হৃদয়ে_রেখো #মেঘলা_আহমেদ পর্বসংখ্যা -০৮

0
358

#হৃদয়ে_রেখো
#মেঘলা_আহমেদ
পর্বসংখ্যা -০৮

আদ্রিদ খুশিতে নাচানাচি করছে। তার যেন খুশি ধরছেই না। সোফায় বিরক্ত হয়ে জুবায়ের আদ্রিদের উদ্ভট পাগলামি দেখে যাচ্ছে কতক্ষন ধরে। এবার বিরক্তি আরো বেড়ে গেলো।

-” এইভাবে সকাল সকাল পাগলের মতো লাফানোর মানে কি আদ্রিদ? মনে হচ্ছে বন্ধুদের সাথে তুই প্রথমবার আড্ডা দিতে যাচ্ছিস। আমরা তো সেই লেকের পারেই যাচ্ছি। তাহলে এত লাফানোর কি আছে। জায়গাটাও পুরোনো, আর মানুষগুলোও পুরোনো।

জুবায়েরের গম্ভীর কন্ঠে নাচানাচি থেমে যায় আদ্রিদের। চোখ ছোট ছোট করে জুবায়েরের দিকে তাকায়। জুবায়ের ভ্রু নাচায়। যার অর্থ উওর দে।

-” আসলে আসলে মিলিয়াও আসছে।

আদ্রিদ খুব উচ্ছাসের সাথে কথাটা বললো। জুবায়ের সোজা হয়ে বসলো।

-” ভালো কথা তোরা তো বেষ্টু ছিলি। তাই তোর কথায় আস্তে রাজি হয়েছে। এখন আমাদের কথা কি আর সে শুনবে? যা তারাতাড়ি রেডি হয়ে নে।

আদ্রিদ জুবায়েরের কথায় কিছু বলেনা। কারন সে আজ মিলিয়া কে সারপ্রাইজ দিতে চায়। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। নাইলে অতি চালাকের গলা’য় দড়ি অবস্থা হবে।

তেযি সূর্যটার আলো আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। বিকেলে সূর্যটা তার আদুরে কিরন ছড়াচ্ছে। লেকের উপরে ছাউনী দেয়া একটা সুন্দর জায়গা আছে। বসার জন্য টেবিল চেয়ার সবই আছে। মিলিয়া সবার থেকে একটু দূরে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে আছে। অসংখ্য পদ্ম ফুলে ভরা লেকটা দেখলেই কেমন লাগে। আদ্রিদ বেচারা সকাল থেকে কয়েকবার মিলিয়ার সাথে কথা বলতে গিয়েও পারেনি। মিলিয়ার সাথে কথা বলতে গেলেই তার ভয় লাগছে। এবার বিকেল হতে চললো, কিছু একটা করতেই হবে। আদ্রিদ ধীর পায়ে গিয়ে মিলিয়ার পিছে দাড়ায়। নেভি ব্লু টপস, কালো জিন্স, গলায় কালো ওড়না ঝুলি’য়ে দাঁড়িয়ে আছে মিলিয়া। দৃষ্টি তার লেকে নিবদ্ধ। থেকে থেকে হাওয়ায় বেবি হেয়ারগুলো উড়ছে। মিলিয়া কে কোন অপ্সরীর মতো লাগছে। আদ্রিদের ঘোর ভাঙে। সে মিলিয়ার আকর্ষন পাওয়ার জন্য গলা খারাকি দেয়-

-” এহেম এহেম!

মিলিয়া শান্তভাবো পাশে তাকায়। দৃষ্টি আটকে যায়। অফ হোয়াইট জিন্সের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিদ। জেলহীন সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে দাম্ভীকতার সাথে আছড়ে পড়ছে। ব্ল্যাক শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খোলা। খোলা জায়গা থেকে লোমগুলো তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ঠোঁটের নিচে কালো কুচকুচে তিলটার দিকে মিলিয়ার দৃষ্টি আরো আটকে যায়। আদ্রিদ মিলিয়ার এরকম দৃষ্টিতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সব কিছু আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মিলিয়ার ঘোর ভাঙে।

-” কি হয়েছে সাদা বিলাই আমার সামনে যে?

