হদয়ে_রেখো
#মেঘলা_আহমেদ
পর্বসংখ্যা -১১(শেষ)
জীবন তার নিজের মতো বয়ে চলছে। মিলিয়া আর আদ্রিদ সময়গুলো কে নিজেদের মতো উপভোগ করছে। হাঁসি-কান্না, সুখ-দুঃখের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে একটা মাস। রাতে মিলিয়া ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভেঙে গেলে পাশে হাতড়ে আদ্রিদকে খোঁজে সে। কিন্তু বিছানা ফাঁকা। আদ্রিদ নেই! মিলিয়া চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। সেই রুমার আলো জ্বলছে, যেখানে আদ্রিদের নোটস্, ডায়েরিসহ বিভিন্ন পোস্টার লাগানো। মিলিয়া বিছানা ছেড়ে পা টিপে টিপে সেই রুমের দরজায় উঁকি দেয়। আদ্রিদ বসে বসে কি জানি পড়ছে। মিলিয়া আস্তে করে রুমে ঢোকে। খুব সাবধানে আদ্রিদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিলিয়া দেখলো ডায়েরিতে বাসার এড্রেস, তার নিজের বার্থডে, ফোন নম্বর সহ আরো অনেক কিছুই। মিলিয়া আদ্রিদের কাঁধে হাত রাখে। আদ্রিদ হকচকিয়ে ঘুরে তাকায়। মেকি একটা হাসি দিয়ে বলে-
-” তুমি এত রাতে কি করছো এখানে? কষ্ট হচ্ছে? হসপিটালে নিব?
মিলিয়া পেছন থেকে এসে আদ্রিদের পাশ ঘেঁষে সোফায় বসে। এরপর জিজ্ঞেস করে-
-” তুমি কি করছো? এতো রাতে এই রুমে।
-” আরে কিছুনা। চলো ঘুমাবো।
মিলিয়া প্রশ্ন করেনা আর। সে বুঝতে পেরেছে আদ্রিদ এগুলো মুখস্থ করছিলো। আদ্রিদের চোখ পড়ে মিলিয়ার গলায়। একটা লকেটসহ চেইন তার গলায়। আদ্রিদ মিলিয়া কে জিজ্ঞেস করে-
-” মিলি এটা কিসের চেইন?
-” ওমা তোমার মনে নেই? এটা তুমিই তো আমায় গিফট করেছিলে।
আদ্রিদ নিজের মস্তিস্কে কিছুটা প্রেসার দেয়। কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়ে, এটা দিয়ে সে মিলিয়ার রাগ ভাঙিয়েছিলো।
-” ওহ হ্যা এটা দিয়ে তো আমার রাগীনির রাগ ভাঙিয়ে ছিলাম।
মিলিয়া চোখ মুখ কুঁচকে বলে-
-” উফফ কর কতো অদ্ভুত নাম দিবা আমার?
-” ভালোবেসে তোমায় হাজারো নামে ডাকবো। তুমি কি রাগ করবে?
মিলিয়া কর কথা বলেনা। এই রকম মানুষের সাথে কি রাগ করে থাকা যায়?
।
সকালবেলা আদ্রিদ আর মিলিয়া মিলে নিজেদের ছোট ফুলের বাগানের যত্ন নিচ্ছিলো। আদ্রিদ আবারো মিলিয়া কে চেইন টা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে। মিলিয়া বুঝতে পারছে আদ্রিদের কান্ডিশন দিনদিনই খারাপ হচ্ছে। সে আজকাল সেগুলোই মনে রাখতে পারছে যা প্রতিদিন রাতে মুখস্থ করে। মিলিয়া দীর্ঘশ্বাস নিজের মধ্যে চাপা দিয়েই রাতের মতো করে চেইনটার কথা বলে। আদ্রিদের আবারো মনে পড়ে সব। আকাশটা মুহূর্তেই কালো মেঘে ঢেকে যায়। বৃষ্টি শুরু হয়। আদ্রিদ আর মিলিয়া দৌড়ে বাড়িতে ঢোকে। আরেকটু হলেই ভিজে যেতো। দুজনেই বেলকনিতে বসে পড়ে বৃষ্টি দেখতে। মিলিয়া বলে-
