতে ভুলতো না।
খালি পায়ে আমাকে কোলে নিয়ে ঝোপঝাড়ের মাঝেই দিব্যি হেঁটে যেতো।
সেদিন পর তামিম আমাকে তেমন একটা বিরক্ত করতো না।
তবে লক্ষ্য করেছি, আগের থেকেও বেশি কেয়ার করতো আমার।
তামিম এক বেলা না খেলেও আমাকে ঠিকই খাওয়াতো।
যদিও খাবার আইটেম এ ফলটাই থাকতো সবসময়। ভাবতেও পারিনি ফল খেয়ে কখনও এতগুলি দিন পার করে দেবো।
আমিষ কিংবা নিরামিষ জাতিয় কাবার পেটে না যাওয়ায় খুব দূর্বল হয়ে পরেছিলাম আমরা।
কিন্তু তামিম নিজের দূর্বলতা আমার কাছে একবারও প্রকাশ করেনি।
কেমন যেনো রেগে রেগে থাকতো।
খুব প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই বলতো না আমার সাথে।
আমিও সেধে সেধে তার সাথে কথা বলতে যেতাম না।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি নিজেকে প্রতিটা দিনই তামিমের বুকে আবিষ্কার করতাম।
কখনও তামিমের গাঁয়ের কাপড় আমার গাঁয়ে থাকতো কখনও বা নিজেই আমার চাদর হয়ে যেতো।
এক কাপড়ে দু’জন দিনের পর দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম।
না গোসল না ভালো খাবার কোনো সুবিধাই ছিলো না। যেনো ডোরেমনের টাইম মেশিনে করে আমরা অপরিচিত দু’জন আদিম যুগে চলে এসেছি।
আগুন জ্বালাবার মতো কোনো ব্যবস্থাও ছিলো না।
স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, রাতে প্রচুর শীত, কখনও বা বৃষ্টি কখনও বা খুব কড়া রোদ।
এই পরিবেশে বেঁচে ছিলাম এইতো বেশি।
🍁
অবশেষে আমরা লোকালয়ের দেখা পেলাম।
পাহাড় কেটে কেটে একচালা বিশিষ্ট সব ঘর তোলা।
ঘনবসতি না হলেও মানুষের চলাচল মোটামুটি দেখা যাচ্ছে।
লোকালয়ের দেখা পেয়েও তামিমের মুখ যে এতটা শান্ত থাকবে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।
সে যাই হোক, তাকে নিয়ে ভাবার সময় এখন আমার নেই। বসতবাড়ির কাছে আসতেই বেশ কিছু মানুষজন আমাদের ঘিরে ধরে।
তামিম তাদেরকে ঠান্ডা মাথায় সব কিছু খুলে বলার পর তারা আমাদের দু’জনকে খাবার আর পানি এনে দেয়।
গ্রাম অঞ্চলের এই বদ্ধ পরিবেশের ছোট্ট একটা ঘরের আঠালো চাদর বিছানো খাঁটে বসে বসে অনেকদিন পর ভাত মুখে নিচ্ছি।
তামিমকে আশে পাশে দেখতে না পেয়ে একটু অবাকই হলাম বটে, কিন্তু তাতেও আমার কোনো নড়চর নেই।
সে পাশে থাকলে কি আর না থাকলেই বা কি।
এতদিনেও তামিমের প্রতি আমার মনে কোনো সফ্ট কর্ণার তৈরি হয়নি।
সে যাই হোক, এতদিন ভারি খাবার না খাওয়াতে আজ হুট করে ভাত মুখে দিতেই আমার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো।
দুই থেকে তিন বার ভাত মুখে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই আমার বমি বমি ভাব আসে।
প্লেট সরিয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিতে যাবো তখনই আমার মুখ ভর্তি বমি চলে আসে।
দৌড়ে বাহিরে এসে কাঁচা পাকা ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে গল গল করে বমি করে দিলাম আমি।
আমার পেট চিড়ে সব বেড়িয়ে গেলো।
কোনোরকম মুখ হাত ধুয়ে ফিরে আসবো তখনই আমি তামিমের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
কারো সাথে কিছু একটা বিক্রি করার কথা বলছে।
হ্যাঁ ঠিক শুনেছি আমি, বিক্রি করার কথাই তো বলছে।
আমাকে বিক্রি করার কথা বলছে না তো?
এই ছেলের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা মূল্যহীন।
ছিঃ শেষে কিনা আমাকে বিক্রি করার চিন্তা করলো?
ভাগ্যিস আগেই শুনে ফেলেছি আমি তামিমের মনের কথা।
দৌড়ে রুমে চলে এলাম আমি। আমাদের ফিরে যাবার ব্যবস্থা করতেই এখানকার নামকড়া কোনো ধনি ব্যক্তির কাছ থেকে ফোন এনে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে।
সেই লোকের সাথেই বোধহয় কথা বলছে তামিম।
আমাকে খাবার দিয়ে পাশে ফোন রেখেই এক মহিলা ভেতরে চলে গিয়েছিলো।
দ্রুত ফোন নিয়ে বাবার নাম্বারে ডায়াল করলাম।
দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে বাবার কণ্ঠ ভেসে এলো।
তামিমের আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত আমি ফোন কেটে দিলাম।
হাত থেকে ফোনটা বিছানার পাশে রেখে পানির গ্লাসটা হাতে নিতেই তামিম রুমে প্রবেশ করলো। আমাকে দেখে আমার পাশে এসে বসে বললো…
চলবে…