মিলিয়ার এমন কথায় হকচকিয়ে যায় আদ্রিদ। পরক্ষনেই মিলিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। মিলিয়া মুগ্ধ হয় আবার সেই হাসিতে, জ্বলে যায় ভীতরটা। আদ্রিদ হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মিলিয়ার সামনে। একগুচ্ছ তাজা পদ্ম এগিয়ে দিয়ে বলে-

-” আমি কোন কবি বা লেখক নই। তাদের মতো করে বলতেও পারবোনা। আসলে আমার অনুভূতি গুলো খুব অগোছালো। অনুভূতি কখনোই গল্পের মতো গুছিয়ে বলা যায়না। আমি প্রেমে পড়েছি তোমার মায়াবী হাসির। তোমার কাজলমায়া চোখের। আমি ভালোবেসেছি তোমাকে। আমি আটকে গেছি তোমার পাগলামীতে। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। সব সময় শুধু তোমার কথা মনে পড়ে, প্রতিটা ক্ষন, প্রতিটা মুহূর্ত, তোমার ভাবনায় ডুবে থাকি আমি সারাক্ষন। তোমাকে ছাড়া আমি একটা মুহূর্ত কাটাতে পারবো না। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটাতে ভরসা ছিলো। কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও আমার ভালোবাসা ঠিকই থাকবে। জীবনে একটা স্বপ্ন থাকা প্রয়োজন আবার সেটাকে ভালোও বাসতে হয়। আমার হৃদয়ে যতোটুকু ভালোবাসা আছে, তার সবটুকু দিয়েই তোমাকে আগলে রাখতে চাই । আমি কথা দিচ্ছি, আমার ভালোবাসা হবে পবিত্র এবং নির্মল। যেখানে কোন নষ্টামীর সামান্য ছিটে ফোঁটাও থাকবে না। ভালোবেসে আমার ওপরে, বিশ্বাস রাখতে পারো। Will you marry me?

মিলিয়া হতভম্ব হয়ে যায়। আপনা আপনি হাত দুটো মুখের উপর চলে যায়। এদিকে আদ্রিদের প্রপোজের কথা শুনে সবাই খুশি হয়। সবাই চাইতো আদ্রিদ আর মিলিয়া এক হোক। মিলিয়ার অবাকের রেশ কাটতেই একরাশ রাগ এসে ভর করে শরীরে। পদ্মফুল গুলো আদ্রিদের হাত থেকে নিয়ে ছুড়ে ফেলে লেকে। আদ্রিদ অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। একবার ছুড়ে ফেলা পদ্মফুল গুলোর দিকে তাকায় তারপর রাগে অগ্নিশর্মা মিলিয়ার দিকে তাকায়।

-” আদ্রিদ তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? তোমার কি মনে হয়না তুমি বেশিই করছো? একদিনেই বিয়ের প্রপোজাল দিচ্ছো।

রাগে কটমট করে মিলিয়া কথাগুলো বলে। আদ্রিদ একটা শুকনো ঢোক গিলে বলে-

-” তোমার একদিন মনে হচ্ছে? একদিন? সিরিয়াসলি! দীর্ঘ ১৫ টা বছর ধরে তোমায় ভালোবাসি। ১৫ টা বছর তোমার কাছে একদিন। আমরা তো বাচ্চাকাল থেকেই একে অপরের পরিচিত। তাহলে একদিন কেন মনে হচ্ছে তোমার। আমার অনুভূতি গুলো একদিনের নয়। অনেকগুলো বছর ধরে সাজিয়েছি। একটু একটু করে ভালোবাসা জমিয়েছি এঞ্জেল মিলি। আর তোমার তা একদিন মনে হচ্ছে?

কন্ঠে শীতলতা ঢেলে কথাগুলো বলে আদ্রিদ। মিলিয়ার রাগ মুহুর্তেই মিলিয়ে যায়। বহুদিন পর আদ্রিদের মুখে এঞ্জেল মিলি নামটা শুনলো। মাথা টা কাজ করছে না। এভাবে দূর্বল হলে চলবেনা। সবটা ঠান্ডা মাথায় সামল দিতে হবে‌। এর মধ্যে আদ্রিদ আবার বলে-

-‘ ছোটবেলায় তুমিও আমায় পছন্দ করতে। তাহলে চাইলেই আমরা বিয়ে করতে পারি। যেদিন থেকে তোমায় দেখেছি, সবসময় তোমার কথাই ভেবেছি। গত কবছর তখন আমরা আলাদা ছিলাম বিশ্বাস করো আমার মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগতো। আমি শুধুই সবসময় তোমাকে নিয়েই ভাবি।

-” আমি তোমার কথা ভাবিনি। আর স্কুলের সময়টার কথা বাদ দাও! তখন আমরা খুবই ছোট ছিলাম। তাই তখনকার করা বোকামি করে পাগলামি গুলো নিয়ে এখন পড়ে থেকো না।

মিলিয়া নিজেকে সামলে অনেক কষ্টে কথাগুলো বলে‌। কথাগুলো বলতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। সে চায়না আদ্রিদ হার্ট হোক। আদ্রিদ মিলিয়ার দু বাহু ধরে। হালকা নাড়া দিয়ে বলে-