-” আগে আমার বৃষ্টি কখনোই ভালো লাগতো না। কিন্তু এখন ভালো লাগতে শুরু করেছে। বৃষ্টি হচ্ছে আমাদের হৃদয়ের গভীরতার মতো। আর আমাদের হৃদয়টা হচ্ছে একটা ইউনিভার্সের মতো। এ হৃদয়ে আমরা কতকিছুই একসাথে সামলে রাখি।
আদ্রিদ মিলিয়ার কথা শুনে বলে-
-” আচ্ছা আমাদের ইমোশন আর মেমোরি গুলোকে আমরা কি আলাদা করতে পারবো। কারন মেমোরি গুলো তো আমি আস্তে আস্তে ভুলে যাব। তাই আমার ইমোশন গুলো যদি থেকে যায় তাহলে সেটাই হবে আমার বড় পাওয়া।
মিলিয়া আদ্রিদকে বুঝিয়ে বলে-
-” ইমোশন গুলো অবশ্যই থেকে যাবে, কারন ইমোশন থাকে হৃদয়ে মস্তিষ্কে নয়।
মিলিয়া আদ্রিদের কাঁধে মাথা রাখে। আদ্রিদ উঠে রুমে যায়। মিলিয়া চুপি চুপি আদ্রিদের ডায়েরি পড়ছে। প্রথমেই দেখতে পায় আদ্রিদের পছন্দের খাবার আইসক্রিম। মিলিয়ার আইসক্রিম খাওয়ার প্রচুর ইচ্ছে হয়। স্কুলের দিনগুলো তে তারা একসাথে কতো আইসক্রিম খেয়েছে। হঠাৎই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। মিলিয়া বিরক্ত মুখে গিয়ে দরজা খোলে। কিন্তু দরজা খুলতেই বিরক্তি উবে যায়। রিনি আর জুবায়ের কে দেখে মুখে হাঁসি ফুটে ওঠে। দুজনেই একসাথে মিলিয়া কে জড়িয়ে ধরে। আদ্রিদ এসে দেখে রিনি আর জুবায়ের মিলিয়ার সাথে চিপকে আসে। কিছুটা জোড়েই বলে-
-” হায় আল্লাহ গ*ন্ডার দুইটা আমার বউরে শেষ করলো। ছাড় আমার বউরে।
দুজনেই মিলিয়ার থেকে সরে দাঁড়ায়। এরপর টুকটাক কথা বলে চলে যায় ফ্রেশ হতে। এরপর মিলিয়া আদ্রিদের কাছে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরে। আদ্রিদ মিলিয়া কে রেখে চলে যায় আইসক্রিম আনতে। কিন্তু আসার সময় আদ্রিদ বাড়ির রাস্তা ভুলে যায়। নিজের ডায়েরিটাও আনতে সে ভুলে গেছে। সে কি করবে বুঝতে পারছেনা। অপরদিকে রিনি আর জুবায়ের ফ্রেশ হয়ে মিলিয়ার রুমে যায়। গিয়েই যা দেখে তাতে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। মিলিয়া যন্ত্রনায় ছটফট করছে। জুবায়ের তারাতাড়ি এম্বুলেন্স এ কল করে। দ্রুত মিলিয়া কে হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা। এদিকে মিলিয়ার মা ছুটে আসে মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে। এদিকে আদ্রিদ হতাশ হয়ে একটা বেঞ্চে বসে আছে। সে কিছুতেই বাসার এড্রেস মনে করতে পারছেনা। ফোনটাও ভুলে বাসায় রেখে এসেছে। আদ্রিদকে ফোনে না পেয়ে জুবায়ের আদ্রিদের বাসায় যায়। আদ্রিদ একজন পরিচিত লোকের কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করে বাড়িতে এসেছে সবেমাত্র। কিন্তু বাসায় কাউকে দেখতে পায়না সে। জুবায়ের হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢোকে। আদ্রিদ জিজ্ঞেস করে-
-“কিরে তোরা কই গেলি সব। মিলি কই?
জুবায়ের আদ্রিদকে তাড়া দিয়ে বলে-
-” আমার সাথে চল।
-” কেন কোথায় যাবো কি হয়েছে?
-” মিলিয়া হসপিটালে। ওর কান্ডিশন ভালো না প্লিজ তারাতাড়ি কর।
জুবায়ের আদ্রিদের হাত ধরে বেরিয়ে আসে। আদ্রিদের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। সে কেন গেলো মিলিয়া কে একা রেখে। আদ্রিদের বাগানে আসতেই ভিডিও কল দেয়। জুবায়ের তারাতাড়ি কল রিসিভ করে। মিলিয়া কল দিয়েছে রিনির ফোন থেকে।
-” জুবায়ের আদ্র কে ফোনটা দে ভাই।
মিলিয়া অনেক কষ্টে টেনে টেনে কথাটা বলে। আদ্রিদ জুবায়েরের কাছ থেকে ফোনটা একপ্রকার ছিনিয়ে নেয়।
-” মিলি মিলি তোমার কি কষ্ট হচ্ছে। আমায় বলো। আমার তোমাকে রেখে যাওয়া উচিত হয়নি।শীট।
-” আদ্র এতো ব্যস্ত হয়োনা। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমাকে কিছু কথা বলি। তুমি একটুও কাঁদবে না। নিজের মেডিসিন ঠিকমতো নেবে। আর আমি তোমার ফিলিংস আমাকে মনে রাখার জন্য তোমার কোন ডায়েরি প্রতিদিন পড়তে হবেনা। মানুষের স্মৃতি থাকে মস্তিষ্কে কিন্তু ফিলিংস থাকে হৃদয়ে। আমাকে তোমার #হৃদয়ে_রেখো।
মিলিয়া আর কিছু বলতে পারেনা। প্রানপাখিটা তার আগেই খাঁচা ছেড়ে উড়ে যায়। শেষবারের মতো আদ্রিদের মুখ দেখেই সে চোখ বোজে। নিজের চোখের সামনে প্রিয়জনের এমন মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারবেনা। আদ্রিদ একটা চিৎকার দেয়। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে মিলিয়ার মা আর রিনিতা আহজারি। এপাশে আদ্রিদ আর জুবায়ের। পৃথিবীটা বড়ই আজব। সুখের দিনগুলো কত তারাতাড়ি কেটে যায়। তাদের কি এই একমাসই একসাথে থাকার কথা ছিলো?
।
মিলিয়ার মৃত্যুর পর কেটে গেছে বেশ কিছু দিন। আদ্রিদ মিলিয়ার কাটানো মুহূর্তগুলোর ছবি দেখছে ফোনে। হঠাৎই তার মনে পড়ে মিলিয়া একদিন আলমিরা তে কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছিলো। আদ্রিদ তারাতাড়ি গিয়ে আলমিরা টা খোলে। একটা মোবাইল ফোন পায়। ফোনে মিলিয়ার রেকর্ড করা একটা ভিডিও। মিলিয়া ভিডিওতে বলছে-
-“আদ্র তুমি যদি ভিডিওটা খুঁজে পাও তাহলে এই কথাগুলো সবসময় মনে রাখবে। যে লাইফে কখনোই তোমার মেমোরিস গুলো হারিয়ে ফেলার ভয়ে থাকবেনা। আমাদের সবার মধ্যেই তার নিজস্ব একটা জগত রয়েছে, সেটা হচ্ছে আমাদের হৃদয়। আর লাইফে আমরা যাই করিনা কেনো সবকিছুই আমাদের হৃদয়ে রয়ে যায়। তোমার মস্তিষ্ক থেকে সবকিছুই মুছে গেলেও, সেগুলো তোমার হৃদয়ে থেকে যাবে। সেইসাথে আমিও তোমার হৃদয়ে থেকে যাব। তোমার মতই আমিও আমার শেষ মূহুর্তে এসে তোমার কথাই ভাববো। জানো তোমার সাথে কাটানো দিন আমার কাছে মনে হয়েছে কয়েক বছরের খুশির চেয়েও অনেক কিছু। এই সবকিছুর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এত সুন্দর সুন্দর সেরা কিছু মুহূর্ত উপহার দেয়ার জন্য। তোমাকে আরো অনেক ধন্যবাদ আমাকে কষ্ট করে এতগুলো বছর মনে রাখার জন্য। আমি তোমাকে কখনোই বলিনি, কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে বলতে চেয়েছিলাম –
-” I love you. I love you adrid.
।
কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এক বৃদ্ধ লোক বেঞ্চে বসে আছে। তার কাছে সেই চেইনটা আর একটা লকেট। লকেটে মিলিয়ার একটা ছবি আছে। হ্যা এটা আর কেউ নয় আদ্রিদ নিজেই। সে এতগুলো বছর পরেও মিলিয়া কে তার স্মৃতি থেকে মুছে যেতে দেয়নি। একদিন মিলিয়া তাকে প্রশ্ন করেছিলো- সব ভুলে গেলে সে কাকে মনে রাখতে চাইবে? আদ্রিদ জবাব দিয়েছিলো- আমার মিলিকে। মিলিয়া তখন হেসে বলেছিলো- হ্যা আমাকে তোমার হৃদয়ে রেখো।
#সমাপ্ত
(গল্পটা শেষ করে দিলাম। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। শিঘ্রই আসবো নতুন গল্প নিয়ে, ইনশাআল্লাহ।)