-” কিসের জন্য এতো ভয় পাচ্ছো? আমার মেমোরি লস ডিজিজ এ আমি তোমাকে ভূলে যাবো এই জন্যে? নাকি তোমার কাছে আর সময় নেই এই জন্যে। স্পিক মি ডেইম ইট।

আদ্রিদ খুব রাগী স্বরে মিলিয়ার বাহু ঝাঁকিয়ে বলে। মিলিয়া আদ্রিদের এই রূপে থমকে যায়। চোখ দিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ঝরছে। আদ্রিদের রাগে গা কাঁপছে। মিলিয়া এক ঝটকায় আদ্রিদের হাত ছাড়িয়ে দেয়। কান্না করতে করতে চলে যায়। পিছ থেকে আদ্রিদ চিল্লিয়ে বলে-

-” আই লাভ ইউ সো মাচ এঞ্জেল মিলি।

মিলিয়া কথাটা শুনে থামেনা আর। দৌড়াতে থাকে। এদিকে মিলিয়া কে এভাবে দৌড়াতে দেখে ওদের বন্ধুরা উঠে দাড়ায়। তারা ওদের স্পেস দিয়ে চলে এসেছিলো অন্য দিকটায়। কিন্তু মিলিয়ার কান্নায় সবাই অবাক হয়ে যায়। রিনি মিলিয়ার পিছন পিছন যায়। ততক্ষণে মিলিয়া একটা রিকশায় উঠে গেছে। সবাই দৌড়ে আদ্রিদের কাছে যায়। আদ্রিদ দুই হাতে মুখ ঢেকে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। লিমন গিয়ে আদ্রিদ কে প্রশ্ন করে –

-” কিরে ওরে না প্রপোজ করলি? তাইলে কাদতে কাদতে গেলো কেন? কিছু করছোস নাকি।

আদ্রিদ নিজেকে শান্ত করে একটু আগের সমস্ত ঘটনার পরিপূর্ণ বিবরন দেয়। সবাই থ হয়ে যায়। এতোটা সিন ক্রিয়েট হয়ে যাবে তাঁরা ভাবতেও পারেনি। এরপর সবাই মিলে আদ্রিদ কে স্বান্তনা দেয়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে যে যার বাড়ির পথে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। আজ বহুবছর পর অনেকক্ষন আড্ডা দিয়েছে সবাই মিলে। মিলিয়ার কথাগুলো যেন সবার মন খারাপের কারন। কেন আদ্রিদকে একসেপ্ট করলো না?

মিলিয়া রিকশা থেকে নেমেই একপ্রকার দৌড়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য দৌড় দিতে নিলেই রিকশাওয়ালা বলে-

-” আপা ভাড়াটা দিবেন না?

মিলিয়া রং হুশ ফিরল। রিকশাওয়ালার হাতে একশত টাকা গুঁজে দিয়ে আবার দৌড় দেয়। মেইনরোড থেকে সরু বাধাই করা রাস্তা বাড়ি পর্যন্ত। রিকশাওয়ালা আবারো উচ্চস্বরে বলে-

-” আপা ভাড়া তো বিশটাকা। আর আশিটাকা নিবেন না?

মিলিয়া চিল্লিয়ে বলে-

-” রেখে দেন আপনি।

মিলিয়া বাসার সামনে দাড়িয়েই পাগলের মতো কলিংবেল চাপতে থাকে। কাজের মেয়ে এসে দরজা খোলে। মিলিয়ার মা একটু অসুস্থ হওয়ায় কাজের লোক রাখা। মিলিয়া হন্তদন্ত হয়ে ধপ করে সোফায় গিয়ে বসে। কাজের মেয়েটা তা মিলিয়ার মা কে জানায় গিয়ে-

-” খালাম্মা মিলিয়া আফায় কানতাছে।

মেয়ের কান্নার কথা শুনে তৎক্ষণাৎ শোয়া থেকে উঠেন মিলিয়ার মা। তারাতাড়ি মেয়ের কাছে যায় সে। মিলিয়া মা কে দেখে খুব জোরেই বলে-

-” তুমি আদ্রিদকে কেন বলেছো আমার ক্যান্সারের কথা। আমি কাউকে বলতে বলেছি?

মিলিয়ার মা মেয়ের দিকে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। গিয়ে মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলায়। মিলিয়া মা কে পেয়েই জড়িয়ে ধরে। গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকে কান্নারত মুখটা লুকায়। মাও পরম যত্নে তার বাচ্চাকে আগলে নেয়। মনে মনে দুঃচিন্তা মেয়েটার মুখে হাসি কবে ফুটবে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here